ইকুয়েডর একটা ছোটো দেশ, আয়তনে ভারতের প্রায় ১২ ভাগের এক ভাগ, আর ভারতের জনসংখ্যা যেখানে ১৪২ কোটিকে ছাপিয়ে গেছে, ইকুয়েডরের জনসংখ্যা সেখানে মাত্র ১ কোটি ৮২ লক্ষ। কিন্তু ছোটো দেশও কখনও কখনও দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর কাছে পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে। গত ২০ আগস্ট ২০২৩ ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি ও আইনসভার সদস্যদের নির্বাচিত করার ভোটের সঙ্গে দুটি বিষয়ে গণভোটও নেওয়া হল। গণভোটের বিষয় দুটো ছিল — পূর্ব অ্যামাজনের ইয়াসুনি জাতীয় পার্কে যে তেল খনি থেকে তেল তোলা হচ্ছে, সেই খনিতে থাকা ৭২৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল অনির্দিষ্ট কাল ধরে মাটির নীচেই থাকবে নাকি তার উত্তোলন অব্যাহত রাখতে হবে; আর অন্য বিষয়টা ছিল রাজধানী কুইটো সংলগ্ন চোকো অ্যানডিনো অঞ্চলে তামা, সোনা, রূপো ইত্যাদি খনিজ দ্রব্যের খনন চলতে থাকবে নাকি খনিগুলো থেকে উত্তোলনকে বন্ধ করতে হবে। দুটি বিষয়েই অনুষ্ঠিত জাতীয় ভোটে ইকুয়েডরের জনগণ তাঁদের রায়ে জানিয়ে দিলেন — দু’টি খনন কাজই পরিবেশের ক্ষতি করছে, মানুষের অস্তিত্বে বিপর্যয় ঘটাচ্ছে, ইকুয়েডর এবং তার সাথে পৃথিবীর ভবিষ্যতকেও বিপন্ন করে তুলছে, আর তাই দুটো শিল্প উদ্যোগকে অব্যাহত রাখাটা অসংগত হবে, সেগুলো থেকে তেল ও খনিজের উত্তোলনে যতি টানতে হবে। গণভোটে যাঁরা অংশ নিলেন তাঁদের ৫.২ মিলিয়ন বা ৫২ লক্ষ মানুষ ইয়াসুনি জাতীয় পার্কে তেল খনি বন্ধের পক্ষে মত দিলেন, এর বিপক্ষে মত দানের মানুষের সংখ্যা ছিল ৩৬ লক্ষ। অতএব তেল খনি বন্ধের পক্ষে রায় দাঁড়ালো প্রদত্ত মোট ভোটের ৫৯ শতাংশ। আর তামা, সোনা, রূপো উত্তোলনের খনি বন্ধের পক্ষে ৭০ শতাংশ ভোটদাতা তাঁদের সম্মতি জানালেন। ইকুয়েডর তেল সমৃদ্ধ দেশ, তেল বিক্রি থেকেই সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আসে সরকারি তহবিলে। ইকুয়েডরের সরকারি রাজস্বে খনিজ দ্রব্যের উৎপাদন ও বিক্রির অবদানও রয়েছে চার নম্বরে। তেল ও খনিজর উৎপাদন ও সেগুলির বিক্রয়ের হ্রাস মোট জাতীয় উৎপাদনে সংকোচন ঘটাবে, অর্থনীতিতে প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে — এ’সম্পর্কে অবহিত হয়েও ইকুয়েডরের জনগণ তেল ও খনি সম্পদকে মাটির নীচে রেখে দেওয়ার বিকল্পকেই বেছে নিলেন। আশু লাভের চেয়ে ভবিষ্যতের সুরক্ষাই তাঁদের বিবেচনায় অধিকতর গুরুত্ব পেল।
পূর্ব অ্যামাজনের ইয়াসুনি জাতীয় পার্ক অঞ্চল জীব-বৈচিত্রের এক সমৃদ্ধ স্থান। এখানে রয়েছে রেনফরেস্ট বা ঘনবর্ষণের বনাঞ্চল। রয়েছে অন্তত ১১৩০ প্রজাতির গাছ, ৮০ প্রজাতির অধিক বাদুড়, প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি এবং আরও অনেক প্রজাতির সরিসৃপ ও উভচর। অ্যামাজন হল এক গুরুত্বপূর্ণ কার্বন সিঙ্ক যা পরিমন্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে পরিমন্ডলকে নির্মল করে। বিজ্ঞানীরাও সতর্ক করে বলেছেন এবং এখনও বলছেন যে, অ্যামাজনকে ঘিরে যে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চলছে তাতে অ্যামাজন দ্রুতই এমন একটা সংকটজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাবে, সেখানে এমন পরিবর্তন ঘটবে যার ফলে তার বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্যগুলোকে ধরে রাখা বা সেগুলোকে ফিরিয়ে আনা হাজারো প্রচেষ্টাতেও আর সম্ভব হবে না, আটকানো যাবে না পরিবেশের সর্বনাশকে। এর মোকাবিলায় প্রতিবাদ প্রতিরোধও তাই জারি রয়েছে কয়েক দশক ধরে।
প্রেসিডেন্ট রাফাল ক্যুরির জমানায় ২০১৬ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থা পেট্রো-ইকুয়েডরের পরিচালনায় এখানে তেল উৎপাদন শুরু হয়, এবং সেই উৎপাদন ইকুয়েডরে মোট উৎপাদিত তেলের ১২ শতাংশ বা ৫৭,০০০ ব্যারেল প্রতিদিন। এর পাশাপাশি প্রকৃতির এমন সংবেদনশীল অঞ্চলে তেল উত্তোলন বন্ধের দাবি ও প্রতিবাদও চলতে থাকে। তেল খনি বন্ধের প্রচারের সঙ্গে স্বাক্ষর সংগ্ৰহ অভিযানও চলে এবং ৭,৫০,০০০ স্বাক্ষর সংগৃহীত হয়। নির্বাচন পরিচালনার জাতীয় পরিষদ গণভোটের শর্ত পূরণ হয়েছে বলে স্বীকার করে নেয় এবং বিষয়টা এরপর যায় সাংবিধানিক আদালতে। সাংবিধানিক আদালত মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয়, রাষ্ট্রপতি ও আইনসভার সদস্য নির্বাচনের সঙ্গেই উপরিউল্লিখিত দুটি বিষয় ব্যালটে অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলিতে ভোট নেওয়া হবে। গণভোটের আগে কয়েক মাস ধরে পরিবেশবিদ এবং তেল খনি বন্ধ করা আন্দোলনের কর্মীরা সমাবেশ, জনসভা ও ডিজিটাল সমাজমাধ্যমের ওপর ভর করে প্রচার অভিযান সংগঠিত করেন। পরিবেশবিদরা এই রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ফল বেরোনোর পর ইকুয়েডরের ওয়াওরানি সম্প্রদায়ের সহ-সভাপতি নর্মা নেমকুইমো জানিয়েছেন, “ইকুয়েডরের বিভিন্ন প্রদেশে প্রচার সংগঠিত করতে যাওয়াটা যথেষ্ট কাজের হয়েছে। আমরা অ্যামাজন, পার্বত্য এলাকা ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে গিয়েছি — আর তার ফলাফল হল এই।” ঐ সম্প্রদায়ের আর এক নেতা নেমন্তে নেমকুইমোও বলেছেন, “আমাদের এখন তেল কোম্পানিগুলোকে বিদায় জানানো এবং জল, জমি ও জীবনকে বিজয়ী করার ক্ষমতা রয়েছে।”
তেল খনি থেকে লাভ পাওয়া একটা অংশ ইয়াসুনি জাতীয় পার্কের তেল খনি থেকে তেল উত্তোলন অব্যাহত রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। ইকুয়েডরের খনন সম্পর্কিত বাণিজ্য চেম্বারের প্রধান মারিয়া ইউলালিয়া সিলভা রয়টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “স্পষ্টতই, ইয়াসুনি এবং চিকো অ্যানডিনোতে যা ঘটল তা তেল বা খনন কাজে সহায়তা করবে না, বনাঞ্চলে বিনিয়োগেও না। জনগণ দারিদ্র্য জর্জরিত থাকলে পরিবেশকে রক্ষা করা যাবে না।” বাণিজ্য সংগঠনের প্রধান যা বলছেন তার মর্মার্থ হল — শিল্পপতিদের বিনিয়োগ করতে না দিলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে না, বেকারি বাড়বে, ফলে জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না এবং তার পরিণামে পরিবেশও নিরাপদ থাকবে না। যে বিনিয়োগ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে শেষের শুরুর সূচনা ঘটাচ্ছে আজ তা পৃথিবীর কাছে কতটা ভরসাস্থল হতে পারে? পৃথিবীতে কোনো প্রকল্প থাকবে না এমন কথা বলার কোনো অবকাশই নেই। আজকের পৃথিবীতে প্রকৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করেই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে চালিত হতে হবে, এবং পুঁজির অবাধ ছাড়পত্র কখনই সেই দিশার অনুগামী হবে না। পুঁজির ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আজ তাই অনেক বেশি আবশ্যক হয়ে উঠেছে। দূষণ কমাতে গেলে তার ধাক্কা ধনীদের তুলনায় অনেক বেশি পড়ে দরিদ্রদের ঘাড়ে। আর তাই জীবাশ্ম জ্বালানি-মুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে গেলে জনগণের সামনে যে এক কঠিন লড়াই রয়েছে তা অবোধগম্য হওয়ার নয়।
ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটে ফলাফলের নিষ্পত্তি হয়নি। আট প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে কেউই ৫০ শতাংশ ভোট পাননি বা ৪০ শতাংশ ভোট ও নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভোটের ব্যবধানকে ১০ শতাংশে রাখতে পারেননি। প্রথম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লুইসা গনজালেজ (প্রাপ্ত ভোট ৩৩.৬১ শতাংশ) এবং ভ্যানিয়েল নোবোয়ার (প্রাপ্ত ভোট ২৩.৪৭ শতাংশ) মধ্যে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন হবে ১৫ অক্টোবর ২০২৩। যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, তেল জনিত রাজস্ব কমে যাওয়া এবং কিছু কর্মসংস্থান লোপের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে অবশ্যই সমাজ ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।
ইকুয়েডরের গণভোট ভারতবাসীর কাছেও এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হয়ে দেখা দিচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ এবং বনভূমি সংরক্ষণ সারা পৃথিবীর সামনে এবং ভারতের কাছেও এখন এমন এক কর্তব্য হিসাবে হাজির হয়েছে যাকে আর কিছুতেই উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটাতে গিয়ে পরিবেশকে জলাঞ্জলি দেওয়ার স্বেচ্ছাচারের পরিহার অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দেখা দিচ্ছে। মোদী সরকারের তৈরি নতুন বন আইনের অনুসারী হয়ে গ্রামসভার অনুমোদন না নিয়েই কি আমরা ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ কর্পোরেটদের বন ধ্বংস করতে দেবো? ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ই বৃক্ষছেদনের বিপুল আয়োজন ও জলাভূমি বোজানোকে বাধাহীনভাবে চলতে দেবো? হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড ও দিল্লীর বন্যা এবং গ্রীষ্মপর্বে পশ্চিমবাংলার তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে উষ্ণতায় আফ্রিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়া, ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনের তছনছ হওয়া — চরম আবহাওয়া জনিত বিপর্যয়ের এই নিদর্শনগুলো কি ‘উন্নয়নের’ অপরিণামদর্শী কর্মযজ্ঞে লাগাম পরাতে আমাদের প্রণোদিত করবে না? সর্বোপরি, ইকুয়েডরের জনগণ সেখানকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনুমতিতে দুটো বিষয়ে তাঁদের মতামত জানানোর অধিকার পেলেন। পরিবেশ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্ৰহণে ভারতের জনগণও কি নিজেদের অভিমত জ্ঞাপনে গণতান্ত্রিক রীতির অবাধ প্রয়োগের অধিকারী হতে পারবেন না?