“চুপ করুন! নয়তো ইডি আপনার দোরে গিয়ে কড়া নাড়বে” — এই মারাত্মক হুমকি সংসদে দিয়েছেন মীণাক্ষী লেখি বিরোধীদের উদ্দেশ্যে।
৩ আগস্ট দিল্লী সার্ভিস বিল নিয়ে বাদল অধিবেশনে আলোচনা চলছিল লোকসভায়। বিদেশ দপ্তর ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মীণাক্ষী লেখি’র ভাষণে বিরোধী দলের কয়েকজন সাংসদ যখন বাধা দিতে থাকেন, তখন তিনি বিরোধীদের উদ্দেশ্যে এই হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ইডি সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কত নগ্নভাবে ব্যবহার করতে পারে। মিথ্যা যে কোনো মামলায় ইডি’কে দিয়ে যখন তখন যাকে খুশি গ্রেপ্তার করাতে পারে। ইডি’র কর্ণধারের অবসরের সময়সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও বার বার তাঁর মেয়াদ কেন যে বাড়াতে মোদী সরকার তৎপর তা আরও একবার খুল্ললাম খুল্লা প্রকাশ হয়ে গেল।
এবার আরও একটা মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। মোদীর অন্তরঙ্গ বন্ধু গৌতম আদানি’র যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পসংস্থাকে প্রতিযোগিতার বাজার থেকে সরাতে ইডি-সিবিআই-আয়কর দপ্তরকে আদানি’র স্বার্থে লেলিয়ে দেওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে। আর, নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে মোদী সরকার। হালে, সঙ্ঘী ইন্ডাস্ট্রি’কে আদানির সংস্থা অম্বুজা সিমেন্টস যেভাবে কব্জা করল তা অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
ঘটনাক্রম পর পর সাজালে দেখা যাবে, ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট প্রস্তুতকারক শ্রী সিমেন্টের সাথে সঙ্ঘী সিমেন্টের কথাবার্তা শুরু হয় কেনার জন্য। ২১ জুন, শ্রী সিমেন্টের পাঁচটি দপ্তরে আয়কর বিভাগ হঠাৎ তল্লাশি শুরু করে। ১৯ জুলাই শ্রী সিমেন্ট সঙ্ঘী সিমেন্টকে কেনার দৌড় থেকে সরে আসে। আর, ৩ আগস্ট আদানির সংস্থা অম্বুজা সিমেন্ট ঘোষণা করল যে তারা সঙ্ঘী সিমেন্ট সংস্থাকে কিনে নিয়েছে।
২০২০’র ১২ নভেম্বর, ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত বিশ্বের নামজাদা কর্পোরেটদের পত্রিকা ফাইনান্সিয়াল টাইমস একটা লেখা প্রকাশ করেঃ ‘মোদীজ্ রকফেলার — গৌতম আদানি অ্যান্ড দ্য কনসেনট্রেশন অফ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’! বেশ বড় ওই লেখায় তারা দেখিয়েছেন, মোদীর পেয়ারের দোস্ত আদানির বিমানবন্দর পরিচালনার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৮-তে ছ’ছটা বিমানবন্দরের মালিকানা পেয়ে গেল যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ছিল। আদানি’র কপালেই যাতে শিকে ছেঁড়ে সেই মতো নিলামের দরপত্র স্থির করা হয়, অন্য প্রতিযোগী যাতে সেই যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে — পরম যত্নে সেদিকে নজর ছিল আর বিমানবন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যাতে আনকোরা সংস্থা তা কিনতে পারে তার সমস্ত শর্ত মজুত ছিল। দেখা গেল অনায়াসেই অক্লেশে আদানি ছটা বিমানবন্দর পকেটে পুরে ফেলল আর রাতারাতি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিমানবন্দরের মালিক হয়ে বসল। মোদীর হাত ধরে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে আদানি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বন্দরের মালিক হয়ে উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত পরিকাঠামো এখন আদানির নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভগুলো আদানির এই উল্কাগতি উত্থানে বিরাট মদত যুগিয়েছে।
২০১৫ সালেই ক্রেডিট সুইজি ‘হাউস অফ ডেট’ শিরোনামে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতেই সতর্কবাতা দিয়ে তারা বলে যে আদানি গ্রুপ হচ্ছে ভারতের প্রথম ১০টি কর্পোরেট যাদের ঋণ বিপজ্জনক সীমায় রয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো থেকে আদানি গ্রুপ যে ঋণ নিয়েছে তা ব্যাঙ্কের দেয় মোট ঋণের ১২ শতাংশ! তারপরও নানান বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে সে ক্রমাগত ঋণ নিয়েছে — কার্যত ঋণের বিরাট সমুদ্রে তখনই ডুবে ছিল আদানির সাম্রাজ্য। মোদী ক্ষমতায় আসার পর আদানির সম্পদ অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পায় ২৩০ শতাংশ হারে!
এই আদানি সহ হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেটদের প্রতাপ, দাপট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি মোদী জমানায় কদর্য মাত্রা নিয়েছে। ক্রোনি পুঁজিবাদের সর্বনাশা মডেল আজ দেশের সমস্ত সম্পদকে লুট করে চলেছে। আর, তাদেরই তুষ্ঠ করতে দেশের সম্পদের ঢালাও বেসরকারিকরণ, বিক্রি, গোটা পরিকাঠামো তুলে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞ চলছে।
- অতনু চক্রবর্তী