মণিপুর থেকে হরিয়ানা ও সেখান থেকে চলন্ত ট্রেন — এই ঘৃণা ভারতকে শেষ করে দিচ্ছে, একে রুখে দিন
hate-which-is-destroying-india

তিন মাস হয়ে গেল মণিপুর জ্বলছে। তিন মাস ধরে নিরন্তর হিংসা ষাট হাজারের ওপর মানুষকে নিজভূমে গৃহছাড়া করেছে। এই হিংসা হামলার টুকরো টাকরা কিছু ভিডিও আন্তর্জাতিক মহলের নজরে এসেছে। কিন্তু দুনিয়া চষে বেরানো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এখনও সময় হয়নি মণিপুরে যাওয়ার। সংসদে অথবা সামাজিক গণমাধ‍্যমে তিনি কিছু বলতেও অস্বীকার করেছেন। এবং একমাত্র যে ক্ষেত্রে তিনি মণিপুরের বীভৎস ভিড় হিংসা ও যৌন হামলার ভাইরাল ভিডিওর কথা উল্লেখ করেছেন সেখানেও তিনি একে অবিজেপি রাজ‍্যে ঘটা নারীবিরোধী অপরাধের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাথে একাসনে বসিয়েছেন। এবং এইভাবে তিনি একটি সংখ‍্যালঘু গোষ্ঠির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় তদারকিতে চলা হামলার প্রেক্ষাপট থেকে ঘটনাটিকে ছেঁকে আলাদা করে নিয়েছেন। সংসদের চলতি বাদল অধিবেশনের একদম প্রথম দিন থেকেই সরকার মণিপুর প্রসঙ্গে বিতর্ক এড়িয়ে গেছে। বিতর্কে বাধ‍্য করতে বিরোধী পক্ষ শেষ পর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। কিন্তু তবু সরকার বিতর্ক পিছিয়ে দিয়ে তুলে রেখেছে অধিবেশনের অন্তিম লগ্নের জন‍্য।

প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার যখন মণিপুর প্রসঙ্গে সংসদে কোনোরকম আলোচনাই করতে দিচ্ছে না, তখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বাধ‍্য করল বিচার বিভাগের সম্মুখীন হতে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে সূচীমুখ প্রশ্ন উত্থাপিত হল ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের ব‍্যর্থতা প্রসঙ্গে। আর মোদী সরকারের এড়িয়ে যাওয়া এবং দায়সারা ও নিষ্ঠুর উত্তরগুলি মণিপুর সরকার এবং সেই সাথে মোদী সরকারেরও, যে সরকার ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করে ওই রাজ‍্যের বহুবিধ প্রশাসনিক কাজকর্ম নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, সমগ্র দুষ্কর্মে যুক্ত থাকার সত‍্যটা প্রকাশ করে দিয়েছে। ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মণিপুর মামলা শুনানির পর একে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া বলে অভিহিত করেছে। নরসংহারের লক্ষ‍্যে রাষ্ট্রীয় মদতে চলা সন্ত্রাস অভিযানের শিকার সংখ‍্যালঘু কুকি সম্প্রদায়, এবং সংঘ পরিবারের ছড়ানো সুপরিচিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘অপরাধপ্রবণ’ ইত‍্যাদি তকমা কাজে লাগিয়ে গণহত‍্যা, উচ্ছেদ ও যৌন অত‍্যাচারকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে — এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সুপ্রিম কোর্ট কেমন সুবিচার দেয় সেটাই এখন দেখার।

অতীব গুরুত্বপূর্ণ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত হিংসার এই সঞ্চারপথ আবারো একবার দেশের অন‍্যান‍্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যেতে পারে। ইউপি ও হরিয়ানা এবং জয়পুর-মুম্বাই সুপারফাস্ট চলন্ত ট্রেনে গুলি চালনা — তিনটি আলাদা আলাদা রিপোর্ট এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার একটা বাস্তব ছবি হাজির করছে। হরিয়ানার মেওয়াট অঞ্চলকে বিজেপি অনেকদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সহিংসতার আরেক গবেষণাগারে পর্যবসিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। নুহ’র মুসলিম প্রধান এলাকাগুলির মধ‍্যে দিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ উসকানিমূলক মিছিল নিয়ে যায়। এই মিছিলের বিদ্বেষমূলক অভিঘাত আরো বাড়িয়ে দেয় বজরং দলের পলাতক গুণ্ডা মনু মানেসরের পোস্ট করা ভিডিও, যে মনু এ’বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নাসির ও জুনেইদ হত‍্যায় মূল অভিযুক্ত। মিছিলটি চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে তিনজনের প্রাণ নেয় যাদের মধ‍্যে দুজন হোমগার্ড। সেদিনই গভীর রাতে গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৭’র অঞ্জুমান জামা মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের বরাদ্দ করা জমিতে স্থাপিত এটাই একমাত্র মসজিদ যেখানে শহরের মুসলমানরা নমাজ পড়তে পারেন। মসজিদের ১৯ বছর বয়সী সহকারী ইমামকে নৃশংসভাবে হত‍্যা করা হয়। অতীতেও এই মসজিদে বারবার হামলা চালানো হয়েছে।

ইউপি’র বরেলিতেও একই ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু পুলিশের সতর্ক উপস্থিতি ও সময়োচিত হস্তক্ষেপ তা আটকে দেয়। কানোয়ারিয়াদের মিছিল অননুমোদিত রাস্তায় নিয়ে যাওয়াকে আটকানো হয়। কিন্তু এই কাজে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই এখন প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুজন পুলিশ কর্মীকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে এবং পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট প্রভাকর চৌধুরিকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ইনি তাঁর চাকুরি জীবনে এই ২১তম বার শাস্তিমুলক পদ পাওয়ার বা বদলির শিকার হলেন। মোদীর ‘নয়া ভারতে’ যোগীর ‘বুলডোজার রাজ’এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কর্তব‍্য পালন করলে পুলিশ অফিসারকে এই মূল‍্যই চোকাতে হয়। বাস্তবিকই, মোদী-শাহর গুজরাট মডেল থেকে শুরু করে আদিত‍্যনাথের ইউপি আর বিরেন সিংহের মণিপুর — ভিড় হিংসার ঘটনা এবং দুষ্কর্মের বিভিন্ন স্তরে রাষ্ট্রের যুক্ত হয়ে পড়াটা এখন বিজেপি শাসনের পরিচিতিমূলক বৈশিষ্ট‍্য হয়ে উঠেছে।

জয়পুর-মুম্বাই ট্রেনে গুলি চালানোর ঘটনাটি অবশ‍্য ভারতকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রার টেররিস্ট হামলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন আরপিএফ জওয়ান একটি চলন্ত ট্রেনের আলাদা আলাদা কোচে তার ঊর্ধ্বতন বসকে এবং তিনজন মুসলিম যাত্রীকে গুলি করে হত‍্যা করল, সে তার শিকারদের পাকিস্তানের এজেন্ট বলে দোষারোপ করল এবং যাত্রীদের বলল যে ভারতে থাকতে হলে আর ভোট দিতে হলে মোদী ও যোগীকে সমর্থন করতে হবে। হাড় হিম করা এই ভিডিও আমাদের এক নতুন বাস্তবতায় এনে ফেলল যেখানে মূলধারার মিডিয়ার, বিশেষত গোদি মিডিয়া চ্যানেলগুলির নিরন্তর ঘৃণা প্রচার এবং সংঘ বাহিনীর আইটি সেলের সুব‍্যবস্থিত বিদ্বেষপূর্ণ মিথ‍্যার জালের অভিঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যা এযাবৎকাল অভাবনীয় ছিল। টিভি চ‍্যানেলগুলির ঘৃণা প্রচারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও গোদি মিডিয়া বিপুল মাত্রায় ঘৃণার বিষ ছড়িয়েই চলেছে। জয়পুর-মুম্বাই ট্রেনের গুলি চালনার ঘটনাকে সরকার ও গোদি মিডিয়া সাথে সাথেই এক মানসিক রোগির ঘটানো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে খারিজ করে দিয়েছে। সমস্ত নজর কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে হরিয়ানার হিংসায়, যেখানে মুসলমানদের দেখানো হচ্ছে ‘পাথর ছোঁড়া’ দাঙ্গাবাজ হিসেবে। একটা চ‍্যানেল এমনকি এর ‘স্থায়ী উপশম’ চেয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে যা নাৎসি জার্মানির ‘চূড়ান্ত সমাধান’এর কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে ষাট লক্ষ ইহুদি, কয়েক লক্ষ রোমা জনতা, কমিউনিস্ট ও অন‍্যান‍্যদের হত‍্যা করা হয়েছিল।

পাঁচ বছর আগে ২০১৯’র নির্বাচনের দৌড়ে মোদী সরকার ও সংঘ-বিজেপি বাহিনীর ফ‍্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে জনপ্রিয় ক্ষোভের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়েছিল। বিজেপি তার শক্তিশালী ভিত্তি রাজস্থান, মধ‍্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিল। আর সেই সময়ই ঘটেছিল পুলোয়ামা। চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ান এক সন্ত্রাসী হামলায় মারা গিয়েছিলেন, আর নির্বাচনী আবহাওয়া নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল। আজ দেশ জানে যে কীভাবে একের পর এক ফাঁকফোকর তৈরি করে সেদিন পুলোয়ামা ঘটতে দেওয়া হয়েছিল, এবং কীভাবে প্রধানমন্ত্রী নিজে জম্মু কাশ্মীরের গভর্নর সত‍্যপাল মালিককে সরকারী ব‍্যর্থতার কথা চেপে যেতে বলেছিলেন। এখন সামনে বেশ কিছু নির্বাচন আসন্ন। মানুষের মোহভঙ্গ আরো গভীরতর হতে দেখা যাচ্ছে, এবং এই চলমান ঘৃণা ও মিথ‍্যার, ভয় ও ধ্বংসের জাল থেকে মুক্তির আকাঙ্খা বাস্তবের মাটিতে আরও বেশি বেশি দৃশ‍্যমান হয়ে উঠছে। পরিবর্তনের এই জনপ্রিয় আকাঙ্খাকে বিপথগামী করতে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হিংসার তীব্রতর অভিযান চালানোর ছক কষা হচ্ছে যাতে সামাজিক মেরুকরণ তীক্ষ্ণতর করে অস্থিরতার আবহ তৈরি করা যায়। মণিপুর থেকে হরিয়ানা — বিপদঘণ্টা খুবই তীব্র ও স্পষ্টভাবে বাজছে। আমরা ভারতের জনগণ নিশ্চয় এই ফাঁদে পা দেব না। আমরা বদলে দেওয়ার সংগ্রাম জোরালো করব আর বিজয় অর্জন করব।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন
(১-৭ আগস্ট ২০২৩ এমএল আপডেট সম্পাদকীয়)

খণ্ড-30
সংখ্যা-27