সম্পাদকীয় : ত্রাসের রাজত্বে
reign-of-terror

বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গী ঘোষণা করে দিলেন, “দেশের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে”। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মীণাক্ষী লেখি সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের খোলাখুলি হুমকি দিয়ে বললেন, “চুপ করুন। নয়তো ইডি আপনার দোরে গিয়ে কড়া নাড়বে।” সাংবাদিক করণ থাপারের সাথে মেইতেই’র জঙ্গী সংগঠনের এক নেতা রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিল যে কুকি নিধনে তারা পুলিশ ও সরকারের সাহায্য পেয়েছে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর জবরদখল উচ্ছেদের নামে নুহের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি, হোটেল, দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারই প্রভাবে কয়েকদিনের মাথায় নুহ প্রশাসন ৩৫০টি ঝুপড়ি এবং ৫০টির মতো স্থায়ী পাকা নির্মাণ ভেঙে দেয়। এরমধ্যে ডজনখানেক ওষুধের দোকানও রয়েছে। মণিপুরের পর হরিয়ানায় হিংসার আগুন ছড়ালো। এবার গোয়াতেও তা ছড়ানোর তোড়জোড় চলছে বলে সতর্কতা জারি করেছে কিছু ক্রিশ্চান সংগঠন। ২০২৪’র আগে আরও কতই না জনপদ শূন্য হবে, কত হাজার মানুষ ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় প্রাণ হারাবে কে জানে।

গোটা দেশজুড়ে কায়েম করা হয়েছে সন্ত্রাস, ভয়ভীতির এক গা ছমছমে দমবন্ধ করা পরিবেশ। প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কাজে নামানো হয়েছে। খুব সম্প্রতি সংসদীয় কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে, সরকার যাদের যাদের পদক দিয়ে সম্মানিত করেন, এরপর পদক গ্রহণ করার আগে পদকপ্রাপকদের এই মর্মে মুছলেখা দিতে হবে যে ভবিষ্যতে তাঁরা কখনই প্রতিবাদ জানানোর অজুহাতে তা ফেরত দেবেন না। শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পদকের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্বশাশিত সংস্থাগুলো যে সমস্ত পুরস্কারে সম্মানিত করে, যেমন সাহিত্য আকাডেমি, তার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।

এটাও দেখা গেল, বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার দেশের সীমান্তরেখায় নানা ফাঁক ফোকর ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঘটে যাওয়া গুরুতর অবহেলার নানা দিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন কঠোর ভাবে নিজেদের নাম গোপন রাখার শর্তে। এমনকি, এইমস’এর মতো উৎকর্ষ চিকিৎসা ক্ষেত্র ও গবেষণা কেন্দ্রে গবেষকদের জন্য ছ’বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। দেশের অনেক নামজাদা মেডিকাল গবেষণা কেন্দ্রের প্রখ্যাত গবেষকরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের কাছে মুখ খুললেও নিজেদের নাম গোপন রাখেন এই আশঙ্কায় যে কেন্দ্রীয় সরকার জানতে পারলে তাঁরা বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তারজন্য প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে।

এখানেই থেমে নেই মোদী সরকার। এবার উচ্চপদস্থ আমলাদের শাসানোর, তাঁদের দাবিয়ে রাখার নতুন এক রাস্তা বার করল কেন্দ্রীয় সরকার। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধন করল ‘অল ইন্ডিয়া সার্ভিসেস (ডেথ কাম রিটায়ারমেন্ট বেনেফিট) রুলস্, ১৯৫৮। আইএএস-আইপিএস-আইএফএস — প্রশাসনের এই তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারদের বশে রাখতে রুলস বা বিধিতে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, অবসরকালীন জীবনে ‘অপরাধমূলক কার্যকলাপ’, ‘গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গ’র মতো ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ঠ আমলা-পুলিশ অফিসারদের পেনশন আটকে যাবে, অবসরকালীন সুযোগ সুবিধাতে কোপ পড়বে। এতদিন পর্যন্ত নিয়ম ছিল, রাজ্যে রাজ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত আমলাদের বিরুদ্ধে উপরে উল্লিখিত অভিযোগ যদি রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রের কাছে করে, তবে তাঁদের পেনশন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় কোপ পরতো। কিন্তু নয়া সংশোধনী আসার পর রাজ্য সরকারের সুপারিশের দরকার পড়বে না। ওই সমস্ত অভিযোগ আদালত কর্তৃক প্রমাণিত না হলেও স্রেফ কেন্দ্রের ‘প্রাইমা ফেসি’ ‘মনে হওয়া’র ভিত্তিতেই কোপ পড়বে পেনশন ও অন্যান্য অবসরকালীন পেনশনে। এই দমনমূলক সংশোধনীর বিরুদ্ধে ৯৫ জন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ অফিসার খোলাখুলি এক গণপ্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে, অবিলম্বে এই সংশোধনী যেন ফেরত নেওয়া হয়। তাঁরা মনে করেন, অবসরকালীন জীবনে জনহিতের স্বার্থে এই সমস্ত অফিসারদের অবস্থান গ্রহণের অধিকার রয়েছে।

ইতিমধ্যেই গোটা ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছে বিরাট এক জেলখানায়। বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষক অধ্যাপক, ছাত্র, শিল্পী সাহিত্যিক, সাংবাদিক — সমাজের সর্বস্তরকে ত্রাসের চাদরে মূড়ে ফেলেছে মোদীর ফ্যাসিস্ট রাজ।

কিন্তু ইতিহাস কি এই ত্রাসের রাজত্বের সামনে থমকে দাঁড়াবে? নাকি আসমুদ্রহিমাচল আবার জেগে উঠে এই অন্ধ তমসাবৃত প্রহরকে খান খান করে নতুন জীবনের জয়গানে মেতে উঠবে?

খণ্ড-30
সংখ্যা-27