মণিপুরে মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষের সূত্রপাতে যে মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এক রায়ের গুরুতর ভূমিকা থেকেছে তা এক স্বীকৃত তথ্য। সুপ্রিম কোর্ট মণিপুর হাইকোর্টের ঐ রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছে ঠিকই, তবে বিচারপতি এস ভি মুরলিধরণের রায়ের তাৎপর্য ছিল সুগভীর এবং ডাবল ইঞ্জিনের সরকার মণিপুরে যে সংখ্যাগুরুবাদী প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজেদের চালিত করছিল ঐ রায় তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল। মেইতেইরা কুকি-নাগাদের বসবাসের অঞ্চল পার্বত্য জেলাগুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ ছিল এবং মেইতেইদের জনজাতি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিচারপতি মুরলিধরণের রায় মেইতেইদের সেই লক্ষ্য পূরণের এক অবলম্বন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জনজাতির মর্যাদা পেলে মেইতেইরা পার্বত্য অঞ্চলের জমি কিনতে পারত এবং তার সাথেই পেত যথেষ্ট খনিজ সম্পদের অধিকার। মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ লাইমস্টোন, ক্রোমিয়াম, নিকেল, তামা, প্লাটিনাম ও অন্যান্য ধাতুর সঞ্চয়, এবং সেই ধাতুর ওপর শিল্পপতিদের নজরও কম নয়। পার্বত্য অঞ্চলে খননের অনুমতি দানের অধিকার বিধানসভার নেই, রয়েছে আদিবাসী পার্বত্য পরিষদের হাতে। নরেন্দ্র মোদী সরকার অনেক দিন ধরেই এই খনিজ সম্পদ বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আদিবাসী পার্বত্য পরিষদ তাদের সঙ্গে খননের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে খুব একটা আগ্ৰহ দেখায়নি। মেইতেইরা জনজাতির মর্যাদা লাভ করলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের অধিকার দেওয়ার পার্বত্য পরিষদের অসম্মতিকে কোণঠাসা করা যেত এবং মেইতেইদের মাধ্যমে মণিপুর পার্বত্য অঞ্চলের খনিজ সম্পদ মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়াটা অনায়াস হত।
রাজ্যের খনিজ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য মোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৫ সালে, ১৯৫৭ সালের খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধন আনে। ঐ সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্র খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ জমির ওপর আদিবাসী বা স্থানীয় জনজাতিদের অধিকারকে খর্ব করতে সক্রিয় হয় এবং বনজ ও খনিজ সম্পদ প্রসঙ্গে রাজ্যগুলোর অধিকারকে গুরুত্বহীন করে তুলে তাদের কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। ঐ আইনে ২০২১ সালে পুনরায় সংশোধনী এনে ২০০৬ সালের বন নিয়ন্ত্রণ আইনকে গুরত্বহীন করে তোলা হয়, এবং খনিজর অন্বেষণ চালানো ও খননের ছাড়পত্র লাভকে সহজসাধ্য করা হয়। গত ১ আগস্ট ২০২৩ সবরং সংবাদ পোর্টালে ঐ সংশোধনীগুলি সম্পর্কে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এই সংশোধনী গ্যাস, তেল এবং অন্যান্য খনিজ আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথেই খনন কাজে হাত দেওয়ার অধিকার দেয়। ২০২১ সালের আইন গ্রামসভার নিজস্ব অঞ্চলে খননে অনুমতি দেওয়া বা খনন বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার গ্রামসভার ক্ষমতাকে চূড়ান্তরূপে লঘু করে তুলেছে। এইভাবে, ২০১৫ ও ২০২১ সালের সংশোধনী আইনগুলো কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, খননের কোম্পানিগুলোকে আরও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং যে সম্প্রদায়গুলো সম্পদের মালিক ছিল তাদের অধিকারচ্যুত করেছে।” অতএব, খননে যুক্ত ও তাতে আগ্ৰহী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সুবিধার লক্ষ্যেই যে খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয়েছিল তা সহজেই বোধগম্য।
মোদী সরকার সম্প্রতি সংসদে পাশ করিয়েছে সংশোধিত অরণ্য আইন। বিশেষ আলোচনা ছাড়াই সাংসদ সংখ্যার জোরে পাশ করানো হয়েছে ঐ বিল। পরিবেশ রক্ষায় অভিজ্ঞ ও সচেতন ব্যক্তিরা সংশোধিত ঐ আইনে কর্পোরেট চালিত কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংহারের, অরণ্যে জীব-বৈচিত্র্যের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের সীমান্ত থেকে একশ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় কেন্দ্র সরকার জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে নিজের কর্তৃত্ব চালাবে। এই আইনে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন তথা কর্পোরেট তোষণের নামে প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন কেমন হয়েছে তা অনুধাবনের জন্য আমরা এখানে ‘ঔদাসীন্যের পরিবেশ’ শীর্ষক আনন্দবাজার পত্রিকার ২ আগস্টের সম্পাদকীয়র অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, “দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা, যেমন মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্ব ভারত বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ পার্বত্য আরণ্যক অঞ্চল এবং জৈব বৈচিত্র্যের অতুলনীয় ভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষার যুক্তিতে এই ভান্ডারগুলি যথেচ্ছ ধ্বংস করা হবে — এই আশঙ্কাতেই পরিবেশ সচেতন প্রতিবাদীরা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।”
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কর্পোরেটদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ, এবং কেন্দ্রে এসেও তিনি সারা দেশেই গুজরাট মডেলকে প্রয়োগ করে চলেছেন। আর তাই ক্রোনিইজম বা স্যাঙাতি পুঁজিবাদ মোদী সরকার চালিত অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। তাঁর সরকারের ছত্রছায়ায় হাতে গোনা কয়েকজন পুঁজিপতির অর্থবলের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটে চলেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে অতি সস্তায় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকার ওপর স্থানীয় জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে দেশের সম্পদকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই যে ২০১৫ ও ২০২১ সালে খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন হয়েছিল এবং অতি সম্প্রতি সংশোধিত অরণ্য আইনকে পাশ করিয়ে নেওয়া হলো, তার অনুধাবনে বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন নেই। বি আর আম্বেদকরের পৌত্র, বঞ্চিত বহুজন আগাদির সভাপতি প্রকাশ আম্বেদকর সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে সাংবাদিকদের বলেছেন, যেহেতু কুকি জনজাতিরা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের এলাকায় খননের অনুমতি দিতে অস্বীকার করছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাই উসকিয়ে তুলল মেইতেইদের জনজাতি সংরক্ষণের ইস্যুটাকে। তাঁর নির্দিষ্ট অভিযোগ হলো, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শিল্পপতি বন্ধু আদানিকে সরকার প্লাটিনাম খননের অধিকার দিতে চায়। এবং মণিপুরের ঘটনাবলীর বিকাশ খননের চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই একটা কৌশল।” তবে, শুধু প্রকাশ আম্বেদকরই নন, আরও অনেকই মণিপুরের সহিংস ঘটনাবলীর পিছনে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের এই নিকৃষ্ট মতলবকে দেখতে পেয়েছেন। জুলাই মাসের শেষে ‘মনিপুরের মিত্ররা’ নামে এক নাগরিক সংগঠনও বান্দ্রাতে এক জনসভায় ঐ ধরনের অভিমত প্রকাশ করে। ঐ জনসভায় বরিষ্ঠ আইনজীবী মিহির দেশাই বলেন, “মণিপুরের খনিজ সম্পদ ও গ্যাসের সঞ্চয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতিরা আগ্ৰহী, এবং খনিজ সম্পদ, গ্যাস ও ধর্মের মতো বিভিন্ন বিষয়ের সংমিশ্রণকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা উসকিয়ে তোলা হচ্ছে।” সেদিনের জনসভার একটা রিপোর্টও প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাইয়ের টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “তাঁরা (জনসভার বক্তারা) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, পার্বত্য রাজ্যটির খনিজ সম্পদ এবং গ্যাস সঞ্চয়ের ওপর বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের নজর পড়েছে এবং জাতিগত সংঘাতে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে যার পিছনে সম্ভাব্য অভিপ্রায় হলো জমি গ্রাস।” এইভাবে আইনে সংশোধন এনে এমন রূপ দেওয়া হচ্ছে যাতে কর্পোরেটরা অনায়াসে খনিজ ও অরণ্য সম্পদ হাতাতে পারে।
ওপরে আমরা দেখলাম, কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মণিপুরে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পিছনে নরেন্দ্র মোদী সরকারের দুরভিসন্ধিকে দেখতে পেয়েছেন। মণিপুরের খনিজ সম্পদের ওপর কর্পোরেটদের অধিকার প্রদানের লক্ষ্যে, বিশেষভাবে মোদীর প্রিয় শিল্পপতি আদানির প্লাটিনাম খননের অধিকারকে অনায়াসলভ্য করতে সুপরিকল্পিতভাবে হিংসাকে উসকিয়ে তোলা হচ্ছে বলে তাঁদের অভিমত। মোদী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যক্ত তাঁদের এই বক্তব্যকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না।
- জয়দীপ মিত্র