“গান ছাড়া বাঁচা মানবাধিকারের ওপর চরম নিগ্রহের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ” — এটা আমরা একবাক্যে মেনে নেব। কিন্তু সত্যিই যদি এমন হয়!
হয়েছে, আফগানিস্তানে। আরএসএস চিন্তক সাভারকারের কথায়, “ধর্ষণ একটি বৈধ রাজনৈতিক হাতিয়ার” (অর্থাৎ সাধারণভাবে যেটা ঘটে থাকে তাকে নিন্দিত নয়, নন্দিত করেছেন ‘বৈধতা’ দিয়ে!)। এটা জেনে বা না জেনেই, বিজেতারা বিজিত নারীদেহের যেমন দখল নেয়, তেমনই চলে নারীকে ঘরবন্দি করে, নারীর জীবনের ওপরও নানা দখলদারি। তালিবানরা নতুন করে, আমেরিকার অনুগ্রহে আফগানিস্তান দখলের পর, প্রথমেই মেয়েদের মুখের ওপর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগার তো বটেই অফিস আদালত সহ যে কোনও রকম কর্মক্ষেত্রের দরজাও বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের ঘরে থাকতে হবে। বাইরে বেরোনোই নিষেধ। কারণ হিসেবে আফগান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ ২০২১-এ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাদের নতুন সদস্য ও প্রশিক্ষণহীন যোদ্ধারা মহিলাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে। সেই ঝুঁকি তালিব সরকার নেবে না! তাই আপাতত মহিলাদের ঘরে থাকতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মহিলাদের জীবন আবার আগের ছন্দে ফিরবে।
না, আগের ছন্দ তো ফেরেইনি, বরং নিত্য নতুন নিষেধাজ্ঞায় নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর হয়ে চেপে বসেছে। মহিলাদের জন্য সংগীত নিষিদ্ধ হল। গর্ভনিরোধক নেওয়া বারণ। মাত্র ক’দিন আগে বিউটি পার্লারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের জিমে-পার্কে যাওয়াও নিষিদ্ধ। এবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই সংগীতচর্চা নিষিদ্ধ করা হল। কারণ “সংগীত নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। যুব সমাজকে উচ্ছন্নে পাঠায়!” তাই ‘চারিত্রিক গুণের প্রসার ও দোষ প্রতিরোধ’ মন্ত্রকের নির্দেশে প্রশাসন সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজেয়াপ্ত করে হেরাট প্রদেশে সেগুলো জ্বালিয়ে বহ্ন্যুৎসব পালন করেছে! ঠিক যেমন বজরঙ্গীরা বিহারে আজিজিয়া মাদ্রাসা ও গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দিয়েছিল যেখানে ৪৫০০’র ওপর দুষ্প্রাপ্য বই ধ্বংস হয়ে গেছে।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বঞ্চিত আফগান মহিলারা তাহলে কী করবেন? কেন, মনুস্মৃতিতেই তো তার নির্দেশ রয়েছে! মনে আগল এঁটে শুধু শরীরকে উন্মুখ রাখা পুরুষের ইচ্ছামতো ‘পৌরুষ’ চরিতার্থতার জন্যে; আহার্যের প্রস্তুতি, সংসার ও সন্তান প্রতিপালন সহ সমস্ত গার্হস্থ্য কাজ মুখ বুজে করে যাওয়া! প্রায় বাড়ির পোষা ভারবাহী পশুটির জীবন!
ইরানে মাহসা আমিনিকে নীতি পুলিশরা ‘নীতি’ শেখাতে গিয়ে মেরে ফেলার পর ইরানী মেয়েরা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে গর্জে উঠেছিল শাসকের অন্যায় হিজাব-ফতোয়ার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রাণ কেড়েছে প্রতিবাদে উত্তাল নারী-পুরুষের। আজও জ্বলছে সে আগুন। আফগান মহিলারাও জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে মাঝে মাঝেই প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। আগামীতে নিশ্চয়ই আরও বড় প্রতিবাদ হবে।
কিন্তু জীবন থেকে সংগীত’কে শুধু বন্দুকের জোরে মুছে দেওয়া সম্ভব? যে সংগীতকে ঈশ্বরের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে যুগ যুগ ধরে সাধনা করে গেছেন সুরের ইন্দ্রজাল স্রষ্টা সংগীতসাধকেরা! আমাদের বাউল আর সিরিয়ার ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া সুফি সংগীতের বার্তা তো প্রায় একই! গোটা পৃথিবীকে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান ঘুচিয়ে, ভাষা রীতিনীতির দেওয়াল ভেঙে একসূত্রে বাঁধতে পারে তো সুরই! যা বহতা নদীর মত মানুষের দুঃখ বেদনা আনন্দ সংগ্রামের জীবন রসে পুষ্ট এবং পৃথিবীজোড়া সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমন্বয়ের নির্যাসে ক্রমশ ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর হয়ে উঠেছে! আবার মানুষের সভ্যতাকেও পুষ্টি ও গৌরব দিয়েছে!
আফগানিস্তানে সুরের ওপর নিষেধাজ্ঞা এই প্রথম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ — তালিব শাসনের প্রথম পর্যায়ে সংগীত, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিয়ম ভাঙলে কঠোর শাস্তি। সেই সময় তারা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্মরক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইতিহাস তথা সভ্যতার অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল। ঠিক যেমন আরএসএস-বিজেপি'র করসেবকরা ১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল।
মার্কিনী সেনা অভিযানে তালেবরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর আবার আফগান জীবনে সুর ফিরে আসে। সেখানে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মিউজিক প্রতিষ্ঠিত হয়। মহিলারাও দেশে-বিদেশে কনসার্টে অংশ নিয়েছেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের তালেব শাসনে সেই ইন্সটিটিউট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া হয় রবাব সন্তুর সেতার তবলাসহ বহুমূল্য সমস্ত বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু সংগীতকে বাঁচিয়ে রাখার দুর্মর বাসনায় প্রাণ হাতে করে ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ, অন্যান্য শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে পালিয়ে পর্তুগালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই চলেছে সুরসাধনা। তাদের অনেকেই বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। কিন্তু ছেড়ে যাওয়া দেশের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে।
যাঁর উচ্চারণ দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম, তিনি বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সাইমন ব্রাউটন। তাঁর দুটি ছবি, ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স : মিউজিক অব আফগানিস্তান’ এবং ‘সুফি সৌল : দ্য মিস্টিক মিউজিক অব ইসলাম’ হয়তো অনেকে দেখেছেন। আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুরস্ক সহ মধ্যপ্রাচ্যের সংগীত পরিক্রমার এক ইতিবৃত্ত। তাঁর এক সাক্ষাৎকারে (পুরোনো) বলেছিলেন, ৯/১১’র পর ইসলামকে ‘দানবীয়’ চেহারা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম প্রকৃত অর্থে শান্তির বার্তা বহন করে। সুফি গানের মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারি, সংগীত, কবিতা ও শিল্পকলার অন্যান্য ধারায় কী দারুণ ঐতিহ্য রয়েছে মুসলিমদের। তাঁর কথায়, আফগানদের মধ্যে সংগীতের প্রবল ক্ষুধা আছে যা তিনি ছবি তৈরির সময়ে লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব সংস্কৃতিতেও পড়ে। আইসিস আক্রমণে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহুমূল্যবান ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন যেমন চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে তেমনই সুফিবাদ তথা উদার বহুমুখী সাংস্কৃতিক সমন্বয়ও বড় বিপন্ন। তাঁর সেই আশঙ্কাই আজ আরও গাঢ হল।
যে আফগান শিশুরা সুরের নির্বাসনের মধ্যেই বড় হচ্ছে তাদের মস্তিষ্ক তথা মানসিক বিকাশ কী করে সম্পূর্ণ হবে সুরের অনুরণন ছাড়া? কোমল শিশুমন সুরপিয়াসী। তার সুকুমার প্রবৃত্তিগুলির কোমল পরিচর্যা তো সংগীতই করতে পারে। গান তাকে কল্পনাবিলাসী আবেগপ্রবণ করে তুলবে। নিজের দেশকে, দেশের অতীত ইতিহাসকে, সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষকে চিনতে জানতে সাহায্য করবে। বিশ্বমানবতার দরজায় হাত ধরে পৌঁছে দেবে। তাই সংগীত ছাড়া সে এক মানবিক পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে কীভাবে? মণিপুরের এক ত্রাণ শিবিরে প্রায় সমস্ত শিশুই জানিয়েছে, তাদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ‘বন্দুক’! যুদ্ধবাজ, দাঙ্গা-দীর্ণ, ‘গ্লোবাল বয়েলিং’এর এই পৃথিবীতে নিরাপত্তাহীন, জীবনের সমস্ত কোমলতা থেকে বঞ্চিত ক্ষুধার্ত শিশুরা চায় ‘অস্ত্র’! কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি আমাদের সন্ততিদের জন্য?
আরএসএস-বিজেপি আজ ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণে কোণে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির আগুন জ্বালিয়ে তুলছে। মানবতাকে সমানে কলঙ্কিত করে চলেছে। আমাদের শিশুদের জন্য যেমন এই মুহূর্তেই চাই হিংসার কলুষমুক্ত ভালোবাসার এক সবুজ সকাল, মানবতা-বিদ্বেষী তালিব সংস্কৃতিও আফগান জীবন তথা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যাক! উপত্যকা জুড়ে কর্মক্লান্ত দিনের শেষে নেমে আসুক সংগীত-উচ্ছল এক মায়াবী সন্ধ্যা! পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে আবার রবাব, সন্তুরের অনুনাদ, মরমিয়া সুফি সংগীতের অনুরণন বাতাসে ছড়িয়ে দিক শুধু মুঠো মুঠো ভালোবাসা! চঞ্চল রঙীন প্রজাপতির মত!
তার আগে চাই দুরন্ত, দুর্ধর্ষ এক লড়াই যা কখনও দেখেনি কেউ। সংগীত তাকে উজ্জীবিত করে চলুক!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত