হরিয়ানায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর এখন মেরুকরণের তোড়জোড়
in-haryana-there-is-now-a-wave-of-polarization

আজকের ভারতের প্রশাসনিক ধারা থেকে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সরকার ডাবল ইঞ্জিনে পরিচালিত হলে রাজ্যের নানান সম্প্রদায়গুলোর প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ডাবল বা দ্বিমুখী হয়। সব সম্প্রদায়কে সমান চোখে দেখা, সম-অধিকার ও সম-মর্যাদাসম্পন্ন বলে গণ্য করাটা দুই ইঞ্জিন চালিত রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক রীতি হয় না। এক সম্প্রদায়কে মিত্র ও অন্যান্য সম্প্রদায়কে বৈরি জ্ঞান করাটাই তাদের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মণিপুরে এন বিরেন সিং সরকার যেমন মেইতেই সম্প্রদায়ের সরকার বলেই নিজেদের জ্ঞান করে এবং কুকি সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের মনোভাব বৈর ভাবাপন্ন বলেই পরিলক্ষিত হয়। একইভাবে, হরিয়ানাতে বিজেপির যে ডাবল ইঞ্জিন সরকার রয়েছে, নিজেদের তারা হিন্দুদের সরকার বলেই বিশ্বাস করে, আর মুসলিমরা হলো তাদের ‘অপর’ বা প্রতিপক্ষ, প্রশাসনিক পীড়নই যাদের প্রাপ্য। সম্প্রতি গত ৩১ জুলাইয়ের বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জলাভিষেক যাত্রাকে কেন্দ্র করে নুহ জেলায় সূত্রপাত হয়ে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ গুরুগ্রাম ও সংলগ্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল, তাতে মুসলিম সম্প্রদায় একদিকে প্রশাসনিক পীড়ন এবং অন্যদিকে বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের রড-লাঠি-আগ্নেয়াস্ত্র ধারী দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্যের প্রাণান্তকর পরিস্থিতির মুখে পড়ল এবং তার পরিণতিতে আশ্রয় ও জীবিকাচ্যুত হয়ে তাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন।

আমরা দেখলাম, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ৩১ জুলাই সংঘর্ষ বাধার পর থেকেই হরিয়ানায় বিজেপি শাসিত মনোহরলাল খট্টর প্রশাসন সহসাই নুহ ও গুরুগ্রামে ‘অবৈধ’ অনুপ্রবেশকারী ও তাদের দখলদারি সম্পর্কে প্রবল সচেতন হয়ে উঠল! আর এর প্রতিকারে সেই হাতিয়ারটাই তাদের চূড়ান্ত অবলম্বন হয়ে উঠল, ন্যায় প্রদানে যেটির প্রয়োগে যোগী আদিত্যনাথ হলেন একনিষ্ঠ। মনোহরলাল খট্টর ৩ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে একনাগারে চালিয়ে গেলেন বুলডোজার অভিযান। সেদিনই নুহ জেলার তাওড়ু শহরে হরিয়ানা নগরোন্নয়ন কতৃপক্ষ রেফ ও মহিলা পুলিশ নামিয়ে চার ঘণ্টা ধরে বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিল মুসলিমদের ২৫০টা ঝুপড়ি। কয়েক বছর কেউ কিছু না জানলেও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর জনগণকে জানানো হলো যে, বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ’ অভিবাসীরা বছর তিনেক ধরে এক একর জায়গা দখল করে ঝুপড়ি বানিয়ে রয়েছে। মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট অশ্বিনী কুমার জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী খট্টরের নির্দেশেই এই অভিযান চালানো হয়েছে। শুক্র ও শনিবারেও বুলডোজার অভিযানে কোনও ছেদ পড়ল না। শনিবার ৫ আগস্ট দু’ডজন ‘অবৈধ’ ওষুধ ও অন্যান্য দোকান ধূলিসাৎ করা হলো। রবিবার ৬ আগস্ট জেলা প্রশাসন নলহার রোড অঞ্চলে ৪৫টারও বেশি দোকান ভেঙে দিল। কখনও বলা হলো দোকানগুলো দখলিকৃত জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি হয়েছিল। আবার, এই যুক্তিও দেওয়া হল যে ঐ দোকানগুলোর পরিচালকদের কেউ কেউ হিন্দু-বিরোধী হামলায় যুক্ত হয়েছিল আর তাই তার শাস্তি তারা পেল। রবিবার দিনই নুহতে বুলডোজার দিয়ে ধূলিসাৎ করা হলো সোহনা নামক স্থানের সাহারা নামের তিনতলা বিশিষ্ট একটি হোটেল ও রেস্তোরাঁ। অভিযোগ, এই হোটেলের ছাদ থেকেই নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ব্রিজ মন্ডল জলাভিষেক যাত্রা মিছিলে ইট ছোড়া হয়েছিল। তবে, ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার ৬ আগস্টের এক প্রতিবেদনে হোটেলের মালিক জামশেদের উক্তিকে উদ্ধৃত করে জানানো হয়েছে — ইট ছোড়ার যে হোটেলের ছবি প্রশাসন তাদের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখিয়েছে সেটা অন্য হোটেল, তার হোটেল নয়। প্রতিবেদনে জামশেদের এই উক্তিও উদ্ধৃত হয়েছে যে, “আমি ন’বছর ধরে এই রেস্তোরাঁটা চালাচ্ছি। আমি আমার কর্মীদের রেস্তোরাঁটা বন্ধ করে দিতে বলি। আমার কর্মীরা এবং আমি পিছনে একটা কলোনিতে চলে যাই।” তাহলে হোটেলের মালিক মুসলিম বলেই কি তার ওপর হামলার খাঁড়া নেমে এলো? প্রকাশিত একটি সংবাদ জানিয়েছে, ৩ আগস্ট থেকে চারদিনে খট্টর প্রশাসন ৭০০ ঘর, নির্মিত কাঠামো ও ঝুপড়ি ধ্বংস করেছে যার ব্যাপক সংখ্যাধিকই মুসলমানদের।

now-a-wave-of-polarization

সংঘর্ষ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হলেও এবং বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দিক থেকে মুসলিম-বিরোধী কটুকথা ও প্ররোচনা যথেষ্ট মাত্রায় থাকলেও প্রশাসনিক আক্রোশ এবং হামলার শিকার হয়েছে শুধু মুসলিমদেরই। নিজেদের মুসলিম-বিরোধী মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে খট্টর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনিল ভিজও চন্ডিগড়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘অবৈধ’ নির্মাণের বিরুদ্ধে বুলডোজারও এক প্রতিকার এবং ‘যেখানেই দরকার’ সেখানেই তার ‘ব্যবহার’ হবে। তবে বুলডোজার দিয়ে এই চূর্ণকরণ এতটাই দৃষ্টিকটু এবং তারমধ্যে পক্ষপাতদুষ্টতা এতটাই প্রকট ছিল যে, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে খট্টর সরকারকে বুলডোজার অভিযান বন্ধের নির্দেশ দিয়ে সরকারের উদ্দেশে বলেছে, “আমাদের নজরে এটা এসেছে যে, গুরুগ্রাম ও নুহতে কিছু দাঙ্গা হয়েছে। আপাতভাবে জানা গেছে, ভাঙার কোনো নির্দেশ ও বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে আইন ও শৃঙ্খলাকে অছিলা করে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ না করেই ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ করা হচ্ছে। এই প্রশ্নটি উঠেছে যে, আইন ও শৃঙ্খলাকে ছলা করে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িই ভাঙা হচ্ছে কিনা এবং রাজ্য সরকার জাতি বিতাড়নের পদক্ষেপ করছে কিনা।” আদালত তাদের নির্দেশে আরও বলেছে, সরকারকে হলফনামা দিয়ে জানাতে হবে, নুহতে ও গুরুগ্রামে গত দু’সপ্তাহে কত ঘরবাড়ি ভাঙা হয়েছে এবং সেগুলো ভাঙার আগে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়েছিল কিনা।

নুহ ও গুরুগ্রামে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর প্রশাসনিক পদক্ষেপে অন্তত ৫০০০ হকার, দোকানদার, ছোটোখাটো ব্যবসায়ী নিজ নিজ রাজ্যে ও গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এত মানুষ যে জীবিকা হারালেন, বাস্তুচ্যুত হলেন, চূড়ান্ত সংকটে নিমজ্জিত হলেন তা নিয়ে বিজেপির খট্টর সরকারের বিবেক বিন্দুমাত্র আহত বোধ করেনি। উল্টে পরিকল্পনা মাফিক অশান্তি ও বিদ্বেষ সৃষ্টির পর প্রশাসন ঝাঁপালো সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ধ্বংস করতে, নিজেদের তৈরি করা আশ্রয় থেকে তাদের বিতাড়িত করতে। আর প্রবল রূপে সক্রিয় হয়ে উঠল মেরুকরণের প্রক্রিয়া। এই সক্রিয়তার উদ্যোগ দেখা গেল গুরুগ্রামের টিগরা গ্রামে রবিবার (৬ আগস্ট) আয়োজিত মহাপঞ্চায়েতে। সেই পঞ্চায়েত থেকে ওঠানো হলো এই প্রস্তাব — আঞ্জুমান মসজিদের ইমামকে হত্যা এবং মসজিদে আগুন লাগানোর জন্য যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দিতে হবে। অন্যথায় বড় আন্দোলন সংগঠিত করে এলাকাকে অচল করে দেওয়া হবে। মহাপঞ্চায়েত থেকে এই আহ্বানও উঠে এলো — মুসলমানদের অর্থনৈতিক ভাবে বয়কট করুন! মুসলমানদের কাছ থেকে হিন্দুরা যেন কিছু না কেনেন, তাদের ঘর ও দোকান ভাড়া যেন না দেওয়া হয়। সমাজমাধ্যমে তোলা মহাপঞ্চায়েতের ভিডিওতে সংগঠকরা দিলেন এই নির্দেশ, “সব দোকানদাররা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। আপনার দোকানে কোনো মুসলমান কাজ করলে তাকে অবিলম্বে ছাঁটাই করুন। আপনাকে দু’দিন সময় দেওয়া হচ্ছে। এই দু’দিন পরও কোনো দোকানদার তার দোকানে কোনো মুসলমানকে কাজে রাখলে আমরা তাকে বিশ্বাসঘাতক বলে ঘোষণা করব।… তাকে বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে দোকানের বাইরে পোস্টার সাঁটাবো।” এলাকায় ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও সহস্রাধিক লোকের জমায়েতে ঐ মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত হয়েছিল এবং প্রশাসনের প্রশ্রয় ছাড়া সেটা যে সম্ভব ছিল না তাও সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

হরিয়ানার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং মুসলিম-বিরোধী বুলডোজার অভিযানের সবটাই সংঘটিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে ছকা নীল নকশার রূপায়ণে। এর উদ্দেশ্য, ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচনের আগে সংখ্যালঘু বিরোধী ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে সংখ্যাগুরুবাদী মেরুকরণ ঘটানো। নরেন্দ্র মোদী, মোহন ভাগবতদের উপলব্ধি সম্ভবত এই যে, একমাত্র এই পথেই তাঁরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন। হরিয়ানার জাট সম্প্রদায়ের কৃষক নেতা ইন্দরজিৎ তোমার যথার্থভাবেই বলেছেন, “নুহতে আমরা যা দেখলাম, লোকসভা নির্বাচনের আগে আগামী মাসগুলোতে দেশের অন্যান্য অংশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হবে। বিজেপি মনে করছে যে, তারা যেহেতু প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি তাই মেরুকরণই তাদের উদ্ধার করে দেবে।” তবে, একই কৌশল বারবারই সমানভাবে সার্থক হবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া অতি বড় শক্তিমানের পক্ষেও কি সম্ভব!

- জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-30
সংখ্যা-27