প্রতিবেদন
বার্থ সার্টিফিকেট বাধ‍্যতামূলক ...
certificate-mandatory
মোদি সরকারের আনা আইন জনতার কাঁধে নতুন বোঝা ও বৈষম্য চাপিয়ে দিচ্ছে

লোকসভায় ২৬ জুলাই পেশ হয়ে ১ আগস্ট পাস হল এই আইন সংশোধনী। রাজ‍্যসভায় পাশ হয় ৭ আগস্ট। এই বিলের মাধ‍্যমে ‘জন্ম ও মৃত‍্যু নথিভুক্তি আইন, ১৯৬৯’-এ বদল আনা হয়েছে।

জন্ম ও মৃত‍্যুর তথ‍্যভাণ্ডার কেন্দ্রীকরণ: এনআরসির এক ধাপ

মূল আইনে ছিল, একজন রেজিস্ট্রার-জেনেরাল নিযুক্ত হবেন এবং তিনি চাইলে জন্ম ও মৃত‍্যু নথিভুক্তকরণের সাধারণ নির্দেশাবলী জারি করতে পারেন। এখন সংশোধন করে বলা হয়েছে, রেজিস্ট্রার-জেনেরাল জন্ম ও মৃত‍্যুর একটি জাতীয় তথ‍্যভাণ্ডার গচ্ছিত রাখবেন। চীফ রেজিস্ট্রার (রাজ‍্য সরকার দ্বারা নিয়োজিত) ও রেজিস্ট্রারেরা (স্থানীয় স্তরের পঞ্জীকরণের জন‍্য রাজ‍্য দ্বারা নিয়োজিত) জন্ম ও মৃত‍্যুর সমস্ত তথ‍্য জাতীয় তথ‍্যভাণ্ডারে বাধ‍্যতামূলকভাবে জমা করবেন। চীফ রেজিস্ট্রারও রাজ‍্যস্তরে একইরকম তথ‍্যভাণ্ডার রাখবেন।

কয়েক বছর আগে ‘নাগরিক পঞ্জী’ বা এনআরসি করার উদ‍্যোগ ব‍্যাপক গণপ্রতিরোধের মুখে পড়েছিল। ‘এনআরসি’-র জন‍্য যে ‘এনপিআর’ বা ন‍্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টারের ধাপ দরকার তা এখন এইভাবে করতে চলেছে কেন্দ্র সরকার। বিভিন্ন রাজ‍্য সরকার বিজেপির এনআরসি-উদ‍্যোগের বিরোধ করেছিল। জন্ম ও মৃত‍্যুর নথিভুক্তি সংক্রান্ত বিষয়টি রাজ‍্য ও কেন্দ্র উভয়েরই ক্ষমতাক্ষেত্র বা যৌথ তালিকায় ছিল। নতুন এই বিলটি রাজ‍্যকে জাতীয় তথ‍্যভাণ্ডারের অধীনস্ত করেছে এবং কেন্দ্রীয়করণের মধ‍্যে দিয়ে চরম বৈষম‍্যকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চলেছে।

সর্বক্ষেত্রে বার্থ সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক : শিক্ষার অধিকার ও ভোটাধিকার খর্ব করবে, বৈষম‍্য বাড়াবে

মূল আইনে ছিল, যে কেউ চাইলে রেজিস্ট্রারকে দিয়ে তথ‍্যভাণ্ডার খুঁজিয়ে যে কোনো জন্ম বা মৃত‍্যু সংক্রান্ত তথ‍্য নিতে পারবেন। সংশোধন করে বলা হয়েছে, তথ‍্য নেওয়ার বদলে সার্টিফিকেট নিতে পারেন। জন্মের ৩০ দিনের মধ‍্যে বার্থ সার্টিফিকেট পেতে হবে। না পারলে, পরবর্তীতে এক বছর সময় দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্ট্রারের (অথবা অনুরূপ কোনো আধিকারিকের) লিখিত অনুমতি লাগবে এবং জরিমানা দিতে হবে। এক বছর পেরিয়ে গেলে ডিস্ট্রিক্ট ম‍্যাজিস্ট্রেটের আদেশ পেতে হবে যিনি জন্মের দাবির সত‍্যতা যাচাই করে এবং জরিমানা নিয়ে এই আদেশ দেবেন।

রেজিস্ট্রারের কোনো আদেশ বা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে আদেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ‍্যে তা জানাতে হবে এবং রেজিস্ট্রার এই আবেদন পাওয়ার ৯০ দিনের মধ‍্যে তার উত্তর দিতে বাধ‍্য থাকবেন।

বিলে বলা হয়েছে, যে কোনো ব‍্যক্তিকে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এই সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। এই “নির্দিষ্ট ক্ষেত্র”-গুলির মধ‍্যে ফেলা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া, ভোটার লিস্টে নাম তোলা, সরকারি পদে নিয়োগ পাওয়া, বিবাহ নথিভুক্তকরণ এবং এগুলি ছাড়াও কেন্দ্র সরকার নির্দেশিত অন‍্য যে কোনো ক্ষেত্র।

এই নির্দেশিত ক্ষেত্রগুলির কয়েকটি বাস্তবে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রগুলিতে বার্থ সার্টিফিকেট বাধ‍্যতামূলক করার অর্থ নাগরিকের সেই সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা।

সংবিধানের ২১(ক) অনুচ্ছেদে স্কুলে ভর্তি হওয়ার যে অধিকার প্রত‍্যেক শিশুর জন‍্য লব্ধ তা এই নির্দেশ লঙ্ঘন করছে। ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন বলেছে স্কুলে ভর্তি হতে আসা শিশুর বয়স নির্ধারণের জন‍্য বার্থ সার্টিফিকেট সহ অন‍্য যে কোনো নথিকে গণ‍্য করতে হবে এবং বয়সের প্রমাণ না থাকলেও কোনো শিশুকেই স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। নতুন আইন এই অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। যারা বার্থ সার্টিফিকেট করাতে পারবে না তারা সারা জীবনে কখনই আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারবে না। সাধারণ প্রান্তিক গরিব মানুষ এবং বহু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক বা অন্য বিভিন্ন বিপর্যয়ের শিকার হওয়া পরিবারের শিশুরা চরম বৈষম‍্যের মধ‍্যে পড়বে।

সংবিধানের ৩২৬ অনুচ্ছেদে ১৮ বছর বয়স্ক সমস্ত নাগরিকের ভোটাধিকারের গ‍্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। অপরাধ, দুর্নীতি, অপ্রকৃতিস্থতা বা দেশে বসবাস না করার ব‍্যতিক্রমী ক্ষেত্রে ভোটদানে অযোগ‍্য হওয়ার কথাও বলা আছে। কিন্তু বার্থ সার্টিফিকেট (বা কোনোরকম বয়স প্রমাণ) না থাকাকে ভোটদানের অযোগ‍্যতা বলেনি সংবিধান। জন্ম নথিভুক্ত করতে না পারা নাগরিকের ভোটাধিকার কেড়ে নিচ্ছে এই নতুন আইন।

তদুপরি অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিচারের ক্ষেত্রে যে আইনি ধারা আছে তাকেও লঙ্ঘন করছে এই নতুন আইন। বার্থ সার্টিফিকেট না থাকলেও বয়সের প্রমাণ হিসেবে অন‍্যান‍্য যে সকল পন্থা এই জুভেনাইল জাস্টিস আইনে বিবৃত আছে তা নতুন আইনে নাকচ হয়ে যাচ্ছে। ফলত বিচারে বৈষম‍্য হবে।

নতুন আইন অনুসারে বার্থ সার্টিফিকেটই বয়সের একমাত্র প্রমাণপত্র। বার্থ সার্টিফিকেট না থাকলে কেউই ভোট দিতে, স্কুলে ভর্তি হতে, বিবাহ নথিভূক্ত করতে বা সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারবে না। বার্থ সার্টিফিকেট যিনি বা যারা ইস‍্যু করার অধিকারী হবেন তিনি বা তাঁরা ব‍্যক্তির জীবন নিয়ন্ত্রণে এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবেন যে ঘুষ ও দুর্নীতির বিরাট ক্ষেত্র খুলে যেতে পারে।

পিতা-মাতার বা তথ‍্যপ্রদানকারীর আধার ডিটেলস জমা দিতে হবে : ব‍্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার খর্ব হবে

মূল আইন অনুযায়ী, জন্ম বা মৃত‍্যুর খবর কোনো না কোনো ব‍্যক্তিকে রেজিস্ট্রারের কাছে জমা দিতে হবে। যেমন, যে হাসপাতালে শিশুর জন্ম হল তার মেডিক‍্যাল অফিসার, বা পরিত‍্যক্ত শিশুর ক্ষেত্রে রাজ‍্যের স্বাস্থ‍্য আধিকারিক। এবারে নতুন আইনে বলা হয়েছে, যে ব‍্যক্তি জন্মের খবর দেবেন তাঁকে রেজিস্ট্রারের কাছে তাঁর নিজের এবং ওই শিশুর পিতা-মাতার আধার নাম্বার জমা করতে হবে। জেল, হোটেল ইত‍্যাদিতে জন্মের ক্ষেত্রে সেখানকার আধিকারিকের ওপরও এই দায় বর্তাবে।

জন্ম নথিভুক্তকরণে পিতা-মাতা ও তথ‍্য প্রদাণকারীর আধার ডিটেলস বাধ‍্যতামূলক করাটা নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করছে। হাসপাতালে জন্ম নেওয়া প্রতিটি শিশুর সাথে মেডিক‍্যাল অফিসারের আধার জুড়ে দেওয়া বা সমস্ত পরিত‍্যক্ত শিশুর সাথে স্টেট হেলথ অফিসারের আধার যুক্ত করা এই সমস্ত অফিসারের ব‍্যক্তিগত তথ‍্যের গোপনীয়তার অধিকারকে খর্ব করছে। ২০১৮'র আধার রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়ছিল যে ২০১৬’র আধার আইন অনুযায়ী, সরকারি সুযোগ ও পরিষেবামূলক ক্ষেত্রে আধার লিঙ্ক বাধ‍্যতামূলক হতে পারে কিন্তু সেই কারণ দেখিয়ে ব‍্যাঙ্ক একাউন্ট ও মোবাইল ফোন নাম্বারের সাথে আধার লিঙ্ক করাটা বেআইনি। একই কথা জন্ম নথিভুক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ‍্য। বিবাহ নথিভুক্তিতে আধার লিঙ্ক করার প্রশ্নেও সুপ্রিম কোর্ট একইরকম নির্দেশ দিয়েছিল।

বিভিন্ন তথ‍্যভাণ্ডারের সংযুক্তিকরণ : ব‍্যক্তিগত তথ‍্যের ওপর সেই ব‍্যক্তির অধিকার হরণ করবে

নতুন আইন অনুযায়ি, জন্ম ও মৃত‍্যুর এই তথ‍্যভাণ্ডারকে অন‍্যান‍্য বিবিধ তথ‍্যভাণ্ডার যেমন, জনসংখ‍্যা পঞ্জিকা, নির্বাচক তালিকা, রেশন কার্ড বা অন‍্য যে কোনো সরকার নির্দেশিত ডেটাবেসের সাথে সংযুক্ত করা হবে। এই সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব‍্যক্তির অনুমতি নেওয়া বাধ‍্যতামূলক করা নেই। ফলত এই সংযুক্তিকরণ ব‍্যক্তির গোপীয়তার অধিকারকে লঙ্ঘন করছে। নাগরিককে সুযোগ বা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রেই একমাত্র সরকার এক তথ‍্যভাণ্ডারকে অন‍্য কাজে ব‍্যবহার করতে পারে, অন‍্যথায় নয়। ভারতে তথ‍্য সুরক্ষা বিষয়ক কাঠামো গড়ে তোলার প্রশ্নে গঠিত শ্রীকৃষ্ণ কমিটি সুপারিশ করেছিল যে এক উদ্দেশ‍্যে নেওয়া তথ‍্য অন‍্য কোনো উদ্দেশ‍্যে ব‍্যবহার করা সঠিক নয়।

জন্মমৃত্যু নথিভুক্তি সংক্রান্ত আইন সংশোধনীটি ইতিমধ্যেই সংদদের উভয় কক্ষেই পাস হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপতির সীলমোহর পাওয়ার অপেক্ষা। সব মিলিয়ে এই নতুন আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রের মোদি সরকার সাধারণ মানুষের ওপর বিপুল বোঝা ও নতুন বৈষম‍্য চাপিয়ে দিতে চলেছে।

- মলয় তেওয়ারি

খণ্ড-30
সংখ্যা-32