সুপ্রিম কোর্ট ঘৃণা ভাষণ না দেওয়ার শর্তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে দিল্লীতে মিছিলের অনুমতি দিয়েছিল। ঘৃণা ভাষণ রুখতে কেন্দ্রকে কমিটি গড়ার নির্দেশও দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু কী সুপ্রিম কোর্ট, কী পুলিশ প্রশাসন কারুরই তোয়াক্কা না করে ঘৃণা ভাষণের পথে, মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানোর পথেই অবিচল রইল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। রবিবার ১৩ আগস্ট হরিয়ানার নুহ সংলগ্ন পালিওয়ালের পোন্ডোরি গ্রামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো আয়োজিত ‘সর্ব জাতীয় মহাপঞ্চায়েত’ থেকে হিন্দুদের জন্য বন্দুকের লাইসেন্সের দাবি ওঠানো হল, সমর্থন জানানো হল হরিয়ানার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টরের ‘বুলডোজার অভিযানকে’। প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই নুহতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রিজমন্ডল জলাভিষেক যাত্রাকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হলে মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর বুলডোজার নামিয়ে মুসলিমদের শত শত ঝুপড়ি, বাড়ি, দোকানপাট ধূলিসাৎ করেন। রবিবার পালিওয়ালের পোন্ডোরি গ্রামের মহাপঞ্চায়েতে এক বক্তা মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ওরা আমাদের দিকে আঙুল তুললে আমরা হাতই কেটে ফেলব”। হরিয়ানা গো রক্ষক দলের প্রধান আজাদ শাস্ত্রী বলেন, “প্রত্যেকটা হিন্দু গ্রামে ১০০টা আগ্নেয়াস্ত্র চাই।… অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে, এফআইআর নিয়ে ভয় পেলে চলবে না।” নুহর বিধায়ক আফতাব আহমদ এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণের বিরোধিতা করে বলেন, “ওরা যা বলেছে সেগুলো শুধু ঘৃণা ভাষণই নয়, বরং দাঙ্গা উস্কিয়ে তোলারই শামিল।… এই ধরনের জমায়েতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি আমরা জানাচ্ছি।” উল্লেখ্য যে, এই সমস্ত ঘৃণা ভাষণ পুলিশের উপস্থিতিতেই ব্যক্ত হলেও পুলিশ কাউকেই গ্রেপ্তার করেনি।
কেন্দ্রে এবং রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার থাকার জন্যই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ও তাদের নেতৃবৃন্দ পুলিশ প্রশাসন এবং এমনকি সুপ্রিম কোর্টকেও উপেক্ষা করার ঔদ্ধত্য দেখাতে পেরেছিল। গত ৩১ জুলাইয়ের জলাভিষেক যাত্রা থেকে শুরু করে ১০ আগস্টের মহাপঞ্চায়েত পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদীদের সমস্ত উদ্যোগের লক্ষ্যই যে ছিল সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটানো তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। এই ধরনের এক পরিমণ্ডলের বিদ্যমানতাই এই মুহূর্তে বিজেপির পরম কাঙ্খিত। ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আর কয়েক মাসের মধ্যেই, এবং সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ যথার্থ রূপ পেলে বিজেপির ভোটের ভাঁড়ারও উপছে পরবে।
তবে, পরিস্থিতি সব সময় অভিলাষীর কামনার অনুসারী হয় না, এবং পরিস্থিতি বিকাশ লাভ করে তার নিজস্ব গতিক ও শর্ত মোতাবেক। হরিয়ানায় শাসক বিজেপি সরকার ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যদি সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণের প্রয়াসী হয়ে থাকে তবে এক ভিন্ন স্বর, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিরোধী ও মুসলিম সম্প্রীতির এক জোরালো স্বরও অনুরণিত হল হরিয়ানার বেশ কিছু জেলায় যা জানালো যে, হরিয়ানার গোটা রাজ্য বিজেপির অভিলষিত পথের অনুগামী হতে একেবারেই রাজি নয়। সেই সমস্ত জেলাতে শুধু হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আকাঙ্খাই মূর্ত হলো না, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলের মতো মুসলিম-বিদ্বেষী ও হিংসাশ্রয়ী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার দাবিও সোচ্চারে ঘোষিত হল।
মনোহরলাল খট্টরের বিজেপি সরকারের বুলডোজার অভিযান যখন চলছে, তার মধ্যেই গত ৫ আগস্ট হরিয়ানার জিন্দে অনুষ্ঠিত হল এক ‘সর্ব ধর্ম সম্মেলন’। এই সম্মেলনে অংশ নেন খাপ পঞ্চায়েতের প্রধানরা, কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। মাজরা, উঝানা, নারাওয়ানা, থাওয়া, চাহাল, মোর, দাহারান প্রভৃতি খাপের প্রধান ও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতারা এবং অখিল ভারতীয় কিষাণ সভার নেতৃবৃন্দ এই সম্মেলনে অংশ নেন। এই সম্মেলন থেকে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য স্থাপনের আকাঙ্খা যেমন ব্যক্ত হয়, তেমনই আরএসএস, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা সম্পর্কিত প্রস্তাবও পাশ হয়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ফিরোজ খান বলেন, অগ্নিদগ্ধ হওয়া থেকে হরিয়ানাকে বাঁচিয়েছে খাপগুলো, কেননা, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের এজেন্ডাকে তারা সমস্ত স্থানে সক্রিয় হতে দেয়নি।
এর চারদিন পর হিসার জেলার বাস গ্রামে ৯ আগস্ট ভারতীয় কিষাণ মজদুর ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগঠিত হয় এক মহাপঞ্চায়েত। হিন্দু, মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০০ কৃষক মহাপঞ্চায়েতে অংশ নেন। মহাপঞ্চায়েতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বকে শক্তিশালী করে তোলার আহ্বান জানানো হয়। মহাপঞ্চায়েতে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয় — “সরকারকে ঘটনার (সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার) নিরপেক্ষ তদন্ত করতে ও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। যারা সমাজমাধ্যমে প্ররোচনামূলক বক্তব্য ও ভিডিও পোস্ট করে সমাজে দাঙ্গা উস্কিয়ে তুলেছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে ও তাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।”
মহাপঞ্চায়েত থেকে মনু মানেসার ও বিট্টু বজরঙ্গির গ্রেপ্তারির দাবি জোরালোভাবেই ওঠে। এই দুজন বজরং দলের নেতা এবং দুজনেই ৩১ জুলাই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলের আগে মুসলিম-বিরোধী উস্কানিমূলক ভিডিও সমাজমাধ্যমে তোলেন, প্ররোচনামূলক বক্তব্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে এমন উত্তেজনাময় করে তোলেন যার ফলে দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। আর মনু মানেসর জুনাইড ও নাসির নামে দুই মুসলিমকে গাড়ির মধ্যে পুড়িয়ে মারায় মূল অভিযুক্ত। আরএসএসের দুই সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দল যেহেতু সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির সুপরিকল্পিত প্রয়াস সমানে চালিয়ে যাচ্ছে, হরিয়ানার সমস্ত গ্রামেই দুই সংগঠনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার দাবি মহাপঞ্চায়েত থেকে প্রবলভাবেই ওঠে। মহাপঞ্চায়েতে অংশগ্রহণকারী সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতা সুরেশ কোঠ ঘোষণা করেন, “জাত ও ধর্মের ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির জন্য হরিয়ানার মাটিকে আমরা ব্যবহৃত হতে দেব না।”
মুসলিম বিদ্বেষের ওপর ভিত্তি করে সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটাতে গেলে বিজেপি-আরএসএসের একটা সামাজিক ভিত্তির প্রয়োজন হয়। এই সামাজিক ভিত্তি অনেক স্থানেই তাদের থাকলেও কিছু পুরনো সামাজিক ভিত্তি আবার তাদের কাছ থেকে সরে এসেছে। হরিয়ানার নুহ ও গুরুগ্রামে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গার পাশাপাশি মুসলমানদের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের যে আকাঙ্খা ব্যক্ত হল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরং দলকে নিষিদ্ধ করার যে আওয়াজ উঠল, তাতে কিন্তু সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছে জাট সম্প্রদায়। এই জাট সম্প্রদায়ই কিন্তু একটা সময়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষকে ছড়ানো ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটনের সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ২০১৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে ২০১৩’র মুজাফ্ফরনগরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অমিত শাহর পরিকল্পনায় জাট সম্প্রদায়কেই বিজেপি ব্যবহার করেছিল। আজ কিন্তু জাট সম্প্রদায়ই উত্তর ভারতে বিজেপি-বিরোধী প্রতিরোধের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে। মোদী সরকারের তৈরি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, হরিয়ানার মহিলা কুস্তিগিরদের যৌননিগ্ৰহ বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বর্জনের স্পৃহা, যে কারণই জাটদের বিজেপি বিরোধিতায় সক্রিয় করুক না কেন তা আজ এক অবিসংবাদী বাস্তবতা এবং মোদী-শাহদের মতো অতি ক্ষমতাধর নেতাদের পক্ষেও তাদের পুরনো সামাজিক ভিত্তির পুনরুদ্ধার সম্ভব হচ্ছে না। এই সামাজিক ভিত্তি থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ও বিদ্বেষের অবসানের যে আওয়াজ উঠেছে তা আরও সম্প্রসারিত হয়ে হরিয়ানায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ডাবল ইঞ্জিন সরকারের অপসারণের পথ প্রশস্ত করুক।
- জয়ন্ত মিত্র