নিধিরাম সর্দার, ক্ষমতায়নে নারীর নাম
women-in-empowerment

একটি ছবিতে তিনটি নারী। দিদিমা, মা ও শিশুকন্যা। একটি রান্নার গ্যাস সিলিণ্ডারকে জড়িয়ে ধরে হাস্যমুখে বসে আছে। “প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা গ্যাস যোজনা প্রকল্প”-এর পোস্টার এটা। ওই বালিকাটির জীবনও কী তার মা দিদিমার মতো আঁতুড়ঘর আর রান্নঘরের সীমানায় বাঁধা থাকবে! অবিকল মনু সংহিতার চিত্রায়ন। তাহলে মহিলাদের ক্ষমতায়নের কী হবে? হ্যাঁ ক্ষমতায়ন তো হয়েছে। অলিম্পিকজয়ী সাক্ষী মালিককে “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার করা হয়েছে। ক্ষমতাবান সেই নারীর উপর পুলিশের তাণ্ডব দেখে শিহরিত সারা দেশ।

সারা পৃথিবী জুড়ে নারীর ক্ষমতায়নের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা অনুসারে ভারতকেও সেই দাবি পূরণ করতে হবে। ৮০’র দশকের মাঝামাঝি দেশের উন্নয়ন ভাবনায় ‘ক্ষমতায়ন’ শব্দটি বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই ক্ষমতা হল সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক। এর জন্য প্রয়োজন নারীর সুস্থ থাকা। বুদ্ধি বিকাশে দরকার শিক্ষা। আর সদিচ্ছার জন্য চাই একটি আদর্শগত ভিত্তি। এভাবে নারীরা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠবে। আর্থনীতি হবে সচল। আর রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করে তারা নিজেদের কথা নিজেরাই বলবে। সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। ২০১৪-তে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তেহারে মহিলাদের “ক্ষমতায়ন”-এর কথা ছিল। বিগত ৯ বছরে মহিলারা ক্ষমতার স্বাদ কতটুকু পেয়েছে? বরং রক্ষণশীল হিন্দু আধিপত্যবাদ তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে।

বাস্তবিকই মহিলাদের যা কিছু উন্নয়নের বিষয় তা পুরুষতান্ত্রিকতাকতার পায়ের নিচে রেখেই এগিয়ে চলেছে এই বিজেপি সরকার। বিজেপির সমর্থকরা বলে থাকেন, পুলওয়ামা বা বালাকোট ঘটনার সময় নির্মলা সীতারামনের তেমন ভূমিকা খুঁজে পাওয়া গেল না। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষে আসীন পুরুষ মানুষ তাঁর পেশী প্রদর্শন করেছিলেন, যা আমরা সবাই দেখেছি। বিজেপির সমর্থক পুরুষরা চিৎকার করে বলেন, “মহিলাদের খুঁজে কী হবে? আমরা পুরুষ চাই। কারণ আমরা দাঙ্গা চাই।” সংঘীরা শুধু পুরুষ নয়, বিশেষ পুরুষ চায়। সে হবে আর্যদের মতো রূপবান, বাহুবলী এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তাহলে আপনাদের বেটি বাঁচানোর কী হবে, সাধুগণ? উত্তর দিচ্ছে মোদি স্বয়ং।

২০১৪-এ বেনারসের জনসভায় তিনি বলেন, “যদি ১০০০ জন পুরুষ প্রতি ৮০০ জন মহিলা হয়, তাহলে ২০০ জন পুরুষের বিয়ে হবে কী করে?” বিজেপির ছোটোবড় নেতাদের কেউ বলছে, একজন নারীকে ৪টে করে, কেউ বলছে ১০টি করে সন্তান উৎপাদন করতে হবে। আর ক্ষমতায়ন মানে, মোদিই বলছে, “কন্যা না জন্মালে পুরুষদের জন্য রুটি কে বানাবে?” মহাভারতের মহারাজা দ্রুপদ যজ্ঞ করে পুত্র সন্তান পেলেন। কিন্তু একটি কন্যা না নিলে সেই পুত্র তিনি পাবেন না। এভাবেই যজ্ঞের আগুন থেকে যাজ্ঞসেনী তথা দ্রৌপদীকে স্বীকার করতে হল। এটাই আসলে প্রকৃতিক সাম্য। যেটা সংঘীদের দর্শন অস্বীকার করছে। আবার তাদের কর্পোরেট পরিষেবাও দিতে হয়। অর্থাৎ নারী ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু কাজ করার পরিবেশ থাকবে প্রতিকূল। ফলে তাদের প্রকল্পের মধ্যে যেমন থাকবে চমক তেমনই থাকবে ধমক।

ধমকটা কেমন? ওরা মহিলাদের কীভাবে সম্বোধন করে? মাতাওঁ, বেহেনাওঁ, বেটিওঁ। অর্থাৎ তুমি যেই হও, তুমি আমারই কেউ। তুমি কোনো স্বাধীন ব্যক্তি হতে পারো না। তাই আমার তুমিকে আমি মাথায় কাটবো না লেজে কাটবো, সেটা একমাত্র আমার ব্যাপার। এই ভাবনাটিই রূপ গ্রহণ করে ব্রীজভূষণ শরন সিংহ হয়ে দেখা দিল। বুক চিতিয়ে সে বলছে, “আরে ইয়ে তো ছুঁয়াছুঁয়ি কা মামলা হ্যায়। ‘নয়া অছ্যুৎ নীতি’ চালু কর দিয়া কেয়া?’’ অপরিচিত উন্নাও ভারতের মানচিত্রে স্পষ্ট হয়ে উঠল “ধর্ষকদের গ্রাম” নামে। কাশ্মীরের কাঠুয়াতে বিজেপির মন্ত্রী তেরঙা পতাকা উড়িয়ে মার্চ করল, আসিফার উপর গণধর্ষণকারী বীরপুরুষদের সমর্থনে। ওদিকে যোগী আদিত্য নারীদের সর্বনাশ করা লোকদের নাম দিল “রোমিও স্কোয়াড”। মহিলাদের উপর ঘটা যৌন হেনস্তাকে এভাবেই উপেক্ষা করে ওরা।

আর চমকটা কেমন? মহিলাদের কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রুখতে ইন্টারনাল কমপ্লেইন্ট কমিটি তৈরি হল যার চেয়ারম্যান ও অর্ধেকের বেশি সদস্য মহিলা। কিন্তু অভিযুক্তর পাশে তার পুরুষ সহকর্মী বা সিনিয়ররা দাঁড়িয়ে যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত কোনো সাক্ষী থাকে না। মহিলা জাতীয় কমিশনের হাতে শাস্তি ঘোষণার চূড়ান্ত ক্ষমতাও দেওয়া হয়নি। তারা শুধু মাত্র প্রস্তাব করতে পারে। এইরকম নিধিরাম সর্দার হয়ে কী করবে এই মহিলারা?

২০১৫ সালে ভারত পেয়েছে “বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও” প্রকল্প। উদ্দেশ্য লিঙ্গভিত্তিক সমতা সৃষ্টি করা। এবং শিক্ষিত করে ক্ষমতায়ন বাড়ানো। এই প্রকল্প মূলত হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, দিল্লী ও উত্তরাখণ্ডকে লক্ষ্য করে নামানো হয়। কিন্তু কন্ট্রোলার ও অডিটর জেনারেল এই প্রকল্পকে ব্যর্থ বলে ঘোষণা করে। কারণ তারা দেখেছে ২১টি রাজ্যের মধ্যে ১৭টি রাজ্যে এই রেশিও আরও কমে গেছে। ৪৩ কোটি টাকার মাত্র ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয় ২০১৬-১৭ এই একবছরের জন্য। যার ৫৬% প্রচারে ও ২৪% বিভিন্ন রাজ্যে ও জেলায় গেছে। আর বাকি ২৫% ব্যবহৃতই হয়নি। বেটিরা পড়াশুনা কেমন করছে? গ্রামীণ মেয়েদের ৩৮%-ই স্কুলের সাতবছর পার করতে পারে না। স্বভাবতই উচ্চ শিক্ষার হারে মেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। তাই দেখা যায় ৪৮.৭% মেয়েরা যখন উচ্চশিক্ষিত সেখানে ছেলেরা ৫১.৩%। কিন্তু মেয়েরা কেনো স্কুলে যায় না? দারিদ্র এর প্রধান কারণ। ৩০% উপর বালিকারা ছোট্ট বয়স থেকেই ঘরের কাজে লেগে যায়। পড়া তৈরি হয় না। অপমানিত হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না। ওদিকে স্কুলে বাথরুমও নেই। বয়ঃসন্ধির বিষয়গুলো সামলানো মুশকিল। আর এখন তো নতুন শিক্ষানীতি চালু হয়ে গেছে। পাকাপোক্ত সর্বনাশের ব্যবস্থা হয়ে গেছে গরিব মানুষের পড়াশুনোর। ক্ষমতায়ন শুরুতেই শেষ।

সুরক্ষার জন্য ১৮১ নম্বর ডায়াল করতে বলা হয়েছিল। হ্যাঁ, ডায়ালও কিছু হয়েছে হয়ত। কিন্তু মহিলাদের উপর অত্যাচার কমেনি। বরং বেড়ে গেছে। ২০২২-এ জাতীয় মহিলা কমিশন এমনটাই বলেছে। ২১-২২ এই একবছরে এই অপরাধ বেড়েছে ৩০%। ২০২২ সালে নথিভুক্ত অপরাধের সংখ্যা রেকর্ড করেছে। প্রায় ৩৪ হাজার কেস নথিভুক্ত হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে যে, ৫০% ক্ষেত্রেই পুলিশ কেস নেয়নি। সভ্যতার সংকটেও পড়েছে মেয়েরা। ২০২২-এ সাইবার অপরাধ রেকর্ড হয়েছে ৫৬ হাজারেরও বেশি। কিন্তু পুলিশ মাত্র ৯টি ক্ষেত্রে এফআইআর করেছে। নামহীন অভিযোগ — এই কারণেই সমস্যা, এই বলে পুলিশ দায় এড়াচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল ভারতে নির্মাতারা কেনো এই ডিজিটাল ঠেকাতে অন্য কোনো ডিজিটাল উদ্যোগ নিচ্ছে না?

ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কাজের বাজারে মহিলা কোথায়? ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী মহিলা কর্মশক্তি হল মাত্র ২৩.৯%। এদের বেশিরভাগই কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। কিন্তু সেখানে কাজের বা মজুরির সমতা কোনোটাই নেই। ডিজিটাল ভারতের বেশ কিছু অংশে লাঙলে গরুদের মতো জুতে দেওয়া হয় মহিলাদের। আর পিছন থেকে লাঙল ঠেলে পুরুষ চাষিরা। ১০০ দিনের কাজেও মহিলাদের দেখা যায়। কিন্তু তা এখন বন্ধ। প্যানডেমিক পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে নির্দিষ্ট মাইনের কাজ থেকে তারা সরে গেছে। সেখানে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে মেয়েদের নিয়ে অনেক কঠিন ও বেশি কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে বেআইনিভাবে। সেখানে কোনো ভদ্র চুক্তিও করা হচ্ছে না। ফলে আগে যারা সেখানে কাজ করত তারা এখন প্রতিদিন কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। হ্যাঁ অনেক মহিলারা নিজেরা ব্যবসা করছেন। কিন্তু ভারতের মত অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় তাদের সংখ্যা সবথেকে কম। যে সমস্ত ক্ষেত্রে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটে সেখানে তো মেয়েদের প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ। যেমন, আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং, পরিকাঠামো, ওষুধ শিল্প, ডিজিটাল মার্কেটিং, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, শক্তি উৎপাদন, রিটেলিং, ইত্যাদি। ভারতের আর্থিক বিকাশ এভাবেই পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় আচ্ছন্ন।

রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বেও কি একই অবস্থা? বছরের পর বছর ধরে ধুলো জমছে ৩৩% সংরক্ষণের দাবিতে। বিগত ৯টি বছরে আমরা এর কোনো উচ্চবাচ্য শুনিনি৷ ২০১৪-তে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ১১%। আর ২০১৯ সে তা হয়েছে ১২.৪৫%৷ লম্বাচওড়া স্বপ্ন দেখায় মোদির দল। সেই বিজেপিই ২০১৪ ও ২০১৯-এ বিজেপি যথাক্রমে মাত্র ৮% ও ১২% মহিলাকে প্রার্থী করেছিল।

ভারতের মহিলারা কিন্তু সরকারি ক্ষমতায়নের আশায় বসে নেই। তারা তাদের মত কাজ করে চলেছে। মহিলাদের উপর যে কোনো হিংসাতে যেমন তারা পথে নামছে, তেমন বৃহত্তর মানুষের দাবিতেও তারা এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে কৃষক মহিলাদের বিদ্রোহী রূপ দেখেছে দেশ ও সরকার। তারও আগে এনআরসির বিরুদ্ধে মুসলমান মহিলাদের শাহীনবাগ আন্দোলন ইতিহাস হয়ে গেছে। মণিপুরে শিশু বুকে জড়িয়ে আহত হচ্ছে তারা। আজ সাক্ষী মালিকদের পিছনে গোটা ভারত। আজ সবাই মানছেন যে, মহিলাদের ক্ষমতায়ন শুধু ভোটের প্রচারে মুখ দেখানোর একটা বিষয় মাত্র। যেমন উজ্জ্বলা গ্যাস জোযনায় ৯৯.৮% সংযোগ দেওয়া হয়েছে বলে এবার প্রচার করবে। কিন্তু তাদের ৫৬.৫% যে চারবারের পর আর সিলিন্ডার নেয়নি। সে কথাটা মোদি বলবে তো! লোকে বলে, “বিজেপি কি কথনি, বিজেপি কি করনি।” কথায় আর কাজে তার এতটাই ফারাক।

মোদি, তোর আয়না কোথায়?

- বর্ণালী রায়

খণ্ড-30
সংখ্যা-23