ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লালকেল্লা থেকে তার দশম স্বাধীনতা দিবসের ভাষণকে আরেকটি নির্বাচনী বক্তৃতা করে তুললেন, বেপরোয়া ঔদ্ধত্যে! কিন্তু তার সেই চর্বিতচর্বণ, সেই দুর্নীতি আর রাজবংশের রাজনীতি নিয়ে জীর্ণ বাগজাল, শুধু তার ভয়কেই প্রকাশ করে ফেলল! তার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ফুঁসে ওঠা ক্রোধ আর রাজনৈতিক একতার ক্রম উদ্ভাসে তার বেড়ে চলা ভয়কে! তিনি ঘোষণা করলেন পরবর্তী নির্বাচনের পর তিনি সেই সব প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন যেগুলোর শিলান্যাস তিনি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন। এমনকি তার সেই দাম্ভিক দাবিও তার সেই ভয়কে অজান্তেই ফাঁস করে ফেলল যে প্রতিদিন তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! ‘আমরা, ভারতের জনগণ’এর কাছে এর (এই ভাষণের) একটাই অর্থ — আগামী দিনগুলো সংসদীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি ও ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ সামাজিক বুনন-কাঠামোর ওপর আরও নিলর্জ্জ, আরও উদ্ধত আক্রমণের সাক্ষী হতে চলেছে।
হামলা তীব্রতর হতে চলেছে। তার লক্ষণ একেবারে স্পষ্ট। সংসদের গোটা বাদল অধিবেশন সাক্ষী থাকলো মোদী-রাজের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি চরম তাচ্ছিল্য এবং ভারতকে ক্রমশ এক ‘আইনসম্মত স্বৈরতন্ত্রের’ অধীনে অন্ধকার বন্দিদশার দিকে ঠেলে দেওয়ার। প্রধানমন্ত্রীর আচার-আচরণ ক্রমশ হয়ে উঠছে এক মহামহিম সম্রাটের মতো, তিনি সংসদকে মনে করেন তার ‘রাজ দরবার’ — যেখানে বিজেপি সাংসদরা ‘মোদী-মোদী’ জয়ধ্বনিতে তাকে অভিবাদন জানিয়ে থাকেন। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী সংসদভবন এবং তার কাছাকাছি থেকেও সংসদকে এড়িয়ে যাচ্ছেন, তা এক পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীকে সংসদে আনার জন্য বিরোধীদের যে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে হল — এটাকে সংসদীয় গণতন্ত্রের এক অভূতপূর্ব সংকট হিসেবেই দেখতে হবে।
‘প্রতীকীয়তা’ ছেড়ে, আমাদের অবশ্যই সংসদে পেশ করা ও পাস হওয়া বিলগুলোর সারমর্মে নজর দিতে হবে হবে। দিল্লী বিল, যেটি রাজ্যসভায় পাস হতে পারল শুধুমাত্র দু’টি আঞ্চলিক দল, ওড়িশার বিজেডি আর অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি’র সরকারের পক্ষ নেওয়ায় — যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর এক নৃশংস হামলা। যে আঞ্চলিক দলগুলো এই বিলটিকে এক বিশেষ দিল্লী-নির্দিষ্ট বিল মনে করে সমর্থন করেছিল, তারা ঠিক একই ভুলটা করল যেটা আপ করেছিল ২০১৯’র আগস্টে। আপ যখন জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার প্রত্যাহারের বিষয়টিকে একটি ‘বিশেষ ব্যাপার’ মনে করে সমর্থন করেছিল, তার জানা ছিলনা যে সেই আঘাতটাই তারজন্যে ফিরছে চার বছর বাদে!
এই অধিবেশনে শুধু দিল্লী বিল পাস করিয়ে যে সুপ্রিমকোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়কে লঙ্ঘন করা হয়েছে, তা নয়। এই বছর মার্চে, সুপ্রিম কোর্ট মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনের অন্যান্য সদস্যদের নিয়োগ সম্পর্কে একটি আদেশ দিয়েছিল। নির্বাচন কমিশনের স্বশাসন ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে, যা আবার গোটা নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতার একটি পূর্বশর্ত, সুপ্রিম কোর্ট তিন সদস্যের এক নির্বাচন কমিটি গড়ার আদেশ দিয়েছিল যার মধ্যে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলনেতা বা বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতি। মোদী সরকার ঐ কমিটিতে ভারতের প্রধান বিচারপতির জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীকে রাখার জন্য একটি বিল এনেছে! অর্থাৎ, নির্বাচন কমিশনের মতো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক সংস্থার নিয়োগে কার্যনির্বাহী প্রশাসনের হাতেই থাকবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা!
দেশের আইনী কাঠামোর ওপর ভয়ঙ্করতম আঘাতটা এল বাদল অধিবেশনের শেষ দিনে। সেদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচলিত ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (১৮৬০), ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড (১৯৭৪) এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট (১৮৭২)’কে প্রতিস্থাপিত করার জন্যে তিনটি বিল আনলেন যেগুলোকে সরকারি পছন্দে বলা যেতে পারে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা এবং ভারতীয় সাক্ষ্য বিল। মাত্র কয়েকমাস আগে স্বরাষ্ট্র বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছিলেন আইনী সংস্কারের বিষয়টি দেখার জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি তার সুপারিশ চূড়ান্ত করার আগে সমস্ত অংশীদারদের সঙ্গে ব্যাপক স্তরে আলাপ-আলোচনা চালাবে আর সেইজন্যেই গোটা প্রক্রিয়াটা বেশ সময় নেবে। সেই অংশীদারদের মধ্যে থাকবেন সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল এবং লেফটেন্যান্ট গভর্নরবৃন্দ, ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্টগুলির প্রধান বিচারপতি, সমস্ত বার কাউন্সিল, বিশ্ববিদ্যালয় ও ল’কলেজগুলি, সংসদের সমস্ত সদস্য। অথচ সেই প্রতিশ্রুত বিশদ ‘আলাপ-আলোচনা’র কোন পাবলিক রেকর্ড ছাড়াই সরকার সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর দাবিসহ ঝটতি নির্বিচার ও বিপর্যয়কর সংস্কারের প্রস্তাব রেখে তিনটি বিলই পেশ করেছে।
সরকার আমাদের বিশ্বাস করাতে চায় যে নতুন কোডগুলি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার ও মানসিকতায় ইতি টানবে এবং দণ্ডবিধানে ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু একটু নিবিড় চোখে বিলগুলোর অনুবিধি খুঁটিয়ে দেখলেই ঐ দাবি নস্যাৎ হয়ে যায় এবং পরিষ্কার বোঝা যায় আসল ভাবনাটি হল নাগরিকদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকারকে দুর্বল করার জন্য রাষ্ট্রকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় বলীয়ান করা, এবং সরকারের নীতিসমূহ নিয়ে প্রশ্ন ও বিরোধিতা করার ও পরিবর্তন এবং ন্যায়ের জন্য লড়াই করার অধিকার, যা গণতন্ত্রের প্রাণশক্তিস্বরূপ — তাকে নিঃশেষ করা। যেমন শুধু দু’টো উদাহরণ দেওয়া যাক — পুলিশ হেফাজতের মেয়াদ এখন প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ১৫ দিন থেকে অনকটা বেড়ে ৬০ থেকে ৯০ দিন হবে। আর ‘রাজদ্রোহ’ (সিডিশন) শব্দটা বাদ দেওয়া হয়েছে কার্যত, মতবিরোধের প্রতিটি ধরণকে ‘সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ’ বলে অপরাধীকরণের সম্ভাব্যতা আরও বাড়িয়ে তোলার জন্য।
কার্যনির্বাহী প্রশাসনের হাতে সমস্ত ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবন চলছে। এর দ্বারা সরকার প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সাংবিধানিক সংস্থাগুলির স্বশাসনকে তথা কার্যনির্বাহী প্রশাসন, আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যকে দুর্বল করে চলেছে। এখন ঐ প্রস্তাবিত বিলগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকারের সেই বিশেষ চেতনা ও বোধকে কেড়ে নেওয়া হবে। কথান্তরে, সংঘ বাহিনীর লালিত হিন্দুরাষ্ট্র শুধু মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পর্যবসিত করবে না, স্বাধীন নাগরিকবৃন্দের ধারণাটিরও মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেবে। আর সংবিধানগতভাবে বলীয়ান নাগরিকত্বকে ঔপনিবেশিক যুগের প্রজার অস্তিত্বে পরিণত করবে। আর এ’সবই হবে ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, পরম্পরাকে শেষ করার নামে! এই জন্যই বাবাসাহেব আম্বেদকর ‘রাজনীতিতে ভক্তি’কে একনায়কতন্ত্রে পৌঁছানোর নিশ্চিততম পথ বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি ‘হিন্দু রাজ’কে দেশের ভয়ঙ্করতম বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করে ভারতে তার বাস্তব হয়ে ওঠার বিপদ সম্পর্কেও সতর্ক করেছিলেন।
নরেন্দ্র মোদী মসৃণ সাবলীলতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভীষণ মুখর এবং নিজের সরকারকে ‘ঘোটালা-মুক্ত সরকার’ বলে থাকেন। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা ক্যাগ রিপোর্ট পেয়ে দেখছি, কার্যত তার সরকারের প্রতিটি দপ্তর ‘ঘোটালা’য় জড়িত! দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের খরচ বেড়ে গেছে ১৪ গুণ — কিলোমিটার পিছু অনুমোদিত অনুমিত ব্যয় ১৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫০ কোটি টাকা! প্রচুর ঢাক-ঢোল পেটানো ‘আয়ুষ্মান ভারতের’ দুর্নীতি-জর্জরিত চেহারাটাও উন্মোচিত হয়েছে এই রিপোর্টে। একটিই মোবাইল নম্বর ‘9999999999’এ ৭,৫০,০০০ জনের বিপুল সংখ্যক উপকারভোগীর নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে; আর মৃত রোগী ও ভুয়ো হাসপাতালের নামে বিশাল পরিমাণ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বার্ধক্য ভাতার তহবিলের টাকা খরচ করা হয়েছে মোদী সরকারের প্রচার-বিজ্ঞাপনে। অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পে আবারও বেনিয়ম সামনে এসেছে, স্বদেশ দর্শন তীর্থযাত্রা প্রকল্পের নামে কন্ট্রাক্টররা প্রচুর মুনাফা লুটেছে।
আমরা মোদী সরকারের দশম বর্ষে রয়েছি। এই দশ বছরে শাসন প্রক্রিয়ার সমস্ত ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। সেই ক্ষতি ভারতের এতটাই সর্বনাশ করেছে, ভারতকে এতটাই পিছিয়ে দিয়েছে যে তা যেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্বপ্নের প্রতি, সংবিধানের নীতির প্রতি এবং ১৪০ কোটি ভারতবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারের প্রতি এক বিরাট বিদ্রুপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মণিপুর থেকে হরিয়ানা — আইনের শাসন রাষ্ট্র পোষিত জাতি-নিধন অভিযান ও নিশানাবদ্ধ বুলডোজিং’এর রাস্তা করে দিয়েছে। মোদী-রাজের বেলাগাম ধারাবাহিক বিপর্যয়গুলোকে রুখে দিতে ও ভারতকে ফ্যাসিবাদী ধ্বংস থেকে মুক্ত করতে আজ ভারতকে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শক্তি ও অনুপ্রেরণা পেতে হবে!
- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২১ আগস্ট ২০২৩