পঞ্চায়েত নির্বাচন ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন : রক্তস্নাত ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে হুগলি জেলার মহিলা প্রার্থীদের ভূমিকা কেমন ছিল সেই সম্পর্কে দু-চার কথা

empowerment-of-womenপান্ডুয়া ব্লকের তিন্না গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন প্রবীণ কমরেড ময়না কিস্কু। তিনি আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ এবং সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেত্রী। এলাকায় তাঁর পাশে অন্য কোনো পার্টির সদস্য বা সমর্থক নেই। (যদিও তাঁর জনসংযোগ আছে) তাই জেলার মহিলা সমিতির সদস্যরা এখানে জোর দেয়। নির্বাচনেও তাঁর এই প্রথম অংশগ্রহণ। মনোনয়নের পরই সিপিএম বিরোধিতা করে। তাতে ময়নাদি বেশখানিকটা বিচলিত হয়েছিলেন। প্রচারে বেরোতেও দ্বিধাবোধ করছিলেন। তবে কিছুটা আলোচনার পর দ্বিধা কাটিয়ে ওঠেন। প্রচার করতে গিয়ে দেখা গেল, উনি এলাকায় বেশ পরিচিত। মানুষের সাড়াও পাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি উৎসাহিত হন এবং পরবর্তীতে নিজেই কোন কোন এলাকায় প্রচার করা হবে তার পরিকল্পনা করেন। প্রচার দেখে সিপিএম সদস্যরা তাঁর বাড়িতে এসে বলেন, বেশি ভালো প্রচার করতে হবে না, দাঁড়ানোর যদি ইচ্ছা ছিল, তাহলে আমাদের পার্টির হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। ময়নাদি ঠান্ডা মাথায়ে জবাব দেন, আপনারা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তো একজন আদিবাসী মহিলাকে দাঁড় করানোর কথা ভাবেননি। এই এলাকায় ঋণ মুক্তির বড় আন্দোলন হল, তখনও তো আমাদের পাশে দাঁড়াননি। এর উত্তরে তাঁরা আর কিছু বলতে পারেনি। পার্টির সাধ্যমত ওই এলাকায় দেওয়াল লিখন, পোস্টারিং, রিফলেটিং, টোটো প্রচার ইত্যাদি হয়। ময়নাদি উৎসাহের সঙ্গে সমস্ত রকম প্রচার‌ কাজে সামিল হন। এসবের মধ্যে দিয়ে কমরেডের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও দৃঢ়তা আরো বেড়েছে।

পান্ডুয়া ব্লকে দ্বারবাসিনী দক্ষিণ পাড়ায় গ্রামসভার প্রার্থী শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়। তিনি জেলা পার্টি কমিটির সদস্য ও মহিলা সমিতির জেলা সম্পাদিকা। নির্ভীক কমরেড শিপ্রা পতাকায় তিন তারা ঝান্ডা কাঁধে প্রতিদিন দলমত নির্বিশেষে ঘরে ঘরে প্রচার করেছেন। সারা বছর আন্দোলনের মধ্যে থাকার সুবাদে গ্রামের মানুষের কাছে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। পথ সভায় প্রার্থী হিসেবে তাঁর তীব্র, তীক্ষ্ণ বক্তব্য এলাকার মানুষকে আকৃষ্ট করে।

রাজনীতিতে পোড় খাওয়া কমরেড রূপা শীট ধনিয়াখালিতে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী ছিলেন। অঞ্চলে সিপিআই (এমএল)-এর সংগ্রামী সদস্য হিসেবেই পরিচিত। পার্টি সর্বস্ব তাঁর জীবন। সিপিএমের সন্ত্রাস মোকাবিলা করেছেন। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই জারি আছে। খেটে খাওয়া মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন তিনি। নির্বাচনের তিন দিন আগে শাসক দল রুপাদিকে প্রার্থী পদ তুলে নেওয়ার জন্য টাকার প্রস্তাব দেয়। কমরেড সঙ্গে সঙ্গে তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, আমার কোনো অভাব নেই। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়াইনি। যতদিন বাঁচব সিপিআই(এমএল)-ই করে যাব। গরিব মানুষের জন্য লড়াই চালিয়ে যাব। কমরেড রূপা শীট নির্বাচন পুরো পর্বে তিন তারা ঝান্ডা কাঁধে নিয়ে লড়ে গেলেন।

বলাগড় ব্লকে গুপ্তিপাড়ার মেহনতি পরিবারের কমরেড জ্যোৎস্না বিদ্যান্ত গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন। তিনি বলাগড় লোকাল কমিটির ও জেলা মহিলা সমিতির সদস্য। এলাকায় পার্টির দুর্বল অবস্থা, কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, লোকবলও তেমন নেই — এসব নিয়ে কোনো দ্বিধা কোনো সময় তাঁর মধ্যে কাজ করেনি। সংসারের সমস্ত কাজ সামলে নিয়মিত প্রচার কাজ চালিয়েছেন। পড়াশোনা বেশি না জানলেও, পার্টি শিক্ষা ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। এবং সেটা সম্বল করেই কেন আমাদের পার্টিকে ভোট দেবেন তা নিয়ে মানুষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছেন।

ধনিয়াখালি ব্লকে তালবোনা অঞ্চলে গ্রামসভার প্রার্থী ছিলেন লড়াকু সেনানী রুমা আহিরি। পার্টি, গ্রামীণ কৃষি মজুর সমিতি ও মহিলা সমিতির স্থানীয় সংগঠক। তিনি পার্টিতে এসেছেন ঋণ মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সংসার, অঙ্গনওয়াড়ি সব কাজ সামলে হাসিমুখে উৎসাহের সঙ্গে গোটা গ্রামে কমরেডদের সঙ্গে বিরামহীন প্রচার করেছেন। নিজের গ্রাম ছাড়াও ওই ব্লকের অন্যান্য প্রার্থীদের সমর্থনেও প্রচারে অংশ নিয়েছেন। আন্দোলনের ময়দানে থাকার কারণে এলাকায় কমরেড রুমার বেশ পরিচিতি রয়েছে। একই বুথে গ্রাম সভায় সিপিএম প্রার্থী দিয়েও তুলে নেয়। রুমা কিন্তু লড়ে গেছেন। নিজের উদ্যোগে পোস্টার, ব্যানার, ঝাণ্ডায় এলাকাকে সজ্জিত করেছিলেন। ফলে এখানে পার্টির উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ছিল। ভোটের দিন সকাল থেকেই তিনি পোলিং বুথে বসে ছিলেন। বিকেল তিনটে নাগাদ তৃণমূলের মস্তানরা বলে অনেক হয়েছে, এবার চলে যান। না হলে পরিস্থিতি খারাপ হবে। রুমা সঙ্গে সঙ্গে রুখে দাঁড়ান। বলেন, পরিস্থিতি যা হবে দেখে নেবো। আমি শেষ পর্যন্ত থাকবো। তখনই অবজার্ভারকে খবর দেওয়া হয়। তিনি পুলিশ সমেত সেখানে আসেন এবং রুমাকে বলেন, আপনি এখানেই থাকবেন। ইতিমধ্যে সিপিএমের জেলা পরিষদের প্রার্থী মস্তানদের হুমকিতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখনই রুমা ওই প্রার্থীর (পাড়ার সম্পর্কে মামা) হাত ধরে বলেন আজ যদি চলে যান তাহলে আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াতে পারবেন না। রুমার কথায় সাহস ফিরে পেয়ে ওই প্রার্থী শেষ পর্যন্ত বুথে থাকেন। মস্তানরা নিরাশ হয়ে ফিরে ‌যায়। ‌‌নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় কমরেড রুমা খুবই উৎসাহিত আগামীতে এলাকায় পার্টির কাজকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছেন।

এছাড়া ধনিয়াখালি, পান্ডুয়া, বলাগড়, পোলবা ব্লকের কমরেড তনুশ্রী দে, চাঁপা টুডু, শ্রাবণী মালিক, সুকুমনি মান্ডি, রেখা মাঝি সহ আরো বেশ কিছু মহিলা প্রার্থী যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। প্রার্থীরা ছাড়াও জেলা মহিলা সমিতি এবং মিড-ডে মিল রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের সদস্যরাও সাবলীলভাবে প্রচারে সামিল হয়েছিলেন। মহিলা সমিতির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রার্থীদের সমর্থনে প্রচার পত্র প্রকাশ করা হয়।

- চৈতালী সেন

খণ্ড-30
সংখ্যা-23