এত অজস্র মানুষ তাঁর চলে যাবার পর অশ্রু সজল কলমে তাঁকে প্রণতি জানিয়েছেন তার লেখাজোখা হয় না। সত্যিই আক্ষরিক অর্থেই তিনি কতশত বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষর রেখে গেছেন, এই ছোট পরিসরে তা ধরার ক্ষমতাই এই প্রতিবেদকের নেই। প্রায় একানব্বই বছরের এই যুবক এই সেদিনও ৬ ডিসেম্বর, বাবরি ধংসের কালো দিনটিতে মেধা পাটকরের আহ্বানে হাজরা পার্কের সামনে শাসকদের প্রতি দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের সাথে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছেন, দেশ বাঁচাও, সংবিধান বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও। আবার তিনিই গ্রেটা থুনবার্গের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিশাল মিছিলে পা মিলিয়েছেন জলঙ্গী নদী বাঁচাতে কলকাতায়। প্রয়াত এই অক্লান্ত উদ্যমী নানা রঙের মানুষটি অন্ধকার সময়ে আমাদের বাতিঘর। তিনি আর কেউ নন। তিনি সমর বাগচী, বিহারের মুঙ্গেরে জন্মানো প্রতিবেশী সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোড়াই চরিত মানসের এক চরিত্র। যার প্রয়াণে চোখের জলে ভাসছে শহর কলকাতা। কী প্রখর ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি : এনএপিএম’এর পুরী সম্মেলন শেষ করে যখন ফিরে এলাম তখন তিনি জানতে চাইলেন কীরকম হোল? আমাদের এক সাথী পুরনো আমলের একটা গান গেয়ে উত্তর দিলেন ওয়াক্ত কি আওয়াজ হ্যায় মিল কে চলো। সঙ্গে সঙ্গে গানের গীতিকারের নাম বলে দিলেন। তাঁর অনেক কবিতা মুখস্ত শুনেছি। কবি অরুণ মিত্রের কবিতা ভালবাসতেন। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি ধরলেন, বৃক্ষমূলে আমার গভীরতম কথা আমি রেখে দিয়েছি।
আরও পুরনো একটা গল্প বললে সমর বাগচীর চরিত্রের একটা দিক উন্মোচিত হবে। যখন তিনি বিড়লা মিউজিয়ামের অধিকর্তা ছিলেন, তখন একটা পেট লাইব্রেরী করেছিলেন, ছোটরা সেখান থেকে কিছু দিনের পোষ্য পশু-পাখি বাড়ি নিয়ে যেতে পারত। আবার মেয়াদ ফুরোলে ফেরৎ দিতে হতো। একবার এভাবে নেওয়া একটি বিরল প্রজাতির পাখি এক সদস্যের খাঁচা থেকে উড়ে যায়। বাচ্চাটির মা ও বাবা সারা কলকাতা চষে ফেলেও তেমন পাখি কিনতে না পেরে সমরবাবুর কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে জানতে চান কত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমরবাবু বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করেন — ওকি উড়ে গেছে না তুমি উড়িয়ে দিয়েছো? ছেলেটি নিশ্চুপ হয়ে আছে দেখে উনি ওকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে জানতে চান, তুমি এ’কাজ কেন করলে? ছেলেটি বলে, ওর তো খাঁচায় খুব কষ্ট হতো! এই উত্তর শুনে সমরবাবু ওর মা বাবাকে এসে জানান, আপনাদের ক্ষতিপূরণ তো দিতে হবেই না, বরং এতোদিনে আমার এই প্রজেক্ট সফল হল। ছোটদের মধ্যে পশু-পাখিদের সম্পর্কে ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতেই তো এই লাইব্রেরী চালু করা!
এইরকম মানসিকতার একজন প্রাকৃতিক মানুষ যখন এই দুনিয়ার খাঁচা ছেড়ে উড়ে যান তখন কষ্ট হয় বৈকি!
ডঃ সমর বাগচী বিজ্ঞান জনপ্রিয় করার বিষয়ে যত পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তার বেশির ভাগ তিনি শুরু করেছিলেন মিউজিয়ামে থাকাকালিন। ১৯৬২ সালে তিনি যোগ দেন, ১৯৮৪ সালে অধিকর্তা হন এবং ১৯৯১ সালে অবসর গ্রহণ করেন সেখান থেকে। অবসর নেবার পর তাঁর কর্মকাণ্ড তীব্র গতি নেয়। বিজ্ঞানকে পড়ুয়াদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্য রাজ্যজুড়ে বিজ্ঞান মডেল প্রতিযোগিতা, অগুনতি সেমিনার ও বিজ্ঞান মেলায় তিনি সক্রিয় অংশ নিতেন। সারা রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে তিনি ছুটে বেরিয়েছেন। হাতেকলমে বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। দূরদর্শনে কোয়েস্ট বলে অভিনব বিজ্ঞান প্রশিক্ষণ তিনি সুত্রপাত করেন। তাঁর অনুরাগীরা এখনো এই প্রকল্প গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন। একবার তাঁর সঙ্গে হঠাৎ দেখা শান্তিনিকেতনের অদূরে খঞ্জনপুর গ্রামে যেটা কোড়া বলে আদিবাসীদের গ্রাম। তাদের সঙ্গে কাজ করতেন রাহুল নামে এক উৎসাহী যুবক এবং তাঁর ইংরেজ স্ত্রী কার্স্টি। এখন এই কোড়ারা প্রায় সাঁওতালদের মতো একই ভাষায় কথা বলে। উভয় সম্প্রদায় পরস্পরের সঙ্গে প্রায় একই ভাষায় কথা বলে। সাঁওতালদের কাছাকাছি আরও অনেক ভাষাগোষ্ঠী আছে যেমন হো, বীরহড়, মুন্ডা ইত্যাদি। এই সাদৃশ্যের বিষয়ে তিনি অপার আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন। রাহুল কার্স্টি দম্পতি ডঃ বাগচীর পরামর্শে স্থানীয়দের সাহায্যে অনেক পাঠ্য বই প্রকাশ করতেন। নিজেদের ভাষায় পাঠদানও করা হত। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতিষ্ঠিত সাঁওতাল মেয়েদের নিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠান খেলাঘর, কলকাতার অদূরে বাদুতে, এর কথা মনে পড়ে গেল। সেখান ডঃ বাগচী ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কী অপূর্ব দক্ষতায় তারা রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নাচ, গান, নাটক পরিবেশন করে। যখন তাদের ভাষা নিয়ে কেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না বলা হয়েছিল, মনে আছে ডঃ বাগচী গভীর মনোযোগের সঙ্গে বিতর্কটি নিয়ে ভেবেছিলেন। পরে প্রতিবেদককে জানান। আগ্রহী পাঠক ইউটিউবে তাঁর অনেক হাতে কলমে কঠিন বিজ্ঞান শিক্ষার নমুনা দেখতে পাবেন।
এবার দর্শনে আসা যাক। মার্ক্স, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী ছিল তাঁর বিচরণ ভূমি। ফলে তিনি প্রগতি শিবিরেই ছিলেন। মানবাধিকারের পক্ষেই সবসময় কথা বলেছেন। নর্মদা আন্দোলন থেকেই তিনি তাঁর অনেক প্রেরণার সঞ্চার পেয়েছেন। ফলে সমাজকর্মী মেধা পাটকর এবং তাঁর সাথীরা ছিলেন তাঁর ন্যাচারাল মিত্র। বাংলার এনএপিএম’এর তিনি উপদেষ্টা ছিলেন। যদিও এককালে এখানেও সংগঠন যথেষ্ট মজবুত ছিল। ভবিষ্যতের ইতিহাস তাঁকে শুধু অপবিজ্ঞানের আবহে গণবিজ্ঞানের চেতনাবাহী নিবেদিত প্রাণ মানুষ বলেই মনে রাখবে তাই নয়। তিনি একটা যুগের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাঁর মধ্যে এক পথসেনাকে আমরা খুঁজে পাই যিনি জীবনের কর্মচাঞ্চল্যে বলিয়ান হয়ে আমাদের হাল না ছেড়ে কণ্ঠ ছাড়তে শিখিয়েছেন। তিনি বাংলার মাঠঘাট, পথ প্রান্তরে এক অশান্ত যুবকের মতো পদচারণা করেই চলবেন তাঁর জীবন ও কাজ চর্চার মধ্য দিয়ে। আপনার ভাঙ্গা পাঁজরে যত দুঃখ জমে আছে তার নিরাময় করবে আগামী সময়।
– অসিত টুডু