১৬ আগস্ট ২০২৩, কলকাতা প্রেস ক্লাব, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
সিপিআই(এমএল), সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও অল ইণ্ডিয়া লইয়ার্স ফর জাস্টিস সংগঠনগুলির আটজনের একটি তথ্যানুসন্ধানী দল মণিপুর পরিদর্শন করে।
তথ্যানুসন্ধানী দলের উপলব্ধি, মণিপুরের বীরেন সিং সরকার ও কেন্দ্র সরকারের যোগসাজস মণিপুরে সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ার জন্য দায়ী যা মণিপুরে এক অভুতপূর্ব মানব দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে।
কার্বি আংলং’এর সিপিআই(এমএল) নেত্রী এবং আইপোয়ার সহ-সভাপতি প্রতিমা এঙ্গিপি, আসামের সিপিআই(এমএল) নেতা বিবেক দাস, দিল্লীর সিপিআই(এমএল) নেত্রী সুচেতা দে, কর্নাটকের সিপিআই(এমএল) নেতা ক্লিফটন ডি রোজারিও, কর্নাটকের সিপিআই(এমএল) নেতা অবনি চোক্সি, আইপোয়া নেত্রী কৃষ্ণাবেণী, আইনজীবী সমিতির সদস্য মধুরিমা টি এবং কর্নাটকের দলিত ও নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী ডু সরস্বতী — এই আটজনের পরিদর্শক দল গত ১০ আগস্ট থেকে ১৩ আগস্ট পর্যন্ত মণিপুর পরিদর্শন করেন। বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার সেখানে যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে তা প্রত্যক্ষ করেছে পরিদর্শকদল। প্রতিনিধিদল ইম্ফল উপত্যকা, কাংপোকপি ও চুড়াচাঁদপুর জেলার শরণার্থি শিবিরগুলি পরিদর্শন করেন। তাঁরা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এবং ‘মেইরা পাইবি’ ও ‘ইণ্ডিজেনাস ট্রাইবাল লিডার্স ফোরাম’ সহ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠিগুলির বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলেন।
১) উপত্যকা ও পাহাড়, দুই এলাকায় যথাক্রমে মেইতেই ও কুকি দুই জাতিগোষ্ঠিকে এরকম সম্পূর্ণ আলাদা আলাদাভাগে বিভাজিত করে ফেলাটা ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে দেশকে বিজেপির দেওয়া উপহার। ভারতের ইতিহাসে এরআগে কখনই এরকম কোনও সরকার আসেনি যারা নিজের হাতে এভাবে সমাজের সামাজিক বুনটকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার কাজ করেছে। একটা রাজ্যে একসাথে বসবাসকারী দুটি জাতিগোষ্ঠিকে রাজ্যের দুটি পৃথক পৃথক এলাকায় সম্পূর্ণরূপে আলাদা ও আবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার এরকম বিভাজন সৃষ্টি করেছে এমন এক রাজ্যে যেখানে এই দুই জাতিগোষ্ঠি, আগেকার কিছু সংঘর্ষের ঘটনা সত্ত্বেও, পরস্পর মিটমাট করে একসাথে বসবাস করতে স্বচ্ছন্দ ও সক্ষম ছিল।
২) এ’কথা উল্লেখ না করলেও চলবে যে, জাতিগোষ্ঠিগুলোর মধ্যে বগত তিনমাস ধরে যে বিভাজন, আবদ্ধকরণ ও হিংসা চলছে তা বিজেপি সরকারের নেওয়া পদক্ষেপেরই পরিণাম। একদিকে দেখা গেল যে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং হিংসার নিরসনে অক্ষম ও অনাগ্ৰহী, অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে মণিপুরের সমস্যার চেয়ে ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরই অগ্রাধিকার পেল। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে যে নিকৃষ্ট ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তা এই সংকটের সর্বাঙ্গীণ রাজনৈতিক সমাধান প্রদানে তাঁদের দেউলিয়াপণাকেই উন্মোচিত করেছে।
৩) ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থা শোচনীয়। উপত্যকা এবং পার্বত্য অঞ্চলে উচ্ছেদ ও স্থানান্তরিত হাজার হাজার মানুষ অত্যন্ত দুরাবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বুনিয়াদি পরিষেবার ব্যবস্থাই নেই। সরকার হাত ধুয়ে ফেলেছে, দুর্দশাগ্ৰস্ত জনগণের দায়দায়িত্ব নিচ্ছে না।
বাস্তুচ্যুত মেইতেইদের জন্য উপত্যকার ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থা একেবারেই নিকৃষ্ট। জানা গেল, ইম্ফলের কেন্দ্রস্থলে শ্যামাসাক্ষী হাইস্কুলে চালিত ত্রাণ শিবিরে রাজ্য সরকার কিছু চাল ও ডাল ছাড়া শিবিরে থাকা মানুষদের জন্য মাথাপিছু ৮০ টাকা করে দেয়, যেটা একেবারেই অপর্যাপ্ত। পরিদর্শক দলের সদস্যরা এটাও জানতে পারলেন যে, বর্তমানে এক বাজারে অবস্থিত মৈরাং’এর ত্রাণ শিবিরেও যথাযথ সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। ঐ শিবিরে থাকা ব্যক্তিদের আজ পর্যন্ত মাথাপিছু মাত্র ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। আকামপটের স্কুল প্রাঙ্গণে যে ত্রাণ শিবির চলছে সেখানে ভিড় অত্যন্ত বেশি এবং বুনিয়াদি পরিষেবাও অপ্রতুল।
পাহাড়ে কুকিদের জন্য যে ত্রাণশিবির চলছে তার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। চুড়াচাঁদপুরের যুব হস্টেলে স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচালনায় যে ত্রাণশিবির চলছে সেখানে ঘরগুলো জনাকীর্ণ এবং সংক্রামক ব্যাধি দ্রুত ছড়াচ্ছে। ঐ শিবিরে হাম, জল বসন্ত এবং ভাইরাস ঘটিত জ্বর প্রতিদিনের ব্যাপার। দলের সদস্যরা যে শিবিরগুলো পরিদর্শন করেছেন সেখানে জঞ্জাল সাফাই ব্যবস্থা খুবই খারাপ, প্রতিটি ঘরে প্রায় ৫০০ ঘরছাড়া মানুষ থাকেন এবং শৌচাগার ব্যবস্থা শোচনীয়। অধিকাংশ ত্রাণ শিবিরেই বাসিন্দারা পুষ্টিকর খাবার পান না এবং দিনে দুবারই ভাত ও ডাল দেওয়া হয়। কাংপোকপির ত্রাণ শিবিরগুলোর অবস্থাও একই রকম এবং পুষ্টিকর খাবার ও শৌচাগারের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। ঐ জেলায় একটাই হাসপাতাল রয়েছে যেটাকে জেলা হাসপাতালের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং ওষুধের ব্যবস্থা নগন্য।
৪) উপত্যকা এবং পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে সীমানা বিভাজন এবং অঘোষিত অবরোধের ফলে পার্বত্য জেলাগুলোর ত্রাণ শিবিরে থাকা ঘরছাড়া কুকিদের কাছে বুনিয়াদি খাবারসামগ্রী, ওষুধের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের পরিবহণ পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরজন্য আবার উপত্যকার বাইরে মেইতেইদের যাওয়াটাও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে।
৫) চলমান হিংসা এবং জীবনহানি ও আক্রান্ত জনগণের সম্পত্তি নাশের জন্য সরকারকেই সরাসরি দায়বদ্ধ করতে হবে। এটা অত্যন্ত লজ্জার যে এই সমস্ত অমানবিক ও প্রকট অপরাধগুলোর তদন্তে প্রাথমিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সুনিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্টকেই হস্তক্ষেপ করতে হল।
মানবতার এই সংকটের সম্ভবপর রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপটা হতে হবে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে বীরেন সিং’এর পদত্যাগ। আমরা যুযুধান সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছেই বৈরিতা বন্ধের আবেদন জানাচ্ছি যাতে ত্রাণ শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া দুর্দশা পীড়িত জনগণের পরিচর্যা করা সম্ভব হয় এবং সেটা যেন চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে অতিক্রম করে বর্তমান অচলাবস্থা অবসানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার এক সংকেত হয়েও দেখা দিতে পারে।
পরিদর্শকদল মণিপুরের বর্তমান রাজ্যপাল শ্রীমতী অনুসুয়া উইকেইয়ের সাথেও দেখা করেন এবং তাঁকে মণিপুরের বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। ত্রাণশিবিরগুলির জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে বিশেষ আবেদন জানানো হয়। এবং রাজনৈতিক সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং’এর পদত্যাগ দাবি করা হয়।
- পরিদর্শক দলের পক্ষে সুচেতা দে এবং ক্লিফটন ডি রোজারিও এবং সিপিআই(এমএল) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির পক্ষে কার্তিক পাল