আজকের দেশব্রতী : ১০ আগস্ট ২০২৩ (অনলাইন সংখ্যা)
https://www.ba.cpiml.net/conference-of-aisaall-india-conference-of-aisa

১০ আগস্ট শহিদ বেদিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে শুরু হল এই সর্বভারতীয় সম্মেলন। এআইএসএফ, এসএফআই, পিএসইউ, এআইডিএসও থেকে ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র সংগঠন এই সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে আমন্ত্রিত ছিল। তারা প্রত্যেকেই মোদীর ফ্যাসিবাদী রাজের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের উপর জোর দেন।

এই সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন পার্টির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রতিনিধিদের স্বাগত জানিয়ে তিনি এই আশা প্রকাশ করেন যে আগামী দিনে দেশজুড়ে সর্বত্র আইসার উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। আইসা’র জন্ম, তার গড়ে ওঠার পেছনে যে নির্দিষ্ট ধারা, ইতিহাস, এক বিপ্লবী ঐতিহ্য রয়েছে তা তিনি স্মরণ করে বলেন, আজ আইসার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মোকাবিলা করে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। যখন সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়, চিনে ঘটে যায় তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ারের ঘটনা, যখন দুনিয়া জুড়ে মার্ক্সবাদ, লালঝান্ডা ও বামপন্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠতে শুরু করে, ঠিক সেই সন্ধিক্ষণেই জন্ম নেয় আইসা। সেই সময় দেশেরই বা কী পরিস্থিতি ছিল? আজ আমরা ফ্যাসিবাদের যে ভয়ঙ্করতম রূপ দেখছি, সেই সময়ই তার লক্ষণগুলো ফুটে ওঠে। রামমন্দির বিবাদ, রথযাত্রা, যেখান যেখান দিয়ে রথযাত্রা যায়, সেই সব জায়গা রক্তাক্ত হয় ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়। আইসা এই সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ভিপি সিং’এর মন্ডল কমিশনের বিরুদ্ধে যখন তীব্র ভাবে সংঘ পরিবার সংরক্ষণ বিরোধী ভাবাবেগে সবকিছু ভাসানোর অপচেষ্টা করে তখন আইসা এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংরক্ষণের পক্ষে দাঁড়ায়।

চন্দ্রশেখরের স্মৃতি তুলে ধরে সাধারণ সম্পাদক বলেন যে চন্দ্রশেখর দুই ভারতের ছবি তুলে ধরেন। তিনি যে মহান স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে শহিদ হয়েছেন, তাকে পূরণ করার লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে হবে। চন্দ্রশেখর মনে করতেন দুটো ভারত রয়েছে। একটা বিজেপির ভারত, সমস্ত পশ্চাদপদতাকে নিয়ে যা দেশকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে পেছন দিকে, আর আরেকটা প্রগতির ভারত, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। যে বুলডজার রাজ আজ তার সমস্ত নৃশংসতা নিয়ে হাজির, তার প্রাথমিক লক্ষণ সেই সময় মাথা চাড়া দিয়েছিল। এই দুই রাস্তা, দুই ভারতের মধ্যে বেছে নিতে হবে কোন লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাব। চন্দ্রশেখরের হত্যাকারীদের ছাত্র আন্দোলন ও পার্টি জেলে পাঠিয়েছে, শাস্তি দিয়েছে। চন্দ্রশেখরের অপূর্ণ কাজকে এখন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

conference-of-aisa-was-held

ভগৎ সিং ও আম্বেদকরের যে স্বপ্নের ভারত গড়ে তোলার ডাক আইসা দিয়েছে তার তাৎপর্যও তিনি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে আম্বেদকর ছিলেন এক বিরাট মাপের ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। তিনি জানতেন যে বৃটিশ চলে গেলে, ভারত স্বাধীন হলেও রয়ে যাবে চরম বৈষম্যমূলক এক সামাজিক কাঠামো। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, এক ব্যক্তি এক ভোটের সমতা অর্জিত হলেও গোটা সমাজের বনিয়াদ দাঁড়িয়েই থাকবে চরম অসাম্যের ভিত্তিতে, যার অবসান না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে যাবে অর্থহীন। আর, ভগৎ সিং মনে করতেন, বৃটিশ চলে গেলেও দেশবাসীর শোষণ মুক্তি ঘটবে না। তাই স্বাধীনতার পরও লড়াই চালাতে হবে দেশীয় শাসকদের বিরুদ্ধে।

সাধারণ সম্পাদক যে বিষয়টাতে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তা হল, মোদী বা যোগী তো শুধু দুই ব্যক্তি নয়। তারা আজ চতুর্দিকে এক উন্মত্ত ভিড়ের জন্ম দিয়েছে। যারা হিংসাত্মক কার্যকলাপে মত্ত।

এই ভীড়ে যারা সামিল তারা সাধারণ যুবক, বেকার যুবক। তারা জানে না কেন তাদের হাতে কাজ নেই। বিজেপির কোনো নেতা-মন্ত্রীর ছেলেদের সেই ভিড়ে দেখা যাবে না। তাদের নেতারা পাঠিয়ে দেন বিদেশে।

মণিপুরে এত দিন ধরে যে জাতি হিংসা চলছে, হাজার হাজার ঘরছাড়া ত্রাণ শিবিরের আর্ত মানুষ, অগুন্তি প্রাণ চলে যাওয়া, কিন্তু আজ পর্যন্ত মোদী মণিপুর নিয়ে টুঁ-শব্দটি করলেন না। তিনি বিশ্ব ভ্রমণ করে বেড়ান, কিন্তু মণিপুর যাওয়ার সুযোগ পান না।

সাধারণ সম্পাদক নির্ভয়া কান্ডে আইসার অসামান্য ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। নারী নিরাপত্তার নামে মেয়েদের ঘরের কোণে বন্দি করে, সিসিটিভির আতস কাঁচে আটক রাখার বিরুদ্ধে নির্ভয় স্বাধীনতার অধিকারের দাবিতে আইসা আইপোয়া আন্দোলনের ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন।

আইপোয়ার রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্ত, সাউথ এশিয়া সলিডারিটির পক্ষ থেকে কল্পনা উইলসন ছিলেন অন্যতম বক্তা।

সারা দেশ থেকে প্রায় ৫০০ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

reign-of-terrorreign-of-terror

বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গী ঘোষণা করে দিলেন, “দেশের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলা হবে”। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মীণাক্ষী লেখি সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের খোলাখুলি হুমকি দিয়ে বললেন, “চুপ করুন। নয়তো ইডি আপনার দোরে গিয়ে কড়া নাড়বে।” সাংবাদিক করণ থাপারের সাথে মেইতেই’র জঙ্গী সংগঠনের এক নেতা রাখঢাক না করেই জানিয়ে দিল যে কুকি নিধনে তারা পুলিশ ও সরকারের সাহায্য পেয়েছে। হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টর জবরদখল উচ্ছেদের নামে নুহের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি, হোটেল, দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারই প্রভাবে কয়েকদিনের মাথায় নুহ প্রশাসন ৩৫০টি ঝুপড়ি এবং ৫০টির মতো স্থায়ী পাকা নির্মাণ ভেঙে দেয়। এরমধ্যে ডজনখানেক ওষুধের দোকানও রয়েছে। মণিপুরের পর হরিয়ানায় হিংসার আগুন ছড়ালো। এবার গোয়াতেও তা ছড়ানোর তোড়জোড় চলছে বলে সতর্কতা জারি করেছে কিছু ক্রিশ্চান সংগঠন। ২০২৪’র আগে আরও কতই না জনপদ শূন্য হবে, কত হাজার মানুষ ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গায় প্রাণ হারাবে কে জানে।

গোটা দেশজুড়ে কায়েম করা হয়েছে সন্ত্রাস, ভয়ভীতির এক গা ছমছমে দমবন্ধ করা পরিবেশ। প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কাজে নামানো হয়েছে। খুব সম্প্রতি সংসদীয় কমিটি প্রস্তাব দিয়েছে, সরকার যাদের যাদের পদক দিয়ে সম্মানিত করেন, এরপর পদক গ্রহণ করার আগে পদকপ্রাপকদের এই মর্মে মুছলেখা দিতে হবে যে ভবিষ্যতে তাঁরা কখনই প্রতিবাদ জানানোর অজুহাতে তা ফেরত দেবেন না। শুধুমাত্র সরকার কর্তৃক প্রদত্ত পদকের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ থাকবে না। স্বশাশিত সংস্থাগুলো যে সমস্ত পুরস্কারে সম্মানিত করে, যেমন সাহিত্য আকাডেমি, তার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।

এটাও দেখা গেল, বেশ কিছু উচ্চপদস্থ অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার দেশের সীমান্তরেখায় নানা ফাঁক ফোকর ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঘটে যাওয়া গুরুতর অবহেলার নানা দিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেন কঠোর ভাবে নিজেদের নাম গোপন রাখার শর্তে। এমনকি, এইমস’এর মতো উৎকর্ষ চিকিৎসা ক্ষেত্র ও গবেষণা কেন্দ্রে গবেষকদের জন্য ছ’বছরের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। দেশের অনেক নামজাদা মেডিকাল গবেষণা কেন্দ্রের প্রখ্যাত গবেষকরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের কাছে মুখ খুললেও নিজেদের নাম গোপন রাখেন এই আশঙ্কায় যে কেন্দ্রীয় সরকার জানতে পারলে তাঁরা বর্তমানে যে বিষয় নিয়ে গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তারজন্য প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে।

এখানেই থেমে নেই মোদী সরকার। এবার উচ্চপদস্থ আমলাদের শাসানোর, তাঁদের দাবিয়ে রাখার নতুন এক রাস্তা বার করল কেন্দ্রীয় সরকার। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় সরকার সংশোধন করল ‘অল ইন্ডিয়া সার্ভিসেস (ডেথ কাম রিটায়ারমেন্ট বেনেফিট) রুলস্, ১৯৫৮। আইএএস-আইপিএস-আইএফএস — প্রশাসনের এই তিনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারদের বশে রাখতে রুলস বা বিধিতে সংশোধনী এনে বলা হয়েছে, অবসরকালীন জীবনে ‘অপরাধমূলক কার্যকলাপ’, ‘গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গ’র মতো ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ঠ আমলা-পুলিশ অফিসারদের পেনশন আটকে যাবে, অবসরকালীন সুযোগ সুবিধাতে কোপ পড়বে। এতদিন পর্যন্ত নিয়ম ছিল, রাজ্যে রাজ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত আমলাদের বিরুদ্ধে উপরে উল্লিখিত অভিযোগ যদি রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রের কাছে করে, তবে তাঁদের পেনশন বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধায় কোপ পরতো। কিন্তু নয়া সংশোধনী আসার পর রাজ্য সরকারের সুপারিশের দরকার পড়বে না। ওই সমস্ত অভিযোগ আদালত কর্তৃক প্রমাণিত না হলেও স্রেফ কেন্দ্রের ‘প্রাইমা ফেসি’ ‘মনে হওয়া’র ভিত্তিতেই কোপ পড়বে পেনশন ও অন্যান্য অবসরকালীন পেনশনে। এই দমনমূলক সংশোধনীর বিরুদ্ধে ৯৫ জন অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ অফিসার খোলাখুলি এক গণপ্রতিবাদপত্রে স্বাক্ষর করে কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছে, অবিলম্বে এই সংশোধনী যেন ফেরত নেওয়া হয়। তাঁরা মনে করেন, অবসরকালীন জীবনে জনহিতের স্বার্থে এই সমস্ত অফিসারদের অবস্থান গ্রহণের অধিকার রয়েছে।

ইতিমধ্যেই গোটা ভারতবর্ষ পরিণত হয়েছে বিরাট এক জেলখানায়। বুদ্ধিজীবী, আমলা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষক অধ্যাপক, ছাত্র, শিল্পী সাহিত্যিক, সাংবাদিক — সমাজের সর্বস্তরকে ত্রাসের চাদরে মূড়ে ফেলেছে মোদীর ফ্যাসিস্ট রাজ।

কিন্তু ইতিহাস কি এই ত্রাসের রাজত্বের সামনে থমকে দাঁড়াবে? নাকি আসমুদ্রহিমাচল আবার জেগে উঠে এই অন্ধ তমসাবৃত প্রহরকে খান খান করে নতুন জীবনের জয়গানে মেতে উঠবে?

from-manipur-to-haryanahate-which-is-destroying-india

তিন মাস হয়ে গেল মণিপুর জ্বলছে। তিন মাস ধরে নিরন্তর হিংসা ষাট হাজারের ওপর মানুষকে নিজভূমে গৃহছাড়া করেছে। এই হিংসা হামলার টুকরো টাকরা কিছু ভিডিও আন্তর্জাতিক মহলের নজরে এসেছে। কিন্তু দুনিয়া চষে বেরানো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এখনও সময় হয়নি মণিপুরে যাওয়ার। সংসদে অথবা সামাজিক গণমাধ‍্যমে তিনি কিছু বলতেও অস্বীকার করেছেন। এবং একমাত্র যে ক্ষেত্রে তিনি মণিপুরের বীভৎস ভিড় হিংসা ও যৌন হামলার ভাইরাল ভিডিওর কথা উল্লেখ করেছেন সেখানেও তিনি একে অবিজেপি রাজ‍্যে ঘটা নারীবিরোধী অপরাধের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাথে একাসনে বসিয়েছেন। এবং এইভাবে তিনি একটি সংখ‍্যালঘু গোষ্ঠির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় তদারকিতে চলা হামলার প্রেক্ষাপট থেকে ঘটনাটিকে ছেঁকে আলাদা করে নিয়েছেন। সংসদের চলতি বাদল অধিবেশনের একদম প্রথম দিন থেকেই সরকার মণিপুর প্রসঙ্গে বিতর্ক এড়িয়ে গেছে। বিতর্কে বাধ‍্য করতে বিরোধী পক্ষ শেষ পর্যন্ত অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। কিন্তু তবু সরকার বিতর্ক পিছিয়ে দিয়ে তুলে রেখেছে অধিবেশনের অন্তিম লগ্নের জন‍্য।

প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার যখন মণিপুর প্রসঙ্গে সংসদে কোনোরকম আলোচনাই করতে দিচ্ছে না, তখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে বাধ‍্য করল বিচার বিভাগের সম্মুখীন হতে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে সূচীমুখ প্রশ্ন উত্থাপিত হল ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের ব‍্যর্থতা প্রসঙ্গে। আর মোদী সরকারের এড়িয়ে যাওয়া এবং দায়সারা ও নিষ্ঠুর উত্তরগুলি মণিপুর সরকার এবং সেই সাথে মোদী সরকারেরও, যে সরকার ৩৫৫ ধারা প্রয়োগ করে ওই রাজ‍্যের বহুবিধ প্রশাসনিক কাজকর্ম নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, সমগ্র দুষ্কর্মে যুক্ত থাকার সত‍্যটা প্রকাশ করে দিয়েছে। ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মণিপুর মামলা শুনানির পর একে মণিপুরের আইনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়া বলে অভিহিত করেছে। নরসংহারের লক্ষ‍্যে রাষ্ট্রীয় মদতে চলা সন্ত্রাস অভিযানের শিকার সংখ‍্যালঘু কুকি সম্প্রদায়, এবং সংঘ পরিবারের ছড়ানো সুপরিচিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’, ‘সন্ত্রাসবাদ’ ও ‘অপরাধপ্রবণ’ ইত‍্যাদি তকমা কাজে লাগিয়ে গণহত‍্যা, উচ্ছেদ ও যৌন অত‍্যাচারকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে — এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সুপ্রিম কোর্ট কেমন সুবিচার দেয় সেটাই এখন দেখার।

অতীব গুরুত্বপূর্ণ আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত হিংসার এই সঞ্চারপথ আবারো একবার দেশের অন‍্যান‍্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যেতে পারে। ইউপি ও হরিয়ানা এবং জয়পুর-মুম্বাই সুপারফাস্ট চলন্ত ট্রেনে গুলি চালনা — তিনটি আলাদা আলাদা রিপোর্ট এই ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার একটা বাস্তব ছবি হাজির করছে। হরিয়ানার মেওয়াট অঞ্চলকে বিজেপি অনেকদিন ধরেই সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও সহিংসতার আরেক গবেষণাগারে পর্যবসিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। নুহ’র মুসলিম প্রধান এলাকাগুলির মধ‍্যে দিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ উসকানিমূলক মিছিল নিয়ে যায়। এই মিছিলের বিদ্বেষমূলক অভিঘাত আরো বাড়িয়ে দেয় বজরং দলের পলাতক গুণ্ডা মনু মানেসরের পোস্ট করা ভিডিও, যে মনু এ’বছর ফেব্রুয়ারি মাসে নাসির ও জুনেইদ হত‍্যায় মূল অভিযুক্ত। মিছিলটি চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করে তিনজনের প্রাণ নেয় যাদের মধ‍্যে দুজন হোমগার্ড। সেদিনই গভীর রাতে গুরুগ্রামের সেক্টর ৫৭’র অঞ্জুমান জামা মসজিদ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের বরাদ্দ করা জমিতে স্থাপিত এটাই একমাত্র মসজিদ যেখানে শহরের মুসলমানরা নমাজ পড়তে পারেন। মসজিদের ১৯ বছর বয়সী সহকারী ইমামকে নৃশংসভাবে হত‍্যা করা হয়। অতীতেও এই মসজিদে বারবার হামলা চালানো হয়েছে।

ইউপি’র বরেলিতেও একই ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা ঘটতে পারত। কিন্তু পুলিশের সতর্ক উপস্থিতি ও সময়োচিত হস্তক্ষেপ তা আটকে দেয়। কানোয়ারিয়াদের মিছিল অননুমোদিত রাস্তায় নিয়ে যাওয়াকে আটকানো হয়। কিন্তু এই কাজে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই এখন প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুজন পুলিশ কর্মীকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে এবং পুলিশের সিনিয়র সুপারিন্টেন্ডেন্ট প্রভাকর চৌধুরিকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ইনি তাঁর চাকুরি জীবনে এই ২১তম বার শাস্তিমুলক পদ পাওয়ার বা বদলির শিকার হলেন। মোদীর ‘নয়া ভারতে’ যোগীর ‘বুলডোজার রাজ’এ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কর্তব‍্য পালন করলে পুলিশ অফিসারকে এই মূল‍্যই চোকাতে হয়। বাস্তবিকই, মোদী-শাহর গুজরাট মডেল থেকে শুরু করে আদিত‍্যনাথের ইউপি আর বিরেন সিংহের মণিপুর — ভিড় হিংসার ঘটনা এবং দুষ্কর্মের বিভিন্ন স্তরে রাষ্ট্রের যুক্ত হয়ে পড়াটা এখন বিজেপি শাসনের পরিচিতিমূলক বৈশিষ্ট‍্য হয়ে উঠেছে।

জয়পুর-মুম্বাই ট্রেনে গুলি চালানোর ঘটনাটি অবশ‍্য ভারতকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রার টেররিস্ট হামলার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন আরপিএফ জওয়ান একটি চলন্ত ট্রেনের আলাদা আলাদা কোচে তার ঊর্ধ্বতন বসকে এবং তিনজন মুসলিম যাত্রীকে গুলি করে হত‍্যা করল, সে তার শিকারদের পাকিস্তানের এজেন্ট বলে দোষারোপ করল এবং যাত্রীদের বলল যে ভারতে থাকতে হলে আর ভোট দিতে হলে মোদী ও যোগীকে সমর্থন করতে হবে। হাড় হিম করা এই ভিডিও আমাদের এক নতুন বাস্তবতায় এনে ফেলল যেখানে মূলধারার মিডিয়ার, বিশেষত গোদি মিডিয়া চ্যানেলগুলির নিরন্তর ঘৃণা প্রচার এবং সংঘ বাহিনীর আইটি সেলের সুব‍্যবস্থিত বিদ্বেষপূর্ণ মিথ‍্যার জালের অভিঘাত এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে যা এযাবৎকাল অভাবনীয় ছিল। টিভি চ‍্যানেলগুলির ঘৃণা প্রচারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও গোদি মিডিয়া বিপুল মাত্রায় ঘৃণার বিষ ছড়িয়েই চলেছে। জয়পুর-মুম্বাই ট্রেনের গুলি চালনার ঘটনাকে সরকার ও গোদি মিডিয়া সাথে সাথেই এক মানসিক রোগির ঘটানো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে খারিজ করে দিয়েছে। সমস্ত নজর কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে হরিয়ানার হিংসায়, যেখানে মুসলমানদের দেখানো হচ্ছে ‘পাথর ছোঁড়া’ দাঙ্গাবাজ হিসেবে। একটা চ‍্যানেল এমনকি এর ‘স্থায়ী উপশম’ চেয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে যা নাৎসি জার্মানির ‘চূড়ান্ত সমাধান’এর কথা মনে করিয়ে দেয় যেখানে ষাট লক্ষ ইহুদি, কয়েক লক্ষ রোমা জনতা, কমিউনিস্ট ও অন‍্যান‍্যদের হত‍্যা করা হয়েছিল।

পাঁচ বছর আগে ২০১৯’র নির্বাচনের দৌড়ে মোদী সরকার ও সংঘ-বিজেপি বাহিনীর ফ‍্যাসিস্ট হামলার বিরুদ্ধে জনপ্রিয় ক্ষোভের লক্ষণ পরিস্ফুট হয়েছিল। বিজেপি তার শক্তিশালী ভিত্তি রাজস্থান, মধ‍্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচনে পরাস্ত হয়েছিল। আর সেই সময়ই ঘটেছিল পুলোয়ামা। চল্লিশ জন সিআরপিএফ জওয়ান এক সন্ত্রাসী হামলায় মারা গিয়েছিলেন, আর নির্বাচনী আবহাওয়া নাটকীয়ভাবে বদলে গিয়েছিল। আজ দেশ জানে যে কীভাবে একের পর এক ফাঁকফোকর তৈরি করে সেদিন পুলোয়ামা ঘটতে দেওয়া হয়েছিল, এবং কীভাবে প্রধানমন্ত্রী নিজে জম্মু কাশ্মীরের গভর্নর সত‍্যপাল মালিককে সরকারী ব‍্যর্থতার কথা চেপে যেতে বলেছিলেন। এখন সামনে বেশ কিছু নির্বাচন আসন্ন। মানুষের মোহভঙ্গ আরো গভীরতর হতে দেখা যাচ্ছে, এবং এই চলমান ঘৃণা ও মিথ‍্যার, ভয় ও ধ্বংসের জাল থেকে মুক্তির আকাঙ্খা বাস্তবের মাটিতে আরও বেশি বেশি দৃশ‍্যমান হয়ে উঠছে। পরিবর্তনের এই জনপ্রিয় আকাঙ্খাকে বিপথগামী করতে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হিংসার তীব্রতর অভিযান চালানোর ছক কষা হচ্ছে যাতে সামাজিক মেরুকরণ তীক্ষ্ণতর করে অস্থিরতার আবহ তৈরি করা যায়। মণিপুর থেকে হরিয়ানা — বিপদঘণ্টা খুবই তীব্র ও স্পষ্টভাবে বাজছে। আমরা ভারতের জনগণ নিশ্চয় এই ফাঁদে পা দেব না। আমরা বদলে দেওয়ার সংগ্রাম জোরালো করব আর বিজয় অর্জন করব।

- দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন           
(১-৭ আগস্ট ২০২৩ এমএল আপডেট সম্পাদকীয়)

violence-at-nuh-a-story-of-hatred-intimidationcommunal-violence

আগস্টের ৩ তারিখ সিপিআই(এমএল) ও এআইসিসিটিইউ’র দুটি তথ‍্যানুসন্ধানী দল হরিয়ানার নুহ ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল পরিদর্শন করে, যে জায়গাগুলোতে ৩১ জুলাই ২০২৩ তীব্র সাম্প্রদায়িক উসকানি ও হিংসার ঘটনা ঘটিয়েছে দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলো। তথ‍্যানুসন্ধানী দল দুটির একটিতে (টিম-১) ছিলেন সিপিআই(এমএল) কেন্দ্রীয় সদর দপ্তর সদস‍্য প্রেম সিং গহলোয়াত, রবি রাই, স্বেতা রাজ, আকাশ ভট্টাচার্য ও অরুণ। তাঁরা নুহ (মেওয়াট) ও সোহনা (গুরগাঁও)-এর মুসলমান ও হিন্দু — উভয় ধর্মের মানুষের সাথে দেখা করেন এবং এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হল ভূমিস্তরের সেই ঘটনা পরম্পরা বোঝার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় দলটিতে (টিম-২) ছিলেন এআইসিসিটিইউ সদস‍্য অভিষেক, অমরনাথ শর্মা ও এডভোকেট গণেশ (একজন মানবাধিকার বিষয়ক উকিল)। তাঁরা সেক্টর ৭০A’র নিকটবর্তী পারলা গ্রামের মুসলমান শ্রমিক বস্তিগুলি, ভোণ্ডসি গ্রাম এবং সোহনা গ্রাম পরিদর্শন করেন।

টিম দুটি তাঁদের তদন্তে দেখতে পায় যে, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং দিল্লীর জাহাঙ্গিরপুরিতে ‘শোভাযাত্রা’কে ঘিরে সম্প্রতি যে ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসা তৈরি করা হয়েছিল সেই একই প‍্যাটার্নে নুহ’তেও বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি ‘শোভাযাত্রা’ নিয়ে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়ায়। বজরং দল ও ভিএইচপির সংগঠিত এইসব বিরাটাকার ‘শোভাযাত্রাগুলি’ সাম্প্রতিক পরিঘটনা। নুহ’তে যেমন মাত্র তিন বছর আগে থেকে এটা শুরু হয়েছে। তার আগে এইসব জুলুসের প্রায় সবগুলিই স্থানীয় স্তরে সংগঠিত হত এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হত।

দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলির দ্বারা ৩১ জুলাই শোভাযাত্রার আগে চালানো তীব্র মুসলিম-বিরোধী বিদ্বেষ ও ভীতি প্রদর্শন অভিযানের দিকে আঙুল তোলেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ, ধর্মীয় পরিচিতি নির্বিশেষে। দক্ষিণপন্থী ঠ‍্যাঙাড়ে বাহিনীর মনু মানেসর, যিনি ২০২৩’র ফেব্রুয়ারি মাসে নাসির ও জুনেইদের নৃশংস হত‍্যাকাণ্ডের মূল আসামী, এবং বজরং দলের নেতা বিট্টু বজরংগী যিনি ৩১ জুলাইয়ের মিছিলে উপস্থিত ছিলেন — এই দুজনের চরম উসকানিমূলক ভিডিও পোস্টের পরেও পুলিশ কোনও নিবারণমূলক পদক্ষেপ নেয়নি। নুহ’তে হিংসা ছড়িয়ে পড়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভিএইচপির সাধারণ সম্পাদক সুরেন্দ্র জৈনকে দেখা গেছে মেওয়াটে মেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ-ভাষণ দিতে। নুহর একটি মন্দিরের সামনে উপস্থিত এক বিশাল জমায়েতকে সম্বোধিত করে তিনি আহ্বান রাখেন, মুসলিম জনাধিক‍্যের মেওয়াত এলাকাটির চরিত্র বদলে দেওয়ার।

স্থানীয়দের মতে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা তলোয়ার, পিস্তল ও আধুনিক সফিস্টিকেটেড বন্দুকে সসজ্জিতভাবে সশস্ত্র ছিল। যখন তারা নুহ শহরের মধ‍্যে দিয়ে যাচ্ছিল তখন অস্ত্র উঁচিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক শ্লোগান দিচ্ছিল এবং স্থানীয়দের বিভিন্নভাবে হয়রান করছিল। এই উস্কানির ফলে এবং মনু মানেসর প্রচারিত ভিডিওর ঘৃণা ভাষণে ইতিমধ‍্যেই স্থানীয় জনতার মনে জমে থাকা ক্রোধের কারণে, তীব্র সংঘাত শুরু হয়।

ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা দেখা গেল যে নুহর প্রাথমিক হিংসার পর সামাজিক গণমাধ‍্যমকে ব‍্যবহার করে হিন্দু-বিরোধী প্রবল আক্রমণের বানোয়াট গল্প ও অনেক হিন্দুর খুন হয়ে যাওয়ার মিথ‍্যা কাহিনী ব‍্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। হিংসা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে গুরগাঁওয়ের সোহনা ও অন‍্যান‍্য স্থানে, যেখানে কয়েকশ পুরুষ মানুষের দক্ষিণপন্থী জটলা মুসলমানদের দোকানগুলিতে এবং মসজিদে হামলা চালায়। রাস্তাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং মুসলমানদের, শিশুদের সহ, বিশেষভাবে নিশানা বানানো হয়েছিল। এই সম্প্রদায়ের স্থানীয় মানুষদের মতে, এত হিংস্র আক্রমণ সত্ত্বেও পুলিশ সম্পূর্ণ নিরব ছিল।

nuh violence investigation team
স্থানীয়রা পরস্পরের পাশে এসে দাঁড়ায়

দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি সাম্প্রদায়িক সংঘাতককে ব‍্যাপ্ত দাঙ্গার রূপ দেওয়ার অনেক চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও ধর্ম নির্বিশেষে স্থানীয় সাধারণ মানুষের মধ‍্যে বিরাজমান সংহতি বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দেয় এবং এই বিস্ফোরক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। সোহনা মসজিদে হামলার নির্দিষ্ট ঘটনাটিতে দক্ষিণপন্থী গুণ্ডাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে মুসলমানদের সুরক্ষা দেন। মেওয়াত এলাকার জাঠেরাও হিংসার বিরুদ্ধে স্থানীয় মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়ায়।

নুহ’তে, ঐ সম্প্রদায়ের অনেকেই বলেন যে, দাঙ্গাবাজরা ওই এলাকার বাইরে থেকে এসেছিল। নুহ ও সোহনা দুই জায়গার স্থানীয়রাই পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নুহর শান্তি কমিটি আগেই স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েছিল মনু মানেসরকে এনে এলাকায় সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা তৈরীর অপচেষ্টার কথা। কিন্তু শোভাযাত্রার সময় পুলিশ প্রহরা ছিল নামমাত্র।

রাষ্ট্র অপরাধীদের দোসর হয়ে যায়

হরিয়ানা ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিষিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ জানান স্থানীয় মানুষেরা। তাঁরা বলেন যে নুহর হিংসা রাষ্ট্রের যোগসাজসের ফলেই ঘটেছে, এই অস্থির পরিস্থিতি সম্পর্কে ওরা আগে থেকেই জানত, তবু তা নিবারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রকৃতই, ঘৃণাভাষণ ও মিছিলে সশস্ত্র সমাবেশ সম্পর্কে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনওরকম ব‍্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

স্থানীয়রা ব‍্যক্ত করেছেন যে নুহর পরিস্থিতিকে রাজ‍্যজুড়ে এবং সারা দেশজুড়ে চলমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সাথে সংযুক্তরূপেই বুঝতে হবে। বছরের পর বছর ধরে দক্ষিণপন্থী গ্রুপগুলো বিজেপি সরকারের অপরাধসুলভ সহযোগিতায় মেওয়াত অঞ্চলে হিংস্র হিন্দুত্ব প্রকল্প নামিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গরিব পরিযায়ি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে এক অভিযান

নুহ ও গুরগাঁওয়ের এলাকাগুলিতে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠিগুলি ও স্থানীয় প্রশাসন মুসলমান পরিযায়ী শ্রমিক জনসংখ‍্যাকে, বিশেষত যারা বাংলা থেকে ওখানে গেছেন তাঁদে, নিশানা করে সুসমন্বিত অভিযান চালিয়েছে। বেশ কিছু মুসলমান বস্তি এলাকা, বিশেষ করে গুরগাঁওয়ের, আক্রান্ত হয় অথবা বসতি ফাঁকা না করলে হামলা চালানো হবে বলে হুমকির সম্মুখীন হয়। গরিব মুসলমানদের মধ‍্যে ত্রাস তৈরি করতে সামাজিক গণমাধ‍্যম ও মূলধারার মিডিয়া — উভয় মাধ‍্যমেই খবর করা হয়েছে ‘রোহিঙ্গ‍্যা মুসলমান’ তকমা জুড়ে দিয়ে।

যখন তথ‍্যানুসন্ধানী দলের সদস‍্যরা কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিকের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন তখন পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। বেশিরভাগ বস্তিগুলিই এখন ফাঁকা, অনেকেই শহর ছেড়ে পালিয়েছেন।

nuh riot
প্রতিহিংসা ও সন্ত্রাসের ভয়

নুহ’তে এবং গুরগাঁওয়ের বেশ কিছু অঞ্চলে পরিস্থিতি এখনও উদ্বেগপূর্ণ। গুরগাঁওয়ের যে অঞ্জুমান জামা মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং তার ইমামকে হত‍্যা করা হয়, সেই মসজিদ পরিদর্শনের সময় তথ‍্যানুসন্ধানী দল দক্ষিণপন্থী বাহিনীর যুবকদের বাইকে চক্কর মারতে ও আরো ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা চালাতে দেখে। পরবর্তীতে অবশ‍্য এই গ্রুপকে পুলিশ তাড়া করে সরিয়ে দেয়।

টিম যখন নুহ পরিদর্শন করছিল তখন শহরটাকে এক ভুতুড়ে শহর মনে হচ্ছিল : সমস্ত দোকানপাট বন্ধ, বাড়ির বাইরে কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। কার্ফিউ চলছে। স্থানীয়রা বলেন যে, পুলিশ গণহারে গ্রেপ্তার ও রেইড চালাচ্ছে, অনেক নিরীহ ব‍্যক্তিকেও তুলে নিয়ে গেছে। মেও মুসলমান জনতার মধ‍্যে ভীতির পরিবেশ বিরাজ করছে। সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দল নুহর ডেপুটি কমিশনারের সাথেও দেখা করেন এবং বহুসংখ‍্যক নিরপরাধ ব‍্যক্তিকে গ্রেপ্তার, যা স্থানীয় জনতার মধ‍্যে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করেছে, সে সম্পর্কে উদ্বেগ ব‍্যক্ত করেন।

trade-unions-is-protestingthe-position-of-central-trade-unions

কলকাতার রাণী রাসমনি রোডে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো দু’দিন ধরে সংগঠিত করল অবস্থান বিক্ষোভ। মোদী সরকারের দেশবিরোধী, শ্রমিক বিরোধী  কর্পোরেট বান্ধব নীতি সমুহের বিরুদ্ধে ৯ আগস্ট দেশব্যাপী মহাঅবস্থান ও বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছিল দেশের ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। এরাজ্যে, ৮ আগস্ট থেকেই শুরু হয় এই অবস্থান বিক্ষোভ।

৮ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে শুরু হয় অবস্থান।

যতই বেলা বাড়তে থাকে শ্রমিক কর্মচারীরা সমবেত হতে শুরু করেন সভাস্থলে। এদিন, পরিষেবা ক্ষেত্রের শ্রমিক কর্মচারীরাই বেশি সংখ্যায় অংশ গ্রহণ করেন। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত রেল ও প্রতিরক্ষা শিল্পের কর্মীরাও এদিন উপস্থিত ছিলেন। এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বোস, কাশিপুর গান অ্যান্ড শেল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জয়দেব দে অবস্থান সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।

aicctu portest in delhi

 

central-trade-unions-is-protesting

৯ আগস্ট সকাল ১০টা থেকে ফের অবস্থান শুরু হয়। অঝোর বৃষ্টি হয় মাঝে মধ্যে। তবুও বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিক কর্মচারীরা তারমধ্যেও সমাবেশে মিছিলে ও ফেস্টুন পতাকায় শ্লোগানে মুখরিত হয়ে সামিল হন। এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে ভিক্টোরিয়া হাউস থেকে এক মিছিল শুরু হয়ে সমাবেশ স্থলে যায়। এই মিছিলে আইসিডিএস সহ স্কিম কর্মী, রাষ্ট্রীয় পরিবহনের ছাঁটাই-অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, হকার, চটকল শ্রমিক, ডেকরেটর, রিক্সাচালক, বাটা কারখানার কর্মী, নির্মাণ থেকে শুরু করে কাশিপুর গান অ্যান্ড শেল’এর শ্রমিক ইউনিয়ন তাদের নিজস্ব ব্যানার নিয়ে উপস্থিত ছিল। রাণী রাসমনি রোড পর্যন্ত মিছিল যায়। সেদিন এ আইসিসিটিইউ’র সারা ভারত স্কিম কর্মী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শীলা দে সরকার ও এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন। অন্যান্য কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেত্রীবৃন্দ ও বিভিন্ন সেক্টরের নেতারা সমাবেশে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেন। প্রত্যেক বক্তাই মোদী সরকারের জনবিরোধী, কর্পোরেট বান্ধব নীতির বিরুদ্ধে শাণিত আক্রমণ করেন। মোদী হঠাও, দেশ বাঁচাও রণধ্বনি গোটা সমাবেশ ও অবস্থানেই মুখরিত হয়ে ওঠে।

the-position-in-siliguri

৯ তারিখেই, শিলিগুড়িতে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর যুক্ত বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। মহানন্দা ব্রিজ থেকে হিল কার্ট রোড হয়ে সংযুক্ত ট্রেড ইউনিয়নের মিছিল শেষ হয় বাঘাযতীন পার্কে। এই সমাবেশে শ্রমিকদের সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। সমাবেশে এআইসিসিটিইউ’র পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মুক্তি সরকার। আয়ারলা, কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকেও ওই মিছিলে কর্মীরা অংশ নেন।

bankura-on-adivasi-dayprotest-in-bankura-on-adivasi-day

গত ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে বাঁকুড়ার মাচানতলার আকাশ মুক্ত মঞ্চে দুপুর ১১টা থেকে দুপুর ৩টে পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। এই অবস্থানে বক্তব্য রাখেন সারা ভারত কিষান মহাসভার জেলা নেতা আদিত্য ধবল, ভারতীয় খেতমজুর ইউনিয়নের জেলা নেতা কল্যাণ সিং, বাঁকুড়া কোর্টের বার এসোসিয়েশনের সদস্য শৌভিক বিশ্বাস, বিশিষ্ট আইনজীবী অভিষেক বিশ্বাস, আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চের জেলা নেতা রামনিবাস বাস্কে, বিশিষ্ট শিক্ষক সহদেব মান্ডি যিনি নিজের ভাষায় বক্তব্য রাখেন, এছাড়াও বক্তব্য রাখেন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য নেত্রী তিতাস গুপ্ত, বিশিষ্ট সামাজিক কর্মী পরিবেশবিদ শান্তব্রত সেন। সভা পরিচালনা করেন এআইএআরএলএ জেলা সভাপতি বাবলু ব্যানার্জি। সভায় সকল বক্তাই বলেন আজ বড় বড় সভা করে সরকারের পক্ষ থেকে আদিবাসীদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে অপরদিকে বিজেপি সরকার বন সংরক্ষণ সংশোধন আইন কোন আলোচনা ছাড়াই লোকসভায় পাস করিয়ে নিল। এর ফলে আদিবাসীদের দখলীকৃত বনের জমি বড় বড় কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে কোন বাধা রইল না। এর ফলে বনের জমি-বনজ সম্পদ থেকে আদিবাসীরা উচ্ছেদ হবে। আর আদিবাসীদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেওয়ার জন্য বিজেপি জাতি দাঙ্গা লাগিয়ে দিতে পিছপা নয়। উদাহরণ মনিপুর। মনিপুরের ডবল ইঞ্জিনের সরকার তিন মাস ধরে ইন্টারনেট বন্ধ করে জাতিদাঙ্গা লাগিয়ে রেখেছে। এই দাঙ্গায় সবচেয়ে বেশি অত্যাচারিত হচ্ছেন মহিলারা। মনিপুরের দাঙ্গা মহিলা নির্যাতন নিয়ে মন কি বাতের প্রধানমন্ত্রীর বাতের সময় নেই। শুধু মনিপুর নয় সারা দেশেই এরা জাতি দাঙ্গা লাগাতে চাইছে আমাদের রাজ্য আমাদের জেলাতেও চক্রান্ত করে চলেছে। আমাদের জেলায় ছাতনা ব্লকের মহসিনা গ্রামের দীর্ঘদিন ধরে আদিবাসীদের দখলে থাকা প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে গাছ লাগিয়ে দিচ্ছে এখানেও সেই একই পন্থা নিজেদের মধ্যে মারপিট লাগিয়ে দাও। বক্তারা আরো বলেন শুধু বনের জমি নয়, মনিটাইজেসন পাইপ লাইনের মধ্য দিয়ে এরা দেশের রেল স্টেশন-বিমান বন্দর-খনি-জাতীয় সড়কের দুই পাশ কর্পোরেটদের বিক্রি করে দিচ্ছে। বাঁকুড়া স্টেশনের জায়গাও বিক্রি করে দেবে — এর ফলে বহু মানুষ কাজ হারাবে, তাই এই সরকারটার বিরুদ্ধে সকলকে একজোট হতে হবে।

অবস্থান থেকে বাঁকুড়ার জেলাশাসক, জেলা বনাধিকার এবং দেশের রাষ্ট্রপতিকে পৃথক পৃথক স্মারকলিপি দেওয়া হয়। স্মারকলিপি দিয়ে আসার পর সঞ্চালক বাবলু ব্যানার্জি সমাপ্তি ভাষনে বলেন আজকের দিনে বিজেপির নয়া ব্রাহ্মণ‍্যবাদ আদিবাসী-দলিত-সংখ্যালঘু-মহিলাদের সামাজিকভাবে হেয় করছে। মধ্যপ্রদেশে যেমন দলিত যুবকের গায়ে মূত্রত্যাগ করে দিচ্ছে আবার কেথাও গায়ে পায়খানা লেপে দেওয়া হচ্ছে অপরদিকে চলন্ত ট্রেনে আরপিএফে কর্মরত যুবক যোগী-মোদির স্লোগান দিতে দিতে সংখ্যালঘুদের গুলি করে দিচ্ছে আর এগুলোকে বৈধতা দিতে এসসি/এসটি নিপীড়ন বিরোধী আইনকে লঘু করা হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে যেহেতু এরাজ‍্যের মানুষ ভোট দেয়নি তাই উচিত শিক্ষা দিতে দু-বছর ধরে কেবল আমাদের রাজ্যেই ১০০ দিনের কাজ বন্ধ করে মজুরি বকেয়া রেখেছে। অজুহাত, চুরি হচ্ছে। যারা চুরি করছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক কিন্তু গরিব মেহনতি মানুষ কেন বঞ্চিত হবেন? আসলে আমাদের রাজ্যে কাজ বন্ধ রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে মজুরি কম রেখে বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য করিয়ে আমাদের মেহনতি মানুষের শ্রম লুঠ করা হচ্ছে। নিরব মোদী-বিজয় মালিয়ার মতো মানুষরা ব্যাঙ্কের টাকা ধার করে শোধ না দিয়ে যারা বিদেশে চলে গেছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য মোদি-শাহ ১৫ লাখ কোটি টাকা মকুব করে দিচ্ছে অপরদিকে গরিব মেহনতি মানুষ যাদের নিজেদেরই করের টাকার সামান্য কিছু সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে পান তাদের মোদি-শাহ বলছেন অনুগ্রহজীবী, ধান্দাবাজ। এটা আসলে মেহনতি মানুষদের অপমান। এই অপমানের জবাব দেওয়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি আরো বলেন আজ শুধু আদিবাসী দিবস নয় আজ ভারত ছাড়ো দিবস। ১৯৪২ সালের আজকের দিনে ভারতের শ্রমিক-কৃষক জোট বেঁধে ডাক দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছাড়ো। তেমনি করে আজ ১৯২৩ সালের ৯ আগষ্ট শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব সকল মেহনতি মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করে আওয়াজ তুলতে হবে দেশ বেচনেওয়ালা দাঙ্গাবাজ দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সংবিধান বিরোধী মোদি-শাহ পরিচালিত বিজেপি সরকার ভারত ছাড়ো।

Save-educationsave-the-future

অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন-এর দশম জাতীয় সম্মেলনের প্রাক্কালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষার গৈরিকীকরণ বিষয়ে অনুষ্ঠিত হলো ‘শিক্ষার হেরফের’ শীর্ষক এক আলোচনাসভা। সভার প্রধান বক্তাদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক অভিজিৎ মজুমদার, অধ্যাপক নন্দিনী মুখার্জী, অধ্যাপক সঞ্জীব আচার্য এবং অধ্যাপক মানস ঘোষ।

আলোচনায় উঠে এসেছে জাতীয় শিক্ষা নীতি কিভাবে সার্বিকভাবে শিক্ষায় বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগের পথকে সুগম করছে। সঞ্জীব আচার্যেরন বক্তব্যে উঠে এসেছে যে এই শিক্ষানীতি শুধুমাত্র ১০ শতাংশের স্বার্থ রক্ষার জন্যে তৈরি।

এর সাথে সাথেই নন্দিনী মুখার্জী যুক্ত করেন যে ক্রেডিট সিস্টেম কিভাবে প্রান্তিক অংশের শিক্ষার্থীদের আরো দূরে ঠেলে দেবে শিক্ষার পরিসর থেকে। অন্যদিকে অধ্যাপক মানস ঘোষ তুলে ধরেন ইতিহাস বিকৃতির বিষয়, দ্বর্থ্যহীন ভাষায় তিনি সামলোচনা করেন বিজেপি-আরেএসএস-এর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকে এক সাম্প্রদায়িক মোড়কে পাঠ্যবইতে উপস্থাপনা করার প্রক্রিয়াকেে। পার্টির রাজ্য সম্পাদক অভিজিৎ মজুমদার দেশের সামাজিক রাজনৈতিক পরিসরে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন কি ভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নব্য প্রজন্মের মানসিকতাকে প্রভাবিত করছে এবং সাম্প্রদায়িক মনন গড়ে উঠছে তা নিয়ে আলোচনা করেন। এই ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী— কৃষিজীবী জনতার সাথে ছাত্র যুবদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন যে একমাত্র বিকল্প, সেই বার্তা তিনি বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

সমস্ত সময় প্রায় সভাগৃহ পূর্ণ থেকেছে এবং উল্লেখযোগ্য যে শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ ছিল শিক্ষার্থী কমরেড। সভায় অ-শিক্ষক কর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতন। শিক্ষার বেসরকারীকরণ এবং গৈরিকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার নেওয়ার মাধ্যমে সভা শেষ হয়।

demand-for-judicial-inquirystudent-death-in-jadavpur-university

অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-র রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু এবং রাজ্য সম্পাদক স্বর্ণেন্দু মিত্র এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন —

৫০০-র ওপর প্রতিনিধি ও দেশী-বিদেশী অতিথিদের উপস্থিতিতে সল্টলেকের ইজেডসিসিতে আজ শুরু হল অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন (আইসা)-এর দশম জাতীয় সম্মেলনের প্রতিনিধি অধিবেশন। শহীদ স্মরণের পরে শুরু হয় অন্যান্য বাম ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য অধিবেশন। শুরুতেই গতকাল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ ও তীব্র নিন্দা করে দ্রুত তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানায়।

এরপর সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কুমার রাণা। এআইএসএফ-এর সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড কমরেড শুভম ব্যানার্জী, এসএফআই-এর জাতীয় কমিটির পক্ষে কমরেড প্রতীক উর রহমান, পিএসইউ-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড নউফেল মহঃ শইফুল্লা, এবং এসডিএসও’র জাতীয় কমিটির পক্ষে কমরেড মণিশংকর পট্টনায়েক এই সম্মেলনকে সম্বোধিত করেন। প্রত্যেকেই এই সম্মেলনের মাধ্যমে আগামীদিনে ঐক্যবদ্ধ বাম ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল করার জন্য জোরদার আন্দোলনের কথা বলেন এবং ফ্যাসিস্ট মোদি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইকে আরো জোরালো করার ওপর জোর দেন। উপস্থিত ছিলেন আইসা গঠনের পূর্বে বাংলায় গঠিত ছাত্র সংগঠন এবিএসএ-এর পক্ষে কমরেড নীলকন্ঠ আচার্য। দুনিয়া ও দেশ জোড়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা স্মরণ করিয়ে এই সম্মেলনকে সংহতি জানান সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি আগামীদিনে মোদী সরকারের নতুন শিক্ষানীতি সহ সামগ্রিক দেশ বিকিয়ে দেওয়া নীতি ও ফ্যাসিবাদী উৎপাতের বিরুদ্ধে নির্ধারক লড়াইয়ে আইসাকে ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান।

shut-up-otherwise-ed-will-knockshut-up

“চুপ করুন! নয়তো ইডি আপনার দোরে গিয়ে কড়া নাড়বে” — এই মারাত্মক হুমকি সংসদে দিয়েছেন মীণাক্ষী লেখি বিরোধীদের উদ্দেশ্যে।

৩ আগস্ট দিল্লী সার্ভিস বিল নিয়ে বাদল অধিবেশনে আলোচনা চলছিল লোকসভায়। বিদেশ দপ্তর ও সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী মীণাক্ষী লেখি’র ভাষণে বিরোধী দলের কয়েকজন সাংসদ যখন বাধা দিতে থাকেন, তখন তিনি বিরোধীদের উদ্দেশ্যে এই হুমকি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, ইডি সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কত নগ্নভাবে ব্যবহার করতে পারে। মিথ্যা যে কোনো মামলায় ইডি’কে দিয়ে যখন তখন যাকে খুশি গ্রেপ্তার করাতে পারে। ইডি’র কর্ণধারের অবসরের সময়সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও বার বার তাঁর মেয়াদ কেন যে বাড়াতে মোদী সরকার তৎপর তা আরও একবার খুল্ললাম খুল্লা প্রকাশ হয়ে গেল।

এবার আরও একটা মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। মোদীর অন্তরঙ্গ বন্ধু গৌতম আদানি’র যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পসংস্থাকে প্রতিযোগিতার বাজার থেকে সরাতে ইডি-সিবিআই-আয়কর দপ্তরকে আদানি’র স্বার্থে লেলিয়ে দেওয়ার একাধিক অভিযোগ উঠেছে। আর, নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে মোদী সরকার। হালে, সঙ্ঘী ইন্ডাস্ট্রি’কে আদানির সংস্থা অম্বুজা সিমেন্টস যেভাবে কব্জা করল তা অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

ঘটনাক্রম পর পর সাজালে দেখা যাবে, ২৮ এপ্রিল ২০২৩ ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম সিমেন্ট প্রস্তুতকারক শ্রী সিমেন্টের সাথে সঙ্ঘী সিমেন্টের কথাবার্তা শুরু হয় কেনার জন্য। ২১ জুন, শ্রী সিমেন্টের পাঁচটি দপ্তরে আয়কর বিভাগ হঠাৎ তল্লাশি শুরু করে। ১৯ জুলাই শ্রী সিমেন্ট সঙ্ঘী সিমেন্টকে কেনার দৌড় থেকে সরে আসে। আর, ৩ আগস্ট আদানির সংস্থা অম্বুজা সিমেন্ট ঘোষণা করল যে তারা সঙ্ঘী সিমেন্ট সংস্থাকে কিনে নিয়েছে।

২০২০’র ১২ নভেম্বর, ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত বিশ্বের নামজাদা কর্পোরেটদের পত্রিকা ফাইনান্সিয়াল টাইমস একটা লেখা প্রকাশ করেঃ ‘মোদীজ্ রকফেলার — গৌতম আদানি অ্যান্ড দ্য কনসেনট্রেশন অফ পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া’! বেশ বড় ওই লেখায় তারা দেখিয়েছেন, মোদীর পেয়ারের দোস্ত আদানির বিমানবন্দর পরিচালনার বিন্দুমাত্র অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ২০১৮-তে ছ’ছটা বিমানবন্দরের মালিকানা পেয়ে গেল যা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ছিল। আদানি’র কপালেই যাতে শিকে ছেঁড়ে সেই মতো নিলামের দরপত্র স্থির করা হয়, অন্য প্রতিযোগী যাতে সেই যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে — পরম যত্নে সেদিকে নজর ছিল আর বিমানবন্দর পরিচালনার অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও যাতে আনকোরা সংস্থা তা কিনতে পারে তার সমস্ত শর্ত মজুত ছিল। দেখা গেল অনায়াসেই অক্লেশে আদানি ছটা বিমানবন্দর পকেটে পুরে ফেলল আর রাতারাতি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বিমানবন্দরের মালিক হয়ে বসল। মোদীর হাত ধরে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে আদানি দেশের বৃহত্তম বেসরকারি বন্দরের মালিক হয়ে উঠেছে। গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত পরিকাঠামো এখন আদানির নিয়ন্ত্রণাধীন। সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভগুলো আদানির এই উল্কাগতি উত্থানে বিরাট মদত যুগিয়েছে।

২০১৫ সালেই ক্রেডিট সুইজি ‘হাউস অফ ডেট’ শিরোনামে এক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতেই সতর্কবাতা দিয়ে তারা বলে যে আদানি গ্রুপ হচ্ছে ভারতের প্রথম ১০টি কর্পোরেট যাদের ঋণ বিপজ্জনক সীমায় রয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো থেকে আদানি গ্রুপ যে ঋণ নিয়েছে তা ব্যাঙ্কের দেয় মোট ঋণের ১২ শতাংশ! তারপরও নানান বিদেশি সংস্থার কাছ থেকে সে ক্রমাগত ঋণ নিয়েছে — কার্যত ঋণের বিরাট সমুদ্রে তখনই ডুবে ছিল আদানির সাম্রাজ্য। মোদী ক্ষমতায় আসার পর আদানির সম্পদ অস্বাভাবিক গতিতে বৃদ্ধি পায় ২৩০ শতাংশ হারে!

এই আদানি সহ হাতে গোনা কয়েকটি কর্পোরেটদের প্রতাপ, দাপট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি মোদী জমানায় কদর্য মাত্রা নিয়েছে। ক্রোনি পুঁজিবাদের সর্বনাশা মডেল আজ দেশের সমস্ত সম্পদকে লুট করে চলেছে। আর, তাদেরই তুষ্ঠ করতে দেশের সম্পদের ঢালাও বেসরকারিকরণ, বিক্রি, গোটা পরিকাঠামো তুলে দেওয়ার এক মহাযজ্ঞ চলছে।

- অতনু চক্রবর্তী

communal-clashes-in-haryanain-haryana-there-is-now-a-wave-of-polarization

আজকের ভারতের প্রশাসনিক ধারা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সরকার ডাবল ইঞ্জিনে পরিচালিত হলে রাজ্যের নানান সম্প্রদায়গুলোর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ডাবল বা দ্বিমুখী হয়। সব সম্প্রদায়কে সমান চোখে দেখা, সম-অধিকার ও সম-মর্যাদাসম্পন্ন বলে গণ্য করাটা দুই ইঞ্জিন চালিত রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক রীতি হয় না। এক সম্প্রদায়কে মিত্র ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে বৈরি জ্ঞান করাটাই তাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মণিপুরে এন বিরেন সিং সরকার যেমন মেইতেই সম্প্রদায়ের সরকার বলেই নিজেদের জ্ঞান করে এবং কুকি সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের মনোভাব বৈর ভাবাপন্ন বলেই পরিলক্ষিত হয়। একইভাবে, হরিয়ানাতে বিজেপির যে ডাবল ইঞ্জিন সরকার রয়েছে, নিজেদের তারা হিন্দুদের সরকার বলেই বিশ্বাস করে, আর মুসলিমরা হলো তাদের ‘অপর’ বা প্রতিপক্ষ, প্রশাসনিক পীড়নই যাদের প্রাপ্য। সম্প্রতি গত ৩১ জুলাইয়ের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জলাভিষেক যাত্রাকে কেন্দ্র করে নুহ জেলায় সূত্রপাত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গুরুগ্রাম ও সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল, তাতে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে প্রশাসনিক পীড়ন এবং অন্যদিকে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রড-লাঠি-আগ্নেয়াস্ত্র ধারী দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যের প্রাণান্তকর পরিস্থিতির মুখে পড়ল এবং তার পরিণতিতে আশ্রয় ও জীবিকাচ্যুত হয়ে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।

আমরা দেখলাম, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ৩১ জুলাই সংঘর্ষ বাধার পর থেকেই হরিয়ানায় বিজেপি শাসিত মনোহরলাল খট্টর প্রশাসন সহসাই নুহ ও গুরুগ্রামে ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশকারী ও তাদের দখলদারি সম্পর্কে প্রবল সচেতন হয়ে উঠল! আর এর প্রতিকারে সেই হাতিয়ারটাই তাদের চূড়ান্ত অবলম্বন হয়ে উঠল, ন্যায় প্রদানে যেটির প্রয়োগে যোগী আদিত্যনাথ হলেন একনিষ্ঠ। মনোহরলাল খট্টর ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে একনাগারে চালিয়ে গেলেন বুলডোজার অভিযান। সেদিনই নুহ জেলার তাওড়ু শহরে হরিয়ানা নগরোন্নয়ন কতৃপক্ষ রেফ ও মহিলা পুলিশ নামিয়ে চার ঘণ্টা ধরে বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিল মুসলিমদের ২৫০টা ঝুপড়ি। কয়েক বছর কেউ কিছু না জানলেও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর জনগণকে জানানো হলো যে, বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ’ অভিবাসীরা বছর তিনেক ধরে এক একর জায়গা দখল করে ঝুপড়ি বানিয়ে রয়েছে। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট অশ্বিনী কুমার জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী খট্টরের নির্দেশেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। শুক্র ও শনিবারেও বুলডোজার অভিযানে কোনও ছেদ পড়ল না। শনিবার ৫ আগস্ট দু’ডজন ‘অবৈধ’ ওষুধ ও অন্যান্য দোকান ধূলিসাৎ করা হলো। রবিবার ৬ আগস্ট জেলা প্রশাসন নলহার রোড অঞ্চলে ৪৫টারও বেশি দোকান ভেঙে দিল। কখনও বলা হলো দোকানগুলো দখলিকৃত জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি হয়েছিল। আবার, এই যুক্তিও দেওয়া হল যে ঐ দোকানগুলোর পরিচালকদের কেউ কেউ হিন্দু-বিরোধী হামলায় যুক্ত হয়েছিল আর তাই তার শাস্তি তারা পেল। রবিবার দিনই নুহতে বুলডোজার দিয়ে ধূলিসাৎ করা হলো সোহনা নামক স্থানের সাহারা নামের তিনতলা বিশিষ্ট একটি হোটেল ও রেস্তোরাঁ। অভিযোগ, এই হোটেলের ছাদ থেকেই নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রিজ মন্ডল জলাভিষেক যাত্রা মিছিলে ইট ছোড়া হয়েছিল। তবে, ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার ৬ আগস্টের এক প্রতিবেদনে হোটেলের মালিক জামশেদের উক্তিকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে — ইট ছোড়ার যে হোটেলের ছবি প্রশাসন তাদের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখিয়েছে সেটা অন্য হোটেল, তার হোটেল নয়। প্রতিবেদনে জামশেদের এই উক্তিও উদ্ধৃত হয়েছে যে, “আমি ন’বছর ধরে এই রেস্তোরাঁটা চালাচ্ছি। আমি আমার কর্মীদের রেস্তোরাঁটা বন্ধ করে দিতে বলি। আমার কর্মীরা এবং আমি পিছনে একটা কলোনিতে চলে যাই।” তাহলে হোটেলের মালিক মুসলিম বলেই কি তার ওপর হামলার খাঁড়া নেমে এলো? প্রকাশিত একটি সংবাদ জানিয়েছে, ৩ আগস্ট থেকে চারদিনে খট্টর প্রশাসন ৭০০ ঘর, নির্মিত কাঠামো ও ঝুপড়ি ধ্বংস করেছে যার ব্যাপক সংখ্যাধিকই মুসলমানদের।

now-a-wave-of-polarization

সংঘর্ষ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হলেও এবং বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দিক থেকে মুসলিম-বিরোধী কটুকথা ও প্ররোচনা যথেষ্ট মাত্রায় থাকলেও প্রশাসনিক আক্রোশ এবং হামলার শিকার হয়েছে শুধু মুসলিমদেরই। নিজেদের মুসলিম-বিরোধী মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে খট্টর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজও চন্ডিগড়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘অবৈধ’ নির্মাণের বিরুদ্ধে বুলডোজারও এক প্রতিকার এবং ‘যেখানেই দরকার’ সেখানেই তার ‘ব্যবহার’ হবে। তবে বুলডোজার দিয়ে এই চূর্ণকরণ এতটাই দৃষ্টিকটু এবং তারমধ্যে পক্ষপাতদুষ্টতা এতটাই প্রকট ছিল যে, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে খট্টর সরকারকে বুলডোজার অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সরকারের উদ্দেশে বলেছে, “আমাদের নজরে এটা এসেছে যে, গুরুগ্রাম ও নুহতে কিছু দাঙ্গা হয়েছে। আপাতভাবে জানা গেছে, ভাঙার কোনো নির্দেশ ও বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে আইন ও শৃঙ্খলাকে অছিলা করে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ করা হচ্ছে। এই প্রশ্নটি উঠেছে যে, আইন ও শৃঙ্খলাকে ছলা করে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িই ভাঙা হচ্ছে কিনা এবং রাজ্য সরকার জাতি বিতাড়নের পদক্ষেপ করছে কিনা।” আদালত তাদের নির্দেশে আরও বলেছে, সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, নুহতে ও গুরুগ্রামে গত দু’সপ্তাহে কত ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে এবং সেগুলো ভাঙার আগে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল কিনা।

নুহ ও গুরুগ্রামে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর প্রশাসনিক পদক্ষেপে অন্তত ৫০০০ হকার, দোকানদার, ছোটোখাটো ব্যবসায়ী নিজ নিজ রাজ্যে ও গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এত মানুষ যে জীবিকা হারালেন, বাস্তুচ্যুত হলেন, চূড়ান্ত সংকটে নিমজ্জিত হলেন তা নিয়ে বিজেপির খট্টর সরকারের বিবেক বিন্দুমাত্র আহত বোধ করেনি। উল্টে পরিকল্পনা মাফিক অশান্তি ও বিদ্বেষ সৃষ্টির পর প্রশাসন ঝাঁপালো সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ধ্বংস করতে, নিজেদের তৈরি করা আশ্রয় থেকে তাদের বিতাড়িত করতে। আর প্রবল রূপে সক্রিয় হয়ে উঠল মেরুকরণের প্রক্রিয়া। এই সক্রিয়তার উদ্যোগ দেখা গেল গুরুগ্রামের টিগরা গ্রামে রবিবার (৬ আগস্ট) আয়োজিত মহাপঞ্চায়েতে। সেই পঞ্চায়েত থেকে ওঠানো হলো এই প্রস্তাব — আঞ্জুমান মসজিদের ইমামকে হত্যা এবং মসজিদে আগুন লাগানোর জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে। অন্যথায় বড় আন্দোলন সংগঠিত করে এলাকাকে অচল করে দেওয়া হবে। মহাপঞ্চায়েত থেকে এই আহ্বানও উঠে এলো — মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভাবে বয়কট করুন! মুসলমানদের কাছ থেকে হিন্দুরা যেন কিছু না কেনেন, তাদের ঘর ও দোকান ভাড়া যেন না দেওয়া হয়। সমাজমাধ্যমে তোলা মহাপঞ্চায়েতের ভিডিওতে সংগঠকরা দিলেন এই নির্দেশ, “সব দোকানদাররা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আপনার দোকানে কোনো মুসলমান কাজ করলে তাকে অবিলম্বে ছাঁটাই করুন। আপনাকে দু’দিন সময় দেওয়া হচ্ছে। এই দু’দিন পরও কোনো দোকানদার তার দোকানে কোনো মুসলমানকে কাজে রাখলে আমরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করব।… তাকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে দোকানের বাইরে পোস্টার সাঁটাবো।” এলাকায় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সহস্রাধিক লোকের জমায়েতে ঐ মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত হয়েছিল এবং প্রশাসনের প্রশ্রয় ছাড়া সেটা যে সম্ভব ছিল না তাও সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং মুসলিম-বিরোধী বুলডোজার অভিযানের সবটাই সংঘটিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে ছকা নীল নকশার রূপায়ণে। এর উদ্দেশ্য, ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু বিরোধী ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটানো। নরেন্দ্র মোদী, মোহন ভাগবতদের উপলব্ধি সম্ভবত এই যে, একমাত্র এই পথেই তাঁরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন। হরিয়ানার জাট সম্প্রদায়ের কৃষক নেতা ইন্দরজিৎ তোমার যথার্থভাবেই বলেছেন, “নুহতে আমরা যা দেখলাম, লোকসভা নির্বাচনের আগে আগামী মাসগুলোতে দেশের অন্যান্য অংশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হবে। বিজেপি মনে করছে যে, তারা যেহেতু প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি তাই মেরুকরণই তাদের উদ্ধার করে দেবে।” তবে, একই কৌশল বারবারই সমানভাবে সার্থক হবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া অতি বড় শক্তিমানের পক্ষেও কি সম্ভব!

- জয়দীপ মিত্র

3rd-largest-economy3rd-largest-economy-but
(কিন্তুর আগের অংশগুলির তেমন কোনো গুরুত্ব থাকে না)

২০১৯ সালে, ২০১৮-১৯ সালের অর্থবর্ষের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন ৫ বছরের মধ্যে দেশের জাতীয় উৎপাদন ৫ ট্রিলিয়ন (১ ট্রিলিয়ন = ১ লক্ষ কোটি) ডলারে পৌঁছে দেবে তার সরকার। অবশ্য কোনো এক টিভি চ্যানেলে বিতর্কের সময়ে তাঁর দলের মুখপাত্র সম্বিত পাত্র ১ ট্রিলিয়নে কটা শূন্য থাকে তা বলতে পারেননি। পরে ২০২০ সালে অক্টোবর মাসে মোদীজি পুনরায় বলেন যে, দেশের জিডিপি ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষেই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে বলে তিনি মনে করেন। করোনায় যে সময় নষ্ট হয়েছে তাকে পুষিয়ে দিতে অর্থনীতিকে একটু দ্রুতলয়ে চলতে হবে মাত্র, যা তাঁর সরকার চালাতে সক্ষম। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে দেশের জিডিপি ৩.৭৩ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে বর্তমান চলতি অর্থবর্ষে জিডিপির বৃদ্ধি ডলারের অঙ্কে ৩৪ শতাংশের বেশি হতে হত। প্রধানমন্ত্রী দেরিতে হলেও বুঝেছেন যে সেটা সম্ভব নয়, তবে তিনি সরাসরি নিজের ভুল স্বীকার করেননি, করেন না, কারণ রাজা কখনো ভুল করতে পারেন না। বলতে শুরু করেছেন যে, ভারত এখন বিশ্বের ৫ নম্বর অর্থনীতি এবং শিগগিরি আমরা ৩ নম্বর অর্থনীতি হয়ে যাব, দেশের জিডিপি ২০২৬-২৭ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। মোদীজি অনৃত ভাষণে পটু। তাছাড়া তাঁর তাঁবে সমস্ত মিডিয়া হাউসগুলি রয়েছে। ফলে তিনি যেটা বলবেন সেটাকে প্রচারের মাধ্যমে সত্যিতে রূপান্তর করা হবেই হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের জিডিপি পরিসংখ্যান অনুযায়ী যদি ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতকে ৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতিতে পরিণত করতে হত তাহলে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রয়োজন ছিল বার্ষিক ১২ শতাংশ। যেখানে ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৮-১৯ সাল পর্যন্ত ওই বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক মাত্র ৬.৮ শতাংশ। ফলে প্রধানমন্ত্রীর ৫ বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার ঘোষণা একটি জুমলা ছিল বলাই যায়। মোদীজির রাজত্বে দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি নিয়ে খুব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রকৃত সত্য হচ্ছে ওই রাজত্বের ৯ বছরে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার বার্ষিক ৬.৯ শতাংশ। তুলনায় মনমোহন সিং সরকারের ১০ বছরে ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল বার্ষিক ৯.৯ শতাংশ। যদি ওই হার বজায় রাখা যেত তাহলে সত্যি সত্যিই ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ৫.২৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যেত। অন্যদিকে যদি ডলার মূল্যে জিডিপি বৃদ্ধির হার মোদীজির রাজত্বের হারে চলতে থাকে তাহলে ওই ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অঙ্ক ২০২৬-২৭ অর্থবর্ষেও ছোঁয়া যাবে না। সেখানে পৌঁছতে আরো এক বছর লেগে যাবে। যদি ডলার মূল্যে বার্ষিক বৃদ্ধির হার অন্তত ৭.৬ শতাংশ থাকে তাহলেই দেশের জিডিপি ২০২৬-২৭ সালে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে পারবে। সুতরাং এটা বলা যেতেই পারে যে, বর্তমান সরকার জিডিপিকে ৫ ট্রিলিয়ন ডলারে যথাসময়ে নিয়ে যেতে সার্বিক ব্যর্থ হয়েছে, অন্তত পক্ষে ৩ বছর পিছিয়ে দিয়েছে দেশের অর্থনীতির পরিমাণকে। দেশের অর্থনীতির পরিমাণ বা বহর নিয়ে মোদী সরকারের গর্বিত নয়, লজ্জিত হওয়ার কথা।

তবে কেবল পরিমাণ নয়, বহু অর্থনৈতিক বিষয়েই বর্তমান সরকারের অক্ষমতা পরিস্কার। প্রকৃতপক্ষে জিডিপির পরিমাণ বা বৃদ্ধি দেশের জনকল্যাণ বিষয়ে কিছুই বলে না, কীভাবে সেই জিডিপি বা তার বৃদ্ধি বন্টিত হচ্ছে তা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপিকে পরিমাপ করার একটি পদ্ধতি হচ্ছে ব্যক্তিগত ভোগব্যয় (C), বিনিয়োগ ব্যয় (I), সরকারি ব্যয় (G), নিট রফতানি (X - M) অর্থাৎ রফতানি (X) – আমদানি (M)

ফলে জিডিপি = C + I + G + (X - M)। জিডিপির হিসেবের অন্তর্ভুক্ত ওই সমস্ত বিষয়গুলির পর্যালোচনা করলেও দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা জানা যেতে পারে। ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের দুএকটি পণ্য ও পরিষেবার দিক থেকে আপাতত দেখা যাক।

২০২২-২৩ সালে দেশের মধ্যে টু’হুইলারের বিক্রির সংখ্যা ১৫৮.৬ লক্ষ, ২০২১-২২ সালের তুলনায় ১৭ শতাংশ বেশি। কিন্তু তা ২০১৪-১৫ সালের ১৫৯.৮ লক্ষের তুলনায় কিছুটা কম, এবং ২০১৮-১৯ সালের ২১১.৮ লক্ষের তুলনায় অনেক কম। অনেক পরিবারের কাছেই টু’হুইলার মধ্যবিত্ত জগতে প্রবেশের একটি ধাপ, এবং অনেকের কাছেই বাড়ির পরে দ্বিতীয় দামি পণ্য। ফলে এই যে টু’হুইলারের বিক্রির পতন তা জানান দেয় যে নিম্ন আয় বর্গের বহু পরিবারের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে। কেবল তাই নয়, কম দামি টু-হুইলারের বিক্রি সামগ্রিক টু’হুইলার বিক্রির তুলনায় আরো দ্রুত কমেছে। ফলে বলা যায় যত আয়স্তরের নিচের ধাপে পৌছনো যাচ্ছে তত ক্রয় ক্ষমতা কমছে।

২০২২ সালে ভারতে ১৪.৪ কোটি স্মার্ট ফোন আমদানি করা হয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ কম। সামগ্রিকে ২০২২ সালে ২০.১ কোটি মোবাইল ফোন এসেছে ভারতে যা ২০২১ সালের তুলনায় ১২ শতাংশ কম। কিন্তু আই ফোনের ও দামি স্মার্ট ফোনের বিক্রি বেড়েছে। এক্ষেত্রেও সেই বিত্তবানের রামরাজ্য।

দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে চিহ্নিত করতে দেশের অসামরিক পরিবহণ মন্ত্রক জানিয়েছে যে ৩০ এপ্রিল ২০২৩এ রেকর্ড সংখ্যক ৪,৫৬,০৮২ যাত্রী বিমানে ভ্রমণ করেছে। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ শতাংশ ভারতীয় ৪৫ শতাংশ বিমান যাত্রী। তাছাড়া ১৪০ কোটির দেশে ৪.৫ লক্ষ বিমানযাত্রী কিছুই না। ২০২২-২৩ সালে ১৩.৭ কোটি দেশের মধ্যে বিমান চড়েছেন। কিন্তু তা ২০১৮-১৯’র ১৪.১ কোটি বা ২০১৯-২০ সালের ১৪.২ কোটিকে ছড়াতে পারেনি। ২০২২-২৩ সালে ট্রেনযাত্রীর সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের যাত্রী সংখ্যার তুলনায় ২৪ শতাংশ কম, ২০১৯-২০ সালের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কম। যদি লোকাল ট্রেনের যাত্রী বাদ দিয়ে ধরা হয় তাহলে ওই সংখ্যা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় ২৯ শতাংশ ও ২০১৯-২০ সালের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম। ফলে ধরা যেতে পারে বহু ব্যক্তিই আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হয়ে পড়ায় দীর্ঘ যাত্রার ট্রেনে চড়ছে না। আবার কাজের ক্ষেত্রে গতি না আসায় লোকাল ট্রেনেও চড়ছে না। হিন্দুস্তান লিভারের কর্তার বক্তব্য অনুযায়ী ফাস্ট মুভিং ভোগ্যপণ্যের (সাবান, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু ইত্যাদি) বাজার ক্রমাগত কমছে, গ্রামীণ বাজার বেশি করে কমছে। অন্যদিকে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা কোভিড অতিমারির সময়ের তুলনায় কমলেও, ২০১৯-২০ বা ২০১৮-১৯ সালের তুলনায় যথেষ্টই বেশি। ফলে কাজের বাজারের অবস্থাও খারাপ। সিএমআইই’র পরিসংখ্যানও তেমনটাই জানাচ্ছে, উপরন্তু শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণের অনুপাতও কমছে, বিশেষত মেয়েদের।

এবছরে ভারত ইউকে’কে জিডিপির পরিমাণে টপকে গেছে। আইএমএফ’এর পরিসংখ্যা অনুযায়ী ইউকের জিডিপি (৩.১৯ ট্রিলিয়ন ডলার) ২০২১ সালে ভারতের জিডিপির (৩.১৮ ট্রিলিয়ন ডলার) থেকে সামান্য বেশি ছিল। ওই সময়ে ইউকের জনসংখ্যা ছিল ৬.৭৩ কোটি, ভারতের জনসংখ্যা ছিল ১৩৯ কোটি। ফলে ভারতীয় জনগণের গড় উৎপাদনশীলতা ব্রিটিশ জনগণের গড় উৎপাদনশীলতার ২০ ভাগের একভাগের থেকেও কম ছিল। ফলে জিডিপির পরিমাণে টপকে গেলেও ইউকের তুলনায় ভারত শক্তিশালী অর্থনীতি তা বলা বাতুলতা। একই ভাবে বলা যায় ভারতের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ব্রিটেনের মাথাপিছু আয়ের তুলনায় ৫ শতাংশের কম। যদি মোদী সরকার ৫ম বৃহত্তম অর্থনীতি বলে গর্ব প্রকাশ করে তাহলে একই সাথে মাথাপিছু আয়ের কথাও বলতে হবে। এবং এও জানাতে হবে যে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের অবস্থান ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪৫তম।

যে সমস্ত কথা এই ছোট্ট পরিসরে লেখা হল তা মোদীজি তথা বিজেপির মেকি গর্বের অসারতার আংশিক উন্মোচন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মহীনতা, দেশব্যাপী দাঙ্গার মতো বিষয়গুলিকে এক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

- অমিত দাশগুপ্ত

when-tone-is-exiled-1when-tone-is-exiled_0

“গান ছাড়া বাঁচা মানবাধিকারের ওপর চরম নিগ্রহের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ” — এটা আমরা একবাক্যে মেনে নেব। কিন্তু সত্যিই যদি এমন হয়!

হয়েছে, আফগানিস্তানে। আরএসএস চিন্তক সাভারকারের কথায়, “ধর্ষণ একটি বৈধ রাজনৈতিক হাতিয়ার” (অর্থাৎ সাধারণভাবে যেটা ঘটে থাকে তাকে নিন্দিত নয়, নন্দিত করেছেন ‘বৈধতা’ দিয়ে!)। এটা জেনে বা না জেনেই, বিজেতারা বিজিত নারীদেহের যেমন দখল নেয়, তেমনই চলে নারীকে ঘরবন্দি করে, নারীর জীবনের ওপরও নানা দখলদারি। তালিবানরা নতুন করে, আমেরিকার অনুগ্রহে আফগানিস্তান দখলের পর, প্রথমেই মেয়েদের মুখের ওপর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণাগার তো বটেই অফিস আদালত সহ যে কোনও রকম কর্মক্ষেত্রের দরজাও বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের ঘরে থাকতে হবে। বাইরে বেরোনোই নিষেধ। কারণ হিসেবে আফগান মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ ২০২১-এ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাদের নতুন সদস্য ও প্রশিক্ষণহীন যোদ্ধারা মহিলাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে পারে। সেই ঝুঁকি তালিব সরকার নেবে না! তাই আপাতত মহিলাদের ঘরে থাকতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে মহিলাদের জীবন আবার আগের ছন্দে ফিরবে।

না, আগের ছন্দ তো ফেরেইনি, বরং নিত্য নতুন নিষেধাজ্ঞায় নিয়ন্ত্রণ কঠোরতর হয়ে চেপে বসেছে। মহিলাদের জন্য সংগীত নিষিদ্ধ হল। গর্ভনিরোধক নেওয়া বারণ। মাত্র ক’দিন আগে বিউটি পার্লারগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের জিমে-পার্কে যাওয়াও নিষিদ্ধ। এবার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্যই সংগীতচর্চা নিষিদ্ধ করা হল। কারণ “সংগীত নৈতিক অবক্ষয় ঘটায়। যুব সমাজকে উচ্ছন্নে পাঠায়!” তাই ‘চারিত্রিক গুণের প্রসার ও দোষ প্রতিরোধ’ মন্ত্রকের নির্দেশে প্রশাসন সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজেয়াপ্ত করে হেরাট প্রদেশে সেগুলো জ্বালিয়ে বহ্ন্যুৎসব পালন করেছে! ঠিক যেমন বজরঙ্গীরা বিহারে আজিজিয়া মাদ্রাসা ও গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দিয়েছিল যেখানে ৪৫০০’র ওপর দুষ্প্রাপ্য বই ধ্বংস হয়ে গেছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বঞ্চিত আফগান মহিলারা তাহলে কী করবেন? কেন, মনুস্মৃতিতেই তো তার নির্দেশ রয়েছে! মনে আগল এঁটে শুধু শরীরকে উন্মুখ রাখা পুরুষের ইচ্ছামতো ‘পৌরুষ’ চরিতার্থতার জন্যে; আহার্যের প্রস্তুতি, সংসার ও সন্তান প্রতিপালন সহ সমস্ত গার্হস্থ্য কাজ মুখ বুজে করে যাওয়া! প্রায় বাড়ির পোষা ভারবাহী পশুটির জীবন!

ইরানে মাহসা আমিনিকে নীতি পুলিশরা ‘নীতি’ শেখাতে গিয়ে মেরে ফেলার পর ইরানী মেয়েরা হাজারে হাজারে রাস্তায় নেমে গর্জে উঠেছিল শাসকের অন্যায় হিজাব-ফতোয়ার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস প্রাণ কেড়েছে প্রতিবাদে উত্তাল নারী-পুরুষের। আজও জ্বলছে সে আগুন। আফগান মহিলারাও জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে মাঝে মাঝেই প্রতিবাদে পথে নেমেছেন। উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। আগামীতে নিশ্চয়ই আরও বড় প্রতিবাদ হবে।

কিন্তু জীবন থেকে সংগীত’কে শুধু বন্দুকের জোরে মুছে দেওয়া সম্ভব? যে সংগীতকে ঈশ্বরের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে যুগ যুগ ধরে সাধনা করে গেছেন সুরের ইন্দ্রজাল স্রষ্টা সংগীতসাধকেরা! আমাদের বাউল আর সিরিয়ার ভূখণ্ডে জন্ম নেওয়া সুফি সংগীতের বার্তা তো প্রায় একই! গোটা পৃথিবীকে হাজার হাজার মাইলের ব্যবধান ঘুচিয়ে, ভাষা রীতিনীতির দেওয়াল ভেঙে একসূত্রে বাঁধতে পারে তো সুরই! যা বহতা নদীর মত মানুষের দুঃখ বেদনা আনন্দ সংগ্রামের জীবন রসে পুষ্ট এবং পৃথিবীজোড়া সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সমন্বয়ের নির্যাসে ক্রমশ ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর হয়ে উঠেছে! আবার মানুষের সভ্যতাকেও পুষ্টি ও গৌরব দিয়েছে!

আফগানিস্তানে সুরের ওপর নিষেধাজ্ঞা এই প্রথম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ — তালিব শাসনের প্রথম পর্যায়ে সংগীত, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিয়ম ভাঙলে কঠোর শাস্তি। সেই সময় তারা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ও অন্যান্য ঐতিহাসিক স্মরক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে ইতিহাস তথা সভ্যতার অপূরণীয় ক্ষতি করেছিল। ঠিক যেমন আরএসএস-বিজেপি'র করসেবকরা ১৯৯২-তে বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল।

মার্কিনী সেনা অভিযানে তালেবরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর আবার আফগান জীবনে সুর ফিরে আসে। সেখানে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মিউজিক প্রতিষ্ঠিত হয়। মহিলারাও দেশে-বিদেশে কনসার্টে অংশ নিয়েছেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ের তালেব শাসনে সেই ইন্সটিটিউট বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া হয় রবাব সন্তুর সেতার তবলাসহ বহুমূল্য সমস্ত বাদ্যযন্ত্র। কিন্তু সংগীতকে বাঁচিয়ে রাখার দুর্মর বাসনায় প্রাণ হাতে করে ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ, অন্যান্য শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে পালিয়ে পর্তুগালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানেই চলেছে সুরসাধনা। তাদের অনেকেই বর্তমানে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। কিন্তু ছেড়ে যাওয়া দেশের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে।

যাঁর উচ্চারণ দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম, তিনি বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সাইমন ব্রাউটন। তাঁর দুটি ছবি, ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স : মিউজিক অব আফগানিস্তান’ এবং ‘সুফি সৌল : দ্য মিস্টিক মিউজিক অব ইসলাম’ হয়তো অনেকে দেখেছেন। আফগানিস্তান, সিরিয়া, তুরস্ক সহ মধ্যপ্রাচ্যের সংগীত পরিক্রমার এক ইতিবৃত্ত। তাঁর এক সাক্ষাৎকারে (পুরোনো) বলেছিলেন, ৯/১১’র পর ইসলামকে ‘দানবীয়’ চেহারা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইসলাম প্রকৃত অর্থে শান্তির বার্তা বহন করে। সুফি গানের মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারি, সংগীত, কবিতা ও শিল্পকলার অন্যান্য ধারায় কী দারুণ ঐতিহ্য রয়েছে মুসলিমদের। তাঁর কথায়, আফগানদের মধ্যে সংগীতের প্রবল ক্ষুধা আছে যা তিনি ছবি তৈরির সময়ে লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাব সংস্কৃতিতেও পড়ে। আইসিস আক্রমণে সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহুমূল্যবান ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন যেমন চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে তেমনই সুফিবাদ তথা উদার বহুমুখী সাংস্কৃতিক সমন্বয়ও বড় বিপন্ন। তাঁর সেই আশঙ্কাই আজ আরও গাঢ হল।

যে আফগান শিশুরা সুরের নির্বাসনের মধ্যেই বড় হচ্ছে তাদের মস্তিষ্ক তথা মানসিক বিকাশ কী করে সম্পূর্ণ হবে সুরের অনুরণন ছাড়া? কোমল শিশুমন সুরপিয়াসী। তার সুকুমার প্রবৃত্তিগুলির কোমল পরিচর্যা তো সংগীতই করতে পারে। গান তাকে কল্পনাবিলাসী আবেগপ্রবণ করে তুলবে। নিজের দেশকে, দেশের অতীত ইতিহাসকে, সমাজ-সংস্কৃতি-মানুষকে চিনতে জানতে সাহায্য করবে। বিশ্বমানবতার দরজায় হাত ধরে পৌঁছে দেবে। তাই সংগীত ছাড়া সে এক মানবিক পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবে কীভাবে? মণিপুরের এক ত্রাণ শিবিরে প্রায় সমস্ত শিশুই জানিয়েছে, তাদের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ‘বন্দুক’! যুদ্ধবাজ, দাঙ্গা-দীর্ণ, ‘গ্লোবাল বয়েলিং’এর এই পৃথিবীতে নিরাপত্তাহীন, জীবনের সমস্ত কোমলতা থেকে বঞ্চিত ক্ষুধার্ত শিশুরা চায় ‘অস্ত্র’! কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছি আমাদের সন্ততিদের জন্য?

আরএসএস-বিজেপি আজ ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণে কোণে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতির আগুন জ্বালিয়ে তুলছে। মানবতাকে সমানে কলঙ্কিত করে চলেছে। আমাদের শিশুদের জন্য যেমন এই মুহূর্তেই চাই হিংসার কলুষমুক্ত ভালোবাসার এক সবুজ সকাল, মানবতা-বিদ্বেষী তালিব সংস্কৃতিও আফগান জীবন তথা পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে যাক! উপত্যকা জুড়ে কর্মক্লান্ত দিনের শেষে নেমে আসুক সংগীত-উচ্ছল এক মায়াবী সন্ধ্যা! পাহাড়ের কন্দরে কন্দরে আবার রবাব, সন্তুরের অনুনাদ, মরমিয়া সুফি সংগীতের অনুরণন বাতাসে ছড়িয়ে দিক শুধু মুঠো মুঠো ভালোবাসা! চঞ্চল রঙীন প্রজাপতির মত!

তার আগে চাই দুরন্ত, দুর্ধর্ষ এক লড়াই যা কখনও দেখেনি কেউ। সংগীত তাকে উজ্জীবিত করে চলুক!

- জয়ন্তী দাশগুপ্ত

revolutionary-singer-gadarsinger-gadar

“যদি তারা আমার কণ্ঠরোধ করে দেয়, 
আমি হাত দিয়ে টেবিল বাজাবো। 
যদি তারা আমার হাত কেটে নেয়, 
তাহলে পায়ে বোল তুলবো। 
যদি পাও কেটে নেয়, 
তবে আমার শরীরকেই জমিতে নাচাবো। 
যদি তারা আমাকে ফাঁসিতে ঝোলায়, 
তবু রক্তসঙ্গীতের ধারায় ধারায় 
আমি আমার গানকে 
মানুষের কাছে পৌঁছে দেব।”

গত ৬ আগস্ট ২০২৩ হায়দ্রাবাদে প্রয়াত হলেন বিপ্লবী জনগায়ক, গীতিকার, রাজনীতিজ্ঞ গদর। প্রকৃত নাম গুম্মাদি বিঠল রাও। তিনি ছিলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনের অগ্রণী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। অন্ধ্রপ্রদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জননাট্যমণ্ডলী’র তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রণী যোদ্ধা।

গদরের জন্ম ১৯৪৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের মেদক জেলার তুপরান গ্রামের এক গরিব উপজাতি সম্প্রদায়ের ঘরে। বাবা ছিলেন আম্বেদকরবাদী, মা ছিলেন এক সাধারণ ক্ষেতমজুর। ছাত্র হিসাবে খুব মেধাবীই ছিলেন, ফলে ১৯৬৭ সালে ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ভর্তিও হন। উপজাতি সম্প্রদায়ের সংরক্ষিত আসনে জায়গা পান, হোস্টেলও পান। কিন্তু যখন ৭৭ শতাংশ নম্বর পেলেন, তখন এক উচ্চবর্ণের ছাত্র তাঁকে ব্যঙ্গ করে বললো, “তুমি তো সরকারের জামাই।” এই কথায় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন। তখন বৌদ্ধদর্শন ও সাহিত্যের বইপত্র পড়তেন। কিন্তু লাভ কিছুই হল না, বরং বিভ্রান্তি বাড়তে থাকে। দলিত আন্দোলনও তখন চলছে না। সবকিছুই স্থিতাবস্থার শিকার। তবু মনের শান্তির জন্যই শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণির মানুষের জীবন নিয়ে গান লিখতে শুরু করেন।

১৯৬৮-৬৯-এ তখন তিনি ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। শ্রীকাকুলামের কৃষক বিদ্রোহও তখন তুঙ্গে। সুব্বারাও পাণিগ্রাহীর মতো বিখ্যাত কবি গায়কগণ যুক্ত হয়েছেন আদিবাসীদের জমি আন্দোলনে। যাঁরা শত শত বছর ধরেই ওইখানে বাস করেছেন, তাঁরা তাদের জমি দাবি করলেন। তৎকালীন সিপিএম থেকে বিভক্ত সিপিআই(এমএল)’কে সমর্থন জানালেন। গণশিল্পীরা মঞ্চে মঞ্চে গাইছেন — “এসো চলো আমরা জনসেনায় শামিল হই, প্রজাসেনায় শামিল হই, লালসেনায় সামিল হই”। এই ঘটনায় গদর দারুণভাবে প্রভাবিত হলেন। একজন ছাত্র এবং একজন বুদ্ধিজীবী হিসাবে তিনিও উন্মুখ ছিলেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য কিছু করতে; শ্রীকাকুলামের আন্দোলনের ফলে তাঁর আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠল। এই সময়ের ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও সারা ভারতে এই আন্দোলন ব্যাপক প্রভাব সাড়া ফেলে। তিনিও তাতে অংশগ্রহণ করেন। ক্রমে এই প্রবাহের মধ্যে মিশে যান।

সিকন্দ্রাবাদের চলচ্চিত্র নির্মাতা নির্দেশক নরসিংহ রাও ১৯৬৮ সালে ‘আর্ট লাভার্স’ নামে শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীদের একটি সংস্থা গঠন করেন; গদর তাতে শামিল হন। মার্কসবাদের প্রতি এই গ্রুপটির বিশেষ আকর্ষণ ছিল। নরসিংহ রাও তেলেঙ্গানার সশস্ত্র সংগ্রামের উপর গৌতম ঘোষের নির্দেশনায় ‘মাভূমি’ নামে একটি ফিল্ম তৈরি করেন। গদর তাতে গান গেয়েছিলেন এবং একটি ছোট্ট ভূমিকাতেও অভিনয় করেছিলেন।

ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা জর্জ রেজ্জির হত্যার প্রতিবাদে ‘আর্ট লাভার্স’ ‘স্মৃতি সপ্তাহ’ পালন করে। এই উপলক্ষে একটি গানের বই প্রকাশ করা হয় এবং সারা শহরে বহু অনুষ্ঠান করা হয়। এই অনুষ্ঠানগুলিতে ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে তাঁরা আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। জনগণের মধ্যে যে শিল্পরূপগুলি বিদ্যমান ছিল সেগুলিকে তাঁরা বিপ্লবের বাণী প্রচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অগ্রসর হলেন এবং এই বিকাশের পরিণতি হিসেবে ১৯৭৩ সালে ‘জননাট্যমণ্ডলী’র জন্ম হল। তাঁরা মানুষের আন্দোলনের সাথে একাত্ম হতে গেয়ে উঠলেন,

“ও রিক্সাচালক রহিম ভাই, 
পাথর ভাঙ্গিয়ে রাম ভাই, 
ড্রাইভার মল্ল ভাই, কুলি কোমরম ভাই, 
ভারিওয়ালা মেসন ভাই, 
আর মজুর ভাইদের প্রতি নিবেদন 
অনুগ্রহ করে আমাদের কথা শুনুন ...”

আর কাঁধের উপর লালপাড় চাদর, হাঁটু অবধি লালপাড় হলদে ধুতি, পায়ে ঘুঙুর, হাতে লাঠি নিয়ে জনগণের কাছে আবেদন রাখছেন জননাট্যমণ্ডলীর নেতৃত্বকারী শিল্পী গদর। আড়াই দশক ধরে বিপ্লবী গান গেয়ে, পালা বদলের নাটক অভিনয় করে, নৃত্যনাট্যে নেচে গেয়ে বিদ্রোহের বাণী শুনিয়ে আসছিলেন। খেটে খাওয়া মানুষদের কাওয়ালি, রাখালদের নৃত্যে মাতিয়ে দিচ্ছিলেন গ্রামগঞ্জ। জনগণের হৃদয় আর মস্তিষ্কের কাছে আবেদন রাখছিলেন শিল্পীদল। বিপ্লবী চিন্তাধারা এবং সংগ্রামী সংস্কৃতিকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দিন প্রতিদিন। এখনও অন্ধ্রপ্রদেশের জননাট্যমণ্ডলী ও গদর নামের সাথে সাধারণ সর্বস্তরের মানুষ পরিচিত।

জননাট্যমণ্ডলী জনগণের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব রচনাই সংগঠনের সদস্যরা জনগণের সাহায্যেই লেখেন, তাঁদের সাহায্যে লেখার পরিমার্জনা করেন। এই প্রক্রিয়া ততদিন চলতে থাকে যতদিন পর্যন্ত না রচনাটি ঠিকঠাক উঠে আসে। তারপর তা ব্যাপক জনগণের সামনে উপস্থিত করা হয়। যখন কোন নতুন গান লেখা হয়, সেই গানের প্রস্তুতির জন্য বেশভূষা, ভঙ্গিমা, শব্দাবলী, বাক্যরচনা, ভাষা — সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রদর্শনের জন্য খুঁটিনাটি সবকিছুই জনগণের কাছ থেকে তাঁরা শেখেন। প্রক্রিয়াটি এই রকম : জনগণের কোন শ্রেণির সম্বন্ধে কিছু লিখতে হলে, জননাট্যমণ্ডলীর শিল্পীরা তাঁদের মাঝে থেকে তাঁদের জীবন যাত্রার অংশীদার হয়ে জ্ঞানার্জন করেন। “জনগণের কাছ থেকে নিয়ে জনগণকে দেওয়া”র প্রয়োগ করেন। এই কারণেই তাদের গান সোজা, সরল ও হৃদয়গ্রাহী হয়।

“আগুন এ যে আগুন 
খালি পেটের আগুন 
এ যে অশ্রুজলের অঙ্গার 
এ যে দুঃখীজনের হাহাকার 
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে এ যে 
দিক থেকে দিকে ছাইছে যে এ ...”

গত আড়াই দশক ধরে অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রামেগঞ্জে, কারখানার গেটে, মিছিলে, সভায়, প্রদেশের প্রতিটি কোণায় জননাট্যমণ্ডলী হাজার হাজার প্রোগ্রাম করে লক্ষ লক্ষ লোকের কাছে বিপ্লবের বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে, দলিত ও নিপীড়িত জনগণের কল্পনাকে আশ্বস্ত করে — মজুর, কৃষক, ছাত্র-যুবক ও কর্মচারী সকলেরই সমস্যা তাঁরা ছুঁয়েছেন। রেল মজদুর, রিক্সাওয়ালা ও গরিব পুলিশের উপর লেখা গান অতুলনীয়। প্রোগ্রাম ভেস্তে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছে পুলিশ। তখন জননাট্যমণ্ডলী গরিব পুলিশের উপর লেখা গান গাইতে শুরু করেছে, পুলিশের লাঠি থেমে গেছে, গানের তালে তালে তাঁরা মাথা নেড়েছে। এন টি রামারাও, সত্য সাঁইবাবার উপর ব্যঙ্গগীত এবং শহিদদের উপর লেখা ‘অমর বীরলোকু জয় বোলো’ অত্যন্ত লোকপ্রিয়। এছাড়া ‘গাঁও হামারা গলি হামারী’, ‘মজদুর মেরে ভাই’, ‘লাল সেলাম’ এবং ‘ভারত অপনী মহান ভূমি’ গানগুলি আজ শুধু অন্ধ্রেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের বিভিন্ন সংগ্রামী অঞ্চলের সাংস্কৃতিক দলই আজ এই গানগুলি গাইছে। জননাট্য মণ্ডলী প্রায় ৩০০ গান ‘রগল জণ্ডা’ (লাল পাতাকা), ‘অসম’ এবং ‘কাশ্মীর’ নৃত্যনাট্য ও নাটকে তাদের রচনা কুশলতা এবং প্রয়োগ নৈপুণ্যের পরিচয় রেখেছেন। আর এর নেতৃত্ব দিয়েছেন গদর। জননাট্যমণ্ডলী এটা প্রমাণ করেছে যে লেখক শিল্পীরা প্রতিভা নিয়েই জন্মগ্রহণ করেন ধারণা ঠিক নয়; পরিবেশ লেখক-শিল্পীকে তৈরি করে। জননাট্যমণ্ডলীর সব শিল্পীরাই খুব সাধারণভাবেই শুরু করেছিলেন, কিন্তু জনগণের সঙ্গে তাঁদের একাত্মতা এবং প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে গদর, সঞ্জীব, বাঙ্গপাণ্ডু প্রসাদ রাও, দিবাকর ও রমেশের মত শিল্পীদের মুক্তোয় পরিবর্তিত করেছে। শিল্পীদের সম্পর্কে কোনো রকম দেবদত্ত ধারণা জননাট্যমণ্ডলী মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়েছে। আসল শিল্প জনগণের মধ্যে বিদ্যমান, বিপ্লবী শিল্পীদের অত্যন্ত বিনম্রভাবে তাঁদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এইভাবে শিক্ষাগ্রহণ করে জননাট্যমণ্ডলী আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে।

বিপ্লবী সাংস্কৃতিক সংগঠন হওয়ার অপরাধে জননাট্যমণ্ডলীকে শ্রেণীশত্রুর আক্রমণের সামনে পড়তে হয়েছে। ভূস্বামী ও তাদের গুণ্ডারা এবং সরকার বহুবার জননাট্যমণ্ডলীর প্রোগ্রাম ভেস্তে দিয়েছে — শিল্পীদের উপর আক্রমণ করেছে। পুলিশ শিল্পীদের প্রেপ্তার করেছে; তাঁদের বেধড়ক পিটিয়েছে, বিভিন্ন সময়ে জেলে পুরেছে। গুন্টুর জেলার র‍্যাডিক্যাল ইয়ুথ লীগের প্রতিষ্ঠা অধিবেশনের প্রচার অভিযানের সময় ১৯৭৫ সালে পুলিশ জননাট্য মণ্ডলীর সদস্যদের গ্রেপ্তার করে। গদরকে পুলিশ বেশ কিছুদিন বেআইনিভাবে তাদের হেফাজতে আটক রাখে, শারীরিক যন্ত্রণা দেয়। পরে উনি জামিনে মুক্ত হন এবং জননাট্যমণ্ডলীর অন্য সদস্যদের সঙ্গে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যান। কানাড়া ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে পার্টি এবং জননাট্যমণ্ডলীতে পুরোপুরি সক্রিয় হন। জরুরি অবস্থায় গদর মোষপালকের বেশে গ্রামে ঘুরেছেন, এই সময় জননাট্যমণ্ডলী তেলেঙ্গানায় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। জননাট্যমণ্ডীর উপর পুলিশি অত্যাচার নেমে আসলে পাঁচ বছর অবধি গুপ্ত জীবন যাপনের পর ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯০ সালে হায়দ্রাবাদের প্রেস ক্লাবে পত্নী বিমলা, কন্যা কেল্লা (চাঁদনী) ও দুই পুত্র সূর্যকিরণ ও চন্দ্রকিরণের সঙ্গে গদর আবার সাধারণ জীবনে ফিরে এলেন। এই ফেরার পর জননাট্যমণ্ডলী যখন প্রথমবার প্রোগ্রাম করেন তা দেখতে দু’লাখ লোক এসেছিলেন। ১৯৯০ সালের ৫ এবং ৬ মে ‘রায়তু কুলী সঙ্ঘম’ (ক্ষেত মজদুর সঙ্ঘ)-এর তৃতীয় রাজ্য সম্মেলনে এক সাক্ষাৎকারে গদর বলেন, “পুলিশ এবং শাসকদলের বক্তব্য হল সিপিআই(এমএল) শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা জীবনমরণ পণ করে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। লক্ষ লক্ষ লোক আমাদের সঙ্গে রয়েছেন — জনগণের এগিয়ে যাওয়া কেউ রুখতে পারবে না।” এটা কিন্তু ফাঁকা আওয়াজ ছিল না, ছিল কৃষি বিপ্লবের বাস্তব ছবি।

গদরের স্বর ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁকে রামনগর ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ানো হয়। ১৯৯০ সালে ভিলাই’য়ে গদর সহ জননাট্যমণ্ডলীর ২৫ জন শিল্পী এবং কবি ভারভারা রাওকে ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার গ্রেপ্তার করে।

৬ই এপ্রিল ১৯৯৭। সময় সন্ধ্যা ছ’টা দশ। নিজের ঘরে বসে রেডিওতে সান্ধ্য খবর শুনছিলেন কমরেড গদর। তখন কয়েকজন আততায়ী তাঁকে সরাসরি গুলি করে। গদরের দেহে পাঁচটি গুলি লেগেছিল, ডাক্তাররা চারটি গুলি বের করে দিলেও; একটি গুলি তাঁর মেরুদণ্ডের শিরার কাছে আটকে ছিল এবং তাঁর ফুসফুসের একাংশ ফাটল ধরিয়া দিয়েছিল। সেই গুলি পিঠে নিয়ে গদর প্রয়াত হয়েছেন কিন্তু তাঁর স্বপ্নকে স্তব্ধ করতে পারেনি। তিনি গেয়ে চলেছেন,

“যখন সময় হবে 
আগুন আর মহাসাগর 
উঠে দাঁড়াবে লক্ষ লক্ষ ঢেউয়ে ...”

আর আগামী প্রজন্ম কাছে রেখে গেলেন তাঁর পরামর্শ “প্রতিটি শহিদের রক্ত থেকে একটি ‘রক্তিম গান’ লিখে লিখে প্রত্যেক ঘরে যদি পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে এই গান শোক কমিয়ে আনবে, ধৈর্য এনে দেবে এবং সংগ্রামের গল্প বলবে। শহিদের রক্ত যে ব্যর্থ হবে না, এই গান সে ভরসা দেবে।”

রক্তিম অভিবাদন কমরেড গদর।

(তথ্যঋণঃ ‘গদর সীমাহীন গানের খনি’ পুস্তক) 
- দীপক মিত্র

bcmf conference
খণ্ড-30
সংখ্যা-27