অর্থহীন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান
meaninglessly-irrelevant

২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের গলায় আরও মজবুত বকলশ লাগাতে ১০ আগস্ট ২০২৩ রাজ্যসভায় মোদী সরকার এক বিল পেশ করল। এই বিলের মাধ্যমে মূখ্য নির্বাচন কমিশনার সহ নির্বাচন কমিশনারদের মনোনীত করতে যে নির্বাচক কমিটি ছিল, এই বিলে ওই কমিটি থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে সরিয়ে সেখানে আনা হচ্ছে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। এরফলে, এরপর থেকে নির্বাচন কমিশনের প্যানেলগুলোতে সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের লাগাম আরও শক্ত হল।

এই বছরের মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশ দেয় যার মর্মার্থ ছিল যতদিন পর্যন্ত নতুন কোন আইন সংসদে গৃহীত না হচ্ছে, ততদিন তিন সদস্যের এক প্যানেল দেশের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন কমিশনগুলো মনোনীত করবে। এই প্যানেলে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও সংসদে প্রধান বিরোধী দলের নেতা। কার্যনির্বাহী সংস্থা যাতে নির্বাচন কমিশনগুলোকে তার আজ্ঞাবহ এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে না পারে, তারই এক রক্ষাকবচ হিসাবে এই ধরনের এক ব্যবস্থার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত। নতুন বিলে প্রধান বিচারপতির স্থানে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত কোনো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে রাখার প্রস্তাব রয়েছে।

কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের মধ্যে প্রথম শূন্যপদ তৈরি হবে ২০২৪’র ফেব্রুয়ারি মাসে, যেদিন নির্বাচন কমিশনার অনুপ পান্ডে অবসর নেবেন। আগামী বছরেই ঘোষিত হবে ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচনের দিনপঞ্জি। তাই এখন থেকে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে নিজের পোষ মানা এক সংস্থায় পরিণত করতে মোদী সরকারের এই পদক্ষেপ ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের প্রধান বিচারপতি কেএম জোসেফ (এখন অবসরপ্রাপ্ত) নির্বাচক কমিটির মধ্যে প্রধান বিচারপতিকে যুক্ত করেন। এটা তিনি করেন কেন্দ্রীয় সরকারেরই গঠিত ১৯৯০এ তদানিন্তন আইনমন্ত্রী দীনেশ গোস্বামীর কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে, যার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনী সংস্কারের লক্ষ্যে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বশাসিত এক স্বাধীন সংস্থায় পরিণত করে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত করা। সেই সময় গোস্বামী কমিটি তার রিপোর্টে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে একাধিক সদস্যবিশিষ্ঠ এক সংস্থা হিসাবে সুপারিশ করে এবং জানায় যে মূখ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ করবে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ও বিরোধী দলের প্রধানের সাথে পরামর্শক্রমে (আর, যদি ঘটনাচক্রে বিরোধী দলের প্রধান না থাকেন তবে লোকসভায় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা)। গোস্বামী কমিটির সুপারিশগুলি ভারতের আইন কমিশন গ্রহণ করে ১২ মার্চ ২০১৫ সালে তার ২৫৫তম রিপোর্টে। আইন কমিশন সেই সুপারিশগুলো গ্রহণ করার সময় বলে, “ভারতের নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলার অপরিসীম গুরুত্ব এবং কার্যনির্বাহী সংস্থার নাক গলানো থেকে রক্ষা করতে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের প্রক্রিয়া পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমেই হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।” গোস্বামী কমিটির সুপারিশকে আইন কমিশন কিছুটা পরিমার্জন করে জানায় যে মূখ্য নির্বাচন কমিশনার সহ সমস্ত নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ হবে তিন সদস্য বিশিষ্ঠ এক কলেজিয়াম বা নির্বাচক কমিটি মারফত, যেখানে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিরোধী দলের নেতা এবং প্রধান বিচারপতি।

মোদী আজ কেন্দ্রীয় সরকারের আইন কমিশনের মোতাবেক শীর্ষ আদালতের রায়কেই পুরোপুরি উল্টে দিল। সাংবিধানিক সংস্থার প্রতি এই অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য ও অবমাননা স্বাধীন ভারতবর্ষে এর আগে এত নগ্নভাবে আর কখনও হয়নি।

ভারতের সর্বোচ্চ আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আগামী বছরের গুরুত্বপূর্ণ লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নিজের আজ্ঞাবহ কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন তৈরি করতে তাই মোদী সরকার বদ্ধপরিকর।

রাজদ্রোহ বা সিডিশন আইনকে বাতিল করে আনা হচ্ছে আরও মারাত্মক রাষ্ট্রদ্রোহ আইন

১১ আগস্ট লোকসভার শেষ দিনে অনাস্থা প্রস্তাব সংক্রান্ত বিতর্ক শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পেশ করলেন নতুন তিনটি বিল — ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। বিরোধীশূন্য লোকসভায় ওই বিলগুলো পেশ করেই তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করেন অমিত শাহ, যা অচিরেই ধ্বনিভোটে পাশ হয়ে যায়। আগামী দিনে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ঘুরে ওই বিল সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হলেই তবে আইন হবে। অমিত শাহ জানালেন, সংসদে ওই বিলটি পাশ হলেই নতুন ও বিচারাধীন মামলা ওই আইনের আওতায় চলে আসবে। নতুন বিল এতদিনকার ইন্ডিয়ান পেনাল কোড (ভারতীয় দন্ডবিধি) ১৮৬০, ক্রিমিনাল প্রসিজিয়র কোড (ফৌজদারি দন্ডবিধি) ১৮৯৮, ১৯৭৩ এবং এভিডেন্স অ্যাক্ট — এই ব্রিটিশ আমলের শতাব্দী প্রাচীন আইনগুলোকে বদলে, “ভারতীয় দণ্ডবিধি থেকে ব্রিটিশ প্রভাব ও দাসত্বের মানসিকতা দূর করতেই নতুন করে ভারতীয় দন্ডবিধি ঢেলে সাজানোর” পরিকল্পনা নিয়েছে মোদী সরকার। আর, এটাও ঘোষণা করলেন যে, আইপিসি’র ১২৪এ ধারায় রাজদ্রোহ আইন বাতিল করা হবে। কিন্তু, সেটা বাতিল করে আনা হচ্ছে ১৫০ ধারাঃ যাতে বলা হয়েছে, “যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা জেনেশুনে, শব্দ, চিহ্ন কিংবা দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা অথবা মৌখিক বা লিখিতভাবে কিংবা বৈদ্যুতিন যোগাযোগের মাধ্যমে বা আর্থিক উপায় ব্যবহার করে বা অন্য কোনও ভাবে উত্তেজিত করে বা উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করে, বিচ্ছিন্নতা বা সশস্ত্র বিদ্রোহ বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বা বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের অনুভূতিকে উৎসাহিত করে বা সংঘটিত করে, বা ভারতের সার্বভৌমত্ব বা একতা ও অখন্ডতাকে বিপন্ন করে অথবা এই ধরনের কোনো কাজ করে বা সংঘঠিত করে, তা হলে যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সাত বছর পর্যন্ত কারাদন্ডে দন্ডিত হবে এবং জরিমানাও দিতে হবে।”

গতবছর ১১ মে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর নির্দেশ দেয় যেন এরপর থেকে সিডিশন আইনে কাউকে যেন আর অভিযুক্ত করা না হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তাই এই আইন বাতিল করা ছাড়া আর অন্য কোনো রাস্তা ছিল না।

প্রস্তাবিত নতুন আইনে মহিলাদের উপর হওয়া যে কোনও অপরাধের ক্ষেত্রে কড়া শাস্তির প্রস্তাব রয়েছে। আঠারো বছরের কম বয়সি মহিলাদের ধর্ষণের অভিযোগে মৃত্যুদন্ড বা আজীবন কারাবাসের সাজার কথা বলা হয়েছে আইনে। একই সুপারিশ করা হয়েছে গণপিটুনির ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এই ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠছে যে স্বঘোষিত গোরক্ষকরা গোরক্ষার নাম করে বা উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা লাভ জিহাদের আওয়াজ তুলে যদি কাউকে পিটিয়ে মারে তা হলে শাস্তি হবে কিনা এ’ব্যাপারে রীতিমতো সন্দেহ রয়েছে। বর্তমান আইনেই এই সমস্ত অপরাধ বা অপরাধীদের শাস্তির বিধান থাকলেও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে তারা যে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ায় তা গোটা দেশের মানুষ দেখেছে। দেখেছে, কিভাবে এই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সুপারিশেই বিলকিস বানোর উপর গণধর্ষণে অভিযুক্ত দাগি অপরাধীদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হল, যৌন হেনস্থায় অভিযুক্ত ব্রিজভূষনের এখনও কোনো শাস্তি হল না।

বোঝাই যাচ্ছে, অত্যন্ত কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রশাসন নিজের মর্জিমাফিক বিরোধীদলের বা সরকারের সমালোচক যে কাউকে এর বিস্তৃত ধারায় কারারুদ্ধ করার সমস্ত রাস্তাই খোলা রাখল। রাজদ্রোহ আইনকে বাতিল করার পর নতুন মোড়কে আরও দানবীয় আইন আনতে চলেছে মোদী সরকার আগামী দিনে।

(ক্রমশ)

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-28