(পুর্ব প্রকাশিতের পর)
মোদীর ন’বছরের ভারতে বিচারবিভাগের হালচাল।
“প্রতিবিপ্লবের কেন্দ্রে ছিল বিচারবিভাগ। সুবিধা ও উপযোগিতার বিবেচনার উপর নির্ভরশীল প্রশাসনিক ক্রিয়ার বিপরীতে বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত নির্ভরশীল হয় আইনের, অর্থাৎ, ন্যায় ও অন্যায়ের উপর, এবং এগুলো সর্বদাই প্রচারের আলোয় থাকে। রাজনৈতিক সংগ্রামের সমস্ত হাতিয়ারের মধ্যে আইন সম্ভবত সবচেয়ে ভয়ংকর, তা মূলত ন্যায় ও সুবিচারের ধারণাকে ঘিরে থাকা গৌরবজ্যোতির জন্য।” – ফ্রাঞ্জ নিউম্যান, বেহেমথ
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের বুনিয়াদি বিষয় এবং ক্রিয়াশীল গণতন্ত্রের কাছে অতীব গুরুত্বের। এটা ক্ষমতা বিভাজনের তত্ত্বের এক অপরিহার্য অঙ্গ, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অঙ্গগুলোর সাহায্যে অন্যান্য অঙ্গের বাড়াবাড়িগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হয়। প্রশাসনিক বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আদালতের, বিশেষভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের লক্ষ্য হলো সংবিধানকে রক্ষা করা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনকে প্রতিহত করা — জবাবদিহির বাধ্যবাধকতাকে সুনিশ্চিত করা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। বিভাজন কাঠামোর প্রতিটি অঙ্গেরই — আইনসভা, প্রশাসন ও বিচারবিভাগের আবার থাকে আধিপত্যের অভীপ্সা। জরুরি অবস্থার সময় প্রশাসনিক মতের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারপতিদের দমনের পর থেকে ভারতীয় বিচারবিভাগ বেশ কিছু রায়ের মধ্যে দিয়ে তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে, এবং সরকারগুলিকে কিছু মাত্রায় জবাবদিহিতে বাধ্য করা হয়। তবে, ২০১৪ সালে ক্ষমতায় মোদীর অধিষ্ঠানের পর থেকে গত ন’বছরে আমরা এক আপোসপন্থী বিচারবিভাগকেই দেখতে পাচ্ছি।
রায়দান এবং বিচারকে এড়িয়ে যাওয়া
সুপ্রিম কোর্ট ২০১৪ সালের পর যে রায়গুলো দিয়েছে সেগুলোতে মোদী সরকারের এজেন্ডার প্রতি বিচারবিভাগীয় সমর্থনের জোরালো প্রবণতাই প্রকটিত হয়; কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য রয়েছে (যে রায়গুলোতে নারীর অধিকার, এলজিবিটিকিউআইএ’র অধিকার, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে কেন্দ্র করে সাংবিধানিক আইনি মূল্যায়নের বিকাশ ঘটেছে)।
আয়কর দপ্তর বিড়লা ও সাহারাদের কিছু কলঙ্কিত নথি বাজেয়াপ্ত করায় কালো টাকার বিরুদ্ধে জেহাদের মোদীর দাবি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, এই নথিগুলোতে উৎকোচ ও দুর্নীতির উন্মোচনের সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হয় এবং সেগুলোতে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মন্ত্রীদের নিয়মিত অর্থ প্রদানের উল্লেখও থাকে। এই নথির ভিত্তিতে অ-সরকারি সংস্থা কমন কজ সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে আবেদন রাখে যে, একটা অপরাধের মামলা চালু করা হোক এবং তদন্ত সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে পরিচালিত হোক। এক বিস্ময়কর নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট মামলাটাকে শুধু খারিজই করে না, আদালত ঘোষণা করে যে, “আলোচ্য নথিগুলো এমন যথাযথ নয় যার ভিত্তিতে এফআইআর দায়েরের নির্দেশ দেওয়ার মতো অপরাধ খাড়া করা যায়।” এবং এইভাবে বিড়লা ও সাহারা নথিতে থাকা উৎকোচের বিস্ফোরক দাবির তদন্তকে ভেস্তে দেওয়া হয়। রাফাল যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের পরিণতিও একই হয়েছিল, ক্রয়চুক্তিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নজরদারিতে তদন্তের যে আবেদন উঠেছিল, তাকে খারিজ করা হয়েছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সবচেয়ে বিতর্কিত রায়গুলির অন্যতমটি সম্ভবত হল বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু সম্পর্কিত তদন্তের আবেদনের রায়। বিচারপতি বি এইচ লোয়া ২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন শেখ’এর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হত্যার মামলাটি শুনছিলেন, এবং রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানিয়ে মামলা দায়ের করা হয়। উল্লেখ্য যে, বিচারপতি লোয়ার পরিবারও রহস্যজনক পরিস্থিতিতে তাঁর মৃত্যুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে, এবং অভিযোগ করে যে অভিযুক্ত অমিত শাহর অনুকূলে রায় দেওয়ার জন্য তাঁকে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে চাওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় রচিত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদনকে এক ক্ষুদ্র বিচারে পরিণত করে এবং বিচারপতি লোয়ার স্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হওয়ার রায় দিয়ে আবেদনটিকে খারিজ করে দেয়। দিল্লী হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবং ভারতের আইন কমিশনের পূর্বতন চেয়ারম্যান এ পি শাহ রায়টিকে “চূড়ান্ত ন্যায়বিরুদ্ধ এবং নানা দিক থেকে ত্রুটিপূর্ণ” বলে আখ্যায়িত করে ধিক্কার জানান।
আরেকটি যথেষ্ট গুরুত্বের রায় হল ভীমা কোরেগাঁও মামলার রায়, যাতে অভিযুক্ত ছিলেন সুপরিচিত মানবাধিকার কর্মীরা যাঁদের বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)র সদস্য হওয়া এবং ভীমা কোরেগাঁওতে হিংসা উস্কিয়ে তোলার অভিযোগ এনে ১৯৬৭ সালের অবৈধ কার্যকলাপ (নিরোধক) আইনে (ইউএপিএ) গ্রেফতার করা হয়েছিল। তথ্যপ্রমাণ অনির্ভরযোগ্য এবং সরকার পক্ষের বক্তব্য স্পষ্টতই সাজানো কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিরা অভিযোগের তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠনের আর্জিকে প্রত্যাখ্যান করেন। ঐ বেঞ্চের বিরোধী মত পোষণকারী বিচারপতি চন্দ্রচূড় এই অভিমত পোষণ করেন যে, তখন পর্যন্ত যে তদন্ত চালানো হয়েছিল তা ছিল মনগড়া। এছাড়া, এই রায় ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তদের বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক রাখতেও সহায়ক হয়েছে, আটকের পর পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনও শুরুই হয়নি। বেশ কয়েকজন সিএএ-বিরোধী প্রতিবাদকারীদের দীর্ঘ সময় ধরে জেলে আটক রাখার মধ্যে দিয়ে নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচনও প্রতিপন্ন হচ্ছে।
বাবরি মসজিদ মামলায় সাংবিধানিক বেঞ্চ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে বাবরি মসজিদের ধ্বংস ছিল “আইনের শাসনের শোচনীয় লঙ্ঘন”; এ’সত্ত্বেও তারা মসজিদের জমিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের হাতেই তুলে দিয়েছিল, তাদের সিদ্ধান্তে অবৈধ ধ্বংসের অপরাধজনক ক্রিয়ার তুলনায় অগ্রাধিকার পেয়েছিল তথাকথিত বিশ্বাস। সুপ্রিম কোর্ট মন্দির নির্মাণের জন্য সমস্ত জমিই দিয়ে দিয়েছে এবং সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে মসজিদ স্থানান্তরিত করার পরামর্শ দিয়েছে — এই ঘটনাটা তথ্য এবং ন্যায়ের নীতির চেয়ে বিশ্বাসের দাবির ওপরই বিশেষ অধিকার প্রদান করেছে, এবং এইভাবে সাম্প্রদায়িক প্রচারেও প্ররোচনা জুগিয়েছে।
অতিমারীর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের সমর্থনে দাঁড়াতে সুপ্রিম কোর্টের ব্যর্থতা বিচারবিভাগের এক অগৌরবজনক মুহূর্ত হয়েই রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোপাল গৌড়া এটাকে “চরম ব্যর্থতা বলেই অভিহিত করেছেন”।
জাকিয়া জাফরি মামলায় ২০০২’র গুজরাটের সুপরিকল্পিত গণহত্যায় সিট’এর মোদীকে ক্লিনচিট দেওয়াটাকে চ্যালেঞ্জ জানানো হলে সুপ্রিম কোর্ট তাকে খারিজ করায় সর্বোচ্চ আদালতের গায়ে আরও একবার কলঙ্কের কালি লাগে। সুপ্রিম কোর্ট জাকিয়া জাফরির যন্ত্রণাকে নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগানোর অভিযোগেই শুধু তিস্তা শেতলবাদকে অভিযুক্ত করে না, তারা এও বলে যে, তিস্তা এবং অন্যান্য যারা গুজরাট পুলিশের দেওয়া ব্যাখ্যার বিরোধিতা করেছে তারজন্য তাদের ‘বিচার করতে’ হবে। এই রায়ের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই গুজরাট সন্ত্রাস দমন স্কোয়াড তিস্তা শেতলবাদ, আর বি শ্রীকুমার এবং অন্যান্যদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে তাদের গ্রেপ্তার করে। সমাজ আন্দোলনের গান্ধীবাদী কর্মী হিমাংশু কুমার ছত্তিশগড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আদিবাসীদের হত্যায় নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন, এবং সুপ্রিম কোর্ট তাঁর বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার নিদান দেয়। সুপ্রিম কোর্ট অন্যায়ভাবে তাঁকে এই অভিযোগে অভিযুক্ত করে যে তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনেছেন এবং তাঁকে পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়।
টাকা নয়ছয় প্রতিরোধ আইনের (পিএমএলএ) রায়ের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নাগরিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ অব্যাহত ভাবে চালিয়ে যায়, ঐ রায়ে সুপ্রিম কোর্ট পিএমএলএ’র বেশ কিছু দানবীয় সংস্থানে অনুমোদন দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে জামিন লাভের দুটি পরীক্ষা যেগুলিকে অসাংবিধানিক বলে আগে খারিজ করা হয়েছিল; এরই সাথে প্রমাণ করার দায়কেও পাল্টে দেওয়া হয় এবং অভিযুক্তকে ইসিআইআর’এর প্রতিলিপি (যা এফআইআর’এর সমতুল্য) না দেওয়া-সহ এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেটের লাগামহীন ক্ষমতাকে মঞ্জুর করা হয় এবং জেরার সময় অভিযুক্তর কাছ থেকে আদায় করা বিবৃতিকে তথ্যপ্রমাণ রূপে ব্যবহারের অনুমোদনও দেওয়া হয়।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য (ইডব্লিউএস) ১০ শতাংশের কোটাতে অনুমোদন দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের রায় উচ্চশ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের সংস্থান করেছে, ফলে অন্যান্য দুর্বল শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণের সাংবিধানিক নীতি কার্যত যথেষ্ট লঘু হয়ে পড়েছে। সামাজিক দিক থেকে পশ্চাদপদ যে শ্রেণীগুলি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, সংরক্ষণ লাভ করার কোনও সুযোগ তাদের নেই। সুযোগ লাভের নির্ধারিত মানদণ্ডে মাসিক আয়কে করা হয়েছে ৬৭,০০০ টাকার কম যা নিপীড়িত সম্প্রদায়গুলির প্রকৃত দারিদ্রকে পরিহাসই করে।
এই রায়গুলো আদালতের মানসিকতার আভাস দিয়ে জানাচ্ছে যে, আদালত শাসক গোষ্ঠীর পছন্দের নীতিমালা ও রাজনৈতিক এজেন্ডার প্রতি সহমত জ্ঞাপনই করছে।
সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়গুলোর কথা আমরা যেমন বলছি, তেমনি যে মামলাগুলোর বিচারকে এড়িয়ে চলা হয়েছে সেগুলোর কথাও আমাদের বলতে হবে, সাংবিধানিক আইনজীবী গৌতম ভাটিয়া যেগুলোকে বলেছেন ‘বিচারবিভাগীয় পরিহার’, যেগুলির ক্ষেত্রে সময়ের গুরুত্ব নিহিত থাকলেও সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া হয় যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় নীতি অবিসংবাদী বিষয় হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে একটা বিষয় হল মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরিধানের পুনর্বিবেচনা যাতে কর্নাটকের বিজেপি সরকারের মুসলিম মেয়ে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান নিষিদ্ধকরণকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে; সাংবিধানিক চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনকে যা ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের ভিন্ন অধিকার প্রদান করে, ৩৭০ ধারা বাতিলকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে যার ভিত্তিতে পৈশাচিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে স্বায়ত্ত্বতা প্রদান ছাড়াই দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়, ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্পকেও চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে যে প্রকল্পের মাধ্যমে কর্পোরেট সংস্থাগুলো পরিচয় গোপন রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থ জোগান দেয়; এছাড়া আরও অনেক মামলাকেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আর বিজেপি অসাংবিধানিক পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সুবিধা কুড়িয়ে চলেছে। বিমুদ্রাকরণের ক্ষেত্রে বিষয়টা নিছক কেতাবি আলোচনার বিষয় না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আদালত তার গুণাগুণের বিচারে যায়নি, এবং বিচারের জন্য গ্ৰহণ করার পর আদালত গোটা প্রক্রিয়াটাতেই সমর্থন জানায়, এবং বিমুদ্রাকরণের ঘটানো বিপুল বিপর্যয়কে পুরোপুরি অবজ্ঞা করা হয়।