স্বপ্নদীপের জীবন ব্যর্থ হতে দেব না আমরা। স্বপ্নদীপের ঝরে যাওয়া জীবন সবলে ধাক্কা দিক সমাজে গভীর র্যাগিং সংস্কৃতিকে।
স্বপ্নদীপের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই গড়ে তুলেছে সুবিচারের দাবিতে। র্যাগিং-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই লড়ছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী শিক্ষার্থী সংগঠনগুলি। এখন বিভিন্ন ধারার সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এই সংগ্রামে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও কর্মচারীদের সংগঠনও যোগ দিয়েছে। কিন্তু শাসক ও মিডিয়ার বড় অংশ এক নজিরবিহীন আক্রমণ নামিয়ে আনছে সামগ্রিকভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরেই। বাংলার সেরা ও সংগ্রামী ঐতিহ্যের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধ্বংস করে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিজেপি-আরএসএস।
বিভিন্ন দিক থেকে এই আক্রমণ নামছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ইতিমধ্যেই শুকিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে কেন্দ্র সরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্পগুলি অর্থাভাবে ধুঁকছে অথবা বন্ধ হয়ে গেছে, গবেষকদের বৃত্তি বন্ধ, প্রাপ্য টাকাও পাচ্ছেন না অনেকে। নতুন যন্ত্রপাতির অভাবে বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণাও থমকে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে লোকজন নিয়ে গিয়ে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন “উপড়ে ফেলব”, “তুলে ফেলে দেব” বলে। র্যাগিং সংস্কৃতিকে উপড়ে ফেলা বা তুলে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন না তিনি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও তার ঐতিহ্যকে নিকেশ করে দেওয়ার কথা বলছেন। এবং এই জিঘাংসাপূর্ণ ভাষণের কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর দেহরক্ষী দলকে লেলিয়ে দিলেন প্রতিবাদরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে। দেহরক্ষী সশস্ত্র কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান আর বিজেপি যুব মোর্চার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী মিলে কীরকম নৃশংসভাবে দুজন ছাত্র-ছাত্রীকে রাস্তায় ফেলে মারল সেই চিত্র আপনারা দেখেছেন! রাজ্যের বিরোধী দলনেতা যখন এরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তখন অন্যদিকে বিজেপি সাংসদ তথা আরএসএস নেতা দিলীপ ঘোষ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের “মাথা থেঁতো করে দেওয়া হবে” বলে প্রকাশ্য হুমকিসহ ঘোষণা দিলেন, “বিজেপি ক্ষমতায় এলে যাদবপুরে জয় শ্রীরাম শ্লোগান হবে”। এবং এগুলো নিছক মৌখিক আস্ফালন নয়, বাস্তবিকই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করতে সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওরা। বামপন্থী শিক্ষার্থী সংগঠনগুলিকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য আদালতে মামলা করেছেন শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের দুরভিসন্ধিমূলক পদক্ষেপগুলিও খবু প্রকট। এরকম একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর রাজ্য সরকারকে এড়িয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ আলাদা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়লেন, শোকস্তব্ধ জেইউ কমিউনিটির পাশে দাঁড়াতে নয়, বরং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের “কোর্ট”-এর বৈঠক ডাকলেন নিজের দরবারে এবং শেষে রাজ্য সরকারকে অন্ধকারের সম্পূর্ণ স্বৈরাচারীভাবে আরএসএসের শিক্ষক-নেতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ করলেন। আরএসএসের শিক্ষক সংগঠনের এই নেতাটি তাঁর ফেসবুক পোস্টে প্রায়শই এসসি-এসটি-ওবিসিদের সংরক্ষণের অধিকারকে ব্যঙ্গ করেন, মেয়েদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক ও নারী-বিদ্বেষী মন্তব্য করেন। আশার কথা হল, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজ্যপালের দ্বারা এরকম একতরফাভাবে উপাচার্য নিয়োগ করাকে সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে।
বিজেপি-আরএসএস নেতারা জেএনইউ-এর উদাহরণ টেনে প্রকাশ্যেই বলছেন, “জেএনইউ-কে যেভাবে ঠাণ্ডা করা হয়েছে সেভাবেই বুটের তলায় পিষে যাদবপুরকে ঠাণ্ডা করা হবে”। জেএনইউ-তে এই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের কদর্য রূপ দেশের মানুষ দেখেছে। মিথ্যা ভিডিও বানিয়ে ধারাবাহিক ব্যাপক কুৎসা, আরএসএস-এর গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে হস্টেলে প্রাণঘাতী হামলা, ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা ও বহিষ্কার এবং আরএসএস কর্মীকে উপাচার্য পদে নিয়োগের কথা আমরা সকলেই জানি। এখন এই আরএসএস উপাচার্য যথারীতি প্রাক্তন এবিভিপি নেতা তথা কুখ্যাত সঙ্ঘী হিসেবে পরিচিত অধ্যাপকদের বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাচ্ছেন। এরকমই এক নেতা সৌরভ শর্মা, ব্রহ্মপুত্র হস্টেলের ওয়ার্ডেন, তিনজন অ-ছাত্র বহিরাগতকে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে হস্টেলের রুম দিয়ে রেখেছিল, ধরা পড়ায় এদের একজন কাঁচি দিয়ে হামলা চালায় হস্টেলের গার্ডের ওপর। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিরোধে শেষ পর্যন্ত এই তিনজনকে বহিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। এবং এটা কোনো একক ঘটনা নয়। বয়েজ হস্টেলগুলিতে নতুন ছাত্রদের জায়গা না পাওয়ার যে সমস্যা জেএনইউ-তে সামনে এসেছে তার অন্যতম কারণ এবিভিপির বাহুবলীদের দ্বারা অনেক রুম দখল করে থাকা। বস্তুত কেবল জেএনইউ নয়, সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকেই বুটের তলায় ঠাণ্ডা রাখতে চায় বিজেপি-আরএসএস, তা সে নাজিব আহমেদের ক্যাম্পাস জেএনইউ হোক, রোহিত ভেমুলার ক্যাম্পাস এইচসিইউ হোক বা স্বপ্নদীপের ক্যাম্পাস যাদবপুর।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর এরকম সার্বিক আক্রমণের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রীর “আতঙ্কপুর” বক্তব্য অত্যন্ত দায়িত্বহীন সংকীর্ণ রাজনীতির পরিচায়ক। এবং তা সমাজের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। অত্যন্ত সংকীর্ণ অবস্থান নিয়ে তিনি “আগমার্কা মার্ক্সবাদী”-দের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়েছেন। সিপিএমের সাথে সাথে এক নিঃশ্বাসে তিনি কংগ্রেস ও বিজেপিকে যুক্ত করে দিলেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তাঁর এই বিষোদ্গার বিজেপি-আরএসএস-কে সুযোগ করে দিয়েছে দাঁতনখ খিচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। অন্যদিকে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি কলকাতায় এক ধরনের সামাজিক হিংসাও প্ররোচিত করেছে তাঁর বক্তব্য। ইতিমধ্যে প্রথম বর্ষের অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ঘরভাড়া দিতে অস্বীকার করা এবং রাস্তায় জেইউ স্টুডেন্টদের হেনস্থা করার খবরও সামনে এসেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পর্ধা এবং আনুগত্য-না-মানার মানসিকতাকে সব শাসকদল বরাবর ভয় পেয়ে এসেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বদেশী ধারায়, ব্রিটিশ সরকারের ওপর নির্ভরশীলতার ও আনুগত্যের আওতার বাইরে, ১৯০৬ সালে বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের মধ্যে দিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু। নকশালবাড়ি অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ও সাম্প্রতিক দিল্লী-ঘেরা কৃষক আন্দোলন পর্যন্ত কৃষক বিদ্রোহের প্রতিটি সন্ধিক্ষণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কৃষকের পাশে থেকেছে সর্বশক্তি নিয়ে। নব্বই দশক থেকে শুরু হওয়া শিক্ষার ব্যবসায়ীকরণ ও বেসরকারিকরণের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে এরাজ্যে প্রতিরোধের মূল ঘাঁটি থেকেছে যাদবপুর। সেই কারণেই এখানে অন্যান্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় টিউশন ফি সহ পড়াশোনার অন্যান্য খরচ অনেক অনেক কম, যে কারণে যাদবপুরই একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে সাধারণ পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসে, আসতে পারে। এরাজ্যে বিগত সরকারের শেষ দিকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল এই ক্যাম্পাসেরই ‘লাঠির মুখে গানের সুর’ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। ২০১২ সালে দিল্লীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্থিত নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার বার্তা ২০১৪ সালের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে, ‘প্যাডস এগেইনস্ট সেক্সিজম’ এবং ‘ভালোবাসার চুম্বন’ নিয়ে হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্টদের নীতি-পুলিশগিরির বিরুদ্ধে বারবার রাস্তায় নামে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৪ সালে মণিপুরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সাড়া জাগানো আন্দোলনের সময় হোক বা ইদানিং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ওপর হামলা-গণতান্ত্রিক প্রশ্নে যাদবপুর সর্বদাই সজাগ রেখেছে প্রতিরোধের মশাল। এনআরসির বিরুদ্ধে, সমান নাগরিকত্বের দাবিতে গড়ে ওঠা গণ আন্দোলনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে যাদবপুর। শুধু সংগঠনের সদস্যরা নয়, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিরোধে অংশ নিয়েছে। লকডাউনের পর্বে দুই বছর ধরে দক্ষিণ কোলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকার গরিব মানুষের মধ্যে প্রত্যহ রান্না করা খাবার পৌঁছে দিয়েছে, আম্ফান বিধ্বস্ত অঞ্চলে একটানা ও বিপুল ত্রাণকার্য সংগঠিত করেছে এবং এসবেরও বহু আগে থেকে এরাজ্যের বন্যাকবলিত এলাকাগুলিতে হোক বা উড়িষ্যার সুপার সাইক্লোন বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলিতেই হোক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বড় বড় টিম বারবার গেছে। একদিকে ছাত্রস্বার্থ ও গণতন্ত্রের প্রতিটি প্রশ্নে শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই চালানো, অন্যদিকে গরিব খেটে খাওয়া দেশবাসীর প্রতি ভালোবাসায় একাত্ম হওয়া — শাসকেরা এই ঐতিহ্যকে ভয় পায়। একে দমন করতে চায়।
এরকম জোরালো প্রগতিশীল ঐতিহ্যবাহী একটি প্রতিষ্ঠানে স্বপ্নদীপের হত্যার মতো এমন একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে যাওয়াটা দেখিয়ে দেয় যে সমাজের কত গভীরে র্যাগিং-সংস্কৃতি ঢুকে আছে। এরকম একটি প্রতিষ্ঠানের হস্টেলে র্যাগিং-এর ভয়াবহ ছবি সামনে এসেছে বলেই বোধহয় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে তা অধিক নাড়া দিয়েছে। আমরাও অত্যন্ত মর্মাহত বোধ করেছি। যেখানকার ছাত্র-রাজনীতিতে মূলত বিভিন্ন ধারার বামপন্থী আন্দোলন প্রাধান্যকারী জায়গায় আছে সেখানে কীভাবে ভেতরে ভেতরে এমন এক পশ্চাদপদ ও দমনমূলক চিন্তা-চেতনা কার্যকর থাকতে পারে! এই প্রশ্নে নিশ্চয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষার্থী সংগঠনসহ শিক্ষক ও গবেষক সংগঠনগুলির সার্বিক আত্মসমীক্ষা করা দরকার এবং সেরকম যে শুরুও হয়েছে তার বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোতে ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠনগুলির ভাগিদারী বাস্তবে খুবই কম। আগে যেটুকুছিল সেটুকুও কেড়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস দলটি সরকারে এসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্ট ও এক্সেকিউটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রী প্রতিনিধিত্ব তুলে দেওয়া হয়। ইউনিয়ন ইলেকশনটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে কোনোদিনই জায়গা পায়নি। কিন্তু প্রকাশ্যে না করতে পারলেও ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চগুলির মধ্যে ঢুকে থেকে তারা দক্ষিণপন্থী ক্ষমতাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার কাজ বরাবরই করে এসেছে। এই ধরনের অরাজনৈতিক মঞ্চগুলি মেইন হস্টেলে সম্পূর্ণ প্রাধান্যকারী জায়গায় আছে। কর্তৃপক্ষ এদের মদত দেয় যাতে মেইন হস্টেলে বামপন্থী সংগঠনগুলি প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। কর্তৃপক্ষ ও ‘অরাজনৈতিক’ জোটের আঁতাতের ফলে মেইন হস্টেল চত্বরে কোনো সংগঠনের একটা পোস্টার লাগানো বা প্রচারপত্র বিলি করা কার্যত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আজ বহু বছর ধরে। কেন্দ্রে বিজেপি-আরএসএসের ক্ষমতা দখলের পর থেকে সমগ্র সমাজে বিভিন্ন ধরনের বিভাজন, জাতবাদী সবর্ণ ঘৃণা ও অবজ্ঞা, পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, পৌরুষের আস্ফালন, বিদ্বেষ ও জিঘাংসা উত্তরোত্তর বেড়েছে যা এই ধরনের হত্যাগুলির মূল চালিকাশক্তি। রোহিত ভেমুলা, পায়েল তাড়বি, দর্শণ শোলাঙ্কি, ফয়জান আহমেদ — দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে এরকম অসংখ্য উদাহরণ সামনে আছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেইন হস্টেলের র্যাগিং-এর বিষয়ে কিছু জানত না এমনটা নয়। অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) বরাবর রাগিং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কখনো কখনো এই লড়াই সংঘাতপুর্ণও হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনই এই লড়াইয়ে পাশে এশে দাঁড়ায়নি। ২০১৫ সালে এই এ-ওয়ান-এ-টু ব্লকেই র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দুজন সিনিয়র আইসা কর্মী জাহাঙ্গীর হোসেইন ও পার্থ মালকে মেরে হষ্টেল থেকে বের করে দিয়েছিল রেগার জোট। এর বিরুদ্ধে আইসার আন্দোলন চলেছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এফআইআর করা হয়েছিল, মামলা এখনো চলছে। অন্যদিকে লিঙ্গসাম্যের প্রশ্নে, “জেণ্ডার জাস্ট ক্যাম্পাস”-এর দাবিতে আন্দোলনও আইসার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে আর্টস ফ্যাকাল্টির এক প্রথম বর্ষের ছাত্রীর যৌন হেনস্থার সুবিচারের দাবিতে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে, এবং পরবর্তীতে হোক কলরবের পরেও বেশ কিছু ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই লড়াই চলেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কখনই এ প্রশ্নে দায়বদ্ধতা ও বিচক্ষণতা দেখায়নি।
অন্যদিকে সমগ্র ক্যাম্পাসে যেখানে ন্যূনতম ৩৮০ জন নিরাপত্তা কর্মী লাগে, সেখানে এখন আছে মাত্র ৮০ জন। প্রতি দিন অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে একাংশ ছুটি নিলে মোটামুটি জনা ষাটেককে দিয়ে ৩৮০ জনের কাজ করিয়ে নিতে হয়। যা আসলে হয় না। হস্টেলে সুপারিন্টেনডেন্ট আগে কোনো শিক্ষককে করা হত। তাঁর একটা অথরিটি থাকত। কিন্তু এখন বাইরের প্রাইভেট সিকিউরিটি সংস্থা থেকে সুপুার নিয়োগ করা হয়।
এখন রাজ্যের শাসকদল সুযোগ খুঁজছে স্বপ্নদীপের মৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থীদের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নেওয়ার। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সেই সংকীর্ণ স্বার্থের প্রতিফলন। সেই লক্ষ্যেই বাইরে থেকে মোবিলাইজ করে আক্রমণ হানতে চাইছে তারা। এই হামলাকে প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু টিএমসির এই দখলদারির সংকীর্ণ পন্থার থেকেও অনেক গভীর ও মতাদর্শগত হামলা নামছে হিন্দুত্ববাদী দিক থেকে। মিডিয়ার বড় অংশ তার দোসর। শুভেন্দু অধিকারি, দিলীপ ঘোষ ও রাজ্যপালের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ কাঠামোগত হামলার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত মিডিয়ার এই অপপ্রচার। এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন একমাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েই র্যাগিংয়ের ও ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রতি ৪২ মিনিটে একজন ছাত্রের আত্মহননের ঘটনা ঘটে। গত পাঁচ বছরে শুধুমাত্র আইআইটি, এনআইটি ও আইআইএমএসে ছাত্র আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি যার মধ্যে অধিকাংশই র্যাগিং-জনিত কারণে। ইউজিসি-র তথ্য অনযুায়ী গত ৫ বছরে র্যাগিংয়ের কারণেই আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এমন পড়ুয়ার সংখ্যা ২৫ জন। গোটা দেশ জুড়ে গত ৯ বছর ধরে আরএসএস-বিজেপি যে ঘৃণার রাজনীতির চাষ করে চলেছে তার ফলেই এইভাবে ছাত্র মৃত্যুর ঘটনা বেড়ে চলেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলামেলা পরিবেশ ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে আক্রমণ করা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ছকে। মেয়েদের নির্ভয় বিচরণের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে মিডিয়া হাউসগুলি। কে ধূমপান করছে, কারা প্রেম করছে তা দেখাতে ওঁৎ পেতে আছে ওরা! যে বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে আদিবাসীদের গায়ে পেচ্ছাপ করে দিয়ে আনন্দ পায়, যারা গুজরাট, মুজফ্ফরনগর, দিল্লী, মণিপুর, হরিয়ানায় দাঙ্গা সংগঠিত করে দেশকে বিভাজিত করতে চায়, যারা সংগঠিত ভিড় হত্যাকে উৎসবের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, নৃশংস হত্যা ও অত্যাচারকে দৃশ্য-শ্রাব্য উপভোগের বিষয় বানিয়ে ফেলতে চাইছে, যারা নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি এনেছে জেএনইউ বা জেইউ-এর মতো সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শুকিয়ে মেরে আদানি-আম্বানিদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ব্যবসা সুগম করতে, তাদের কাছে যাদবপুরের প্রতিবাদ বিশেষ বাধাস্বরূপ। মিডিয়ার অপপ্রচারের মাধ্যমে ওরা জনমানসে যাদবপুরের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করে দিতে চায়। সম্পূর্ণ বিষয়টিকে নীতিপুলিশগিরির গ্রহণযোগ্যতার দিকে চালিত করতে চায়।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যেই এই প্রচারের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। র্যাগিং বন্ধের কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে সিসিটিভি (ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন) ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। প্রথমত এটা সকলেই বুঝবেন যে ক্যামেরা অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর শনাক্তকরণের কাজে পুলিশকে সাহায্য করতে পারে মাত্র। সিসি ক্যামেরা না থাকা সত্ত্বেও পুলিশ কিন্তু স্বপ্নদীপের হত্যাকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছে। চাইলে পুলিশ তা পারে, ক্যামেরার জন্য তা আটকায় না।
অন্যদিকে ফায়জান আহমেদের হত্যার মামলাটি দেখনু। গত বছর অক্টোবর মাসে খড়গপুর আইআইটির হস্টেলে এই উজ্জ্বল মেধাবী ছাত্রের মৃতদেহ পাওয়া যায়। আইআইটি কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে এটা আত্মহত্যা। পুলিশও চুপচাপ থেকে যায়। ফয়জানের গরিব মা আদালতে গেলে ঘটনার সাত মাস পর আদালতের রায়ে দ্বিতীয়বার পোস্টমর্টেম হলে ঘটনাটি হত্যা বলে চিহ্নিত হয়েছে। তাহলে নজরদারি ক্যামেরায় মোড়া আইআইটি ক্যাম্পাসেও ৠাগিং ও হত্যা সম্পূর্ণ চেপে যেতে পারে কর্তৃপক্ষ। মুম্বাই আইআইটির হস্টেলের বারো তলা থেকে ছুঁড়ে দর্শন শোলাঙ্কিকে মেরে ফেলারও কোনো বিচার বা শাস্তি এখনও হয়নি। বস্তুত বহু প্রতিষ্ঠানকে সিসি ক্যামেরায় মুড়ে দেওয়া সত্ত্বেও গত এক বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলিতে এই ধরনের প্রায় শ’খানেক মৃত্যু/হত্যার ঘটনা সামনে এসেছে। অন্যদিকে নজরদারি ক্যামেরায় ওঠা ব্যক্তিগত ছবি নিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের ব্ল্যাকমেইল করার সম্ভাবনাও প্রবল, নজিরও আছে। এবং বিজেপি-আরএসএসের প্রত্যক্ষ উসকানিতে ক্যামেরার সামনে নৃশংস অত্যাচার ও খুন করে সেই ভিডিও ভাইরাল করার দৃশ্য-শ্রাব্য উল্লাসের ধারা তো আমরা সকলেই দেখছি।
দ্বিতীয় যে পদক্ষেপটি নিয়েছে কর্তৃপক্ষ তা হল প্রথম বর্ষের বোর্ডারদের আলাদা হস্টেলে রাখা। আপৎকালীন সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে এটা সঠিক মনে হলেও এই হস্টেল বিভাজন নতুন সমস্যার জন্ম দিতে পারে। যাদবপুরে এখন প্রথম বর্ষকে কর্তৃপক্ষ সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাতে একধরনের স্থায়ী সন্দেহ ও বৈরিতার ভিত্তি তৈরি হতে পারে। শিবপুর আইআইইএসটি-তে যেমন এই হস্টেল বিভাজনের ফলে এমনকি এক বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে অন্য বর্ষের ছাত্রদের দলবদ্ধ সংঘাতের ঘটনাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
ক্যাম্পাসে বাইরের মানুষের ঢোকার ক্ষেত্রেও কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ। এটাও ক্যাম্পাসকে বিচ্ছিন্ন করে সমস্যা বাড়াবে। র্যাগিং সমস্যা ভেতরের বিষয়, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন মানুষের স্বাভাবিক আনোগোনা আটকানো তার সমাধান নয় মোটেই, যে মেইন হস্টেলে র্যাগিং চলে বলে প্রকাশ পেয়েছে সেটা যাদবপুর ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থিত। আমরা এর আগেও দেখেছি যখনই যাদবপুরে আন্দোলন হয়েছে, শাসকদল কর্তৃক তাকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের যাদবপুর ও প্রেসিডেন্সিতে ক্লাস ও সেমিনারে যোগ দেওয়ার যে রীতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, তাকে বন্ধ করতে চায় শাসক দল। এমনকি ক্যাম্পাসের ভিতরে তর্কবিতর্ক-মুক্ত চিন্তার যে পরিবেশ বর্তমান, ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ তার প্রতিবন্ধকস্বরূপ। র্যাগিং সংক্রান্ত মূল সমস্যার সমাধান না করে মিডিয়ার একাংশ দ্বারা ‘বহিরাগত’ প্রশ্নটাকে মূল ইস্যু করে তোলা স্বপ্নদীপের হত্যার বিচারের লড়াইকে দুর্বল করছে।
স্বপ্নদীপের হত্যার বিচার চেয়ে এবং র্যাগিং সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থী ছাত্রছাত্রী সংগঠনগুলিই লড়াই করছে। ১০ আগস্ট সকালে স্বপ্নদীপের মৃত্যুর খবর সামনে আসতেই আইসার দশম জাতীয় সম্মেলনের (কোলকাতার ইজেডসিসি সভাঘরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল) সর্বভারতীয় মঞ্চ থেকে স্বপ্নদীপের জন্য শোক প্রকাশ ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে বার্তা দেওয়া হয়। একদিন বাদেই আইসার নেতৃত্বে যাদবপুরে লাগাতার অবস্থান শুরু হয়। দু-একদিনের মধ্যেই ক্যাম্পাসে কর্মরত সাতটি শিক্ষার্থী সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন ও গবেষকদের সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়। স্বপ্নদীপ হত্যার সুবিচারের বিভিন্ন দিকের দাবি ছাড়াও তারা মূলত যে কাঠামোগত দাবিগুলি তুলে ধরেছে তা হল : ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটি পুনর্গঠন করতে হবে; লিঙ্গসাম্য বিষয়ক সংবেদনশীলতা জাগানো ও যৌন হয়রানি নিবারণে একই রকম সেল গঠন করতে হবে; এবং এই কমিটি বা সেলগুলির তত্ত্বাবধানে নিয়মিত কর্মশালার মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে এই পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে ধারাবাহিক সচেতনতা অভিযান ছাড়া র্যাগিং সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
ইতিমধ্যেই বহু শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ রাগিং বিরোধিতার সাথে সাথে যাদবপুরের ওপর সামগ্রিক আক্রমণের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন। এই কণ্ঠস্বরগুলিকে আরো বাড়িয়ে তোলা দরকার। যে যাদবপুর বারবার কৃষকের পাশে সর্বস্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে, আজ কৃষক সমাজকে জোরালোভাবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাদবপুরের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কৃষক ঘরের ছেলে-মেয়েরা যাতে পড়াশোনা করতে যেতে পারে সেজন্যও আজ তার পাশে থাকা জরুরি। বিভিন্ন সময়ে গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্ন হোক বা শিক্ষার অধিকারের প্রশ্ন, যাদবপুর শাসকের আক্রমণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ তাই সমস্ত ছাত্র সমাজ ও আপামর দায়িত্বশীল নাগরিকদের দায়িত্ব যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এই আক্রমণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
(আইসার পুস্তিকা থেকে)