আজকের দেশব্রতী : ৩১ আগস্ট ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
deshabrati31-08-23many-more-deathsmore-deaths

টিভি’তে তখন সবার চোখ। আবেগে, আনন্দে, উত্তেজনায় সবাই থরথর। চন্দ্রযান-৩’র সফল অবতরণ ঘটছে চন্দ্রপৃষ্ঠে!

আরেকটা খবরও তখন টিভির পর্দায় সরে সরে যাচ্ছিল। মালদা’র ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু — ভিনরাজ্যের কর্মস্থলে।

দু’দিন ধরে কফিনবন্দি দেহগুলো পৌঁছালো। কফিন থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের কাছে তারা শুধু ‘লাশ’। গরিবের ‘লাশের’ আবার মর্যাদা! আইজল হাসপাতালের মর্গ থেকে বিনা রাসায়নিকে সেই দেহ যখন ৩৬ ঘণ্টার দীর্ঘ রাস্তা উজিয়ে মালদা মেডিকেল কলেজে পৌঁছালো শনাক্তকরণের জন্য, তখন দুর্গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। তরতাজা যে সন্তানদের হয়তো অনেক আশা নিয়ে ভিনরাজ্যের পথে বিদায় জানিয়েছিলেন, অন্তিম বিদায়ের ক্ষণে সেই প্রিয়তম সন্তানদের প্রাণভরে শেষ আদর করার সুযোগ কি পেলেন হতভাগ্য বাবা-মা!

মালদা’র রতুয়া-২ ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়ার (১৫ জন মৃত), গাজোল (১ জন মৃত), ইংলিশবাজারের সাট্টারি (৫ জন মৃত), কালিয়াচক (১ জন মৃত) থেকে ওরা মিজোরামে গিয়েছিল কাজে। ১৮ থেকে ৩৫’র এই কিশোর ও যুবকরা সকলেই দরিদ্র পরিবারের। উচ্চমাধ্যমিকের মেধাবী পড়ুয়াও ছিল। সংসারের প্রয়োজনে পড়া ছেড়ে কাজে যোগ দিতে হয়েছে। কেউ সদ্যবিবাহিত। ২৩ জনেরই মৃত্যু হয়েছে ২৩ আগস্ট মিজোরামের সাইরাং’এ একটি রেলসেতু তৈরির সময় এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায়। ২২টি দেহ ফিরেছে, কিন্তু সেনাউল হকের মৃতদেহ এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভৈরবী- সাইরাং নিউ রেলওয়ে লাইন প্রজেক্টের ১৩০টি রেলসেতুর মধ্যে অন্যতম এই ব্রিজটি প্রায় দু’বছর ধরে তৈরি হচ্ছিল। দায়িত্বে আছে ‘ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেশপ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’। বাংলার দুই ইঞ্জিনিয়ার সহ আহত আরও তিনজন হাসপাতালে। নিখোঁজ আছেন কয়েকজন। কেন এই দুর্ঘটনা, তার উচ্চপর্যায়ের তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। সাট্টারির সারথি সরকারের বুকভাঙা কান্না — পরিবারে পুরুষ বলতে আর কেউ নেই! স্বামী, ছেলে, জামাই, নাতি কেউ বেঁচে নেই। সেই কান্না কি প্রশাসনকে এতটুকু নড়াতে পারব?

ঐ দুর্ঘটনার পরের দিনের খবর — মুর্শিদাবাদের বড়েঞা-কল্যাণপুরের বাসিন্দা নজরুল মল্লিক মুম্বইয়ের এক বহুতল নির্মাণের কাজের সময় চারতলা থেকে পড়ে মারা গেছেন। এখানেই শেষ নয়। মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের গোকুল মণ্ডল, শুভঙ্কর রায় এবং ফরাক্কার ইস্রাইল শেখ দিল্লীর এক বাড়ির প্লাস্টারিং’এর কাজের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। গতকালের খবর — পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে চেন্নাই’তে সোনার কাজে যাওয়া ১৩টি শিশুকে চাইল্ডলাইন ও চেন্নাই পুলিশ উদ্ধার করে মেদিনীপুরে ফিরিয়ে এনেছে।

মালদা’র আরেক পরিযায়ী শ্রমিক ছোট্টু খান অসমের জোড়হাটে টাওয়ার থেকে পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিদিন দীর্ঘ হচ্ছে এই তালিকা।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত শ্রমজীবী মানুষ ভিনদেশে, ভিনরাজ্যে কাজের জন্য যান, তার একটা উদ্বেগজনক ছবি ধরা পড়েছিল কোভিডের সময়, আর তখনই ধরা পড়েছে ‘পরিযায়ী’ শব্দের সঙ্গে কতটা বিপন্নতা, অনিশ্চয়তা আর বিপদ জড়িয়ে আছে। তবুও কেন লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষকে বছরভর ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে হয় পেটের তাগিদে? কেন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মর্মান্তিক ভাবে প্রাণ হারাতে হয় কর্মস্থলে? রাজ্য সরকার এ’ব্যাপারে কতটুকু ওয়াকিবহাল? পরিযায়ীদের নিরাপত্তার জন্য কী তার পদক্ষেপ? এ’প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটিতে আসব, যেখানে অন্য বহুকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই পরিযানের করুণ আলেখ্য।

গত রবিবার সকাল দশটা নাগাদ দত্তপুকুর থানার মোচপোল গ্রামে ঘটেছে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা — এক বেআইনি বাজি কারখানায়। মারা গিয়েছেন এ’পর্যন্ত ৯ জন। আহত বহু। নিহতদের মধ্যে ৩ জন স্থানীয়, বাকি ৬ জন মুর্শিদাবাদের সূতী থানার বাসিন্দা। মৃতদের মধ্যে এক মহিলা সহ একাধিক নাবালক আছে।

বিস্ফোরণের অভিঘাত এতটাই বেশি যে প্রায় দুশো মিটার দূরের এক পুকুরে মৃতদেহ ছিটকে গিয়ে পড়েছে। কাটা আঙুল উড়ে গিয়ে পড়েছে দেড়শো মিটার দূরের এক বাড়ির উঠোনে। বিস্ফোরণ ঘটেছে যে বাড়িতে তার ছাদ দু’তিনটি বাড়ি টপকে ৫০ ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়েছে অন্য এক বাড়ির ওপর। ধ্বংসস্তুপ দেখলে মনে হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত এক ক্ষেত্র, যেখান থেকে এখনও দেহাবশেষ মিলছে।

সেখানে পরিত্যক্ত ইটভাঁটায় মিলেছে ল্যাবরেটরি, যেখানে বিস্ফোরক সহ রয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। রয়েছে মজুত বিস্ফোরকের অবিশ্বাস্য বিশাল ভাণ্ডার। বাঁশবাগানের নিরালায় প্লাস্টিক ছাউনির নিচে অনেক ছোট ছোট কারখানা যেখানে কাজ করতেন মহিলা, নাবালক ও শিশুসহ প্রায় ১০০ জন। দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। অভাবী স্থানীয় মহিলারা অনেকেই সন্তানসহ কাজ করতেন বিপদ জেনেও।

বিস্ফোরণের অভিঘাত, ল্যাবরেটরিসহ বিস্ফোরকের মজুত ভাণ্ডার, উচ্চ অভিঘাতের বিস্ফোরকের উপস্থিতি — এসব দেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ — ঐ কারখানায় সবুজ বাজি দূরে থাক, শব্দবাজির সঙ্গে সম্ভবত বোমাও তৈরি হত। এবং সেটা হত শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্ব ও স্থানীয় প্রশাসনের জ্ঞাতসারে। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষ মদতে। না হলে এই জনবহুল এলাকায় এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে, লাইসেন্স ছাড়া, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা সহ ন্যূনতম নিরাপত্তাবিধির তোয়াক্কা না রেখে কী করে রমরমিয়ে চলছিল এই কারবার? এই প্রশ্ন স্থানীয়দের। এমনকি, তারা এই অভিযোগও করেছেন, প্রতিবাদ জানাতে গেলে প্রশাসন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়েছে। শুধু তাই নয়, এক যুবক ও এক ইমাম স্থানীয় মহিলাদের বিপজ্জনক বাজি কারখানার সংশ্রব ছাড়তে বলায় কারবারিরা সামাজিকভাবে তাদের অপদস্থও করে।

এই মৃত্যমিছিল আর ধ্বংসলীলা প্রমাণ করে, মাত্র কয়েক মাস আগের এগরার ঘটনা থেকে সরকার ও তার পুলিশ প্রশাসন কোনো শিক্ষাই নেয়নি। যদিও তারপর ভুল স্বীকার, মার্জনা চাওয়া ও বহু প্রতিশ্রুতিও ছিল। তৃণমূল সুপ্রিমো বাজি তৈরিকে ‘কুটির শিল্প’ অভিহিত করে ‘সবুজ বাজির ক্লাস্টার’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তা কথার কথাই থেকেছে। রাজ্যে এখনও পর্যন্ত একটিও সবুজ বাজির কারখানা নেই।

একটু পিছিয়ে ভাবা যাক। ‘মৌর্যবংশ ধ্বংস করার’ মতো তারও প্রতিজ্ঞা ছিল সাড়ে তিন দশকের একটি শাসনের মহীরুহকে উপড়ে ফেলা। যথেষ্ট পরিশ্রম অধ্যবসায় কৌশলে সেটা সম্পন্ন করার পর রাজ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার ব্যাপারে কার্যত তিনি দিশাহারা এবং তৃতীয় মেয়াদে এসে সম্পূর্ণ হালছাড়া। তৃণমূল সরকারের জনমোহিনী প্রকল্পের প্রসাধন চর্চিত আপাত মানবিক মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কালিমায়। আক্ষরিক অর্থে জনজোয়ারে ভাসতে ভাসতে যেদিন প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেদিন কি তার মনে কোনো সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন ও পরিকল্পনা ছিল না! তাহলে মানুষের গণতান্ত্রিক চেতনার ওপর ভরসা না রেখে, সন্ত্রাসকেই কেন ভরসা করলেন ক্ষমতা দখলের জন্য? ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য কেন দুর্নীতিকে আশ্রয় করলেন? আজ তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী হয়ে নিচুতলার পুলিশকে দুষছেন, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন এবং কার্যত নিজের দপ্তরের প্রশাসনিক অপদার্থতাকে স্বীকার করে নিলেন। কিন্তু এই পুলিশের দুর্নীতিগ্রস্ত, অকর্মণ্য তথা দলদাসে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে নিজের তথা দলের ভূমিকাকে অস্বীকার করবেন কীভাবে? দলের নিচুতলার পুরোপুরি দুর্নীতি সন্ত্রাসে ডুবে থাকার প্রতি তিনি ‘ধৃতরাষ্ট্র’ হয়ে থাকলেও রাজ্যবাসী তো দৃষ্টি হারায়নি! আর এ’ভাবেই তিনি বাংলার এই ‘দুর্জয় ঘাঁটি’কে একটা ফ্যাসিস্ট দলের লুঠ ও আগ্রাসনের জন্য উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন যারা গোটা দেশটাকেই কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য গণতন্ত্র হত্যার সার্বিক আয়োজন করে ফেলেছে!

রাজ্যের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রথম থেকেই এই সরকার উদাসীন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে পঞ্চায়েতকে সুষ্ঠুভাবে সামিল করে জনগণের সহযোগিতায়, কৃষি, কুটির শিল্প, কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়ণ, মৎস্য, পশুপালন, রেশম শিল্প, তাঁত শিল্প ইত্যাদির উন্নয়নের ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তার ধারাবাহিক রূপায়ণের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের কোনো লক্ষ্য ছিল না। একশো দিনের কাজসহ অন্যান্য গ্রামীণ প্রকল্পগুলির রূপায়ণে শাসকদলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের ‘করে খাওয়ার’ নীতির দরুণ ব্যাপক দুর্নীতির ফলে অনেক ক্ষেত্রে তার সুফল মানুষের কাছে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি। তাদের অনৈতিক উপার্জন যত বেড়েছে, সমানতালে বেড়েছে রাজনৈতিক ‘প্রতাপ’। তারসঙ্গে, স্থানীয় কিছু সাধারণ মানুষকেও সামিল করে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একেকটি বলয়। আর সেই বলয়ের ঘেরাটোপেই গড়ে উঠেছে বগটুই; প্রশ্রয় পেয়েছে এগরা, মোচপোল। আর তার করুণ পরিণতি চোখের সামনেই দেখছি! সাধারণ মানুষ এই লুঠ, এই বেনিয়ম এই অনৈতিকতা নিশ্চয়ই মেনে নিতে চাননি। কিন্তু প্রতিবাদ জানাবেন কোথায়? সর্ষের মধ্যেই তো ভূত! জনপ্রতিনিধি, আইনরক্ষক সবাই তো সেই দুর্বৃত্তায়নের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়েছেন, প্রতিবাদী মানুষকে নানাভাবে ভয় দেখিয়ে তারা নিরস্ত করছেন। ওদিকে অসদুপায়ে কম সময়ে কম পরিশ্রমে রকেট উত্থানের মূল্য দিয়েছেন, দেবেন জিরাত শেখ, কেরামত আলির মতো মানুষেরা। সন্তানের জীবন কেড়ে, নিজে মরে! আর মুর্শিদাবাদের চাঁদরার মাসুমের মতো কিশোররা, দু’টো বাড়তি আয়ের আশায় নবম শ্রেণির পড়া ছেড়ে বা ঘরে বসে বিড়ি বাঁধা ছেড়ে, জিরাতের মতো আড়কাঠিদের হাত ধরে অজান্তেই পৌঁছে যাবে ভুলভুলাইয়ায়, কিছু জানা বোঝার আগেই কচি শরীরটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। ২০১৫’র ৬ মে মেদিনীপুরের পিংলায় বাজিকারখানার বিস্ফোরণে যে ১৩টি প্রাণ বলি হয়েছিল তার ১২ জনই ছিলেন চাঁদরা গ্রামের। বেশিরভাগই নাবালক। মাসুমের মা সন্তানকে কোনক্রমে শনাক্ত করে কান্নারও সময় পেলেন না। কারণ মাথায় তখন দুশ্চিন্তা — হাতে ফুটো পয়সা নেই, ঐ দেহ তিনি কীভাবে গ্রামে নিয়ে যাবেন?

বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য কৃষি উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঝুঁকি বাড়ছে কিন্তু আয় কমছে। ফলে কৃষির সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলোর অনেক সদস্যই উপার্জনের জন্য শহরমুখী। গ্রামীণ শিল্পগুলো উপযুক্ত উপকরণের অভাবে, উৎপাদন ব্যয়ের সংস্থান না থাকায়, বিপণনের উপযুক্ত ব্যবস্থার অভাবে ধুঁকছে। গ্রামীণ শিল্পী বা বৃত্তিজীবীরা আজ পেটের তাগিদে বংশপরম্পরার শিল্প, পেশা বা বৃত্তি ছেড়ে শহরমুখী। কিন্তু শহরে কাজ কোথায়? বস্ত্র, চট, ইঞ্জিনীয়ারিং কারখানাগুলোয় তালা পড়েছে। নতুন কারখানা গড়ে ওঠেনি। ফলে শহরের মানুষই আজ কর্মহীন। তাই কয়েক দশক ধরেই দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে, মহারাষ্ট্রে, কাশ্মীরে পশ্চিমবঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের স্রোত অব্যাহত। কাশ্মীরে জঙ্গিহানার দরুণ এখন মানুষ যাচ্ছেন উত্তর পূর্বাঞ্চলে। কিন্তু তার সঙ্গে মৃত্যুমিছিলও অব্যাহত। কেন?

many-more-deaths

চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই কাজ করতে হয় বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের। কখনও তারা বিদ্বেষের শিকার হন, যেমন মাত্র কিছুদিন আগে আমরা হরিয়ানার নুহ’তে দেখেছি কীভাবে তাদের সন্ত্রস্ত করে আশ্রয়চ্যুত করা হল। হেনস্থা করা হল। ২০১৭-তে রাজস্থানে আফরাজুলকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কখনও তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হন। যেমন ২০২১-এ কেরলের বন্যায়। কখনও তারা ঠিকাদারের চুক্তিভঙ্গের বা মালিকের উৎপীড়নের শিকার হন। উপযুক্ত পরিচয়পত্র না থাকায় ঘর ভাড়া পেতেও অসুবিধা হয়। ফলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর ও ঠিকানাবিহীন ঝুগগি ঝোপড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজতে হয়। এজন্য অনেক সময়েই তারা সরকারি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। সরকারিভাবে নাম নথিভুক্ত না থাকায় দুর্ঘটনা বা মালিকের অন্যায়ের শিকার হলেও দ্রুত জানানোর উপায় থাকে না। তাদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মালিক ন্যূনতম নিরাপত্তাবিধিটুকুও লঙ্ঘনের সাহস পায় যে কারণে দুর্ঘটনা এত বেড়ে গেছে।

ভারতে আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন (১৯৭৯) চালু আছে। কিন্তু কোন রাজ্য সরকারই তার শর্তগুলো পালন করেনি। পরিযায়ী শ্রমিক বা ঠিকাদার — কারোরই নথিভুক্তির সঠিক তথ্য ভাণ্ডার তৈরি করা হয়নি। ২০২০-২১এ এক জনস্বার্থ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সব রাজ্যকে পরিযায়ী শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেই মর্মে এক হলফনামা জমা দিতে বলে।

অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর রেখার মতো একটা ভরসা তৈরি করেছে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক সুরক্ষা বোর্ড। ভারতে প্রথম। বোর্ডের তরফে কয়েকটি আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। যথা, একটি তথ্যভাণ্ডার গড়া হবে; ২৪ ঘণ্টার সহায়তা কেন্দ্র খোলা হবে; কেরল, দিল্লী, মহারাষ্ট্রে আঞ্চলিক অফিস খোলা হবে; দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কর্মক্ষমতা হারালে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা সাহায্য করা হবে। মৃত্যুর ক্ষেত্রে ২ লক্ষ টাকা।

এই বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজ্যসভার সাংসদ অধ্যাপক সামিরুল ইসলাম মালদা’র নিহত শ্রমিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হাতে রাজ্যসরকারের তরফে সাহায্য তুলে দেন। তিনি জানিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্পর্কে তথ্য ভাণ্ডারের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও বিমার জন্য রাজ্য সরকার ‘কর্মসাথী পরিযায়ী শ্রমিক পোর্টাল ও অ্যাপ’ চালু করেছে। সরকারি প্রকল্পে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ৫ লক্ষ টাকা ঋণেরও ব্যবস্থা করা হচ্ছে যার জন্য ‘দুয়ারে সরকার’ শিবির থেকেই তারা আবেদন করতে পারবেন।

আমরা পরিযায়ী শ্রমিকদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, নিরাপদ মাতৃত্ব, সন্তানের শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা যা প্রতিটি নাগরিকের প্রাপ্য তারজন্য সরকারের যথাযথ উদ্যোগ দাবি করছি! সেই সঙ্গে এইসব মর্মান্তিক দুর্ঘটনার যথাযথ তদন্ত, দ্রুত আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পরিবারগুলির আর্থিক পুনর্বাসন দাবি করছি!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

dattapukur-firecracker-factory-blastrequires-judicial-probe

সিপিআই(এম‌এল) লিবারেশনের উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত এক প্রেস বিবৃতি বলেন, দত্তপুকুর থানার অন্তর্গত মোচপোল বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটনার অনুসন্ধানে ২৭ আগস্ট এলাকায় এক প্রতিনিধি দল যান। প্রতিনিধি দলে ছিলেন জেলা নেতা দিলীপ দত্ত, সুব্রত ব্যানার্জি, সৌরভ কাঞ্জিলাল এবং আমান সেখ।

এই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় নিরাপত্তাহীনভাবে বেআইনি বাজি কারখানাগুলো চলছে। এর আগেও দুর্ঘটনাস্থলের পাশের গ্রামে বেআইনি বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষাই নেয়নি প্রশাসন। উপরন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ — এই বেআইনী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে জানানো হলে প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে। তাদের হেনস্থা করা হয়েছে। শাসক দল ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতেই এই বাজি কারখানাগুলোর রমরমা।

এই বিস্ফোরণে মৃতদের মধ্যে বড় অংশ‌ই মুর্শিদাবাদ থেকে কাজের জন্য আসা শ্রমিক। আমরা অবিলম্বে এই ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারগুলির জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও তাদের পরিবারের জন্য কাজের ব্যবস্থার দাবি করছি।

রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরনের বেআইনি বাজি কারখানার রমরমা ও বিস্ফোরণ নাগরিকদের নিরাপত্তাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা দাবি করছি রাজ্য সরকারকে এই ধরনের মৃত্যুর কারবার অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে ও পাশাপাশি বাজি কারখানার শ্রমিকদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশাসনের অপদার্থতায় দত্তপুকুর বাজি কারখানার বিস্ফোরণ বেশ কিছু মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল, আশেপাশের নিরাপরাধ মানুষদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করল। আমরা এই বিস্ফোরণের বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।

country-obsessed-with-violenceobsessed-with-violence

এবার উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের এক স্কুলের শিক্ষিকা রাতারাতি চলে এলেন সংবাদের শিরোনামে, সম্পূর্ণ ঘৃণিত এক ঘটনার কারণে। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণকে কেন্দ্র করে আবেগ ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি নিয়ে যখন দেশ তোলপাড়, তার ঠিক একদিন পরই যোগীর রাজ্যে ঘটল এই ঘৃণা বিদ্বেষের কলঙ্কিত অধ্যায়।

মজফ্ফরনগরের নেহা পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ত্রিপ্তা ত্যাগী এক সাত বছরের সংখ্যালঘু শিশুকে ‘মুসলমান’ হওয়ার ‘অপরাধে’ সহপাঠীদের ডেকে একে একে থাপ্পড় মারার নির্দেশ দেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিও’তে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিকা আরও জোরে চড় মারার নির্দেশ দিচ্ছেন অন্য সহপাঠীদের। এই ঘটনায় দৃশ্যত আতঙ্কিত শিশুটি অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু তাতেও বিরাম নেই।

এই ঘটনায় এত শোরগোল হলেও প্রধান শিক্ষিকার নেই বিন্দুমাত্র অনুশোচনা। তিনি তাঁর এই কান্ডের সপক্ষে যুক্তি হাজির করে এটাকে স্রেফ এক ‘তুচ্ছ ঘটনা’ বলে মনে করছেন তাই নয়, বরং মিথ্যার জাল বুনে জানালেন, হোমওয়ার্ক ঠিক মতো না করার জন্যই নাকি শিশুটির অভিভাবক তাকে শাস্তি দেওয়ার নিদান দেয়! এদিকে, শিশুটির পিতাই শিক্ষিকার নামে এফআইআর করার সময় জানান, এক-দু ঘণ্টা ধরে তাঁর ছেলের উপর অত্যাচার হয়েছে, শিশুটি তারপর থেকে ভয়ে কুঁকড়ে রয়েছে। শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অত্যন্ত মামুলি অভিযোগ পুলিশ এনেছে, যা গ্রেপ্তারযোগ্য নয়। বুঝতে অসুবিধে হয় না, যোগী রাজ্যে গভীরে গেঁড়ে বসে থাকা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন গোটা প্রশাসনই এই গুরুতর অপরাধকে কেন লঘু করে প্রায় ছাড় দিয়ে দিল ওই শিক্ষিকাকে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, ওই শিশুটির পরিবারের উপর মামলা প্রত্যাহারের প্রবল চাপ, সঙ্গে হুমকি শুরু হয়েছে। ‘নিজেদের’ মধ্যে মিটমাঠ করে নেওয়ার জন্য এলাকাবাসীরা পীড়াপীড়ি করছেন।

এরই ঠিক দিন কয়েক আগে আরেকটি ঘটনা ঘটে খোদ লক্ষ্ণৌ’এ। শহরের মহিলা মেয়র সুশমা খাড়াকওয়াল শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ’তে একজন রোগীকে দেখতে যান সদলবলে। পায়ের জুতো খুলে, ভিড় না করে, একে একে সেখানে ঢোকার অনুরোধ করেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। তাতে ঘোর আপত্তি তোলেন মেয়র ও তার সঙ্গী সাথীরা। এই ঘটনা চলতে থাকার মধ্যেই বুলডোজার সেখানে চলে আসে (বলাই বাহুল্য, মেয়রের নির্দেশে), হুমকির মূর্ত প্রতীক হয়ে। তড়িঘড়ি পুলিশ বাহিনী এসে হস্তক্ষেপ করে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।

যোগীরাজের ‘হিন্দুরাষ্ট্রে’ এমন অনেক ঘটনা হামেশাই ঘটছে, যা আজ যোগীর কল্যাণে হয়ে উঠছে রীতিমতো আইনসম্মত। বুলডোজার হয়ে উঠেছে শাসনতন্ত্রের এক স্বাভাবিক অঙ্গ। ত্রাস সৃষ্টি করে সবাইকে সন্ত্রস্থ করার আরেকটা হাতিয়ার। শুধু সে রাজ্যেই আর তা সীমাবদ্ধ নেই। যোগীর এনকাউন্টার মডেল এ’রাজ্যেও আমদানি করার পক্ষে জোরাল সওয়াল করলেন এ’রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের নেতা। বিজেপির যুব মোর্চা প্রকাশ্য রাজপথে যাদবপুরে ছাত্র সমাজের উদ্দেশ্যে ‘গোলি মারো’ শ্লোগান তোলে, রাষ্ট্রীয় মদতে বিজেপি শাসনাধীনে মণিপুর কি হিংস্রভাবে, মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ভর করে জো-কুকিদের নিকেষ করার নরমেধ যজ্ঞে নামল, সেই ধ্বংসযজ্ঞে কিভাবে গণধর্ষণকে হাতিয়ার করা হল (যা ২০০২ সালে হয়েছিল মোদীর শাসনাধীন গুজরাটে) তা দেখেছে গোটা ভারতবর্ষ। কয়েকজন রাষ্ট্রীয় নেতা, বা কয়েকটি ঘৃণা-বর্ষী সংগঠনের সংগঠকদের উত্তপ্ত উস্কানিমূলক ভাষণ’ই শুধু নয়, আজ আমাদের সমাজের গভীরে কি মারাত্মক দ্রুতগতিতে অপরায়ন — ঘৃণা-হিংসা-বিদ্বেষ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, আমাদেরই সহ নাগরিকেরা কিভাবে তার সওয়ার হয়ে সামিল হয়ে পড়ছেন এই নিমর্মতার মহোৎসবে, ১৯৪৭-এ ভৌগলিকভাবে ভাগাভাগি হওয়ার পরও আজ মোদীর শাসনকালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত ভাগ হয়ে চলেছে ঘৃণা-আশ্রিত হিন্দুত্ববাদী নব্য দেশপ্রেমের বিষাক্ত ছোবলে। এর বিরুদ্ধেই আজ দরকার নতুন এক চেতনার জাগরণ, আরেক স্বাধীনতা সংগ্রাম। নতুন আরেক ভারত নির্মাণের প্রকল্প।

foil-the -conspiracyconstitution-of-india

ভারতের সংবিধানকে অচল বলে বাতিল করে দেওয়াটা হিন্দু প্রভুত্ববাদী শিবিরের দীর্ঘদিনের এজেন্ডা। বর্তমানে প্রকাশ‍্যেই এই চেঁচামেচি শুরু করেছে ওরা। নতুন সংবিধান প্রণয়নের সবচেয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ ওকালতি এসেছে ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের দিনে একটি খবরের কাগজে অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায়ের লেখা এক নিবন্ধ রূপে। এটাকে একজন ব‍্যক্তির বিচ্ছিন্ন একটা মতো হিসেবে গণ‍্য করা মূর্খতা হবে। কারণ ইনি আর কেউ নন, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম‍্যান। এবং এই নিবন্ধে যে বক্তব‍্য তুলে ধরা হয়েছে সেগুলি ইতিপূর্বেই সরকারের বিভিন্ন ঘোষণা ও পদক্ষেপে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। বিবেক দেবরায়ের নিবন্ধকে বরং দেখা যেতে পারে মাত্র ক’দিন আগেই রাজ‍্যসভায় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বক্তব‍্যের ধারাবাহিকতা হিসেবে, যেখানে গগৈ সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামো সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলেন।

বাজপেয়ী জমানার এনডিএ সরকারও এই এজেণ্ডা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। প্রধান বিচারপতি এমএন বেঙ্কটচালাইয়ার নেতৃত্বে এগারো সদস‍্য বিশিষ্ট ‘সংবিধানের কার্যকারিতা খতিয়ে দেখার জাতীয় কমিশন (এনসিআরডব্লুসি)’ গঠন হয়েছিল। তবে, এই কমিশনকে দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের বুনিয়াদি কাঠামো ও মৌলিক বৈশিষ্ট‍্যগুলিতে কোনোরকম হস্তক্ষেপ না করে সম্ভাব‍্য কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করার। ২০০৪ সালে বাজপেয়ী সরকারের পরাজয়ের পর এই এজেণ্ডাকে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি ওরা, এবং সেই এনসিআরডব্লুসি রিপোর্টকে আর কেউ গুরুত্বও দেয়নি। মোদী জমানার সংশোধনীসমূহ ও বিলগুলি অবশ‍্য ইতিমধ‍্যেই সংবিধানের বুনিয়াদি বৈশিষ্ট‍্যকে এবং মূল সুরকে খর্ব করতে শুরু করেছে। নাগরিকত্বের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিমূলে অন্তর্ঘাত চালিয়েছে সিএএ; সামাজিক অবিচার ও বৈষম‍্যের বিরুদ্ধে যে এফার্মেটিভ অ‍্যাকশান সংরক্ষণের মূল ভিত্তি ছিল তাকে নড়িয়ে দিয়েছে ইডব্লুএস সংরক্ষণ; জম্মু ও কাশ্মীর এবং দিল্লীর সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় গঠন কাঠামোর ওপর তীব্র আঘাত হেনেছে; এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন ও নাগরিকের অধিকারকে সম্ভাব‍্য সমস্ত উপায়ে পদে পদে খর্ব করা হচ্ছে।

দেবরায়ের নিবন্ধ এইসব প্রবণতাগুলিকে তাদের স্বাভাবিক যৌক্তিক সিদ্ধান্তে এনে ফেলেছে এবং ধাপে ধাপে সংশোধনী আনার বদলে এবারে গোটাগুটি সংবিধানটাই নতুন করে লেখার আওয়াজ তুলেছে। স্পষ্টতই বুনিয়াদি কাঠামোর শাসন, যা যেকোনো সংশোধনের সীমা নির্ধারণ করে দেয় এবং সরকারকে বাধ‍্য করে যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম‍্য ও ক্ষমতার ভাগাভাগি মেনে চলতে, এবং প্রস্তাবনায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া সাধারণতন্ত্রের চরিত্র ও মৌলিক দিশা, এগুলি মোদী সরকারের ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভূত করার সীমাহীন তাড়নাকে এখনও কিছুটা আটকে রেখেছে। এই বাধা অতিক্রম করতে দেবরায় হাজির হয়েছেন এক সম্পূর্ণ নতুন সংবিধান প্রণয়নের আমূল সমাধান নিয়ে।

মজার বিষয় হল, নতুন সংবিধানের ওকালতি করতে গিয়ে দেবরায় হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী লক্ষ‍্য পূরণ বা মনুস্মৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিষয় মোটেই আলোচনায় আনেননি। এই প্রসঙ্গ তাঁর নিবন্ধে লক্ষ‍্যণীয়ভাবে অনুপস্থিত। তিনি সংবিধানকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে বলছেন কারণ ওটা নাকি ঔপনিবেশিক ঐতিহ‍্য, তাই নতুন সংবিধান হবে ঔপনিবেশিকতা মুক্তির প্রকল্প। অমিত শাহও একই যুক্তি দেখিয়ে ফৌজদারি বিচারশাস্ত্রের আইনগুলিকে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছেন। ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডকে প্রতিস্থাপিত করতে চাওয়া হয়েছে ভারতীয় ন‍্যায় সংহিতা দিয়ে। বেশ মহৎ ভঙ্গী নিয়ে এটা পেশ করা হয়েছে, ঔপনিবেশিক যুগের শাস্তির ধারণা থেকে সরে এসে নাগরিকদের ওপর নজর কেন্দ্রীভূত করা হবে সুবিচার নিশ্চিত করতে। কিন্তু নাম বদলের ভঙ্গীর পেছন দিয়ে আসা ‘নতুন’ বিধিগুলি ঔপনিবেশিক যুগের আইনগুলিকেই আরো কঠোর ও নিপীড়নমূলক করে তুলছে।

অন‍্য প্রেক্ষিতটা হল সরকারের ‘কার্যকারিতা ও গতি’। একনায়কতন্ত্র সর্বদাই গণতন্ত্রকে তুলে ধরে ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া’ এবং তা ‘দ্রুত কার্যকর করার’ পথের বাধা হিসেবে। আমরা ইতিমধ‍্যেই দেখতে পাচ্ছি যে সংসদীয় প্রক্রিয়াকে সুব্যবস্থিতভাবে ছিন্ন করা হচ্ছে, যার উদগ্র বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল কোভিড-১৯ মহামারীর সময়, যখন সরকার সংসদ ও জনতাকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে রেখে নতুন নতুন আইন প্রণয়নের এক আগ্রাসী অভিযান চালালো কর্পোরেটদের ক্ষমতা আরো জোরালো করতে। দেবরায় এই ব‍্যবস্থাকেই এক আইনসিদ্ধ সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চান।

স্পষ্টতই মোদী সরকারের সমস‍্যা কেবল সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার, নির্দশাত্মক নীতি বা প্রস্তাবনার ঘোষণাগুলি নিয়েই নয়, সংবিধানে বিধৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাধ‍্যবাধকতা, আলবৎ ঐক‍্যের দিকে জোর দিয়ে — সমস‍্যা সেটা নিয়েও। এবং কার্যনির্বাহী, আইন প্রণেতা সংস্থা ও বিচার বিভাগের ক্ষমতার আলাদা আলাদা ক্ষেত্র নিয়েও মোদী সরকারের সমস‍্যা। সংবিধান ঘোষণা করে, ইন্ডিয়া অর্থাৎ ভারত রাজ‍্যগুলির একটা ইউনিয়ন। মোদী সরকার রাজ‍্যগুলির ক্ষমতা ক্ষয় করতে এবং রাজ‍্যের আওতাধীন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে সদা তৎপর। অবিজেপি দল শাসিত রাজ‍্যগুলির সরকারের কাজে বাধা তৈরি করতে, অস্থিরতা তৈরি করতে এবং এমনকি সরকার ফেলে দিতে রাজ‍্যপাল ও কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলিকে লাগাতার ব‍্যবহার করছে মোদী সরকার। এবং এখন তো কার্যনির্বাহীও প্রকাশ‍্যে বেরিয়ে পড়েছে পদে পদে যেকোনো উপায়ে বিচার বিভাগকে ধমকানি দিতে আর ঘিরে ধরতে। এর আগে কখনই ভারতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এরকম বিদ্বেষপূর্ণ অভিযান চলতে দেখা যায়নি, কার্যনির্বাহীর আগ্রাসী অভিযানকে সংযত করা বা তাদের সোজা রাস্তায় আনার সপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি রায়কে এরকম সুব‍্যবস্থিতভাবে খাটো করতে দেখা যায়নি আগে কখনো।

আরএসএস, যারা জন্মলগ্ন থেকেই ফ‍্যাসিস্ট মুসোলিনি আর হিটলারের মডেল থেকে অনুপ্রেরণা নেয়, এখন ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ইজরায়েলের জায়নবাদী মডেল অনুকরণ করছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের চলমান যুদ্ধ নেতানিয়াহুর আমলে সেখানকার বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে চলা অভিযানের সাথে মিলে যায়। ইজরায়েলে এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ব‍্যাপক গণবিক্ষোভ ঘটে। সংবিধান হল আধুনিক ভারতের ভিত্তি। আজ যখন মোদী নিজেকে আধুনিক কালের হিন্দু সম্রাট হিসেবে উপস্থাপনা করতে চাইছেন — তাঁর ভক্তরা তাঁকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ বলে থাকে — যিনি নাকি বিগত হাজার বছরের ‘অধীনতা’ থেকে আগামী হাজার বছরের ‘গৌরব’এ উত্তরিত হওয়ার সূচক, তখন একথা স্পষ্ট যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক সুদীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পর গৃহীত সংবিধান যে রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া বা ভারতের সাধারণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল আজ তা মৌলিক সংকট ও গভীর হুমকির মুখে।

রাজতান্ত্রিক সেঙ্গোল প্রতীকসহ নতুন সংসদ ভবন, যাকে দেবরায় ভারতের ‘বিস্মৃত ঐতিহ‍্যের’ পুনর্জাগরণ বলে অভিহিত করেছেন, সংঘ বাহিনীর দৃষ্টিতে তা স্থাপত‍্যরূপে তাদের কাঙ্খিত ‘নয়া ভারতের’ আগমন হিসেবে ইতিমধ‍্যেই ঘোষিত হয়েছে। এক নতুন সংবিধানের জন‍্য দেবরায়ের ওকালতি স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক ভিত্তিমূলে আঘাত হানার এই প্রক্রিয়াকেই সমাপন করতে চায়। ভারতের সংবিধানের বিরুদ্ধে এই বিষাক্ত অভিযানকে শুরু থেকেই প্রতিরোধ করতে হবে। স্বাধীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রকে ধর্মান্ধতা, দাসত্ব ও ত্রাসের নতুন রিপাবলিকে বদলে দেওয়া কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যবে না।

- এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৮ আগস্ট ২০২৩

plan-to-evoke-painful-memoriesmemories-of-partition-rejected

২৯ অগস্ট ২০২৩ রাজ্য সরকার নবান্নে এক বৈঠকের আহ্বান করেন বিজেপির প্রস্তাবিত ২০ জুনকে পশ্চিমবাংলা দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নাকচ করেই শুধু নয়, বাংলা বিভাজনের এক রক্তাক্ত অধ্যায়কে নিজেদের সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট অ্যাজেন্ডার কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রকল্প নিয়ে দিল্লীর নির্দেশে রাজ্যপাল অগ্রসর হচ্ছিলেন, উক্ত বৈঠক তা পুরোপুরি খারিজ করে দিল।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন ও এসইউসিআই(সি) ছিল। সমাজের প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করছে, এমন প্রায় সমস্ত সামাজিক, ব্যবসায়িক সংগঠন (ফিকি, বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স, প্রভৃতি), ফুটবল জগতে তিনটি প্রধান ক্লাবের কর্মকর্তা (মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল ও মহামেডান স্পোর্টিং), বিভিন্ন সংবাদ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমের প্রতিনিধি, সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন, অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার প্রতিনিধি, বুদ্ধিজীবী (যারা বেশিরভাগই শিবিরের), গৌতম ঘোষের মতো চিত্র পরিচালক, এছাড়া আমলা পুলিশ কর্মকর্তারা।

১৯৪৭ সালের ২০ জুন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত বিধানসভায় গৃহীত হয়। রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে, পুরোপুরি অগোচরে রেখে, ফের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে সেই বেদনাদায়ক ইতিহাসকে ফিরয়ে আনার কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে, ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ স্থির করার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেন, যার ভিত্তিতে আলোচনা শুরু হয়। রাজ্য সরকারের মূখ্য পরামর্শদাতা আলাপন বন্দোপাধ্যায় প্রথমেই বিভিন্ন রাজ্যে ঘোষিত রাজ্য দিবসের তারিখ ও রাজ্য সঙ্গীত সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন পাঠ করেন। এরপর একে একে বিভিন্ন সংগঠন বক্তব্য রাখা শুরু করেন।

‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’, ‘বাংলা দিবস’, ‘বিশ্ববঙ্গ দিবস’ — এই তিনটি নামকরণ উঠে আসে। পয়লা বৈশাখ, রাখী বন্ধনের দিন, ১৯ অগস্ট, প্রভৃতি একাধিক দিন ওই দিবসের জন্য প্রস্তাবিত হলেও, পয়লা বৈশাখের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মত প্রকাশ পায়। আর রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে প্রস্তাবিত হয় ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটি। মুখ্যমন্ত্রী উক্ত গানে ‘বাঙালি’র বদলে ‘বাংলা’র পক্ষে ছিলেন। এই শব্দের পরিমার্জন নিয়ে কিছু আপত্তি ওঠায় ঠিক হয় পরবর্তীতে এ’ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

পার্টি রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে মুখ্যন্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক চিঠি মারফত মতামত জানানো হয় যা সভাকক্ষে পাঠ করেন পার্টির পলিটবুরো সদস্য কার্তিক পাল। রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে অতনু চক্রবর্তীও ওই বৈঠকে অংশ নেন।


partition-rejected

১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলার ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক দিন। সেদিনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আধার হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসংঘ, আরএসএসের নেতৃবৃন্দ ও অন্যদিকে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাভাগের সিদ্ধান্ত বিধানসভায় গৃহীত হয়।

সেদিনের বাংলাভাগের কান্ডারীদের উত্তরসূরি বিজেপি অতীতের ধর্মভিত্তিক সংঘাতের ইতিহাসকে খুঁচিয়ে তুলতে আজ বাংলার রাজ্যপালের মাধ্যমে ঐ কলঙ্কিত ২০ জুনকে রাজভবনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে পালন করেছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে বাংলার বুকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি করার এটি একটি অন্যতম ফ্যাসিবাদী কৌশল।

আমরা বাংলার মাটিতে মোদী-শাহদের এই অপকৌশলকে ব্যর্থ করতে বিরোধীদের ঐক্যের পক্ষে এবং ২০ জুন দিনটিকে ক্ষতলাঞ্ছিত ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে মহিমান্বিত করার সম্পূর্ণ বিরোধী।

আমরা মনে করি যদি ২০ জুনের প্রতিস্পর্ধী কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনকে বেছে নিতে হয়, তবে বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, বহুস্বরের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের অনুসারী অন্য কোনো উজ্জ্বল ইতিহাস চিহ্নিত দিনকে সর্বসম্মতিতে গ্রহণ করা যেতে পারে।

- অভিজিৎ মজুমদার, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি


deputation-at-forest-range-officeforest-range-office-in-bankura

গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ বাঁকুড়া জেলার কমলপুর রেঞ্জ অফিসে আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষ থেকে গণডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত হয়। ডেপুটেশনের আগে ভালো সংখ্যক মহিলা সহ তিন শতাধিক মানুষের সুসজ্জিত মিছিল কমলপুর বাজার পরিক্রমা করে। মিছিল শেষে রামনিবাস বাস্কে, সহদেব মান্ডি, পানমনি সরেন সহ ৬ জনের এক প্রতিনিধি দল রেঞ্জারের হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন। এই রেঞ্জের অন্তর্গত মহেশানা গ্রামের সাঁওতাল পাড়ার মানুষদের সাথে কথা না বলেই তাঁদের দীর্ঘদিন দখলে থাকা চাষ জমিতে বনসৃজনের নামে গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ব্যাপারে গ্রামেরই কয়েক জন মাতব্বর যারা সদ্য শেষ হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির পক্ষ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রত‍্যাখ‍্যাত হয়েছে তাঁরা বদলা নেওয়ার জন্য এই মানুষগুলোকে বনের জমি থেকে উচ্ছেদ করে ভাতে মারার চেষ্টা করছে। আর রেঞ্জার এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাচ্ছে।

প্রতিনিধি দল বলেন মহেশানার জমি ফেরত না দিলে আরো বৃহত্তর আন্দোলন করা হবে এবং তার দায় প্রসাসনকেই নিতে হবে। দ্বিতীয় যে বিষয়টি তুলে ধরা হয় তা হল, লোকসভায় কোনো আলোচনা ছাড়াই সদ্য পাশ হওয়া সংশোধিত বন সংরক্ষণ আইন ফেরত নিতে হবে। ডেপুটেশন শেষে শেষবিকেলে ভিড়জমাট কমলপুর বাজারে সভা করা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের পক্ষে রামনিবাস বাস্কে, সুধীর মুর্মু, সহদেব মান্ডি, অল ইন্ডিয়া জন সুরক্ষা কমিটির পক্ষে অবিনাশ হাঁসদা, ভারত জাকাত মাঝি পারগানা মহল থেকে বুদ্ধেশ্বর হাঁসদা এবং সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতির জেলা সভাপতি বাবলু ব্যানার্জি। সভায় সকল বক্তাই বলেন সারা দেশ জুড়ে আজ আদিবাসীদের জমি ও বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এজন্য সরকার ও প্রশাসন, বিশেষ করে বিজেপি, স্থানীয় মানুষদের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিচ্ছে। এটা মহেশানায় যেমন দেখা যাচ্ছে তেমনি মনিপুরে কুকিদের উচ্ছেদের জন্য মেইতিদের সাথে প্রাণঘাতী দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছে। এতেও না পেরে বনের জমি বড় বড় কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে বন সংরক্ষণ সংশোধিত আইন এনেছে। মহেশানা থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র বিজেপির এই বিভাজন-বিভেদ-দাঙ্গার রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে।

mass-deputation-at-forest-range-office

শুধু জমি থেকে উচ্ছেদ নয়, আজ শিক্ষার জগত থেকে আদিবাসীদের বের করে দিতে প্রথমে সরকারি হোস্টেল তুলে দিল। আর এখন বলছে ৩০’র কম ছাত্রছাত্রী আছে এমন সব প্রাথমিক স্কুল তুলে দিবে। এতে আদিবাসী ছেলেমেয়েরা স্কুল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের মতো গরিব মেহনতি মানুষের শ্রম শোষণের জন্য আমাদের রাজ্যে আজ ২ বছর ১০০ দিনের কাজ বন্ধ, মজুরি বকেয়া। এইসব শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্ণায়ক লড়াই লড়তে হবে। বক্তারা আরো বলেন, কয়েকদিন আগে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া থানার আমবাড়ি চা বাগানে আদিবাসীদের বাসস্থানের জায়গা দখল করার জন্য পুলিশের সামনে জমি মাফিয়ারা তাদের ওপর গুলি চালিয়ে ১২ জনকে আহত করে এবং পুরো বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয় যার মধ্যে কয়েকজন গুরুতর আহত। এতে ৫০’র বেশি বাড়ি আগুনে পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এরফলে কয়েক শত আদিবাসী মানুষ আজ নিরন্ন নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশাসন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ পর্যন্ত ‘আদিবাসীপ্রেমিক’ রাজ্য সরকার এঁদের জন্য ত্রাণের কোনো ব্যবস্থাই করেনি। আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছে এবং অবিলম্বে দোষী জমি মাফিয়াদের উপযুক্ত শাস্তি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছে।

migrant-workers-killedcollapses-in-mizoram

মালদা জেলার পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যুর মিছিলে সম্প্রতিক সংযোজন হলো গত ২৩ আগস্ট ২০২৩ মিজোরামের নির্মীয়মাণ রেল সেতু ভেঙ্গে ২৩ জন শ্রমিকের মৃত্যু। বিগত ১৫-২০ বৎসর যাবৎ প্রতি মাসেই অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিকের কফিন বন্দী দেহ মালদায় আসে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। এই জেলায় লক্ষ লক্ষ কর্মহীন মানুষ। জেলায় বা রাজ‍্যে কাজের ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজে যেতে বাধ্য হয়। একদিকে এই জেলায় ৪-৫ দশক ব্যাপী গঙ্গা ও ফুলহর নদীর বিধ্বংসী ভাঙ্গনে কয়েক লক্ষ মানুষ সর্বহারা উদ্বাস্তু, অন‍্যদিকে, জেলার ঐতিহ্যশালী রেশম শিল্প, তাঁত শিল্প ধ্বংস প্রাপ্ত। জেলার উৎপাদিত ফসলের যথাযথ দামও পায়না চাষি, যথা — আম, লিচু, ধান ও পাট এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় কৃষিভিত্তিক কোনো শিল্প না হওয়া, এমজিএনআরইজিএ তথা ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে অত‍্যন্ত স্বল্পমজুরি ও আকাশচুম্বী দুর্নীতির ফলে কর্মহীনতা ও বেকারত্ব সীমাহীন। যার ফলে শ্রমিকরা পেটের টানে ভিনরাজ্যে কাজে যেতে বাধ্য হন।

মিজোরামের রেল সেতু ভেঙ্গে পড়ার ঘটনাটিতে মালদার রতুয়া-২ ব্লকের পুখুরিয়া চৌদুয়া গ্রামেরই ১১ জন শ্রমিক মারা যান। এই ঘটনায় ২৬ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের জেলা কমিটি সম্পাদক কমরেড এব্রাহিম সেখ, জেলা সদস্য কয়েশ আলি ও মৃত্যুঞ্জয় দাস ওই গ্রামের শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎ করা পরিবারগুলির মৃতদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়,

১) সরিফুল সেখ, বয়স ২০, অবিবাহিত, পরিবারে রয়েছে পিতাসহ‌ ৪-৫ জন সদস্য। মাতা আমনুর বিবি পরিবারের জন্য সরকারি চাকরি দাবি করেছেন।          
২) মোজাফ্ফার আলী, বয়স ৩৬, পরিবারে স্ত্রী ও তিন নাবালিকা মেয়ে, বৃদ্ধ মা বাবা রয়েছেন।          
৩) অসীম আলী, বয়স ১৮, অবিবাহিত, পরিবারে অসুস্থ পিতা সহ কয়েকজন সদস্য।          
৪) শহিদুর রহমান, বয়স ৩৫, পরিবারে দু’টি নাবালিকা মেয়ে, স্ত্রী ও পিতা মাতা রয়েছে।          
৫) কাসিম আলী, বয়স ২০, অবিবাহিত, বৃদ্ধা পিতা মাতা রয়েছে।          
৬) সামিরুল, বয়স ১৯, অবিবাহিত, পরিবারের চার সদস্য, মা ১০ বছর শয্যাশায়ী।          
৭) মনিরুল নাদাব, বয়স ২০, অবিবাহিত, পাশের পাড়া কোক্লামারীতে ঘর, মা এবং বোন রয়েছে।          
৮) মোজাম্মেল, বয়স ২৮, পরিবারে পিতা মাতা স্ত্রী ও দু’টি নাবালক সন্তান রয়েছে।          
৯) সাইন আখতার, বয়স ৩০, উচ্চ মাধ্যমিক পাস, ৩ মাস আগে বিবাহ করেছিলেন, ওঁর স্ত্রী এখন বিধবা।          
১০) সানাউল, বয়স ৫০, পরিবারে পিতা মাতা, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে রয়েছে।          
১১) জসিম রহমান, বয়স ১৮, বয়স, স্ত্রী সাবিনূর খাতুন, ছ’মাস আগে বিবাহিত, পরিবারে পিতা মাতা রয়েছে।

১১ জন শ্রমিকই চৌদুয়া গ্রামের। মালদা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এ’গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি টালি ও ভাঙা ইঁটের। কেউ কেউ ঋণ করে বাড়িঘর নির্মাণ করেছিল। এলাকার অধিকাংশ লোক গরিব পরিযায়ী শ্রমিক। মিজোরামে এঁরা গত দেড়-দু’মাস পূর্বে কাজে যান, তারপর এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পার্শ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য মানুষ সকাল হতেই শোকাহত চৌদুয়া গ্রামে হাজির হন। ২৩ জন শ্রমিকের মধ্যে একজন রয়েছেন কালিয়াচক তিন নম্বর ব্লকের পঞ্চানন্দপুর এলাকার শ্রমিক এবং রয়েছে্ন ইংলিবাজারের সাট্টারির শ্রমিক। বাকিদের নামের তালিকা,

১) নুরুল হক, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।          
২) মাসরেকুল, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।          
৩) আনসারুল হক, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।          
৪) রহিম সেখ, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।          
৫) সাকিরুল সেখ, পুখুরিয়া, চৌদুয়া, রতুয়া।          
৬) মহম্মদ জহিরুল শেখ, কালিয়াচক, পঞ্চনন্দপুর।          
৭) সেবুল হক, গাজোল।          
৮) ঝাল্লু সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।          
৯) জয়ন্ত সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।          
১০) রঞ্জিত সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।          
১১) সুমন সরকার, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।          
১২) নব চৌধুরী, সাট্টারি, ইংলিশবাজার।

গত ২৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ডক্টর সি ভি আনন্দ বোস মৃত পরিবারের হাতে রেল প্রশাসনের ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিলেও এলাকা ও পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারি চাকরি দাবি করা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা সত্ত্বেও এখনো ক্ষতিপূরণ মেলে নাই। রাজ‍্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন‍্য আইন থাকা সত্ত্বেও পরিযায়ী শ্রমিকদের অধিকার সেই অনুকূলে নাই। লকডাউনের সময় এই জেলার কুড়ি থেকে বাইশ জন শ্রমিক মারা যায়। আজও কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি। জেলার পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের কান্নার রোল বন্ধেরও কোনো সম্ভাবনার কথা সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে না। মালদা জেলায় যখন কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখন শ্রমদপ্তর তৎপর হয় শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য। শ্রমদপ্তর বেশিরভাগ দালালদের দ্বারা পরিচালিত হয়। শ্রমদপ্তর হতে প্রত্যেকটা পঞ্চায়েতে যে লোক নিয়োগ করা হয়েছে তারাও শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কাজের সঙ্গে যুক্ত, এই সমস্ত কারণে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। আবার কিছু শ্রমিকের যে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে তাদের অনেকেরই রেজিস্ট্রেশন শ্রমদপ্তরের গাফেলতির কারণে বাতিল হয়ে যায়। মালদা জেলায় সাড়ে চার লক্ষ বিড়ি শ্রমিক রয়েছে। এঁরা সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি তো দূরের কথা দিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক মজুরি পান না। কোথাও ১৩০, অথবা ১৪০, কোথাও ১৫০ টাকা হারে মজুরি পেয়ে থাকেন। মজুরি আদায়ে শ্রমদপ্তরের কোনো ভূমিকা নেই।

- সিপিআই(এমএল), মালদা জেলা কমিটি

tragic-death-of-migrant-workersdeath-of-migrant-workers

মিজোরামে রেল সেতু নির্মাণের সময় দূর্ঘটনায় ২৩ জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়। যাঁরা বেশিরভাগই পশ্চিমবাংলার মালদা জেলার বাসিন্দা।

গত ২৬ আগস্ট ২০২৩ এআইসিসিটিইউ পূর্ব-মধ্য কলকাতা আঞ্চলিক টীমের পক্ষ থেকে মৃত শ্রমিকদের স্মরণে মোমবাতি প্রোজ্জ্বলনের মাধ্যমে শোক জ্ঞাপন করা হয়, মৌলালী শহীদ বেদীর সামনে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায়।

পশ্চিমবাংলায় উপযুক্ত কাজ না পেয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে ভিনরাজ্যে এমনকি ভিন দেশে চলে যাচ্ছেন। কেন্দ্র-রাজ্য কোনো সরকারই তা নথিভুক্ত করে না। শ্রমিকদের দেওয়া হয় না কোনো রকমের নিরাপত্তা। প্রায়শই এই ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর আমরা পাই।

বেকার যুবকদের এই রাজ্যে কাজের সংস্থান করা এবং মৃত ও আহত শ্রমিক পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

সভা শেষে মোমবাতি প্রোজ্জ্বলন করে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।

সভায় বক্তব্য রাখেন অতনু চক্রবর্তী এবং দিবাকর ভট্টাচার্য্য। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য পার্থ ঘোষ।

shown-low-covid-deathslow-covid-deaths

কোভিডে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা ভারত সরকার অনেক কম দেখিয়েছে — এই অভিযোগ আগেও উঠেছিল। এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই অভিযোগই করল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে। ২০২১’র ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতে সর্বাধিক ৪০ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন — ভারতের সরকারিভাবে ঘোষিত মৃত্যুর সংখ্যার থেকে যা ১০ গুণ বেশি! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত কোভিডে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে প্রকাশিত এক রিপোর্ট এই তথ্য সামনে এনেছে। 

এই ৪০ লক্ষ ৭০ হাজার মৃত্যুর মধ্যে ৮০.৩ হাজার মানুষ মারা যান ২০২০তে। এরপর কোভিডের ডেল্টা ঢেউয়ের হানায় পরবর্তী বিপর্যয় ঘনিয়ে আসে। ভারতই শুধু মৃত্যুর সংখ্যা যে কম দেখিয়েছে তা নয়। মিশরও একই পথের পথিক। তবে চূড়ান্ত সংখ্যাগত দিক থেকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারতের মতো আর কোনো দেশ এইভাবে সংখ্যা কমিয়ে দেখায়নি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষাকে ভারতের মতো আর কোনো দেশ এত তীব্রভাবে বিরোধীতা করেনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত সমীক্ষা দেখিয়েছে, ৬০-৬৯, ৭০-৭৯ এবং ৮০’র ঊর্ধ্বে বয়সসীমার মানুষ সবচেয়ে বেশি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষদের মৃত্যুর হার ৫৬.৬ শতাংশ — ভারতেও এই হারে মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, যেহেতু কোভিড-১৯ এখনও বজায় রয়েছে, তাই তাদের এই পরিসংখ্যান চূড়ান্ত নয়।

কিন্তু, এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যেই ভারতই একমাত্র দেশ যে এই রিপোর্টকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভুল বলে ময়দানে নামাল তার তিনজন হোমড়াচোমড়া স্বাস্থ্য আধিকারিককে। তাঁরা হলেন — বিনোদ কে পল (কোভিড টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান), বলরাম ভার্গভ (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চের ডাইরেক্টর জেনারাল) আর এইমসের দিল্লীর কর্ণধার রণদীপ গুলেরিয়া। এমনকি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালীন, পরিসংখ্যাগুলো যখন সবেমাত্র প্রকাশ হতে শুরু করে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক এক বুলেটিন মারফত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যগুলোকে বিরোধীতা করতে শুরু করে।

ভার্গভ ও পল অভিযোগ করেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার তথ্য থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁচেছে যা ভুল। কিন্তু তাঁরা কেউই ব্যাখ্যা করেননি, ওই তথ্যগুলোকে কেন ভুল বা মিথ্যা বলা হচ্ছে।

ভারত সরকারের সরকারি নথি বলছে, কোভিডে এ’দেশে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৫ লক্ষ, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য থেকে অস্বাভাবিক হারে কম!

- তথ্যসূত্রঃ দি ওয়্যার

tribal-workers-attackedtea-gardens-in-chopra

২১ আগস্ট সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন — উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া থানার অন্তর্গত আমবাড়ি-লোধাবাড়ি এলাকার পেয়ারেলাল টি কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের অধীন অধুনা বন্ধ চা বাগানের আদিবাসী শ্রমিক পরিবারগুলির ওপর প্রাণঘাতী হামলা নামিয়ে আনে বাগানের নতুন মালিক আশ্রিত জমি মাফিয়াদের বিশাল বাহিনী। গুরুতর আহত হন ১৪ জন আদিবাসী শ্রমিক। এরমধ্যে ১২ জন শিলিগুড়ি সংলগ্ন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে স্থানান্তরিত হন। বর্তমানে তাঁদের মধ্যে ৩ জন আঘাতের গভীরতা নিয়ে এখনও মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য কমিটি সদস্য পবিত্র মোহন সিংহের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধানকারী দল আহতদের সঙ্গে দেখা করে এই ভয়াবহ আক্রমণের প্রেক্ষাপট বিশদে জানতে পারে।

জানা যায় যে, এই বাগানটির মালিকানার হাতবদল হয় বছর পাঁচেক আগে। নতুন মালিক বাগানটিকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার পরিবর্তে স্থানীয় শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস আশ্রিত জমি মাফিয়া ও আদিবাসী সেঙ্গেল সংগঠনের কিছু দলছুট নেতাকে হাত করে বাগানের সরকারীভাবে লিজপ্রাপ্ত ১০০ একর জমি বে-আইনিভাবে পর্যায়ক্রমে জমি মাফিয়াদের মাধ্যমে প্লটে প্লটে বিক্রি করতে শুরু করে। সেই সূত্রে বাগানে বসবাসকারী মালিকের অপকীর্তি — বিরোধী আদিবাসী চা শ্রমিকদের উৎখাত করতে প্রকাশ্য দিবালোকে প্রায় ১৫০ জনের সশস্ত্র দল নিয়ে শ্রমিকবস্তিতে হামলা চালিয়ে ৫০টির বেশি বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে এবং প্রতিবাদীদের ওপর ছররা গুলি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে। অকুস্থলে পুলিশ ক্যাম্প থাকলেও সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মচারীরা কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পালিয়ে যায়।

আমরা দাবি জানাই,

১) এই দলবদ্ধ সশস্ত্র আক্রমণের ঘটনার উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করতে হবে।       
২) বাগান মালিকসহ হামলাকারীদের প্রত্যেককে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে।       
৩) রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আহত ব্যক্তিদের উপযুক্ত আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।       
৪) পুলিশ প্রশাসনের অপদার্থতার দায়ে চোপড়া থানার আইসি’র বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।       
৫) এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক রঙ লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রশাসনিকভাবে প্রতিহত করতে হবে।

the-historic-food-movementhistoric-food-movement

চন্দ্রযানের সফল অভিযান নিয়ে চতুর্দিকে উচ্ছ্বাস ও গর্বের শেষ নেই। চাঁদের মাটিতে এখন চলছে খনিজ সম্পদ সন্ধানের কাজ। আগামী দিনে সেটা কর্পোরেট লুন্ঠনের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠবে কি? সেটা অদুর ভবিষ্যতেই স্পষ্ট হবে। কিন্তু নির্মম বাস্তব এটাই যে, বিজ্ঞানের এই জয়যাত্রায় গর্বের পাশাপাশি লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যায়, যখন দেখা যায় বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান ক্রমশ নিচে নেমে চলেছে। ইউরোপের এক সংস্থার বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে প্রকাশ, বিশ্বের ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১০৭ নম্বরে। গতবছর ছিল ১০১ নম্বর। অর্থাৎ আমরা ৬ ধাপ পিছিয়েছি।

কি অদ্ভূত বৈপরিত্ব! একদিকে ক্ষুধার রাজ্যে ভারতের পতন, অথচ বিশ্বের ধনকুবেরদের তালিকায় ঘটছে তার উত্থান! ২০২০ থেকে ২০২২ করোনাকালের দু’বছরে সেই তালিকায় ভারতের নতুন ৬৪ জন ধনীর নাম যুক্ত হয়েছে। এই বিশ্ব ক্ষুধা সূচক মূলত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। তার অন্যতম হল অপুষ্টি, শিশু মৃত্যু, শিশুদের বয়সের তুলনায় উচ্চতা, শিশুদের ওজন প্রভৃতি। দু’বছর আগে করোনাকালে রেললাইনে চাপা পড়া পরিযায়ী শ্রমজীবীদের মৃতদেহের পাশে দেখা গিয়েছিল কয়েকটি আস্ত পোড়া রুটি। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার সংস্থান করতে আজও দূরদূরান্তে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের মৃত্যু ঘটছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটছে, জিডিপি বাড়ছে কিন্তু ক্ষুধা দারিদ্র্য কমছে না, উল্টে বেড়েই চলেছে।

’৫০’র শেষে ও তার ধারাবাহিকতায় ’৬০’র দশকে খাদ্যের দাবিতে, কালোবাজারি মজুতদারির বিরুদ্ধে, তাদের দালাল কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে ঘটেছিল এক গণঅভ্যুত্থান। শতশত মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল। বাংলার হিন্দু মুসলিম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল। খাদ্য আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিন ৩১ আগস্ট ১৯৫৯ কলকাতার রাজপথকে রক্তস্নাত কসাইখানায় পরিণত করা হয়েছিল। খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনকারী গ্রামবাংলা থেকে আগত হাজার হাজার মানুষকে লাঠি-পেটা করে সংগঠিত করা হয়েছিলো রাষ্ট্রীয় গণহত্যা। খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে, সরকারের খাদ্যনীতির বিরুদ্ধে, কালোবাজারি মজুতদারির বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলা।

আজকের সময়কালে আমরা কী দেখছি! আজও চলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত আইন তুলে দেওয়ার চক্রান্ত। দিল্লীর রাজপথে কৃষকের দুর্বার প্রতিরোধের মুখে মোদী সরকার এ’প্রশ্নে সাময়িক পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে, ঐ আইন স্থগিত রাখা হয়েছে। কিন্তু তলায় তলায় সেই প্রক্রিয়া অবাধে ঘটে চলেছে। সম্প্রতি ‘রিপোর্টার কালেকটিভ’ নামক সংস্থার করা অন্তর্তদন্তে সেই গোপন চক্রান্তের পর্দা ফাঁস হয়ে পড়েছে। কর্পোরেট কোম্পানিগুলোকে যতখুশী মজুত করা, খাদ্যদ্রব্যের যথেচ্ছ দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে কৃষিপণ্যের ব্যবসায় যুক্ত কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা ও মুনাফার বিপুল বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। নয়া কৃষি আইন আনার দু’বছর আগে ২০১৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের টাস্ক ফোর্সের সাথে বৈঠকের কার্যবিবরণীতে দেখা যাচ্ছে কর্পোরেট কোম্পানিগুলি যথা, আদানি গ্রুপ, পতঞ্জলী আয়ুর্বেদ, মাহিন্দ্রা গ্রুপ, বিগ বাস্কেট, এরা সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখছে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ১৯৫৫ শিল্প বাণিজ্যের বিকাশের পথে বাধা। তাই অবিলম্বে একে তুলে দেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা তাকে মান্যতা দিচ্ছে। এটা সকলের জানা যে ঐ আইন নিত্যপণ্যের যথেচ্ছ মজুত রাখা বা কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার হাতিয়ার। তথাকথিত ‘কৃষকের আয় দ্বিগুণ’ করার লক্ষ্যে গঠিত ঐ টাস্ক ফোর্স কোনো কৃষকের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়নি। কেবল কোম্পানিগুলোর সাথেই তারা বৈঠক করেছে। এ’বিষয়ে কৃষক সংগঠনগুলি তদন্তের দাবী তুলেছে।

অপরদিকে দেখা যাচ্ছে সরকার করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। গরিব মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিপুল পরোক্ষ করের বোঝা। সরকারী তথ্যে দেখা যাচ্ছে জিএসটি’র কর আদায়ে ৩ ভাগের ২ ভাগ আসছে নীচুতলার মানুষের কাছ থেকে। আর মাত্র ৩-৪ শতাংশ আসছে উপরতলার ১০ শতাংশ ধনীদের কাছ থেকে। গ্রামের গরিব পাড়ায় বা শহর শহরতলীর মেহনতী মানুষেরা জানাচ্ছেন গতবছর বাজারে যে জিনিস ২০০ টাকায় পাওয়া যেত এখন তার দাম ৫০০ টাকা। আর ৫০০ টাকার মাল কিনতে লাগছে ১৫০০ টাকা! পেঁয়াজ সহ সমস্ত সব্জি আজ অগ্নিমূল্য।

৫০ বা ৬০’র দশকের মতো এখন হয়তো সেইভাবে দুর্ভিক্ষ বা আকাল নেই, কিন্তু সরকারের খাদ্যনীতি আরও বেশি মাত্রায় কর্পোরেটমুখী গণবিরোধী হয়ে উঠছে। ‘খাদ্যের অধিকার’, ‘খাদ্য সুরক্ষা’, ‘খাদ্য সাথী’ এসব অনেক কিছুই সরকারী কর্মসূচিতে বলা হয়ে থাকে। রেশনে নাকি প্রচুর চাল গম দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য সংকট নাকি আর আগের মতো নেই! এ’জাতীয় কথাও বহুল প্রচারিত। কিন্তু রেশনে সরবরাহের পরিমাণ কতো? অধিকাংশ গরিব উপভোক্তা রেশনে পায় গড়ে মাসে মাথাপিছু ৫ কেজি চাল। গম সরবরাহ এখন বন্ধ। কিন্তু অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্যসামগ্রী সরবরাহের কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। উল্টে সরকার ধাপে ধাপে গণবন্টন ব্যবস্থাকে তুলে দিতে চাইছে। এফসিআই’এর জন্য বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আধার সংযোগের নামে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের নাম রেশন থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনাহার মৃত্যুর খবর উঠে আসছে। এই কেন্দ্রীয় নীতির পাশাপাশি রাজ্যে তৃণমূল সরকারেরও ভিন্ন কোনো খাদ্য কর্মসূচি নেই। তাই আজ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছে দাবি উঠেছে,

   • রেশনে প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৩৫ কেজি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করতে হবে।      
   • রেশনে চাল, গম, চিনি, তেল, সব্জি, দুধ সরবরাহ করতে হবে।      
   • রেশন কার্ডে আধার সংযোগ করা চলবে না।      
   • চাষিদের থেকে কমদামে কিনে বাজারে সব্জি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে কেন সরকার জবাব দাও।      
   • ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে আলু পেঁয়াজ সহ সমস্ত ফসল সরকারকে কিনতে হবে, এবং ন্যায্যমূল্যে রেশনে সরবরাহ করতে হবে।      
   • খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করো।      
   • ভোটের আগে রান্নার গ্যাসের দাম কমানো হল কিন্তু পেট্রোপণ্যে চড়া হারে শুল্ক কমানো হল না কেন জবাব দাও।      
   • ঐতিহাসিক খাদ্য আন্দোলনের শহীদদের জানাই লাল সেলাম।

- জয়তু দেশমুখ

memory-of-ghadarin-memory

২৩ আগস্ট ২০২৩ ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে বাংলার লেখক শিল্পী সাংস্কৃতিক কর্মীদের পক্ষে ‘লাল-On’ ও ‘পশ্চিমবঙ্গ গণসংস্কৃতি পরিষদের’ আয়োজনে বিপ্লবী গণগায়ক ‘গদর স্মরণ’ অনুষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রথমে বক্তব্য রাখেন নিত্যানন্দ ঘোষ। নীলাঞ্জন দত্ত বক্তব্যর সাথে গদরকে নিয়ে ‘গণনাট্য মন্ডলীর’ ইংরাজি প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠ করেন। বক্তব্য ও গণসংগীত পরিবেশন করেন বিদ্যুৎ ভৌমিক। এরপর একে একে সংগীতের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বজবজ চলার পথের অভিজিৎ মন্ডল, অশোকনগর গণসংস্কৃতি পরিষদ শাখার বাবুনী মজুমদার, অমিত রায়, অসীম গিরী, অনিমেষ মজুমদার, শুভঙ্কর গোস্বামী, অঙ্কুর, ও লাল-On এর শিল্পীরা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন পরিষদের মধ্যমগ্রাম শাখার শোভনা নাথ। বক্তব্য রাখেন রাজা সরখেল ও অনুপম কাঞ্জিলাল। সভাঘরে উপস্থিত ছিলেন পরিষদের সভাপতি দেবাশিষ চক্রবর্তী, সম্পাদক সরিৎ চক্রবর্তী, সঙ্গীত শিল্পী অভিজিৎ বসু, অধিকার আন্দোলনের নেত্রী রাঙতা মুন্সী, জয়গোপাল দে সহ বিশিষ্ট ব্যাক্তিবৃন্দ। নীতীশ রায়ের বক্তব্য ও গানের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষিত হয়।

the-old-pension-schemenew-pension-scheme

পর্যাপ্ত পরিমাণ পেনশনের জন্য আন্দোলন সারা বিশ্বেই যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে সামনে আসছে, এবং তা আসছে নয়া-উদারবাদী নীতি চালু হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে এবং তার প্রয়োগের পরিণাম স্বরূপ; এই নয়া-উদারবাদী নীতি বৈশ্বিক পুঁজির কাছে হয়ে উঠেছে কেইনস পরবর্তী পর্যায়ে উদ্ভূত সংকট থেকে পরিত্রাণের এক সর্বরোগহর দাওয়াই। নয়া-উদারবাদী নীতি প্রবর্তনের সাথেই কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণার অবসানের শুরু হয়ে যায়। পেনশন-সহ সামাজিক নিরাপত্তার বেসরকারিকরণ পেনশন সংকটকে তীব্রতর করে তুলেছে। সুনির্দিষ্ট সুবিধা হিসাবে পেনশন প্রকল্পের ধারণার বিলোপ ঘটে কনট্রিবিউটরি বা মালিক ও কর্মচারী উভয়ের দান ভিত্তিক পেনশন প্রকল্পের প্রবর্তনের সঙ্গে। পেনশন-সহ সমগ্ৰ সামাজিক নিরাপত্তার ভার এখন বর্তেছে কর্মচারীদের ঘাড়েই। কর্মচারীদের প্রবীণ বয়সে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলছে সরকার ও নিয়োগকর্তারা। পেনশনের ইস্যুটা প্রবীণ বয়সে দারিদ্রের ইস্যু বৈ অন্য কিছু নয়।

পেনশন একটা রাজনৈতিক ইস্যু

দেশে কর্মচারীদের আন্দোলনের চাপ অসহনীয় হয়ে ওঠায় এবং বিজেপি শাসিত কেন্দ্র সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্ন এক ধারণা হাজির করাটা জরুরি হয়ে দেখা দেওয়ায় অবিজেপি শাসিত রাজ্য রাজস্থান, ছত্তিসগড়, ঝাড়খণ্ড, পাঞ্জাব ও হিমাচলপ্রদেশ পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রের মোদী পরিচালিত বিজেপি সরকার পেনশন তহবিল নিয়ন্ত্রক ও বিকাশ কতৃপক্ষের (পিএফআরডিএ) মাধ্যমে এই পদক্ষেপে বাধা সৃষ্টি করছে এবং তা করছে ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় পেনশন প্রকল্পের নামে ঐ সমস্ত কর্মচারীদের থেকে সংগৃহীত অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকার করে।

পেনশনের ইস্যুটা আর প্রান্তিক ইস্যু নয় এবং ২০২৪’র সংসদীয় নির্বাচনের আগে এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু হিসাবে তীব্রতর হয়ে উঠছে। উত্তরপ্রদেশ ও হিমাচলপ্রদেশের মতো কয়েকটা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে এটা এক বড় ধরনের রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলনের দাবি পূরণের লক্ষ্যে বিজেপি এবং অন্য দু’একটি দল ছাড়া বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলকেই পুরনো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিতে হয়ছিল। এই প্রেক্ষাপটেই অর্থমন্ত্রী তাঁর শেষ বাজেট বক্তৃতায় অর্থ সচিবের নেতৃত্বে একটা কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন যারা নয়া পেনশন প্রকল্পের ইস্যুগুলোকে খতিয়ে দেখবে এবং নয়া পেনশন প্রকল্পের উন্নতি সাধনের বিষয়টির বিবেচনা করবে, তা যদিও পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এমন একটা জল্পনা রয়েছে যে, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তেলেঙ্গানা রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার কিছু বেশি পরিমাণের পেনশন সহ উন্নত নয়া পেনশন প্রকল্পের ঘোষণা করতে পারে। সরকার যে পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনবে না, বর্তমানের নয়া পেনশন প্রকল্পে কিছুটা উন্নতিসাধনই করতে পারে এই ব্যাপারে সে তার অভীষ্টকে পরিষ্কার করে দিয়েছে।

নয়া-উদারবাদী যুক্তি এবং অতি মুনাফা

গড় আয়ু ১৯৪৭ সালে যেখানে ছিল ৩২ বছর ২০২০ সালে সেই আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বছরে, এই পটভূমিতে পেনশনের দাবি প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য থেকে রেহাই পাওয়ারই একটা প্রচেষ্টা। নয়া-উদারবাদী অর্থনৈতিক দর্শনে চালিত সারা বিশ্বের দেশগুলোই পেনশনের কারণে অর্থনীতির ওপর আর্থিক চাপকে কমাতে চাইছে একদিকে অবসর গ্ৰহণের বয়সকে বাড়িয়ে এবং অন্য দিকে পেনশনকে নিয়োগকর্তা ও কর্মচারীদের দান ভিত্তিক কন্ট্রিবিউটরি প্রকল্পে পরিণত করার মধ্যে দিয়ে। অঢেল মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে চালিত হয়ে বৈশ্বিক পুঁজি অনুসৃত এই দৃষ্টিভঙ্গি সামাজিক দিক থেকে দায়িত্ত্বজ্ঞানহীন ও অবৈজ্ঞানিক।

প্রবীণ মানুষদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান

ভারতীয় জনগণ তুলনামূলকভাবে তরুণ এবং ২০৫০ নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। আনুমানিক হিসাব বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনগণের ৩০ শতাংশ এবং ভারতীয় জনগণের ২০ শতাংশ প্রবীণ হয়ে গিয়ে পেনশনের উপর নির্ভরশীল হবেন। আনুমানিক হিসাব এটাও বলছে যে প্রতি বছর ৫০ লক্ষেরও বেশি জনগণ ৬০ বছরের অধিক বয়স্ক জনগণের সংখ্যায় যোগ দিচ্ছেন।

জাতীয় নমুনা সমীক্ষা অফিসের (এনএসএসও) রিপোর্ট জানাচ্ছে, ১৯৬১ সালে ভারতীয় জনগণের ৫.৬ শতাংশ ছিল ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, আর ২০২১ সালে ঐ অনুপাতটা এসে দাঁড়িয়েছে ১০.১ শতাংশে। ‘ভারতের এবং রাজ্যগুলির জনসংখ্যার পূর্বাভাস–২০১’ টেকনিক্যাল গোষ্ঠীর রিপোর্ট অনুসারে, ২০২১ সালে ভারতে প্রবীণ জনগণের সংখ্যা ছিল ১৩.৮ কোটি এবং ২০৩১ সাল নাগাদ ঐ জনসংখ্যার আরও বৃদ্ধি ঘটবে ৫.৬ কোটি।

পেনশন কোনো দাক্ষিণ্য নয়, বরং একটা অধিকার

সরকার বলছে যে প্রবীণ বয়সের জনগণ এমন একটা দুর্বহ ভার যা অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। কিন্তু তার নিজেরই প্রবীণ বয়সের কর্মচারীদের প্রতি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সরকার নীরবই থাকে। তার কর্মচারীদের প্রবীণ বয়সের ইস্যুগুলোর দেখভালের দায়িত্ব সরকারেরই। এই জনগণই তো তাদের যৌবন কালে দেশ ও সরকারের সেবা করেছে। আর তাই তাদের প্রবীণ বয়সে এক ভালো মানের ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রদানে সরকার দায়বদ্ধ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো যে সরকারও মুনাফার মনোভাব নিয়ে চালিত হচ্ছে এবং প্রবীণ বয়সের কর্মচারীদের দেশ ও জনগণের করের উপর এক ভার বলে গণ্য করছে।

আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) সুস্পষ্ট ভাবেই বলেছে যে কর্মচারীদের দেয় পেনশন কোম্পানি বা সরকার প্রদত্ত কোনো দাক্ষিণ্য নয়, এটা কর্মচারীদের অধিকার। নিজেদের শ্রমের বিনিয়োগ থেকেই এই সুবিধা কর্মচারীদের প্রাপ্য। তাদের সম্মতি ছাড়া এর থেকে তাদের বঞ্চিত করা বা অন্য অভিমুখে চালিত করা যাবে না। পেনশন হল কর্মচারীদের বেতনের সেই অংশ যেটা কাজে নিয়োজিত থাকার সময় তাদের দেওয়া হয়নি। এ সত্ত্বেও সরকার সুনির্দিষ্ট সুবিধার পেনশন প্রকল্পকে সরিয়ে তার স্থানে কনট্রিবিউটরি বা মালিক ও কর্মচারীর দান ভিত্তিক পেনশন প্রকল্পের পরিকল্পনা ছকে যা ২০০৪ সাল থেকে কর্মচারীদের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলির জন্য অসুরক্ষিত ভবিষ্যতের সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার কর্মচারীদের অধিকার অস্বীকার করে চলেছে এবং জবরদস্তি তাদের ভবিষ্যতকেও ছিনিয়ে নিচ্ছে।

পুরনো পেনশন প্রকল্প বনাম নয়া পেনশন প্রকল্প : সুবিধা বনাম মালিক ও কর্মচারীর অর্থ দান

নয়া পেনশন প্রকল্প সেই সমস্ত কর্মচারীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যারা ২০০৪ সাল থেকে সরকারি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের কাজে যোগ দিয়েছে। পুরনো পেনশন প্রকল্পে পেনশন হিসাবে শেষ লাভ করা বেতনের ৫০ শতাংশ পাওয়াটা কর্মচারীদের কাছে সুনিশ্চিত ছিল। যে কাজ তাঁরা ৬০ বছর পর্যন্ত করেছেন তার জন্য প্রদত্ত শ্রম হলো তাঁদের বিনিয়োগ এবং পেনশন তহবিলের জন্য আলাদা করে কোনো অর্থ তাঁদের দিতে হতো না। পেনশনকে প্রাপ্য একটা সুবিধা হিসাবে গণ্য করা হতো এবং কর্ম জীবনে কৃত কাজের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ পেনশন কর্মচারীদের দেওয়া হতো। ধরা যাক, কোনো কর্মচারী অবসর গ্ৰহণের আগে শেষ মাসিক বেতন পেলেন ৩০,০০০ টাকা, সে ক্ষেত্রে প্রতি মাসে তাঁর লব্ধ পেনশন হতো ১৫,০০০ টাকা, এবং তার সঙ্গে লভ্য হতো মূল্যস্ফীতি জনিত মহার্ঘ ভাতা এবং সব মিলিয়ে প্রাপ্য পেনশন ধরা যাক হতো ২০,০০০ টাকা। এই পরিমাণ অর্থ প্রবীণ নাগরিককে বৃদ্ধ বয়সে দারিদ্রের হাত থেকে বাঁচাত।

কিন্তু নয়া পেনশন প্রকল্প হল কন্ট্রিবিউটরি প্রকল্প যাতে ২০০৪ সাল থেকে কাজ করা কর্মচারীদের তাঁদের বেতনের দিতে হয় ১০ শতাংশ, আর সরকার দেয় ১৪ শতাংশ। এর বিনিময়ে কর্মচারীরা বছরে ১০ শতাংশেরও কম সুদ পান। এর পিছনে বিভিন্ন কারণও কাজ করে, যথা, জমা করা টাকার পরিমাণ, অর্থ বাজারের খামখেয়ালিপনা, কত বছর কাজ করা হয়েছে, ইত্যাদি।

নয়া পেনশন প্রকল্প তহবিলের তত্ত্বাবধান করে দেশি এবং বিদেশী তহবিল পরিচালকরা। এই টাকা খাটানো হয় ফাটকাবাজির অর্থ বাজারে। ইউটিআই’এর ২৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে এমন এক বিদেশী আর্থিক কোম্পানির হাতে এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্যগুলো সামনে আসছে। শেয়ার বাজারে খাটানো পেনশন তহবিল থেকে পাওয়া লাভ ওঠানামা করে এবং তাতে কখনো কখনো এমনকি লোকসানও হয় এবং কর্মচারীদের শেষমেষ দেওয়া পেনশনে তা জোরালো ছাপ ফেলতে পারে। তহবিল পরিচালক কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পড়লে তার ধাক্কাটা কর্মচারীদেরই সইতে হয়। এরজন্য সরকার কর্মচারীদের কোনো গ্যারান্টি দেয় না, কোম্পানিগুলো যদিও তা পেয়ে থাকে।

নয়া পেনশন প্রকল্পকে এমনভাবে ছকা হয়েছে যাতে প্রদেয় পেনশন নির্দিষ্ট কর্মচারীর কর্মজীবনে সঞ্চিত ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত অর্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয় এবং অবসর গ্ৰহণের পর তাদের প্রয়োজন ও সমস্যার দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া হয় না। নয়া পেনশন প্রকল্পের বেশ কিছু ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কর্মচারীরা ১০০০ থেকে ২০০০ টাকার বেশি পেনশন পাচ্ছেন না। ২০২২’র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নয়া পেনশন প্রকল্পের অধীনে নথিবদ্ধ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং রাজ্য সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২২.৭৪ লক্ষ এবং ৫৫.৪৪ লক্ষ।

সরকারি কর্মচারীরা, বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্মের কর্মচারীরা ভবিষ্যৎ অবসর জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হবেন। এবং তা মূলত নয়া পেনশন প্রকল্পের অধীনে প্রাপ্য যৎসামান্য পেনশনের জন্য। পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার দাবি তাঁদের প্রবীণ, ‘অনুৎপাদনশীল’ জীবনে দারিদ্র্য প্রশমনের দাবি ভিন্ন অন্য কিছু নয়। এই দাবি শেষ পাওয়া বেতনের ৫০ শতাংশ পেনশন ও তার সাথে মহার্ঘ ভাতা লাভের দাবি যাতে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতি পুষিয়ে যায়। যে কর্মচারীরা ২০০৩’র পর কাজে যোগ দিয়েছেন তাঁরাই হলেন পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ের মেরুদণ্ড। সরকার তরুণ কর্মীদের দাবিতে গুরুত্ব না দিলে তার ফল তাদের ভোগ করতে হবে।

কর্মচারীদের পেনশন প্রকল্প (ইপিএস)

প্রভিডেন্ট ফান্ডের অধীনে আরেকটা পেনশন প্রকল্প রয়েছে যার আওতায় রয়েছে মূলত বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মচারীরা এবং যারা ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত বেতন পায়। তারা পেনশন তহবিলে বেতনের ১২ শতাংশ দেয় এবং মালিকও ঐ একই পরিমাণ অর্থ তাদের অ্যাকাউন্টে জমা করে। শ্রমিক এবং পরিচালক কর্তৃপক্ষ মিলে যে ২৪ শতাংশ অর্থ জমা করে তার ৮.৩৩ শতাংশ যায় পেনশন তহবিলে এবং বাকিটা অবসর গ্ৰহণের পর কর্মচারীকে সুদসহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ব্যাপক সংখ্যাধিক কর্মচারীই ১০০০ টাকার ন্যূনতম পেনশনই পাচ্ছেন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য মোকাবিলায় পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে থাকেন। এক ভদ্রস্থ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য পেনশন বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনাই সরকারের নেই।

অটল পেনশন যোজনা (এপি ওয়াই)

মাসে ১০০০ থেকে ৫০০০ টাকা পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অটল পেনশন যোজনা চালু হয়েছিল। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের এই পেনশন প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য পেনশনের প্রতিশ্রুতি ছিল তহবিলে শ্রমিকের দান করা অর্থের বিবেচনায় ১০০০ টাকার কয়েক গুণ। এই প্রকল্পে যোগদান করতে পারে ১৮ থেকে ৩৯ বছর বয়স্ক পর্যন্ত শ্রমিকরা এবং তাদের অন্তত ২০ বছর পেনশনের অর্থ মাসে দিয়ে যেতে হয়। শ্রমিকের বয়স ৪০ বা তার বেশি হলে তারা এই প্রকল্পে যোগদান করতে পারে না। কোনো শ্রমিক ৫০০০ টাকা পেনশনকে বেছে নিলে তাকে মাসে ২১০ টাকা (১৮ বছর বয়স্ককে দিয়ে যেতে হবে ৪২ বছর) এবং ১৩১৮ টাকা (৩৯ বছর বয়স্ককে দিয়ে যেতে হবে ২১ বছর) পেনশন প্রকল্পে দান করতে হবে।

এনপিএস-লাইট হল অসংগঠিত শ্রমিকদের পেনশনের আওতায় আনার আর একটা প্রকল্প।

এই প্রকল্পগুলিতে পেনশনকে বেছে নেওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা ২০১৮’র জুলাইয়ে দাঁড়িয়েছিল ১.৫৭ কোটিতে। এ সত্ত্বেও তারা ছিল দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মোট সংখ্যা ৩৯.১৪ কোটির (২০১১’র জনগণনা অনুসারে) মাত্র ৪ শতাংশ।

কাজে যুক্ত থেকেও দারিদ্র্য

দেশে শ্রমশক্তির বৃদ্ধি ক্রমান্বয়ে হয়ে চলেছে অবিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে এবং তার পরিমাণ ৯৩ শতাংশ; এঁরা কিন্তু এমন নিরাপদ বা উৎকৃষ্ট কাজ ও মজুরি পান না যা দিয়ে তাঁরা ভবিষ্যতে পেনশন লাভের জন্য অর্থ দান করতে পারেন, এবং এটা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। এই বিষয়টার বিহিত একমাত্র হতে পারে অপর্যাপ্ত মজুরি এবং ক্রমবর্ধমান বেকারির নিষ্পত্তি এবং এইভাবে দেশের শ্রমজীবী জনগণের দারিদ্রের কিনারা করে। ছদ্ম বেকারি অসংগঠিত শ্রমশক্তির কাছে একটা বড় ধরনের সমস্যা। সামাজিক, সুবিধাধর্মী বা দান ভিত্তিক পেনশন সমস্যার সমাধান হতে পারে না যদি না সরকার উপরিউল্লিখিত বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান করে। কর্ম জীবনে দারিদ্র প্রশমনের নীতিই প্রবীণ, পেনশন লাভের বয়সে দারিদ্র সমাধানের উপায় হতে পারে। দেশীয় এবং বৈশ্বিক পুঁজি উভয়েই মৌলিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় দেশ ও দেশের জনগণের সমৃদ্ধি হতে পারেনি।

সামাজিক পেনশন

মোদী নেতৃত্বে চালিত বিজেপি সরকারের দাবি হলো তারা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পেনশনের আওতায় নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই সমস্ত প্রকল্পে যে পরিমাণ পেনশন দেওয়া হচ্ছে তা কয়েক হাজারের বেশি নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাত্র এক হাজার। দেশের যে কোনো মানুষের একটু ভালো জীবন যাপনের পক্ষে যে পরিমাণটা একেবারেই নগন্য।

অপরদিকে সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব এখন আর নিয়োকর্তাদের বা সরকারের ওপর নেই, সামাজিক নিরাপত্তা কোড’এর প্রবর্তনের সঙ্গে তা এখন বর্তেছে প্রতিটি শ্রমিকের ওপরই যা এখন রূপায়ণের অপেক্ষায়।

পেনশনের সমস্যা দেশের দারিদ্র, বেকারি এবং মজুরির স্তরের সঙ্গে জটিল সম্পর্কে যুক্ত যা নির্দিষ্ট শ্রমিকের জীবনে তার নিজস্ব ধারায় প্রভাব ফেলে। যে সামাজিক পেনশন প্রতিটি শ্রমিককে একটা ন্যূনতম মাত্রার পেনশন দেয় তার কোনো বিকল্প হতে পারে না। বেশ কিছু অনুসন্ধান ও গবেষণায় দেশ, অর্থনীতি এবং পেনশন প্রাপকদের জীবনের উন্নতিতে সামাজিক পেনশন ব্যবস্থার প্রগতিবাদী ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যদি অবশ্য সরকার পরিকল্পনা করে তার যথাযথ রূপায়ণ ঘটায়। অতএব প্রবীণ বয়সে কর্মীরা যখন কাজ করবে না সেই সময় তাদের কল্যণের ব্যয় বহনের পরিকল্পনা সরকারকে করতে হবে। কর্মীদের কাঁধে বোঝাটা চাপালে তা দেশের অর্থনীতির অর্থনৈতিক কল্যাণের ওপরই চাপ সৃষ্টি করবে, যদি না সরকার মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য পর্যাপ্ত পেনশনের ব্যবস্থা করে।

বৈশ্বিক পেনশন সূচক

এই বিষয়ে ভারতের রেকর্ড একেবারেই নিকৃষ্ট। মার্সার এবং সিএফএ ইনস্টিটিউট ২০২২’র অক্টোবরে ৪৪টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের ১৪তম বার্ষিক মার্সার সিএফএ বিশ্ব পেনশন সূচক প্রকাশ করে। এই রিপোর্টের শীর্ষে ছিল আইসল্যান্ড, এবং সবচেয়ে নীচে ছিল থাইল্যান্ড। এই ৪৪টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল নীচের দিকে, ৪১তম। একেবারে ওপরের পাঁচটা দেশ ছিল আইসল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইজরায়েল ও ফিনল্যান্ড, আর নীচের পাঁচটা দেশ ছিল তুরস্ক, ভারত, আর্জেন্টিনা, ফিলিপাইন্স ও থাইল্যান্ড।

ডব্লিউটিডব্লিউ এবং থিংকিং এহেড ইনস্টিটিউট’এর তৈরি করা ‘বিশ্ব পেনশন সম্পদ সমীক্ষা ২০২৩’এ বলা হয়েছে, বিশ্বে পেনশন সম্পদের সাতটা বৃহত্তম বাজার হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের ৯২ শতাংশ পেনশন সম্পদ রয়েছে এই সাতটা দেশে। এই সাতটা দেশেই পেনশনের বৃহত্তম বাজারগুলো কেন্দ্রীভূত এবং বৈশ্বিক পুঁজি বাকি পেনশন বাজারগুলোতে নিজেদের সম্প্রসারিত করা ঢোকার পরিকল্পনা করছে। আর সেই লক্ষ্যেই ভারত-সহ সারা বিশ্বেই পেনশন সংস্কারে জোর পড়ছে পেনশন পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করা এবং সেই ধারায় বাজারগুলোকে সম্প্রসারিত করা। এই লক্ষ্যে অগ্রাধিকারে রয়েছে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো। মোদী সরকার যে অসংগঠিত ক্ষেত্রের সুবিশাল শ্রমশক্তিকে পেনশন এবং অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তার জালে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে তার লক্ষ্য হলো দেশের অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তির মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমানো ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলোকে একত্রিত করে পুঞ্জীভূত পুঁজি দিয়ে এক আর্থিক পরিকাঠামো নির্মাণ করা, আর এটাকেই ঘুরিয়ে অভিহিত করা হচ্ছে সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা বলে। সামাজিক নিরাপত্তা কোড আসলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুঁজি পুঞ্জীভূত করে ধনী ও ক্ষমতাবানদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার হাতিয়ার ভিন্ন অন্য কিছু নয়।

সংগ্রামের হিল্লোলিত তরঙ্গমালা

পেনশন সংস্কার আজ শ্রমিক শ্রেণীর সামনে মোকাবিলার এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে উঠেছে। অতি সম্প্রতি অবসর গ্ৰহণের বয়স বৃদ্ধি এবং পেয়ে আসা সুবিধাকে হ্রাস করার বিরুদ্ধে ফ্রান্সে ফেটে পড়ল লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সহিংস প্রতিবাদ। পেনশনের ইস্যুতে গোটা ইউরোপই আজ অশান্ত।

ভারতেও আমরা নয়া পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে এবং পুরনো পেনশন প্রকল্পকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিভিন্ন মঞ্চ পরিচালিত একগুচ্ছ আন্দোলন দেখতে পাচ্ছি। পুরনো পেনশনকে ফিরিয়ে আনার জাতীয় আন্দোলন (এনএমওপিএস) দিল্লীতে ১ অক্টোবর ২০২৩ এক বিশাল প্রতিবাদ সংগঠিত করার কথা ঘোষণা করেছে এবং তারা বিহারের চম্পারণ থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। এই এনএমওপিএস’এর মধ্যে রয়েছে রেলে নয়া পেনশন প্রকল্পের বিরুদ্ধে ফ্রন্ট (এফএএনপিএসআর), যারা কয়েক বছর ধরেই পেনশন আন্দোলনের এক পুরোধা হয়ে রয়েছে। রেলকর্মীদের এক বিকল্প মঞ্চ ভারতীয় রেলকর্মী ফেডারেশনও (আইআরইএফ) এমএনওপিএস’কে সমর্থন জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ইউনিয়নগুলোর মঞ্চ কিছুটা দেরিতে আন্দোলনে যুক্ত হলেও তারা পুরনো পেনশন প্রকল্প পুনরুদ্ধারের যৌথ মঞ্চর (জেএফআরওপিএস) পতাকাতলে তাদের দাবিকে তুলে ধরতে ১০ আগস্ট ২০২৩ দিল্লীতে এক বিশাল জনসমাবেশ সংগঠিত করে।

ইপিএস’এর অধীনস্থ পেনশন প্রাপকদের সংগঠনগুলোও একদিনের ধর্মঘট সংগঠনের জন্য কোমর বাঁধছে, যে ধর্মঘট হবে দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে সহযোগিতায় এবং ইউনিয়নগুলো যে একদিনের সারা ভারত ধর্মঘটের ডাক দেবে তার সাথে সমাপতন ঘটিয়ে। ২০২৩’র ডিসেম্বরে রেল ও রাস্তা অবরোধ সংগঠিত করার প্রস্তাবও উঠেছে। দেশে পেনশন আন্দোলন ধীরে কিন্তু ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছে।

– ভি শঙ্কর, লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যা থেকে

mineral-resources-behind-the-communal-conflictcommunal-conflict

মণিপুরে মেইতেই ও কুকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘর্ষের সূত্রপাতে যে মণিপুর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির এক রায়ের গুরুতর ভূমিকা থেকেছে তা এক স্বীকৃত তথ্য। সুপ্রিম কোর্ট মণিপুর হাইকোর্টের ঐ রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়েছে ঠিকই, তবে বিচারপতি এস ভি মুরলিধরণের রায়ের তাৎপর্য ছিল সুগভীর এবং ডাবল ইঞ্জিনের সরকার মণিপুরে যে সংখ্যাগুরুবাদী প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় নিজেদের চালিত করছিল ঐ রায় তাতে আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল। মেইতেইরা কুকি-নাগাদের বসবাসের অঞ্চল পার্বত্য জেলাগুলোতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ ছিল এবং মেইতেইদের জনজাতি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিচারপতি মুরলিধরণের রায় মেইতেইদের সেই লক্ষ্য পূরণের এক অবলম্বন হয়ে দেখা দিয়েছিল। জনজাতির মর্যাদা পেলে মেইতেইরা পার্বত্য অঞ্চলের জমি কিনতে পারত এবং তার সাথেই পেত যথেষ্ট খনিজ সম্পদের অধিকার। মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে রয়েছে বিপুল পরিমাণ লাইমস্টোন, ক্রোমিয়াম, নিকেল, তামা, প্লাটিনাম ও অন্যান্য ধাতুর সঞ্চয়, এবং সেই ধাতুর ওপর শিল্পপতিদের নজরও কম নয়। পার্বত্য অঞ্চলে খননের অনুমতি দানের অধিকার বিধানসভার নেই, রয়েছে আদিবাসী পার্বত্য পরিষদের হাতে। নরেন্দ্র মোদী সরকার অনেক দিন ধরেই এই খনিজ সম্পদ বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও আদিবাসী পার্বত্য পরিষদ তাদের সঙ্গে খননের চুক্তিতে আবদ্ধ হতে খুব একটা আগ্ৰহ দেখায়নি। মেইতেইরা জনজাতির মর্যাদা লাভ করলে কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে খনিজ সম্পদ উত্তোলনের অধিকার দেওয়ার পার্বত্য পরিষদের অসম্মতিকে কোণঠাসা করা যেত এবং মেইতেইদের মাধ্যমে মণিপুর পার্বত্য অঞ্চলের খনিজ সম্পদ মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়াটা অনায়াস হত।

রাজ্যের খনিজ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করার জন্য মোদী নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৫ সালে, ১৯৫৭ সালের খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইনে সংশোধন আনে। ঐ সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্র খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ জমির ওপর আদিবাসী বা স্থানীয় জনজাতিদের অধিকারকে খর্ব করতে সক্রিয় হয় এবং বনজ ও খনিজ সম্পদ প্রসঙ্গে রাজ্যগুলোর অধিকারকে গুরুত্বহীন করে তুলে তাদের কেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। ঐ আইনে ২০২১ সালে পুনরায় সংশোধনী এনে ২০০৬ সালের বন নিয়ন্ত্রণ আইনকে গুরত্বহীন করে তোলা হয়, এবং খনিজর অন্বেষণ চালানো ও খননের ছাড়পত্র লাভকে সহজসাধ্য করা হয়। গত ১ আগস্ট ২০২৩ সবরং সংবাদ পোর্টালে ঐ সংশোধনীগুলি সম্পর্কে এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, “এই সংশোধনী গ্যাস, তেল এবং অন্যান্য খনিজ আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথেই খনন কাজে হাত দেওয়ার অধিকার দেয়। ২০২১ সালের আইন গ্রামসভার নিজস্ব অঞ্চলে খননে অনুমতি দেওয়া বা খনন বন্ধের নির্দেশ দেওয়ার গ্রামসভার ক্ষমতাকে চূড়ান্তরূপে লঘু করে তুলেছে। এইভাবে, ২০১৫ ও ২০২১ সালের সংশোধনী আইনগুলো কেন্দ্রের প্রতিনিধিত্ব ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে, খননের কোম্পানিগুলোকে আরও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং যে সম্প্রদায়গুলো সম্পদের মালিক ছিল তাদের অধিকারচ্যুত করেছে।” অতএব, খননে যুক্ত ও তাতে আগ্ৰহী কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সুবিধার লক্ষ্যেই যে খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হয়েছিল তা সহজেই বোধগম্য।

behind-the-communal-conflict

মোদী সরকার সম্প্রতি সংসদে পাশ করিয়েছে সংশোধিত অরণ্য আইন। বিশেষ আলোচনা ছাড়াই সাংসদ সংখ্যার জোরে পাশ করানো হয়েছে ঐ বিল। পরিবেশ রক্ষায় অভিজ্ঞ ও সচেতন ব্যক্তিরা সংশোধিত ঐ আইনে কর্পোরেট চালিত কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংহারের, অরণ্যে জীব-বৈচিত্র্যের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। দেশের সীমান্ত থেকে একশ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় কেন্দ্র সরকার জাতীয় নিরাপত্তার যুক্তিতে নিজের কর্তৃত্ব চালাবে। এই আইনে নিরাপত্তা ও উন্নয়ন তথা কর্পোরেট তোষণের নামে প্রকৃতির ধ্বংসযজ্ঞের আয়োজন কেমন হয়েছে তা অনুধাবনের জন্য আমরা এখানে ‘ঔদাসীন্যের পরিবেশ’ শীর্ষক আনন্দবাজার পত্রিকার ২ আগস্টের সম্পাদকীয়র অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, “দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা, যেমন মণিপুর-সহ উত্তর-পূর্ব ভারত বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ পার্বত্য আরণ্যক অঞ্চল এবং জৈব বৈচিত্র্যের অতুলনীয় ভান্ডার হিসাবে স্বীকৃত। উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষার যুক্তিতে এই ভান্ডারগুলি যথেচ্ছ ধ্বংস করা হবে — এই আশঙ্কাতেই পরিবেশ সচেতন প্রতিবাদীরা শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন।”

গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কর্পোরেটদের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ, এবং কেন্দ্রে এসেও তিনি সারা দেশেই গুজরাট মডেলকে প্রয়োগ করে চলেছেন। আর তাই ক্রোনিইজম বা স্যাঙাতি পুঁজিবাদ মোদী সরকার চালিত অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। তাঁর সরকারের ছত্রছায়ায় হাতে গোনা কয়েকজন পুঁজিপতির অর্থবলের ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটে চলেছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে অতি সস্তায় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এলাকার ওপর স্থানীয় জনগণের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে দেশের সম্পদকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই যে ২০১৫ ও ২০২১ সালে খনি ও খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন হয়েছিল এবং অতি সম্প্রতি সংশোধিত অরণ্য আইনকে পাশ করিয়ে নেওয়া হলো, তার অনুধাবনে বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজন নেই। বি আর আম্বেদকরের পৌত্র, বঞ্চিত বহুজন আগাদির সভাপতি প্রকাশ আম্বেদকর সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদে সাংবাদিকদের বলেছেন, যেহেতু কুকি জনজাতিরা বেসরকারি সংস্থাগুলোকে তাদের এলাকায় খননের অনুমতি দিতে অস্বীকার করছে, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাই উসকিয়ে তুলল মেইতেইদের জনজাতি সংরক্ষণের ইস্যুটাকে। তাঁর নির্দিষ্ট অভিযোগ হলো, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শিল্পপতি বন্ধু আদানিকে সরকার প্লাটিনাম খননের অধিকার দিতে চায়। এবং মণিপুরের ঘটনাবলীর বিকাশ খননের চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই একটা কৌশল।” তবে, শুধু প্রকাশ আম্বেদকরই নন, আরও অনেকই মণিপুরের সহিংস ঘটনাবলীর পিছনে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের এই নিকৃষ্ট মতলবকে দেখতে পেয়েছেন। জুলাই মাসের শেষে ‘মনিপুরের মিত্ররা’ নামে এক নাগরিক সংগঠনও বান্দ্রাতে এক জনসভায় ঐ ধরনের অভিমত প্রকাশ করে। ঐ জনসভায় বরিষ্ঠ আইনজীবী মিহির দেশাই বলেন, “মণিপুরের খনিজ সম্পদ ও গ্যাসের সঞ্চয়ে বিশিষ্ট শিল্পপতিরা আগ্ৰহী, এবং খনিজ সম্পদ, গ্যাস ও ধর্মের মতো বিভিন্ন বিষয়ের সংমিশ্রণকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা উসকিয়ে তোলা হচ্ছে।” সেদিনের জনসভার একটা রিপোর্টও প্রকাশিত হয় ৩০ জুলাইয়ের টাইমস অব ইন্ডিয়া সংবাদপত্রে। ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “তাঁরা (জনসভার বক্তারা) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, পার্বত্য রাজ্যটির খনিজ সম্পদ এবং গ্যাস সঞ্চয়ের ওপর বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের নজর পড়েছে এবং জাতিগত সংঘাতে প্ররোচনা দেওয়া হচ্ছে যার পিছনে সম্ভাব্য অভিপ্রায় হলো জমি গ্রাস।” এইভাবে আইনে সংশোধন এনে এমন রূপ দেওয়া হচ্ছে যাতে কর্পোরেটরা অনায়াসে খনিজ ও অরণ্য সম্পদ হাতাতে পারে।

ওপরে আমরা দেখলাম, কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মণিপুরে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষের পিছনে নরেন্দ্র মোদী সরকারের দুরভিসন্ধিকে দেখতে পেয়েছেন। মণিপুরের খনিজ সম্পদের ওপর কর্পোরেটদের অধিকার প্রদানের লক্ষ্যে, বিশেষভাবে মোদীর প্রিয় শিল্পপতি আদানির প্লাটিনাম খননের অধিকারকে অনায়াসলভ্য করতে সুপরিকল্পিতভাবে হিংসাকে উসকিয়ে তোলা হচ্ছে বলে তাঁদের অভিমত। মোদী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ব্যক্ত তাঁদের এই বক্তব্যকে একেবারে ভিত্তিহীন বলা যাবে না।

- জয়দীপ মিত্র

expansion-of-bricsnew-geopolitical-layout

ব্রিকস গোষ্ঠীতে এ’যাবৎ ছিল ৫টি দেশ। চিন, রাশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত। এরসঙ্গে যুক্ত হল আরো ছ’টি দেশ — সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমীরশাহী, আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া ও মিশর। এই সংযুক্তির মধ্যে দিয়ে ব্রিকস সদস্যভূক্তদের মোট জনসংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ৩৭০ কোটি। সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমীরশাহীর অংশগ্রহণ ব্রিকসের নিজস্ব ব্যাঙ্কিং অর্থনীতিকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি পুষ্ট করবে। এতদিন অবধি ব্রিকস ব্যাঙ্ক চিনের ওপরেই বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল ছিল।

নয়া সংযুক্তিতে সবচেয়ে বেশি চমক নিঃসন্দেহে রয়েছে ইরানকে ঘিরে। ইরানকে আমেরিকা নানাভাবে কোণঠাসা করে রেখেছে এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক এতদিন অবধি অনেকটাই আমেরিকার মর্জির ওপর নির্ভর করত। ইরানের প্রতিবেশি দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক কয়েক দশক ধরেই অত্যন্ত তিক্ত এবং এর পেছনেও আমেরিকার ভূমিকা যথেষ্ট। বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবকে আমেরিকার পক্ষভুক্ত ও ঘনিষ্ট মিত্র বলেই মনে করা হয়। সৌদির অস্ত্রসম্ভারের সিংহভাগই আসে আমেরিকার থেকে। সম্প্রতি ইরানের সঙ্গে সৌদির একটি বৈঠক হয় চিনের রাজধানী বেইজিংএ। সেই বৈঠকের পর থেকে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে, যার পরিণতি দেখা গেল ব্রিকসের এই সম্প্রসারণে।

ব্রিকসের সম্প্রসারণ একদিকে যেমন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন বিন্যাসের সূচনা করতে চলেছে, তেমনি এর মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব আরো খর্ব হওয়া ও চিনের আরো প্রভাব বৃদ্ধির ইঙ্গিৎ দিচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমেরিকার নেতৃত্বাধীন একমেরু বিশ্বকে চিন বেশ কিছুদিন ধরেই চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ন্যাটোকে নিজেদের ইচ্ছেতে চালনা করার চেষ্টা করেও চিনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক প্রভাবকে আমেরিকার পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হয়নি। এশিয়া ও আফ্রিকায় ক্ষমতার ভারসাম্য এখন অনেকটাই চিনের দিকে ঝুঁকে আছে এবং তা ক্রমশ বাড়ছে। ব্রিকসে ব্রাজিলের পর লাতিন আমেরিকার আর এক শক্তিশালী দেশ আর্জেন্টিনার অন্তর্ভুক্তি লাতিন আমেরিকাতেও চিনের প্রভাব বৃদ্ধির সহায়ক হবে। কিউবা, ভেনেজুয়েলা সহ বেশ কিছু দেশ, যারা ব্রিকসের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাদের ওপর চিনের প্রভাব যথেষ্টই। চিনের সহায়তাতেই ভেনেজুয়েলায় মার্কিন কলকাঠিতে সৃষ্ট আর্থিক সঙ্কট ধীরে ধীরে কাটছে। গোটা বিশ্বে যে আবার নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস তৈরি হতে যাচ্ছে, সেটা অনেকদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ব্রিকসের প্রসার তাকে আরো স্পষ্টতা দিল।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সশরীরে এই সম্মেলনে হাজির ছিলেন না কিন্তু রুশ বিদেশমন্ত্রী লাভরভ এতে রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেন। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার অর্থনীতি সঙ্কটে পড়েছে। রাশিয়ার ওপর আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাশিয়া তার কাছাকাছি থাকা দেশগুলোকেই এই সময় সস্তায় তেল বিক্রি করছে এবং তাতে তারা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছে। এর অন্যতম ভারত। ব্রিকসের এই সম্প্রসারণ চিনকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করলেও ভারত এই সম্প্রসারণে সম্মতি দিয়েছে।

ব্রিকস ছাড়াও ভারত কোয়াডের সদস্য। কোয়াডের চারটি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। কোয়াড ও ব্রিকসের ভূ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ আলাদা ও অনেকক্ষেত্রেই বিপ্রতীপ এমনকী সাংঘর্ষিক। কোয়াড ও ব্রিকসের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলাটাই ভারতের বিদেশনীতির কাছে বড় পরীক্ষা হতে চলেছে।

- সৌভিক ঘোষাল

defeat-the-fascistfascist-rss-bjp

সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের ত্রিপুরা রাজ্য সম্পাদক পার্থ কর্মকার এক বিবৃতি বলেন, মোদী রাজত্বে গত ১০ বছরে দেশজুড়ে এবং ৬ বছরে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজত্বকালে রাজ্যে এক অভূতপূর্ব ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছে। যখন দেশের বৈচিত্র্যময় ও বহুত্ববাদী মৌলিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় সাধারণতন্ত্র, মুক্ত নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা সহ সংবিধানের প্রত্যেকটি ক্ষেত্র প্রতি মুহূর্তে আক্রান্ত ও অবদমিত করা হচ্ছে।

একদিকে যেমন মোদীর একনায়কতান্ত্রিক ও আগ্রাসী সরকার সহিংস হয়ে উঠেছে এবং অন্যদিকে আরএসএস ও সংঘ পরিবারের ধর্মান্ধ দুবৃত্ত বাহিনী সমাজজীবনে পরিকল্পিতভাবে লাগাতার সহিংসতা সংঘটিত করছে। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারা ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিষ ছড়ানোর ফলে আজ মণিপুর জ্বলছে। হরিয়ানা জ্বলছে। এর আগে গুজরাট জ্বলেছে, উত্তরপ্রদেশ জ্বলেছে। আগামীকাল সারা দেশ জ্বলবে। এমন অবস্থা স্বাধীনোত্তর দেশে আর কখনো দেখা যায়নি।

সুদীর্ঘ গৌরবময় স্বাধীনতা সংগ্রামের পরে আমরা এক স্বাধীন, মুক্ত, সাম্য, সমান মর্যাদা ও ন্যায়ের সংবিধান ও এক সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র অর্জন করেছি। আজ মোদী সরকারের আগ্রাসী ক্ষমতাকে আরো বিস্তৃত ও স্থায়ী করতে ও কর্পোরেট কোম্পানির হাতে দেশের সমস্ত সম্পদকে তুলে দিতে এক ধর্মান্ধ, গোলামী ও ত্রাসের রিপাবলিক নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সংবিধান তাদের সামনে প্রধান বাধা। তাই সংবিধানকে আস্তাকুঁড়ে ফেলতে হবে। সংবিধান নাকি ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য। তাই ঔপনিবেশিকতা মুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন অর্থনীতিবিদ বিবেক দেবরায় নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন। তিনি রাজতান্ত্রিক সেঙ্গল সহ নতুন সংসদ ভবনকে বিস্মৃত গৌরবের পুনর্জাগরণ হিসাবে তুলে ধরেছন। এই নয়া সংবিধান স্বাধীন ভারতের সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্রের ভিত্তিমূলে আঘাত ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একই যুক্তি দেখিয়ে আইপিসি প্রতিস্থাপন করেছেন ভারতীয় ন্যায় সংহিতা দিয়ে। যাতে ঔপনিবেশিক দানবীয় আইনগুলিকে আরো কঠোর ও অত্যাচারী করে তোলা হয়েছে। সেই কোভিড১৯ মহামারীর সময় থেকে সংসদীয় ব্যবস্থাকে ছিন্নভিন্ন করে কর্পোরেট কোম্পানির স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেছে। এর আগে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এমন বিদ্বেষমূলক প্রচার আর দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ও রায়কে বাতিল করা হয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), এনআরসি, ইউনিফর্ম সিভিল কোড, ইডব্লিউএস ইত্যাদি আজ দেশের নাগরিকদের প্রজায় পর্যবসিত করেছে।

গত ৬ বছরে রাজ্যে ডাবল ইঞ্জিন সরকারের রাজত্বে সংবিধান ও আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে। গত ৬ মাসে ৫৩ জন খুন হয়েছে। লিঙ্গ আধিপত্য, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও পাচার বেড়েছে। চুরি, ছিনতাই, দুর্নীতি ও তোলাবাজি কয়েকগুণ বেড়েছে। যুব সমাজ ড্রাগের নেশায় ভাসছে। ‘রেগা’ প্রকল্পের সংকোচনের ফলে গ্রামে পাহাড়ে কাজ ও খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। সামাজিক ভাতা মাসের পর মাস বন্ধ। সরকারি চাকরি নেই। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ ও ক্ষতির শিকার হচ্ছেন সংখ্যালঘু মুসলিম ও আদিবাসী জনজাতি মানুষেরা। টিটিএডিসিকে আর্থিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও ভিলেজ কমিটির নির্বাচন করা হচ্ছে না। দখলকৃত বনজমির পাট্টা দেওয়া বন্ধ। ককবরক ভাষায় রোমান হরফ চালু করার দাবির প্রশ্নে সরকার নীরব। রাইয়াবাড়িতে বুলডোজার সহযোগে ৭টি মুসলিম পরিবারের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজও ন্যায়বিচার পায়নি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। গণতন্ত্র আক্রান্ত। রাজ্যে বুলডোজার রাজ চলছে।

দেশ ও জাতি আর কখনো এমন বিপর্যয়কর অবস্থার সম্মুখীন হয়নি। তাই এখন দেশকে রক্ষা করা, দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করা আজ দেশের নাগরিকদের সামনে প্রধান কর্তব্য। কাজেই এত বড়ো বিপদ ও বিপর্যয়ের মোকাবেলা করা কারোর একার পক্ষে সম্ভব নয়। সবাই মিলে লড়তে হবে। তাই সময়ের দাবি অনুসারে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সারা দেশে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচনে দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মোদী রাজকে যেকোন মূল্যে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। এই লক্ষ্যে ও প্রেক্ষাপটে এই উপনির্বাচন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই উপনির্বাচনে দু’টি আসনে বিজেপিকে পরাস্ত করে সারা দেশকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করার বার্তা দিতে হবে। তাই সমস্ত অবিজেপি দলগুলিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করা আজ সময়ের দাবি। বাস্তবে এর প্রতিফলনও ঘটেছে।

প্রধান বিরোধী দল তিপ্রা মথা ও জাতীয় কংগ্রেস দল এই দুই আসনে প্রার্থী দেয়নি এবং আলোচনার মধ্য দিয়ে এই দুটি আসনে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের সক্রিয় সমর্থন দিয়েছে। সিপিআই(এমএল) ‘ইন্ডিয়া’ জোটের অন্যতম শরিক। অতএব সিপিআই(এমএল), ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি এই উপনির্বাচনে বিরোধীদের সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী ২০, বক্সনগর আসনে মিজান হোসেন এবং ২৩, ধনপুর আসনে কৌশিক চন্দ’কে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ ও ভয়মুক্ত পরিবেশে ভোটাররা যাতে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নির্বাচন কমিশনকে তার জন্য সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

পাশাপাশি নির্বাচনী সংগ্রামের ময়দানে এই একতাকে আরো সংহত ও শক্তিশালী করে তুলতে সবকটি বিরোধী দলের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে সিপিআই(এমএল)। ২০২৪’র লক্ষ্যে রাজ্যে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে সত্যিকার অর্থে আরো শক্তিশালী, সংহত ও বিস্তৃত করে তুলতে হবে। কারণ সংবিধান না থাকলে আগামীদিনে কারোর অস্তিত্ব থাকবে না।

=== 000 ===

খণ্ড-30
সংখ্যা-30