গত ৩১ জুলাই সোমবার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হরিয়ানার নুহ জেলায় ‘ব্রিজ মন্ডল জলাভিষেক যাত্রা’ সংগঠিত করে। নুহ জেলা মুসলিম অধ্যুষিত। মিছিল সশস্ত্র ছিল, মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের হাতে লাঠি, তরোয়াল ছিল, কারো কারো হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও দেখা যায়। মিছিল থেকে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বিদ্বেষ ও প্ররোচনামূলক উক্তি ভেসে আসছিল, এবং মিছিল গুরুগ্রাম-অলওয়ার জাতীয় সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় মুসলিম জনগণ মিছিলকে আটকান, মিছিল লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়া হয়, মিছিল থেকেও পাল্টা ইটবৃষ্টি হতে থাকে। ঘটনার বিকাশ দেখে মনে হয়, সংঘর্ষের এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েই ছিল এবং দুই গোষ্ঠীই পরস্পরের মোকাবিলায় নিজেদের সজ্জিত করেছিল।
তবে, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ নুহতেই আটকে রইল না, ছড়িয়ে পড়ল। নুহ থেকে মাত্র ৪০ কিমি দূরে গুরুগ্রামের বাদশাহপুরে ২০০ জনের মতো হিন্দুত্ববাদী জনতার একটা দল মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলোতে আক্রমণ হানল, দোকানগুলোতে লুটপাট হল, বিরিয়ানি ও মাংসের দোকানগুলোতে ভাঙচুরের সঙ্গে আগুন লাগানোও হল, একের পর এক গাড়ি অগ্নিদগ্ধ হল। সোমবার গভীর রাতে হিংস্র হিন্দুত্ববাদী জনতা গাড়ি-বাড়িতে অগ্নিসংযোগের সাথে গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৭’র আঞ্জুমান জামা মসজিদে আক্রমণ হানে, আগুন লাগায় এবং ছোরা চালিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে মসজিদের ১৯ বছরের ইমাম মৌলানা সাদকে। অথচ এই ইমামের মধ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল না এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর এই আকাঙ্খা — হে আল্লা, এমন ভারত দাও যেখানে হিন্দু-মুসলমান যেন এক থালা থেকে রুটি ভাগ করে খেতে পারে! নুহ, গুরুগ্রাম ও সংলগ্ন এলাকার এই সাম্প্রদায়িক হিংসায় এখনও পর্যন্ত ছ’জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ৭০’র জনেরও বেশি, পুলিশের ৮টা গাড়ি আগুনে পুড়েছে, আরও অন্তত ১২০টা গাড়ি অগ্নিদগ্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ১১৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হরিয়ানা সরকার বলেছে, এলাকায় ‘তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা’ বিরাজ করছে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুরুগ্রাম ও নুহতে ৩০ কোম্পানি আধা সেনা পাঠানো হয়েছে, নুহতে আপাতত ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে, অশান্ত এলাকাগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কয়েকদিন বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
যদি মনে করা হয় যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিল নুহতে ঢোকা ও মিছিল থেকে প্ররোচনামূলক উক্তির জন্যই মুসলিমরা মিছিলে ইট-পাথর ছুড়তে শুরু করল এবং তার থেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সূচনা ঘটল, তবে তারমধ্যে পরিস্থিতির যথার্থ বিশ্লেষণ মিলবে না। এই সাম্প্রদায়িক বিরোধকে উস্কিয়ে তোলার জন্য কিছু সময় ধরেই পরিস্থিতিতে উত্তেজনা জোগানো হচ্ছিল। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো ও বিজেপির তরফে যেমন মুসলিম-বিরোধী প্রচার ছড়ানো হচ্ছিল, তারই পাশাপাশি কয়েকটা প্ররোচনামূলক ভিডিও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। এই উস্কানিমূলক ভিডিওগুলোর দুটো ছিল মনু মানেসরের ও একটা বিট্টু বজরঙ্গির। বজরং দলের নেতা স্বঘোষিত গোরক্ষক মনু মানেসর মূল অভিযুক্ত নাসির ও জুনেদ নামে দুই মুসলিমের হত্যায় যাদের আগুনে পোড়া দগ্ধ দেহ ফেব্রুয়ারি মাসে পাওয়া যায় রাজস্থানের ভিওয়ানি জেলায়। এই ভিডিওগুলো যে যথেষ্ট প্ররোচনা ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে উত্তেজনাপ্রবণ করে তুলেছিল সে কথা এখন হরিয়ানার বিজেপি সরকারই স্বীকার করছে। হরিয়ানার বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজ বলেছেন, “হিংসায় সোশ্যাল মিডিয়ার ভূমিকা রয়েছে। ভিডিও কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল তা দেখতে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে।” মনু মানেসর জানিয়েছিলেন তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিলে অংশ নেবেন, আর সেই সংবাদই পরিস্থিতিকে তপ্ত করে তোলার সাথে মুসলিম জনগণকে ক্ষিপ্তও করে তোলে। হত্যায় অভিযুক্ত হলেও সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সবাই তাকে দেখতে পেলেও পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না, আর হরিয়ানার বিজেপি সরকার বলছে মনু মানেসরের কোনও সন্ধান তাদের কাছে নেই! মেওয়াট বিকাশ সভা নামে সামাজিক সংগঠনের জনৈক সদস্য বলেছেন, “এটা ছিল গুরুগ্রাম সংলগ্ন মুসলিম অধ্যুষিত নুহ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা উস্কিয়ে তোলার পরিকল্পিত প্রয়াস। প্ররোচনা সৃষ্টিকারী ভিডিওগুলো প্রচারিত হতে থাকলেও পুলিশ যাত্রাকে মেওয়াটে (নুহ যে অঞ্চলে পড়ে) ঢুকতে দেয়।” গুরুগ্রামের বিজেপি সাংসদ ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাও ইন্দারজিৎ সিংও প্রশ্ন তুলেছেন — বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের লাঠি, তরোয়াল নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কেন। নুহর বিধায়ক চৌধরী আফতাব বলেছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিল অশান্তি সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনোহরলাল খট্টর প্রশাসনকে মিছিলে অনুমতি না দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। এ’সত্ত্বেও অনুমতি শুধু দেওয়াই হয়নি, সাড়ম্বরে তার সূচনা ঘটান বিজেপির জেলা সভাপতি গারগি কাক্কার। গুরুগ্রামের বাদশাহপুরে ১৪৪ ধারা বলবৎ হলেও ২০০ জনের একটা দল মোটরবাইক ও এসইউভিতে এসে মূল বাজারে, বিরিয়ানি ও মাংসের দোকানগুলোতে আগুন লাগায়। আর এই হামলার সময় ঘটনাস্থলের ত্রিসীমানায় পুলিশকে দেখা যায়নি। অতএব, সাম্প্রদায়িক বিরোধের পরিকল্পিত প্রয়াস ও তাতে প্রশাসনিক মদতকে বুঝতে পারাটা কঠিন নয়।
হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক বিরোধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয় কিন্তু একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা দুটি ঘটনার উল্লেখ আলোচ্য প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হবেনা বলেই মনে হয়। প্রথমটি জয়পুর-মুম্বাই সেন্ট্রাল সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে পুলিশ অফিসার টিকা রাম মীনা-সহ চারজনকে আরপিএফ কনস্টেবল চেতন সিং’এর হত্যার ঘটনা। এই পুলিশ অফিসার বাদে আর যে তিন যাত্রীকে চেতন সিং হত্যা করে তারা সবাই মুসলিম। উত্তরপ্রদেশের হাথরসের বাসিন্দা চেতন সিং সেদিন তার রাইফেল থেকে ১২ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল এবং এক মুসলিম যাত্রীকে বন্দুকের ডগায় দুটো কামরা পার করে প্যান্ট্রিকারে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। তার গুলির শিকার এক নিহত ব্যক্তিকে সামনে রেখে চেতন সিং সেদিন সবার সামনে বলেছিল, “হিন্দুস্থানে থাকতে হলে, ভোট দিতে হলে মোদী আর যোগীকে ভোট দিতে হবে। আর আপনাদের ঠাকরেকে।” মোদী-যোগী জমানায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং মেরুকরণের মাত্রা কি ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, চেতন সিং সংঘটিত হত্যাকাণ্ড তার এক অকাট্য নিদর্শন।
দ্বিতীয় ঘটনাটির কেন্দ্রে রয়েছেন নীতির প্রতি অবিচল থাকা উত্তরপ্রদেশের আইপিএস অফিসার প্রভাকর চৌধুরী। তিনি উত্তরপ্রদেশের বারেলির এসএসপি’র দায়িত্বে ছিলেন। রবিবার ৩০ জুলাই বারেলিতে হিন্দুত্ববাদী কাঁওয়ারিয়ারা তাদের মিছিল মুসলিম এলাকা দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ডিজে বাজানোর অনুমতি চেয়েছিল। সেই পথে একটা মসজিদও ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনায় প্রভাকর চৌধুরি মিছিল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে যাওয়ার ও ডিজে বাজানোর অনুমতি দেননি। কাঁওয়ারিয়ারা ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার জন্য জেরাজেরি করতে থাকলে লাঠি চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। প্রভাকর চৌধুরী এইভাবে নীতির প্রতি অবিচল থাকলেন, বিজেপি নেতাদের চাপের কাছে নত হলেন না। কিন্তু সেদিন রাতেই তাঁর বদলির নির্দেশ এল, যে বদলি তাঁর ১৩ বছরের কর্মজীবনে হলো ২৩তম। (তাঁর বদলির সাথে অন্য দুই পুলিশ কর্মীকেও অবশ্য সাসপেন্ড করা হয়।) যোগী আদিত্যনাথ তাঁকে ‘এনকাউন্টার’ অনুগত অফিসারে পরিণত করতে পারেননি। এই ঘটনা যদি এক অফিসারের মেরুদণ্ডর জোর ও নীতিনিষ্ঠতাকে প্রতীয়মান করে, তবে তা মোদী-যোগী জমানায় শাসকের সংখ্যাগুরুবাদী স্বৈরিতারও জানান দেয়। প্রভাকর চৌধুরী তাঁদের নির্দেশের অন্যথা ঘটানোয় বিজেপি নেতারা অবলীলায় তাঁকে প্রতিকূল জায়গায় ঠেলে দিয়ে শাস্তি দিলেন।
দুটি ঘটনাই সংখ্যাগুরুবাদী জাতীয়তাবাদের প্রকৃতিকে নির্দেশিত করছে। একটি যদি ঐ জাতীয়তাবাদের প্রভাবে ঘটা মর্মান্তিক পরিণতিকে দেখায়, অন্যটি তবে ঐ জাতীয়তাবাদে নিহিত নীতির নির্বাসন ও সংখ্যাগুরুবাদী স্বেচ্ছাচারিতারই নির্দেশক। ব্যক্তি বিজেপির বশ্য না হলেও প্রতিষ্ঠান তাদের কব্জাতেই থাকে এবং তাদের সাম্প্রদায়িক স্বার্থের অভিমুখেই সেই প্রতিষ্ঠান চালিত হয়। সংখ্যাগুরুবাদীদের সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায়েই আজ রাষ্ট্র চালিত হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের বিশ্লেষক সুশান্ত সিং একটি ট্যুইটে যথার্থই বলেছেন, “মেওয়াটে যা ঘটছে তা মণিপুরে ঘটা ঘটনাবলীরই আর একটা প্রকাশ। রাষ্ট্র ভেঙে পড়েনি, তা দুষ্কর্মের মদদদাতা হয়ে উঠেছে। এটাই মণিপুর নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন নীরবতার ব্যাখ্যা দেয়।” হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ স্পষ্টতই ছিল রাষ্ট্রের একা নীল নকশার অভিপ্রেত রূপায়ণ, এবং এর পুনরাবৃত্তিকে প্রতিহত করতে হলে রাষ্ট্রটাকেই পাল্টাতে হবে, তার বর্তমান শাসকদেরই সর্বাগ্রে অপসারিত করতে হবে।