৯-১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ পাটনার গেট পাবলিক লাইব্রেরীর সুবিশাল মঞ্চ সাক্ষী হয়ে থাকলো ভারতবর্ষের শ্রমিক আন্দোলনের এক নতুন দিক হিসাবে। এই শতাব্দীতে শ্রমিক আন্দোলনের নতুন শক্তি হিসেবে মিড-ডে-মিল, আশা, অঙ্গনওয়ারীর সাথে যুক্ত প্রধানত এক কোটি মহিলা কর্মীদের আগামী দিনে এগিয়ে চলার দৃপ্ত অঙ্গীকার শোনা গেল সম্মেলনে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বুনিয়াদী ক্ষেত্রে এই বিপুল সংখ্যক কর্মীদের গত ২ দশক ধরে প্রায় বেগার শ্রমিক হিসেবে মোদী সরকার যেভাবে কাজ করিয়ে চলেছেন, তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি, ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা আদায়ের দাবিতে ইতিমধ্যেই গত এক দশক ধরে রাজ্যে রাজ্যে কর্মীরা লড়ছেন। রাজ্যভিত্তিক কিছু দাবি আদায়েও সফল হয়েছেন। বিহারের আশা কর্মীদের ঐতিহাসিক ধর্মঘট ও জয়লাভ ছাড়াও উত্তরাখন্ড, আসাম, মহারাষ্ট্রে মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায়ে তারা সফল হয়েছেন। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের মিড-ডে-মিল কর্মীরাও তাদের মজুরি দ্বিগুণ (৩০০০ টাকা) আদায় করতে সক্ষম হন এবং ১০ মাসের বদলে ১২ মাসের জন্য তা বরাদ্দ করাতে পেরেছেন।
সম্মেলনের উদ্বোধনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য স্কিমকর্মীদের এই লড়াইকে ঐতিহাসিক এবং ভারতীয় সমাজের বুনিয়াদী পরিবর্তনের ইঙ্গিত বলেন। তিনি আরো বলেন, আজ যখন মহিলাদের মর্যাদা ও সম্মান আক্রান্ত, তখন এই লড়াই তার বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ। সারা দেশের শ্রমিক, গ্রামীণ মজুর সর্বোপরি সিপিআই(এমএল) পার্টি এই লড়াইকে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।
স্কিম ওয়ার্কার্স ফেডারেশন গঠনের উদ্যোক্তা কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব ডিমরি স্বাগত ভাষণে বলেন, এ এক ঐতিহাসিক সম্মেলন। সাম্প্রতিক শ্রমিক আন্দোলন ও দেশব্যাপী শ্রমিক ধর্মঘটগুলিতে স্কিমকর্মীদের অংশ গ্রহণ এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। সারা দেশে ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কাঁধে কাঁধ রেখে এই লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, স্কিমকর্মীদের প্রতি মোদী সরকারের বেইমানি, ও বঞ্চনার জবাব আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মোদী সরকারকে উৎখাতের মধ্যে দিয়ে করতে হবে। এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শংকর স্কিমকর্মীদের অভিনন্দিত করেন। তাঁদের দাবি পূরণে এআইসিসিটিইউ যে অঙ্গীকারবদ্ধ, তা উল্লেখ করেন।
১০টি রাজ্যের ৪৫০ জনের অধিক মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়ারী ও আশা আন্দোলনের প্রতিনিধি অংশ নেন। রাজ্যে রাজ্যে তাদের লড়াই ও বিজয়ের জন্য অঙ্গীকার প্রতিনিধিদের ভাষণে উঠে আসে। নিঃস্ব, দরিদ্র মহিলারাও যে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সরকারকে তাঁদের দাবি মানাতে বাধ্য করতে পারে, তা প্রতিনিধিদের ভাষণে উঠে এলো।
সম্মেলন সর্বসম্মত ভাবে পশ্চিমবঙ্গের ৪ সদস্য সহ ৪৫ জনের জাতীয় কার্যকরী কমিটি নির্বাচিত করে। ১৩ জনের অফিস বেয়ারার নির্বাচিত হন। যার সম্মানীয় সভানেত্রী সরোজ চৌবে ও সভাপতি রামবলী যাদব, কার্যকরী সভানেত্রী গীতা মন্ডল, ৫ জন সহ সভানেত্রী যার অন্যতম পশ্চিমবাংলার জয়শ্রী দাস, সাধারণ সম্পাদিকা শশী যাদব এবং ৫ জন সহ-সম্পাদিকা সহ একজন কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এরাজ্য থেকে নির্বাচিত ৪ জন জাতীয় কার্যকরী সদস্যরা হলেন, জয়শ্রী দাস, শীলা দে সরকার, আবুল কাশেম শেখ ও সঞ্জীব চক্রবর্তী।
এই সম্মেলন আসন্ন মাসগুলোতে দেশজোড়া এক শক্তিশালী সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলতে ৮ দফা প্রস্তাব গ্রহণ করে। নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক শশী যাদব বলেন করোনাকালে যখন গোটা দেশ ঘরবন্দি, তখন এই স্কিমকর্মীরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জনতার সেবা করে গেছেন। এদের প্রতি মোদী সরকার বিন্দুমাত্র সংবেদনশীল ছিল না।
সম্মেলনে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাব সমূহ।
১) দেশজুড়ে দীর্ঘ বছর কর্মরত এক কোটির অধিক আশা, অঙ্গনওয়ারী, মিড-ডে-মিল মহিলা কর্মী ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত, এই সম্মেলন দাবি জানাচ্ছে — সমস্ত প্রকল্প কর্মীদের সরকারি কর্মীর স্বীকৃতি দাও, সরকারি কর্মীর বেতন ও সামাজিক সুরক্ষা যথা ইপিএফ, ইএসআই, গ্রাচুইটি দাও। এই দাবি নিয়ে অক্টোবর ও নভেম্বর ২০২৩ দেশজুড়ে প্রচার অভিযান করা হবে।
২) দেশব্যাপী প্রচার অভিযান শেষে দিল্লী সংসদ ভবন অভিযান হবে।
৩) দেশজুড়ে প্রকল্প কর্মীদের সংগঠনকে আরো মজবুত করে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
৪) অন্যান্য সংগঠনগুলির সংগঠনের সাথে আলোচনা করে দেশব্যাপী একদিনের ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হবে।
৫) দেশের এক কোটির অধিক প্রকল্প কর্মীর উপর মোদী সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে আগামী লোকসভা নির্বাচনে (২০২৪) কর্মীরা সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রচার করবে এবং উচিৎ শিক্ষা দেবে।
৬) দেশব্যাপী মহিলাদের সম্মান ও সুরক্ষার উপর হামলা এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও সম্মান হানির মতো ঘটনায় সম্মেলন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। মণিপুরের মহিলাদের এবং মহিলা কুস্তিগীরদের সম্মান রক্ষার আন্দোলনের প্রতি সম্মেলন পূর্ণ সংহতি জানায়।
৭) সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা ও কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের যুক্ত আহ্বানে ২৬-২৯ নভেম্বর ২০২৩ নয়াদিল্লীর কেন্দ্রীয় বিক্ষোভ সফল করার আহ্বান জানানো হয়।
৮) সম্মেলন উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানায় চলা আশা কর্মীদের আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়।