প্রতিবেদন
৩১ আগস্ট ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের বার্তা
historic-food-movement

চন্দ্রযানের সফল অভিযান নিয়ে চতুর্দিকে উচ্ছ্বাস ও গর্বের শেষ নেই। চাঁদের মাটিতে এখন চলছে খনিজ সম্পদ সন্ধানের কাজ। আগামী দিনে সেটা কর্পোরেট লুন্ঠনের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে কি? সেটা অদুর ভবিষ্যতেই স্পষ্ট হবে। কিন্তু নির্মম বাস্তব এটাই যে, বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় গর্বের পাশাপাশি লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়, যখন দেখা যায় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ক্রমশ নিচে নেমে চলেছে। ইউরোপের এক সংস্থার বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে প্রকাশ, বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১০৭ নম্বরে। গতবছর ছিল ১০১ নম্বর। অর্থাৎ আমরা ৬ ধাপ পিছিয়েছি।

কি অদ্ভূত বৈপরিত্ব! একদিকে ক্ষুধার রাজ্যে ভারতের পতন, অথচ বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় ঘটছে তার উত্থান! ২০২০ থেকে ২০২২ করোনাকালের দু’বছরে সেই তালিকায় ভারতের নতুন ৬৪ জন ধনীর নাম যুক্ত হয়েছে। এই বিশ্ব ক্ষুধা সূচক মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। তার অন্যতম হল অপুষ্টি, শিশু মৃত্যু, শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা, শিশুদের ওজন প্রভৃতি। দু’বছর আগে করোনাকালে রেললাইনে চাপা পড়া পরিযায়ী শ্রমজীবীদের মৃতদেহের পাশে দেখা গিয়েছিল কয়েকটি আস্ত পোড়া রুটি। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার সংস্থান করতে আজও দূরদূরান্তে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের মৃত্যু ঘটছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটছে, জিডিপি বাড়ছে কিন্তু ক্ষুধা দারিদ্র্য কমছে না, উল্টে বেড়েই চলেছে।

’৫০’র শেষে ও তার ধারাবাহিকতায় ’৬০’র দশকে খাদ্যের দাবিতে, কালোবাজারি মজুতদারির বিরুদ্ধে, তাদের দালাল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ঘটেছিল এক গণঅভ্যুত্থান। শতশত মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। বাংলার হিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। খাদ্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন ৩১ আগস্ট ১৯৫৯ কলকাতার রাজপথকে রক্তস্নাত কসাইখানায় পরিণত করা হয়েছিল। খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনকারী গ্রামবাংলা থেকে আগত হাজার হাজার মানুষকে লাঠি-পেটা করে সংগঠিত করা হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় গণহত্যা। খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে, সরকারের খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে, কালোবাজারি মজুতদারির বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলা।

আজকের সময়কালে আমরা কী দেখছি! আজও চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত আইন তুলে দেওয়ার চক্রান্ত। দিল্লীর রাজপথে কৃষকের দুর্বার প্রতিরোধের মুখে মোদী সরকার এ’প্রশ্নে সাময়িক পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে, ঐ আইন স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু তলায় তলায় সেই প্রক্রিয়া অবাধে ঘটে চলেছে। সম্প্রতি ‘রিপোর্টার কালেকটিভ’ নামক সংস্থার করা অন্তর্তদন্তে সেই গোপন চক্রান্তের পর্দা ফাঁস হয়ে পড়েছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে যতখুশী মজুত করা, খাদ্যদ্রব্যের যথেচ্ছ দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে কৃষিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা ও মুনাফার বিপুল বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। নয়া কৃষি আইন আনার দু’বছর আগে ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের টাস্ক ফোর্সের সাথে বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যাচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলি যথা, আদানি গ্রুপ, পতঞ্জলী আয়ুর্বেদ, মাহিন্দ্রা গ্রুপ, বিগ বাস্কেট, এরা সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ১৯৫৫ শিল্প বাণিজ্যের বিকাশের পথে বাধা। তাই অবিলম্বে একে তুলে দেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা তাকে মান্যতা দিচ্ছে। এটা সকলের জানা যে ঐ আইন নিত্যপণ্যের যথেচ্ছ মজুত রাখা বা কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার হাতিয়ার। তথাকথিত ‘কৃষকের আয় দ্বিগুণ’ করার লক্ষ্যে গঠিত ঐ টাস্ক ফোর্স কোনো কৃষকের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়নি। কেবল কোম্পানিগুলোর সাথেই তারা বৈঠক করেছে। এ’বিষয়ে কৃষক সংগঠনগুলি তদন্তের দাবী তুলেছে।

অপরদিকে দেখা যাচ্ছে সরকার করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। গরিব মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিপুল পরোক্ষ করের বোঝা। সরকারী তথ্যে দেখা যাচ্ছে জিএসটি’র কর আদায়ে ৩ ভাগের ২ ভাগ আসছে নীচুতলার মানুষের কাছ থেকে। আর মাত্র ৩-৪ শতাংশ আসছে উপরতলার ১০ শতাংশ ধনীদের কাছ থেকে। গ্রামের গরিব পাড়ায় বা শহর শহরতলীর মেহনতী মানুষেরা জানাচ্ছেন গতবছর বাজারে যে জিনিস ২০০ টাকায় পাওয়া যেত এখন তার দাম ৫০০ টাকা। আর ৫০০ টাকার মাল কিনতে লাগছে ১৫০০ টাকা! পেঁয়াজ সহ সমস্ত সব্জি আজ অগ্নিমূল্য।

৫০ বা ৬০’র দশকের মতো এখন হয়তো সেইভাবে দুর্ভিক্ষ বা আকাল নেই, কিন্তু সরকারের খাদ্যনীতি আরও বেশি মাত্রায় কর্পোরেটমুখী গণবিরোধী হয়ে উঠছে। ‘খাদ্যের অধিকার’, ‘খাদ্য সুরক্ষা’, ‘খাদ্য সাথী’ এসব অনেক কিছুই সরকারী কর্মসূচিতে বলা হয়ে থাকে। রেশনে নাকি প্রচুর চাল গম দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য সংকট নাকি আর আগের মতো নেই! এ’জাতীয় কথাও বহুল প্রচারিত। কিন্তু রেশনে সরবরাহের পরিমাণ কতো? অধিকাংশ গরিব উপভোক্তা রেশনে পায় গড়ে মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি চাল। গম সরবরাহ এখন বন্ধ। কিন্তু অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী সরবরাহের কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। উল্টে সরকার ধাপে ধাপে গণবন্টন ব্যবস্থাকে তুলে দিতে চাইছে। এফসিআই’এর জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আধার সংযোগের নামে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম রেশন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনাহার মৃত্যুর খবর উঠে আসছে। এই কেন্দ্রীয় নীতির পাশাপাশি রাজ্যে তৃণমূল সরকারেরও ভিন্ন কোনো খাদ্য কর্মসূচি নেই। তাই আজ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে দাবি উঠেছে,

   • রেশনে প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে।
   • রেশনে চাল, গম, চিনি, তেল, সব্জি, দুধ সরবরাহ করতে হবে।
   • রেশন কার্ডে আধার সংযোগ করা চলবে না।
   • চাষিদের থেকে কমদামে কিনে বাজারে সব্জি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে কেন সরকার জবাব দাও।
   • ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে আলু পেঁয়াজ সহ সমস্ত ফসল সরকারকে কিনতে হবে, এবং ন্যায্যমূল্যে রেশনে সরবরাহ করতে হবে।
   • খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করো।
   • ভোটের আগে রান্নার গ্যাসের দাম কমানো হল কিন্তু পেট্রোপণ্যে চড়া হারে শুল্ক কমানো হল না কেন জবাব দাও।
   • ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের জানাই লাল সেলাম।

- জয়তু দেশমুখ

খণ্ড-30
সংখ্যা-30