সনৎ রায়চৌধুরী : আন্দোলনের এক বিরামহীন যোদ্ধা
a-ceaseless-warrior-of-the-movement

আমাদের সকলের প্রিয় সনৎদা (সনৎ রায়চৌধুরী) গত ১ জুলাই ২০২৩ প্রয়াত হন, মারণ রোগ ক্যান্সার বাসা বেঁধেছিল তাঁর যকৃতে। এই মানব দরদী পরিব্রাজকের কিশোর বয়সে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে যে পথচলা শুরু হয়েছিল, বাম গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার আন্দোলনে উজ্জ্বল পদচিহ্ন রেখে তা সাঙ্গ হল এই মারণ ব্যাধিতে।

সনৎদা বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছিলেন রংপুরের তেভাগা আন্দোলন। সনৎদার মুখেই শোনা, বালক অবস্থায় বন্ধুদের সাথে দেখতে গিয়েছিলেন বন্দী হওয়া তেভাগা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেত্রী ইলা মিত্রকে। মৌলানা ভাসানীর কথাও তিনি উৎসাহভরে বলতেন। দেশভাগের পরবর্তীতে প্রথমে উত্তরবঙ্গ ও পরে নিজের দাদা, যিনি কর্মসূত্রে তখন চুঁচুড়া থাকতেন, সেখানে চলে আসেন। সেই সময়কার রীতি অনুযায়ী তাঁর পার্টি সদস্যপদ ভারতে স্থানান্তরিত হয়। তাঁর কমিউনিস্ট জীবনের যাত্রাপথ ছিল সিপিআই থেকে সিপিআই(এম) এবং পরিশেষে সিপিআই(এমএল)-এ যোগদানে। সিপিআই(এম)-এ থাকাকালীন বাঁশবেড়িয়া থেকে উত্তর চন্দননগর পর্যন্ত বিস্তৃত লোকাল কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নকশালবাড়ির ঘটনার পর তিনি সিপিআই(এম)-র সদস্যপদ ত্যাগের চিঠি দিলে, জেলা কমিটি বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়, তৎকালীন জেলা সম্পাদক বিজয় মোদক এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলেছিলেন, “সনৎ’কে আমরা বহিষ্কার করতে পারি না!” নকশালবাড়ি আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে কারাবরণ করেন। জেল থেকে বেড়িয়ে এসে ৭৭ সালে বন্দী মুক্তি আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন কারাগার ঘুরে ঘুরে বন্দী যুবকদের তালিকা তৈরি করে সরকারের কাছে তাদের মুক্ত করার দাবি তোলেন। আটের দশকে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট গঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি হিসেবে বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন, এই সময়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া অনেক মানুষকে আবার রাজনীতির আঙিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সনৎদাকে আমরা দেখেছি বিজ্ঞান মঞ্চ গঠনে সহায়তা করতে, ভাষা শহিদ দিবস পালনের অন্যতম প্রধান মুখ হিসেবে, শ্রমজীবী হাসপাতাল গড়ে তোলার শুরুর সময়ে ও চুঁচুড়ায় ঐ হাসপাতালের বহির্বিভাগ গড়ে তোলার অন্যতম স্থপতি হিসেবে, দেখেছি দুস্থ ছাত্রছাত্রীদের পাশে, অগুন্তি সামাজিক কাজে। মানবাধিকার আন্দোলনে এপিডিআরের গুরত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়।

গণিতের শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রী মহলে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। এতো কাজের মধ্যেও এই সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ নতুন করে না নিলেও বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন ও পুণরায় তার জোরালো আত্মপ্রকাশ সম্পর্কে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহ ও আশাবাদী। একাদশ পার্টি কংগ্রেসের ফ্যাসিবাদ বিরোধী ভূমিকায় তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। স্থানীয় জেলা এবং সারা দেশে পার্টির অগ্রগতি ও আন্দোলন সম্পর্কে সবসময় অনুসন্ধিৎসু থাকতেন। পার্টি ও তার বিভিন্ন গণসংগঠনের পত্রিকা যেমন গণসংস্কৃতি পরিষদের মুখপত্র নবান্ন পত্রিকার তিনি ছিলেন নিয়মিত পাঠক আর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত দেশব্রতী, লিবারেশনের গ্রাহক। মেহনতি মানুষের লড়াই সবসময় তাঁকে অনুপ্রাণিত করত। মনে পড়ে বিগত বিধানসভা নির্বাচনে জেলা তহবিলে অর্থ সাহায্য করার সাথে সাথে সীমন্তি এক্কার কেন্দ্রের জন্য তিনি আলাদা ভাবে অর্থ পাঠান। অসুস্থ অবস্থাতেও ভারভারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে, স্ট্যানস্বামীর হত্যার প্রতিবাদে, গণতন্ত্রের ওপর যেকোনো হামলার প্রতিবাদে চুঁচুড়ায় পার্টির প্রতিটি কর্মসূচিতে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল নিশ্চিত।

গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে তাঁর শহর চুঁচুড়ায় ভাষা আন্দোলনের শহিদ স্মারক স্তম্ভের মাথার ওপর রয়েছে যে অশত্থ গাছ, তার গোড়ায় শান বাঁধানো গোল চাতালে এসে বসে অনেক রকম মানুষ — স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া, বেকার, অভাবি রিক্সা চালক, পাশের মাঠে খেলতে খেলতে ক্লান্ত ছেলে পিলে, প্রেমিক যুগল, উঠতি কবি, রাজনৈতিক দলের কর্মী। সবার কথা যেন মন দিয়ে শোনে বয়োঃবৃদ্ধ পিপল গাছ। এই মহীরুহর বেড়ে ওঠার পিছনেও রয়ে গেছে অনেক সংগ্রাম, যা শুধু সেই গাছের ইতিহাস নয় একটা গোটা ভূমন্ডলের ইতিহাস। পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গা নদী জানে সেই ইতিহাস। আসলে গঙ্গা তো নয়, সেতো ভাগ হয়ে গেছে অনেক আগে, সেই ভাগের স্মৃতি চিহ্ন বহতি নদীর মতো গাছের বুকেও থেকে যায়। এপারে কাকদ্বীপ আর ওপারের রংপুর সেই এক ইতিহাসের অংশ। তেভাগা যেমন সেই ইতিহাসের এক আলেখ্য, তেমনি উত্তরবঙ্গের এক ছোট জনপদ নকশালবাড়ির থেকে আসা ঝড়ো হাওয়া এসে লেখে আরেক গল্প। মৌলানা ভাসানী আর চারু মজুমদার, তেভাগা আর নকশালবাড়ি, নদী ভাগ হয় কিন্তু বহমানতার বিরতি ঘটে না। বৃক্ষের মতো, নদীর মতো এই বহমানতার জীবন্ত নিদর্শন ছিলেন সনৎ রায়চৌধুরী।

কমরেড সনৎ রায়চৌধুরী লাল সেলাম!

খণ্ড-30
সংখ্যা-22