“জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই/ তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই রে, সব মরণ নয় সমান…”
বহু সংগ্রামের সাক্ষী ও বিভিন্ন গণআন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা সাথী সনৎ রায়চৌধুরী, আমাদের সকলের প্রিয় ‘সনৎদা’ দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে ১ জুলাই ২০২৩ চুঁচুড়ায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। গত ৮ আগস্ট শিয়ালদহ জর্জ ভবনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কলকাতা জেলা কমিটির ডাকে সনৎ রায়চৌধুরী’র স্মরণসভায় শুরুতেই নীতীশ রায়ের গলায় এই গান সভার মূল সুরটি বেঁধে দেয়। প্রথমেই সনৎ রায়চৌধুরী’র প্রতিকৃতে মাল্যদান ও নীরবতা পালন করে সভার পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। সনৎদা জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালে যুক্তবঙ্গের রংপুর জেলায়। মাতা শান্তিলতা রায়চৌধুরী ও পিতা গৌরী শঙ্কর রায়চৌধুরীর সাত সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। সভাকক্ষে সনৎদা’র সংক্ষিপ্ত পরিচয় সহ শোক প্রস্তাব পাঠ করেন ইন্দ্রাণী দত্ত। এরপরে সঞ্চালক অতনু চক্রবর্তী সনৎদা’র দীর্ঘদিনের সাথী নিত্যানন্দ ঘোষকে ডেকে নেন। রংপুর জেলা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ হয়ে চুঁচুড়া পর্যন্ত সনৎদা’র ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের এক সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন তিনি। রংপুরে স্কুল ও কলেজ জীবনে ছাত্র আন্দোলন, পাঁচের দশকের শুরুতে ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে সনৎদা কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন ও পার্টি সদস্যপদ লাভ করেন। স্বাধীনতার ১২ বছর পরে ১৯৫৯’র শেষে তিনি উত্তরবঙ্গে এসে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে চুঁচুড়ায় দাদা অজিত রায় চৌধুরীর কাছে চলে এসে দেশবন্ধু মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, সঙ্গে চলে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। পরে তিনি সুগন্ধ্যা জুনিয়র হাই স্কুলে যোগ দেন। চুঁচুড়ায় থাকাকালীনই তিনি হুগলী-চন্দননগর-ভদ্রেশ্বর সিপিআই(এম) লোকাল কমিটির সম্পাদক হন। বসন্তের বজ্র নির্ঘোষে সাড়া দিয়ে সনৎদা নকশালবাড়ি আন্দোলনে সামিল হন ও ১৯৭০ সালে ২০ অক্টোবর কারারুদ্ধ হন। আশির দশকের শুরুতে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট গঠিত হলে তিনি সেই সেই সংগঠনে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে তাঁর জাতীয় সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনে যুক্ত হন কমরেড ধূর্জটি বক্সী’র উদ্যোগে। পার্টি কংগ্রেসেও প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে পার্টি সদস্য হিসেবে না থাকলেও সংগঠনের নানা কর্মসূচিতে যুক্ত থাকেন। সনৎদা ছিলেন এক মুক্ত মনের মানুষ, যেকোনো ব্যক্তিকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর ছিল। সারাজীবন তিনি বিজ্ঞান আন্দোলন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলন, নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন সহ নানা সামাজিক আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি।
সনৎ রায়চৌধুরী’র ভাই অজয় রায়চৌধুরী তাঁর দাদার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সনৎদার মৃত্যুর পর এটি নবম স্মরণসভা যেখানে তিনি বলছেন। সনৎদার জীবন ও আদর্শ গড়ে ওঠার পিছনে তিনি তাঁদের পরিবার ও বিশেষ করে তাঁর মায়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বাড়িতে মায়ের কমিউনিস্ট আদর্শের প্রেরণায় ও তেভাগা আন্দোলনের আবহেই সনৎদার বেড়ে ওঠা। অঞ্চলের মহিলা আত্মরক্ষা বাহিনীর সম্পাদিকা হিসেবেও কাজ করেছিলেন তাঁর মা শান্তিলতা রায়চৌধুরী। তাঁর পরিবারের কেউ কখনো দক্ষিনপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত হননি। শেষ দিন পর্যন্ত দাদাও ছিলেন একজন কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থাশীল এক মানুষ। এক সময়ে, পরিবারের দুই দাদা আত্মগোপন করে ও সনৎদা সহ পরিবারের তিনজন জেলখানায় বন্দীদশায় কাটিয়েছেন। ১৯৭২ সালে আগস্ট মাসে কারামুক্ত হয়ে তিনি নানা সামাজিক রাজনৈতিক কাজে যুক্ত হন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বন্দীমুক্তি আন্দোলন, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য আন্দোলন। পাড়া-প্রতিবেশী, খেলার মাঠ থেকে শুরু চায়ের দোকান সর্বত্র সর্বস্তরের মানুষের সাথে আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের পরপ্রেক্ষিতে গণআন্দোলন ও ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি বারবার বলতেন। সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কমরেডদের সাথে সবসময় তিনি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছেন। চুঁচুড়া শহরে বহিরাগত হলেও, যেভাবে পুরো চুঁচুড়া শহরের মানুষের মনে সনৎদা এক চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন তা অত্যন্ত গর্বের। তাঁর বর্ণময় জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি সঙ্কলন প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও তিনি বলেন।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের পলিটব্যুরো সদস্য কার্তিক পাল বলেন কিভাবে সনৎদা কনিষ্ঠ সবাইকে ‘তুই’ সম্বোধনের মধ্যে দিয়ে আপন করে নিতেন। তাঁর বৈচিত্রময় জীবনে সমস্ত নকশালপন্থী, বামপন্থী, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল সংগঠনের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল। শেষ দেখা হওয়ার সময়ে পাটনায় পার্টি কংগ্রেসের বিস্তারিত রিপোর্ট শুনে তিনি অত্যন্ত উৎসাহিত হন ও ফ্যাসিবাদী হামলার মোকাবেলায় পার্টির ভূমিকাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দেন। রাজনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগের ভূমিকার গুরুত্বের কথাও তিনি বারবার বলতেন। সনৎদার আদর্শ, সংগ্রামী জীবন ও বৈশিষ্ট আমাদের চলার পথের পাথেয়।
সনৎ রায়চৌধুরী’র একমাত্র ভাগ্নে শুভ্র সেন তাঁর ‘মণিমামা’র কথা বলতে গিয়ে তাঁর দুটি বিশেষ উপলব্ধির কথা বলেন; সনৎ রায়চৌধুরী’র মৃত্যুর পরে তাঁর সাথীদের কথা শুনে তাঁকে নতুন করে চিনলাম, তাঁর কাজের ব্যাপ্তিকে জানলাম। আরও বলেন, জন্ম থেকে কে কমিউনিস্ট হতে পারে জানা নেই, কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত যে কিভাবে কমিউনিস্ট থাকা যায় তা সনৎ রায়চৌধুরী’কে দেখে শিখলাম। সনৎদা’র সাদামাটা জীবনযাপন, মানবিক গুণ, মাটির কাছাকাছি থাকা মুক্ত মনের কথাও তিনি বলেন।
পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার বলেন এক বিশেষ সামাজিক রাজনৈতিক সময়ে সনৎদা’র বেড়ে ওঠা। ৪২’র ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ৪৩’র মন্বন্তর, ৪৫’র ভয়ানক ম্যালেরিয়া, ৪৬-৪৮-এ তেভাগা আন্দোলন, স্বাধীনতা, দেশভাগের অভিঘাত এই সবকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি ও তাঁর পরিবার গেছে। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান, তারমধ্যে বিতর্ক ও বিপ্লবী ধারাকে বেছে নেওয়া এই সবই তাঁর বিপ্লবী মনন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যাকে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহন করেন। সনৎদা’র কাছে থেকে শিখতে হবে কমিউনিস্টদের সমাজ জীবন বা যেভাবে তারা সামাজিক সম্পর্কগুলিকে লালন করতেন, আজ যার খানিকটা খামতি দেখা যাচ্ছে। সামাজিক সম্পর্কগুলি ক্ষীণ বা দুর্বল হওয়ার কারণে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ দূর অব্দি চারিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে যা অবশ্যই আমাদের পার হতে হবে। উত্তরবঙ্গে আবারো যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তিনি বারবার জানিয়েছিলেন কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি।
ফ্যাসিবাদী শক্তি ২০২৪’র নির্বাচনকে ধরে বড় আঘাত নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, ধর্ম-জাতকে ব্যবহার করে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে হরিয়ানা থেকে মনিপুরে। জাতীয় স্তরে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হিসেবে আজকের পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরী। পশ্চিমবঙ্গের বিগত বিধানসভা নির্বাচন ও শেষ কর্ণাটক নির্বাচনেও বিজেপিকে পরাস্ত করতে বিভিন্ন নাগরিক-গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলি বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এই নাগরিক সমাজের সাথে যুক্ত হওয়া, বিভিন্ন উদ্যোগ গড়ে তোলা, গণআন্দোলনে ভূমিকা রাখা, সমাজ সম্পর্কগুলিকে প্রশস্ত ও নিবিড় করার ক্ষেত্রে সনৎদা’র থেকে আমাদের বহু কিছু শেখার রয়েছে।
সাথী প্রেমাংশু সনৎদা’র সাথে তাঁর দীর্ঘ পরিচয়ের কথা উল্লেখ করে বলেন হতাশার সময়েও তিনি মানুষের কাছে যাওয়ার কথা, গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে অনুপ্রাণিত করতেন। মানুষের আস্থা অর্জনের এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি দেখিয়েছিলেন যেখানে মৃত ছাত্রীর নাবালক সন্তানের সম্পত্তি দিদিমা সনৎদা’র হাতে দিয়ে গেছিলেন, সাবালক হওয়া পর্যন্ত যার দেখভাল তিনি করেন। পৃথিবী জুড়ে তাঁর অনেক কৃতি ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে রয়েছেন। মিথ্যা আর আত্মপ্রচারের পৃথিবীতে মেধা ও হৃদয়ের মিশেলে তিনি ছিলেন এক সম্পূর্ণ মানুষ।
দেবজ্যোতি মজুমদার হুগলীতে তৈরি হওয়া ‘মিনিমাম ডিমান্ডস কমিটি অফ সিটিজেনস’এর চুঁচুড়া হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজ বানানোর দাবিতে আন্দোলনের সূত্রে সনৎদা’র সাথে পরিচয়ের কথা বলেন। আইপিএফ’এ যুক্ত হওয়া ও পরবর্তী সময়েও তাঁর ভূমিকা থেকে শিক্ষণীয় যে কিভাবে নিজেদের খাঁচাটাকে, হৃদয়কে বড় করা যায়। আজকের পরিস্থিতিতে বিশেষ করে পাটনা কংগ্রেস থেকে যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি সনৎদা’র শিক্ষা আমাদের সেই পথে চলতে সাহায্য করবে।
বাসুদেব বসু বলেন, ৮০’র দশকে চেতলায় পার্টির গোপন আস্তানায় বিনোদ মিশ্র ও ধূর্জটি বক্সীর থেকে সনৎদা’র কথা শোনেন। পরে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আইপিএফ’এর রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সব কর্মসূচিতে থাকতেন। মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট মুখ সনৎদা ছিলেন একাধারে অভিভাবক ও রক্ষক। মানবাধিকার সংগঠনের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে তিনি একই রকম আন্তরিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। বিহার নির্বাচনে পার্টির সাফল্যে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে দার্জিলিঙে পার্টির প্রার্থী চা বাগান আন্দোলনের সুমন্তি এক্কা’র কথা শুনেও বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন।
পরিশেষে পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, সনৎদা মানেই তরতাজা একজন মানুষ, এক বিরাট অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার, এক দীর্ঘ পথ চলার ইতিহাস। সাধারণভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা যখন খুব বেশি হয়, তার ভারে আমরা খানিকটা ঝুঁকে যাই। সনৎদা একেবারেই তা ছিলেন না। চলার পথের এই ব্যাপক অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে হয়তো কিছুটা বলতেন, কিন্তু কখনই অতীতচর্চা, অতীতজীবী বা অতীতমুখী মানুষ তিনি ছিলেন না। সবাই বলছেন সনৎদর থেকে শেখা যায় কিভাবে নিজেদের সম্প্রসারণ করতে হবে; সেটা যে হতে পেরেছিল তার একটা বড় কারণ সনৎদা ভীষণ রকম বর্তমানে বাঁচতেন। দ্বিতীয়ত, এখন পশ্চিমবঙ্গে আমরা বড্ড বেশি বাঙালি হয়ে যাচ্ছি। একটা সময়ে হয়তো খুব আন্তর্জাতিক ছিলাম, এখন খুব বাঙালি হয়ে গেছি। দেশে কোথায় কী হচ্ছে তা বাংলার খবরের কাগজে পাওয়া যাবে না, টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যাবে না, সাধারণ ভাবে বাংলার মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনা চর্চায় এগুলো কিছু পাওয়া যাবে না। বাংলাতেই শুরু বাংলাতেই শেষ। এই অর্থে, সনৎদা খুব ভারতীয় ছিলেন। দেখা হলেই বিহার, ঝাড়খণ্ড, তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, পাঞ্জাব কোথায় কী হচ্ছে বিভিন্ন খবর জানতে আগ্রহ প্রকাশ করতেন। শুধু নির্বাচনের বিষয়ে নয়, চলমান আন্দোলনের বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। ভাষা আন্দোলন, পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলন, নকশালবাড়ি, বন্দীমুক্তি আন্দোলন, আইপিএফ, এপিডিআর এগুলো প্রত্যেকটা একেকটা বিশাল অধ্যায়। আইপিএফ মানেই একদিকে নাগভূষণ পট্টনায়েক, মহেন্দ্র সিং, অন্যদিকে অরিজিত মিত্র, সনৎদা। এই প্রতিটা অধ্যায়েই সনৎদা অত্যন্ত গভীরে ঢুকে ছিলেন। এতো বড় যাত্রাপথে একজন অখণ্ড কমিউনিস্ট ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার এটাই চারিত্রিক বৈশিষ্ট, কোনো একটা জিনিসে তিনি আটকে থাকেননি। বিভিন্ন টুকরো টুকরো ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলনের সাথে সাথে নতুন সমাজ নির্মাণের বৃহৎ অখণ্ড চেতনার মধ্যে কিভাবে অবগাহন করা যায় তা সনৎদা আমাদের দেখিয়ে গেছেন। আজকের রাজনৈতিক সময়ে তাই সনৎদার মতো মানুষ, তাঁর মতো জীবনযাপন আরও বেশি দরকার। তিনি ছিলেন একজন জনপ্রিয় শিক্ষক যার স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে। অনেক শিক্ষকই প্রভাবিত করেন, কিন্তু স্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা সবার থাকে না। এ এক বিশাল সামাজিক অনুশীলন। মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বা সামাজিক মূল্যবোধ গেঁথে দেওয়া। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক চেতনার মানে মানবিক মূল্যবোধ আছে কী নেই। এই যে বুলডোজার চলছে, ধর্মীয় উন্মাদনা, দাঙ্গা, মনিপুর-হরিয়ানার মতো সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা মানুষের মতো প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছি, কী পারছি না। মনুষ্যত্ব কেড়ে নেওয়ার এই সময়ে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে বেঁচে থাকতে গেলেও আজ তারজন্য বিরাটভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সনৎদার মধ্যে বিরাটভাবে সেই মানবিক মূল্যবোধগুলো ছিল, তাগিদ ছিল। তাই সমস্ত আন্দোলন, মানুষের প্রতিরোধের মধ্যে তিনি জড়িয়ে থাকতেন। এই সব অভিজ্ঞতা, ইতিহাস একে একে চলে যাচ্ছে। এগুলোকে কতটা আমরা ধরে রাখতে পারবো, বাঁচিয়ে রাখতে পারবো, শিখতে পারবো সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আজ গোটা দেশজুড়ে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এই ব্যাপক গভীর সঙ্কট আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই খণ্ডিত করে দিচ্ছে। মণিপুরের মতো জায়গায় আজ যে তীব্র মেরুকরণ তা সেখানকার বামপন্থীদেরও খণ্ডিত করে দিচ্ছে কিনা জানা নেই। মণিপুর-হরিয়ানা সহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে শুধু সাম্প্রদায়িক বা সামাজিক মেরুকরণ নয়, মানুষদেরও টুকরো করে দেওয়া হচ্ছে। আজ এই ধ্বংসাত্মক ফ্যাসিবাদের হাত থেকে গণতন্ত্রকে বাঁচানো তাই বড় চ্যালেঞ্জ। ইতালিতে যখন ফ্যাসিবাদ এসেছিল, সেই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক গ্রামসির শুরুর দিকের লেখা পড়ে মনে হয়, তিনি ভাবছিলেন এটা একটা সাময়িক পরিস্থিতি। সংশয় ছিল যে এই ফ্যাসিবাদ হয়তো একটা agrarian reaction। অর্থাৎ ইতালির যে শিল্প বুর্জোয়া তারা কি এতো ধ্বংসের মধ্যে নেমে পরবে? কোথাও না কোথাও একটা ধারণা কাজ করছিল যে এটা বোধ হয় গ্রামাঞ্চলে পুরনো কুলাক ভিত্তি বা জমিদারদের প্রতিক্রিয়া, যা হয়তো বেশি দূর যাবে না। বাস্তবে দেখা গেলো, যখন ধ্বংস যজ্ঞ শুরু হল তখন কে কুলাক আর কে পুঁজিপতি, কে পুরনোপন্থী আর কে আধুনিক সব এক জায়গায় চলে গেল। জার্মানিতে তা আরও বেশি হল। ভারতে আমরা যে স্তরে আছি, যে মাত্রায় ধ্বংস হচ্ছে, ২০২৪-এ যদি এই শক্তি নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তাহলে আর কিছুই পরে থাকবে না। রাজ্যসভায় দিল্লী অর্ডিন্যান্স বিল পাস হওয়ার সময়ে, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও বর্তমানে রাজ্যসভা সাংসদ রঞ্জন গগৈ বলেন, “সংবিধানের মৌলিক কাঠামো নিয়েই অনেক বিতর্ক আছে”। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও যদি বলে দেওয়া যায় এরমধ্যে কোনো মৌলিকত্ব নেই, তাহলে তো সহজেই কিছু সাংবিধানিক ধারাকে ভেঙ্গে বা ছেঁটে ফেলা যায়। আগামী দিনে এই আক্রমণ আরো বড় আকারে নামবে। এটা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়, তবে তা কোথায় যাবে বা কত দূর পর্যন্ত যাবে তা আমরা কেউ বলতে পারবো না। এখনও পর্যন্ত যেটুকু গণতন্ত্র আছে, সেখানে আগামী নির্বাচনে যদি এই শক্তিকে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, এর গতিকে কিছুটা মন্থর করে দেওয়া যায়, এর ধারকে খানিক ভোঁতা করে দেওয়া যায় তবে সেটাও কম নয়। তাই আজকের দিনে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে সার্বিক প্রতিরোধ তা এক বহুমাত্রিক অনুশীলন। সেই অখণ্ড পরিকল্পনার মধ্যে নির্বাচন, গণআন্দোলন, মতাদর্শ, ব্যক্তি, সংগঠন সবই আছে। যে যেখানে আছেন লড়ে যাওয়া। এই লড়ে যাওয়ার স্পিরিটের মধ্যেই সনৎদা রয়েছেন। এই নকশালবাড়ির প্রজন্ম যারা বিপ্লব দ্রুত সম্পন্ন করতে আহ্বান রেখেছিলেন, সেই প্রজন্মকে আজ এক বিশাল পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এক বিরাট প্রতিবিপ্লবের মুখে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী সার্বিক লড়াই কিভাবে লড়া যায় এবং তার যেকোনো উপাদান যেকোনো কর্মসূচিকে সেই একই আগ্রহ, উৎসাহ, সাহস, অঙ্গীকার নিয়ে করা যায়, সেখানে সনৎদার স্মৃতি আমাদের বারেবারে অনুপ্রাণিত করবে। সনৎদার মতো আরও অনেক মানুষ এখনও আছেন। সনৎদার স্মৃতিকে নিয়ে সেই পুরনো মানুষ এবং তাঁদের সাহচর্যে যে নতুন প্রজন্মরা গড়ে উঠছেন তাঁদের সংগঠিত করা আজ জরুরি। শিক্ষা, জ্ঞান, সামাজিক কাজের জগতে বিভিন্ন অনুশীলনে যারা আছেন তাদের সবাইকে নিয়ে আগামী দিনের কঠিন সময়ে লড়ার জন্য সনৎদার উৎসাহ স্নেহ আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাঁর বিরাট চেতনা, ব্যক্তিত্ব, কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও তার সাথে দৈনন্দিন কাজ, এরমধ্যে যোগসূত্র ধরে রেখেছিলেন সনৎদা। আমরাও যদি এই যোগসূত্র ধরে রাখতে পারি তবে সেটাই তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা জানানো হবে। সনৎদার আদর্শ ও প্রেরণা বাংলা তথা ভারতের কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাক।
কমরেড সনৎ রায়চৌধুরী লাল সেলাম!