মণিপুরে আইনের শাসন যে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, মেইতেই জনতার দ্বারা দুই কুকি মহিলাকে নগ্ন করে হাঁটানো ও যৌন নির্যাতন করার ভাইরাল ভিডিও তা গোটা বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। রাজ্যটিতে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠার ঠিক পরের দিন, ৪ মে ২০২৩ স্থানীয় পুলিশের চোখের সামনেই এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার এফআইআর দায়ের হয়েছে ১৮ মে। আর ১২ জুন দুই নারী আন্দোলনকর্মী ও নর্থ আমেরিকান মণিপুর ট্রাইবাল অ্যাসোসিয়েশন জাতীয় মহিলা কমিশনের কাছে মেলে এক অভিযোগ পাঠান। কিন্তু সেই ভিডিও ভাইরাল হওয়া ও সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিতভাবে এই অপরাধকে আদালতের আওতায় আনা পর্যন্ত সময় লাগল বিজেপি-চালিত ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের এই ঘটনাকে স্বীকার করতে এবং তারপর কয়েক জনকে গ্রেপ্তার করতে!
এই ভিডিও আর সুপ্রিম কোর্টের সতর্কীকরণ নরেন্দ্র মোদীর নীরবতা ভাঙতে সক্ষম হল, হিংসার আগুনে টানা ৭৯ দিন মণিপুর দগ্ধ হওয়ার পর! যে হিংসায়, এ’পর্যন্ত বলি হয়েছে ১৫০’রও বেশি প্রাণ, ঘরছাড়া হয়েছেন ৫০,০০০’রও বেশি মানুষ, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, অপবিত্র করা হয়েছে ২০০’র বেশি চার্চ, থানাগুলো থেকে প্রচুর অস্ত্র লুঠ করা হয়েছে। মণিপুর ভিডিও নিয়ে নরেন্দ্র মোদীর কষ্ট আর বেদনার কথা নারীর সুরক্ষা ও মর্যাদার সাধারণ বার্তার একটা অংশ মাত্র, কারণ তিনি চরম বিবেকশূন্য হয়ে মণিপুরের ঘটনাকে রাজস্থান ও ছত্তীশগড়ে মহিলাদের ওপর আক্রমণের ঘটনার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, কংগ্রেস-শাসিত যে দু’টি রাজ্য নির্বাচন-মুখী। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা ছিল ঘটনাটাকে গুরত্বহীন করে নিছক একটি মমুলি ঘটনা হিসেবে দেখানো এবং মূলত খৃস্টান কুকি পার্বত্য উপজাতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপোষিত জাতি-নিধন অভিযানের প্রেক্ষিত থেকে এটিকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা।
প্রকৃত তথ্য, যা মণিপুর মুখ্যমন্ত্রী পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন, তা মোদীর অত্যন্ত হিসেব কষে কুম্ভীরাশ্রু মোচনকে একেবারে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন্দ্র সিং স্বীকার করেছেন নারীদের ওপর আক্রমণের শতাধিক ঘটনা ঘটেছে এবং আরও বলেছেন স্পষ্টতই এইসব ঘটনার প্রকাশ্যে আসা বন্ধ করতেই ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে! মণিপুরের রাজ্যপাল বলেছেন তিনি কখনও এই ধরনের এবং এই বহরের হিংসা দেখেননি, তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে তা অবহিত করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন। ৪ মে থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত, হিংসা জ্বলে ওঠার প্রথম আট সপ্তাহে, প্রায় ৬০০০ এফআইআর দায়ের হয়েছে। এও জানা গেছে, ঐ ভাইরাল ভিডিও’র ভয়ঙ্কর ঘটনার এক ঘন্টার মধ্যেই আরেকটি ঘটনা ঘটেছে ইম্ফলের মেইতেই-প্রধান কোনাগ মানাগ অঞ্চলে; সেখানে ২১ এবং ২৪ বছরের দুই কুকি-ভগ্নীকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়। ঐ নিহত নির্যাতিতাদের বাবা, এক যাজক, ১৬ তারিখ এফআইআর দায়ের করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই নির্যাতনকারী খুনীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া প্রশাসনের দায়িত্ব নেওয়া এবং কোনো পদক্ষেপ নেওয়া এমনকি মণিপুরে শান্তি ফিরিয়ে আনার কোনো আবেদন রাখার পরিবর্তে, সরকার ভিডিও পোস্ট করার জন্যে হুমকি ট্যুইটার দিতে ব্যস্ত। বিজেপি নেতারা সংসদে বাদল অধিবেশনের ঠিক আগে ভাইরাল ভিডিও’র প্রকাশ্যে আসা নিয়ে প্রশ্ন করছেন। ডিজিটাল বেশ কিছু দুর্বুদ্ধিসম্পন্ন সংবাদ সংস্থা মিথ্যা সংবাদ উপস্থাপন করে পুরো ব্যাপারটাতে একটা মুসলিম-বিরোধী মোচড় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তারা মণিপুরে অন্য একটি মামলায় অভিযুক্ত এক মুসলিমকে, নগ্ন করে হাঁটানো ও যৌন নির্যাতনের ভাইরাল ভিডিও’র ‘মূল অভিযুক্ত’ বলে মিথ্যা প্রচার করেছিল। জানা যাচ্ছে, দিল্লীর এক ধর্ষণ কাণ্ডকে, মণিপুরের এক ‘মেইতেই মহিলার ধর্ষণ’ বলে ব্যাপক মিথ্যা রটনার জেরেই ৪ মে কুকি মহিলাদের ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছিল। যে মিথ্যা খবরে কুকি মহিলাদের আক্রমণের জন্য এক মুসলিমকে নির্যাতনকারী হিসাবে দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল, তার পিছনে এক অশুভ ছককে যে কেউ সহজেই বুঝতে পারবেন।
টানা তিনমাস মণিপুর জ্বলছে, মোদী সরকার এখনও কেন নির্বিকার? কোনও কোনও বিশ্লেষক মনে করেন যে মোদী সরকার আসলে রাজ্যটিতে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক একটা বদল চাইছে যাতে মণিপুরের পার্বত্য বনভূমি থেকে কুকি সম্প্রদায়ের জমির অধিকার কেড়ে নেওয়া যায়। কেন? যাতে সেখানকার ভূগর্ভস্থ মহামূল্যবান খনিজ সম্পদ মাইনিং কোম্পানিগুলোর হাতে তুলে দেওয়া যায় এবং মণিপুরকে কর্পোরেট লুঠের এক গবেষণাগারে পরিণত করা যায়। মণিপুর সরকার লাগাতার যেভাবে কুকিদের ‘মায়ানমারের বহিরাগত’ হিসাবে চিত্রিত করে চলেছে, তার পিছনে জাতি-সংঘাত ও মেরুকরণের একটি স্থায়ী পরিস্থিতি সৃষ্টির ষড়যন্ত্র আছে বলেই মনে হয়, যাতে মণিপুরকে, অসমের মতোই আগ্রাসী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের এক গবেষণাগারে পরিণত করা যায়। সংঘ-বিজেপি’র রাজনীতির অন্তর্বস্তু হল ‘ভাগ করে শাসন কর’, সংখ্যালঘু-বিরোধী বিদ্বেষ অভিযান এবং ভীড় হিংসার সংস্কৃতির ঢালাও বিস্তার, যে রাজনীতি ভারতকে একটি ঘৃণা ও ভয়ের প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছে। এই রাজনীতিই মণিপুরকে বাস্তবিকই একটি বারুদস্তুপের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে, যে রাজ্যটিতে ঐতিহাসিকভাবেই চ্যুতিরেখা ও নানা জটিলতা রয়েছে। ২০১৭তে মণিপুরে বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদীর সেই অভিযোগ সুবিদিত “মণিপুরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ কংগ্রেসের রাজ্য শাসনের অধিকার বাজেয়াপ্ত হয়েছে”। আজ সময় এসেছে মোদীর সেই একই নীতি নিজেদের ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের উদ্দেশে প্রয়োগ করার এবং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পদত্যাগ করানোর।
২০০২-তে গুজরাট থেকে ২০০৬এ খয়েরলাঞ্জি, ২০০৮-এ কান্ধামাল এবং এখন ২০২৩’র মণিপুর — সব ক্ষেত্রেই নারীদেহ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিংসার নিশানাবদ্ধ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাভারকারের ‘এক বৈধ রাজনৈতিক হাতিয়ার’ হিসেবে ধর্ষণের ‘সাফাই’ যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে। এ কথা তিনি লিখেছিলেন তার ‘সিক্স গ্লোরিয়াস ইপকস্ অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’ নামক বইয়ে। বিলকিস বানোর মামলাটিও আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে এইসব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পাওয়ার লড়াইটা কত দীর্ঘ এবং কত কঠিন। বিলকিস বানো যদিও বা এক দীর্ঘ সাহসী লড়াইয়ের মাধ্যমে ধর্ষণ-খুনে অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করাতে পেরেছিলেন, মোদী সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সেই অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার পর সংঘ বাহিনী কর্তৃক ‘বীরের সম্বর্ধনা’ দিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটাই উল্টে দিল। এটা নিশ্চয়ই কেউ ভুলে যাবেন না যে, যেদিন এই ভিডিও প্রকাশ্যে এল, সেদিনই কুস্তিগীরদের যৌনহেনস্থা মামলায় ব্রিজ ভূষণকে জামিন মঞ্জুর করা হয়েছে এবং দুটি ধর্ষণ ও খুনের আসামী রাম রহিমকে সপ্তমবারের জন্য প্যারোলে ছাড়া হয়েছে।
এই মণিপুরের মহিলারাই থাংজিয়াম মনোরমার নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, গোটা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন মণিপুরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বাস্তবতার দিকে। কুকি মহিলাদের বিরুদ্ধে হিংসার ভয়ঙ্কর বাস্তবতা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর এই মুহূর্তে জন্ম নিক এক তীব্র তীক্ষ্ণ গণরোষ, শেষ করে দিক এই শাসনের যা মণিপুরের জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতাকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছে! সত্য এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া, ন্যায় ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে শান্তি ফিরিয়ে আনার পথে এগিয়ে নিয়ে চলুক এই রাজ্যকে। মোদী সরকার মণিপুরে রাষ্ট্র-পোষিত হিংসাকে যতই তুচ্ছ করার, মামুলি ঘটনা বলে এড়ানোর চেষ্টা করুক, এই রাজ্য কিন্তু সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া শাসন এবং মোদীর ভারতে মানবতার ক্রম বর্ধমান সংকটকেই আয়নায় তুলে ধরেছে। গুজরাট ২০০২ বাজপেয়ী জমানাকে বিদায় দিয়েছিল; ২০২৩’র মণিপুর ভারতবাসীকে, ২০২৪-এ সর্বনাশা মোদী শাসনকে ছুঁড়ে ফেলতে সংকল্পবদ্ধ করুক!
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৩১ জুলাই ২০২৩