যে গুজরাট মডেলকে সম্বল করে মোদী শুরু করেছিলেন তাঁর স্বপ্নের উড়ান, গোটা কর্পোরেট জগত যাকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মহাকাশে মহিমামন্ডিত করে বিকাশের প্রকৃত রাস্তা হিসাবে ফানুস উড়িয়েছিল, সেই গুজরাট সংস্করণ নিয়েই এবার বড়সড় প্রশ্ন তুলে দিল প্রধানমন্ত্রীরই বড় পেয়ারের নীতি আয়োগ। এই জুলাইয়ে নীতি আয়োগ কর্তৃক প্রকাশিত জাতীয় বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক (ন্যাশনাল মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইন্ডেক্স) অনুসারে গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে ৪৪.৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ২৮.৯৭ শতাংশ মানুষ তীব্র অপুষ্টির শিকার!
নীতি আয়োগের রিপোর্ট দেখিয়েছে, গুজরাটের তুলনায় পশ্চাদপদ রাজ্য ছত্তিসগড়-মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থান-উত্তরপ্রদেশ এই ক্ষেত্রে গুজরাট থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে। নীতি আয়োগের রিপোর্ট আরও দেখিয়েছে, বয়সের তুলনায় কম উচ্চতা সম্পন্ন শিশুদের মধ্যে গুজরাট চার নম্বরে রয়েছে জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা বা ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে অনুযায়ী। বয়সের তুলনায় ৩৯ শতাংশ শিশুর ওজন কম। সমীক্ষা আরও দেখিয়েছে, খুবই ক্ষীণদেহ ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যার দিক থেকে গুজরাট রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে, যথাক্রমে ২৫.১ ও ৩৯.৭ শতাংশ হারে। শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক মাপকাঠিতে গুজরাট যে কত নীচে নেমেছে, তা এই পরিসংখ্যানই দেখিয়ে দেয়। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমেদাবাদের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক বলেছেন, “অপুষ্টি গুজরাটে এক উদ্বেগজনক ক্ষেত্র। গুজরাট ও পশ্চিমবাংলাকে পাশাপাশি তুলনা করলে দেখা যাবে, ২০১৬ সালে পশ্চিমবাংলার ৩৩.৬ শতাংশ পরিবার এবং গুজরাটের ৪১.৩৭ শতাংশ পরিবারের মধ্যে অন্তত একজন সদস্য অপুষ্টিতে আক্রান্ত ছিলেন। ২০২১ পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে তা কমে ২৭.৩ শতাংশ হলেও গুজরাটে তা কমে দাঁড়ায় ৩৮.৯ শতাংশ।”
আবাসের ক্ষেত্রেও গুজরাটের রেকর্ড ভালো নয়। নীতি আয়োগ জানিয়েছে, গুজরাটে ২৩.৩ শতাংশ জনসংখ্যার কোনো আবাস নেই। গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে অবস্থা আরও শোচনীয়। গুজরাটের গ্রামাঞ্চলে ৩৫.৫ শতাংশ মানুষের কোনো বাসস্থানই নেই, যা হরিয়ানা-পাঞ্জাব-কেরল ও তামিলনাড়ু থেকে অনেকটাই বেশি। বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক থেকে এটা স্পষ্ট যে, গুজরাটে আর্থিক বৃদ্ধি খুবই অসম ও বিক্ষিপ্ত। হাতে গোনা কয়েকটি শহর বা শহর সংলগ্ন অঞ্চলে (যেমন, আমেদাবাদ-সুরাট-ভাদোদরা-রাজকোট) তার সুফল লক্ষ করা গেলেও, গ্রামাঞ্চল সেখান থেকে বহু যোজন দূরে।
এই গুজরাট মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে বারবার অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিস্তর বিতর্ক হয়। এ’নিয়ে নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন ও ভগবতীর বিতর্ক প্রণিধানযোগ্য। ২০০২-০৩ থেকে ২০১১-১২ মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের আমলে গুজরাটে শিল্প বিকাশের হাত ধরে যে আর্থিক বিকাশ হয় তা নিয়ে তখন থেকেই বিতর্ক দানা বাঁধে। গুজরাটের আর্থিক বৃদ্ধি কখনই সামাজিক বৃদ্ধির সূচককে প্রতিফলিত করতে পারেনি। কর্পোরেট বান্ধব শিল্পায়নের নগ্ন নব্য উদারবাদী পথরেখা মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে শিল্প সহায়ক পরিকাঠামোর ঝাঁ চকচকে উন্নয়ন ঘটায়। ক্রোনি কর্পোরেটদের ঢালাও রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির প্রশ্নে তদানিন্তন রাজ্য সরকার দিলদরিয়া হলেও সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে ব্যয় বরাদ্দে ব্যাপক কাটছাঁট ছিল এই বহু ঢক্কানিনাদিত মডেলের নির্মম পরিণতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবেশ-কর্মসংস্থান — এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ক্ষেত্র নিদারুণ অবহেলার শিকার হয়। গুজরাট শিক্ষায় ২ শতাংশ ব্যয় করে, আর তারজন্য গুজরাটের শ্রমশক্তির ৪৫ শতাংশই অশিক্ষিত বা মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। গুজরাট সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করে মাত্র ০.৮ শতাংশ। সেখানে প্রায় ৯৪ শতাংশ শ্রমিক ইনফর্মাল, যাদের মজুরি ভারতের অন্যান্য এগিয়ে থাকা রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, সামাজিক সুরক্ষা সেখানে নাম-কা-ওয়াস্তে।
সংখ্যালঘু নিকেষের শাসন প্রণালী, ত্রাসের শাসন, মুষ্ঠিমেয় কর্পোরেটদের ঢালাও আর্থিক উপঢৌকন, সামাজিক ক্ষেত্রগুলোকে অবজ্ঞা অবহেলা, সীমাহীন বেকারত্ব ও দারিদ্র — এই হল গুজরাট মডেলের আসল চেহারা।
আজ ক্ষমতার অলিন্দ থেকেই গুজরাট মডেলের কঙ্কালসার চেহারার কুৎসিত মুখ উঁকি দিয়ে উঠল।