প্রতিবেদন
এক অশ্রুত দীর্ঘশ্বাস
unspoken-sigh

এক ঐতিহাসিক দিন। সেন্ট্রাল হলে শেষ দিন। তিনি প্রথম বক্তা। সূচপতন নিস্তব্ধতায় প্রাচীনতমা সাংসদের লিখিত ভাষণ পাঠ শুনছে ভরা সংসদ। সবুজাভ এক স্নিগ্ধতা নিয়ে তিনি যখন মঞ্চে, তখন তাঁর পাঠে বিকীরিত হচ্ছিল তাঁর বৈদগ্ধ্য, মেধা ও ধীশক্তি, কয়েক দশকের সাংসদ পদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত বিচক্ষণতা। অনন্য তার শব্দচয়ন। অপূর্ব তার গ্রন্থন। আকর্ষণীয় সেই ভাষণের সপ্রতিভ সুললিত প্রতিটি উচ্চারণ স্তম্ভিত বিস্ময়ে শেষবারের মতো শুনছিল সেন্ট্রাল হল – হ্যাঁ, সেন্ট্রাল হল! তার বোধ হয় অন্য প্রত্যাশা ছিল প্রাচীনতমার কছে। মূঢ় প্রত্যাশা! তার দীর্ঘশ্বাসপতনের শব্দ তো শোনা যায় না!

ভাষণে উল্লিখিত তাঁর দেখা সপ্তম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী নাকি সমাজে গভীর-প্রোথিত বৈসাদৃশ্য দূরীকরণে তথা ভবিষ্যৎ ভারতে সকল নারীর জন্য সমান অংশ সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট। সত্যি? তবে কেন তিনি দেশের মহিলা রাষ্ট্রপতিকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন না? ঠিক যেমন নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনে ঘটেছিল? যেমনটা আবারও ঘটেছে নতুন ভবনে প্রথম আনুষ্ঠানিক অধিবেশনের দিনেও? তিনি আদিবাসী জনজাতির মানুষ বলে?

‘হিন্দুহৃদয় সম্রাট’ এখন দেশের ‘রাজাধিরাজ’, তিনি নিজের পছন্দমতো দরবারকক্ষ সাজিয়ে নিয়েছেন, যেখানে নাকি ঐতিহ্য, পরম্পরা আর আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে। ঐতিহ্যময় ‘পুরোনো’ সংসদ ভবন এখন হবে ‘জাদুঘর’। এই সেন্ট্রাল হলের সঙ্গে তাঁর ৩৫ বছরের সম্পর্ক। যখন প্রথম সাংসদ হিসেবে শপথ নেন তখন তিনি এক দৃপ্ত তরুণী (অবশ্য এখনও বাহ্যত তাই!)। কত পরিবর্তনের সাক্ষী তিনি! এই যে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত সেঙ্গোল-ভারতে রূপান্তরিত হতে চলেছে, সে ব্যাপারে তাঁর বিবেক মুহূর্তের জন্যও কি পীড়িত হয়নি? যাক সে কথা।

ভাষণে তাঁর অভিজাত উচ্চারণ মান্যতা পেলেও, দাবিগুলো তো মেনে নেওয়া যাবে না! কোভিড১৯-এ মোদি সরকারের ঔদাসীন্যে আর অবহেলায় গঙ্গায় ভেসে গেছে শ’য়ে শ’য়ে লাশ। মারা গিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। যে মৃত্যু এড়ানো যেত।

শিশুশ্রম বন্ধ তো হয়ইনি, বরং বাড়ছে, চায়ের দোকানে, রেস্তোরাঁয় গ্যারেজে, নির্মাণে, চাষের কাজে, সোনার কাজে— কোভিড-এর পর থেকে অনেকে সপরিবার ভিন রাজ্যে কাজে লেগে যাচ্ছে। স্কুলছুটের সংখ্যাও বাড়ছে।

ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানিগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে? ভারতে তৈরি কাশির ওষুধ আফ্রিকার শতাধিক শিশুর প্রাণ কেড়েছে। গরিব মানুষ নিতান্ত দরকার না হলে ডাক্তার দেখায় না, ওষুধ কেনার পয়সা নেই বলে। ওষুধের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।

‘বেটি বাঁচাও বেটি পঢ়াও’ এক নিষ্ঠুর বিদ্রুপ! প্রতিদিন অসংখ্য মেয়ে ঘরে বাইরে নিগৃহীতা হচ্ছে, খুন হচ্ছে, এমনকি বিচারের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারছে না। পৌঁছালেও দাম্ভিক প্রশাসন সেই রায়কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছে। মনুস্মৃতির প্রচ্ছন্ন প্রভাবে বিজেপি নেতা সাংসদ বিধায়করা নারী নিগ্রহকে ‘বীরের’ কাজ মনে করছেন। এমনকি নেত্রীরাও! তাই ধর্ষক-খুনীদের ‘সংস্কারী’ বলে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নিয়ে মিছিল করা হয়, ফুল-মালা-মিষ্টি দিয়ে বরণ করা হয়। যখন তখন প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। আর কঠিন মেধা পরিশ্রম অধ্যবসায়ে যারা দেশের জন্য পদক জিতে এনে দেশবাসীর গৌরব বাড়িয়েছেন, সেই সোনার মেয়েদের নিগ্রহকারী সাজা তো পায়ই না, বীর দর্পে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়! উল্টে বিচার চাওয়ার অপরাধে সেই সোনার ছেলেমেয়েদের রাস্তায় ফেলে নৃশংস নির্যাতন করা হয়! মহিলাদের নগ্ন করে জনতার মাঝে হাঁটানো হয়, তারপর গণধর্ষণ করা হয়! খুন করা হয়! তাদের অপরাধ – তারা অন্য সম্প্রদায়ের, অন্য জনজাতির মানুষ! এসব কিছুর জন্য লজ্জিত নন প্রাচীনতমা সাংসদ! উল্টে দাবি করছেন, দু’বছরের মধ্যে দেশের মানসিকতা পাল্টে দেওয়া গেছে! হ্যাঁ, ঠিকই। সমাজে দলিত সংখ্যালঘু, আদিবাসী, গরিব শ্রমজীবীদের বিরুদ্ধে যেমন তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে মানুষের মনকে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমনই নারীদের প্রতি ঘৃণা আর বিদ্বেষ এমন উগ্র আর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে তাদের প্রশ্রয়ে, অনলস প্ররোচনায়।

অন্যদিকে, অভাবের কারণে, কুসংস্কারের প্রভাবে মেয়েদের পড়াশুনোয় ইতি পড়ে যাচ্ছে। বাল্যবিবাহ বাড়ছে। নয়া শিক্ষানীতি শুধু উচ্চবিত্তের জন্য শিক্ষাঙ্গন খোলা রেখেছে। দরিদ্র নিম্নমধ্যবিত্তের সেখানে জায়গা নেই!

তিনি বলেছেন মোদিজী এক অনন্য রাষ্ট্রপ্রধান যিনি পরিসংখ্যানকে অতিক্রম করে ব্যক্তিমানুষের কাছে পৌঁছে যান, তাদের সুখ দুঃখের ভাগ নিতে। ঠিকই, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ‘সযত্নে বাছাই করা’ অতি ভাগ্যবান ক’টি পরিবার এই ন’বছরে মোদিজীর ‘মন কী বাতে’ ঠাঁই পেয়েছেন বটে! আর ঐ যে বললেন, তিনি মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন, পাকা বাড়ি, বিদ্যুৎ, নলের জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, রান্নার গ্যাস দিয়েছেন বিনামূল্যে – সে তো কয়েক হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপনে! রাস্তাার মোড়ে মোড়ে টাঙানো হোর্ডিং-এ! ভারতের কোটি কোটি মহিলা শহরে গ্রামে কাজের সুযোগ না পেয়ে অশেষ কষ্টে আছেন। পুষ্টির অভাব, নেই কোনো নিরাপদ আশ্রয়, পানীয় জল বিদ্যুৎ তো দূরের কথা। লক্ষ লক্ষ স্কীম ওয়ার্কার মহিলা – দেশের দরিদ্র প্রসূতি মা-শিশুর স্বাস্থ্য পুষ্টি নিরাপত্তা যাদের কাঁধে – যারা দেশকে পোলিওমুক্ত করেছেন, কোভিদে জীবন দিয়েও দায়িত্ব পালন করে গেছেন – তাদের সরকার বছরের পর বছর ‘পারিতোষিক’, ‘সম্মান দক্ষিণার’ নামে চরম নিষ্ঠুরভাবে শোষণ করে চলেছে। তাদের ন্যূনতম মজুরি, শ্রমিকের মর্যাদা, সামাজিক সুরক্ষার জন্য আজ পথের আন্দোলনে ঠেলে দিয়েছে ‘মহামহিম’ মোদী সরকার। ক’জন উজ্জ্বলা যোজনার গ্যাস সিলিন্ডার পেয়েছেন? ক’জন দুর্মূল্যের গ্যাস পরবর্তীতে কিনতে পেরেছেন? কতজন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে পেরেছেন জন ধন যোজনায়? তাহলে মাইক্রোফিনান্সের বাউন্সারদের দ্বারা নিঃস্ব, নিগৃহীত হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মহত্যা করছেন কেন এত মহিলা? পুরুষ? পশ্চিমবঙ্গ সহ অ-বিজেপি কয়েকটি রাজ্যে একশো দিনের টাকা বন্ধ করে কেন্দ্রীয় সরকার তো গরিব শ্রমজীবী মহিলাদের পেটের ভাত কাড়ছে! এসব সযত্নে এড়িয়ে যান তিনি, তাঁরা!

আসলে তারা তো অন্য ভারতের বাসিন্দা যে ভারত বৈভবের, ঐশ্বর্যের, চটকদারির, মিথ্যাচারের; যে ভারত মুষ্টিমেয় ধনকুবেরদের কৃপাধন্য! তাই তারা ঐ বিলিয়নেয়ারদের মৃগয়াক্ষেত্র অন্য ভারত, শোষিত, বঞ্চিত, ক্রমশ দারিদ্র্য সীমার নিচে নামতে থাকা ভারতের কথা বলবেন কেন তাদের ‘উৎসব’ মুহূর্তে?

কিন্তু মানুষ সব দেখছে!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-33