সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক বিবৃতি বলেন, মোদী রাজত্বে গত ১০ বছরে দেশজুড়ে এবং ৬ বছরে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজত্বকালে রাজ্যে এক অভূতপূর্ব ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। যখন দেশের বৈচিত্র্যময় ও বহুত্ববাদী মৌলিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতন্ত্র, মুক্ত নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা সহ সংবিধানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্র প্রতি মুহূর্তে আক্রান্ত ও অবদমিত করা হচ্ছে।
একদিকে যেমন মোদীর একনায়কতান্ত্রিক ও আগ্রাসী সরকার সহিংস হয়ে উঠেছে এবং অন্যদিকে আরএসএস ও সংঘ পরিবারের ধর্মান্ধ দুবৃত্ত বাহিনী সমাজজীবনে পরিকল্পিতভাবে লাগাতার সহিংসতা সংঘটিত করছে। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর ফলে আজ মণিপুর জ্বলছে। হরিয়ানা জ্বলছে। এর আগে গুজরাট জ্বলেছে, উত্তরপ্রদেশ জ্বলেছে। আগামীকাল সারা দেশ জ্বলবে। এমন অবস্থা স্বাধীনোত্তর দেশে আর কখনো দেখা যায়নি।
সুদীর্ঘ গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে আমরা এক স্বাধীন, মুক্ত, সাম্য, সমান মর্যাদা ও ন্যায়ের সংবিধান ও এক সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র অর্জন করেছি। আজ মোদী সরকারের আগ্রাসী ক্ষমতাকে আরো বিস্তৃত ও স্থায়ী করতে ও কর্পোরেট কোম্পানির হাতে দেশের সমস্ত সম্পদকে তুলে দিতে এক ধর্মান্ধ, গোলামী ও ত্রাসের রিপাবলিক নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংবিধান তাদের সামনে প্রধান বাধা। তাই সংবিধানকে আস্তাকুঁড়ে ফেলতে হবে। সংবিধান নাকি ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য। তাই ঔপনিবেশিকতা মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায় নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন। তিনি রাজতান্ত্রিক সেঙ্গল সহ নতুন সংসদ ভবনকে বিস্মৃত গৌরবের পুনর্জাগরণ হিসাবে তুলে ধরেছন। এই নয়া সংবিধান স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিমূলে আঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একই যুক্তি দেখিয়ে আইপিসি প্রতিস্থাপন করেছেন ভারতীয় ন্যায় সংহিতা দিয়ে। যাতে ঔপনিবেশিক দানবীয় আইনগুলিকে আরো কঠোর ও অত্যাচারী করে তোলা হয়েছে। সেই কোভিড১৯ মহামারীর সময় থেকে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেছে। এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষমূলক প্রচার আর দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও রায়কে বাতিল করা হয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), এনআরসি, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, ইডব্লিউএস ইত্যাদি আজ দেশের নাগরিকদের প্রজায় পর্যবসিত করেছে।
গত ৬ বছরে রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজত্বে সংবিধান ও আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। গত ৬ মাসে ৫৩ জন খুন হয়েছে। লিঙ্গ আধিপত্য, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও পাচার বেড়েছে। চুরি, ছিনতাই, দুর্নীতি ও তোলাবাজি কয়েকগুণ বেড়েছে। যুব সমাজ ড্রাগের নেশায় ভাসছে। ‘রেগা’ প্রকল্পের সংকোচনের ফলে গ্রামে পাহাড়ে কাজ ও খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। সামাজিক ভাতা মাসের পর মাস বন্ধ। সরকারি চাকরি নেই। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ ও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘু মুসলিম ও আদিবাসী জনজাতি মানুষেরা। টিটিএডিসিকে আর্থিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ভিলেজ কমিটির নির্বাচন করা হচ্ছে না। দখলকৃত বনজমির পাট্টা দেওয়া বন্ধ। ককবরক ভাষায় রোমান হরফ চালু করার দাবির প্রশ্নে সরকার নীরব। রাইয়াবাড়িতে বুলডোজার সহযোগে ৭টি মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজও ন্যায়বিচার পায়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র আক্রান্ত। রাজ্যে বুলডোজার রাজ চলছে।
দেশ ও জাতি আর কখনো এমন বিপর্যয়কর অবস্থার সম্মুখীন হয়নি। তাই এখন দেশকে রক্ষা করা, দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করা আজ দেশের নাগরিকদের সামনে প্রধান কর্তব্য। কাজেই এত বড়ো বিপদ ও বিপর্যয়ের মোকাবেলা করা কারোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবাই মিলে লড়তে হবে। তাই সময়ের দাবি অনুসারে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সারা দেশে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মোদী রাজকে যেকোন মূল্যে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। এই লক্ষ্যে ও প্রেক্ষাপটে এই উপনির্বাচন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই উপনির্বাচনে দু’টি আসনে বিজেপিকে পরাস্ত করে সারা দেশকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বার্তা দিতে হবে। তাই সমস্ত অবিজেপি দলগুলিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা আজ সময়ের দাবি। বাস্তবে এর প্রতিফলনও ঘটেছে।
প্রধান বিরোধী দল তিপ্রা মথা ও জাতীয় কংগ্রেস দল এই দুই আসনে প্রার্থী দেয়নি এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে এই দুটি আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে। সিপিআই(এমএল) ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম শরিক। অতএব সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এই উপনির্বাচনে বিরোধীদের সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী ২০, বক্সনগর আসনে মিজান হোসেন এবং ২৩, ধনপুর আসনে কৌশিক চন্দ’কে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ ও ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোটাররা যাতে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নির্বাচন কমিশনকে তার জন্য সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি নির্বাচনী সংগ্রামের ময়দানে এই একতাকে আরো সংহত ও শক্তিশালী করে তুলতে সবকটি বিরোধী দলের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এমএল)। ২০২৪’র লক্ষ্যে রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সত্যিকার অর্থে আরো শক্তিশালী, সংহত ও বিস্তৃত করে তুলতে হবে। কারণ সংবিধান না থাকলে আগামীদিনে কারোর অস্তিত্ব থাকবে না।