সামনে ২০২৪’এ লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু দেশে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে। সেই ক্ষয়কে ঠেকাতে তিনি আরেকবার তার ‘বিশ্বগুরু’ ইমেজের ওপর ভরসা রাখলেন। তিনি নরেন্দ্র মোদী। যদিও মে মাসের গোড়া থেকে মণিপুর জ্বলছে, ১০০-র বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, ২০০র বেশি চার্চ পুড়ে গেছে, ৫০,০০০-এর বেশি মানুষ গৃহহারা হয়ে ত্রাণ শিবিরে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই চালাচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী সংকট-দীর্ণ রাজ্যটিকে চরম বিপদের মধ্যে ফেলে রেখে উড়ে গেলেন আমেরিকায় — ‘রাষ্ট্রীয় সফরে’। ন'বছরে এটা ছিল তার ষষ্ঠ মার্কিন সফর। মোদী সরকারের, নির্বাচনের আগে মার্কিন মুলুকে রাষ্ট্রীয় সফরের জন্য এই চরম কাঙালপনাকে বাইডেন প্রশাসন পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগিয়েছে। কীভাবে? ভারতকে ঘিরে আমেরিকার রণকৌশলগত কব্জাকে আরও কঠোর করার উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করে।
রাজনৈতিক ভাবমূর্তি এবং মোদী সরকার ও গোদী মিডিয়ার আত্মগরিমায় প্রচার থেকে সরে এসে, এই সফরের আসল অন্তর্বস্তুকে বোঝারতে চেষ্টা করতে হবে। সে জন্য আমাদের নজর ফেলতে হবে বাইডেন মোদীর যৌথ বিবৃতিতে। ৫৮ অনুচ্ছেদের দীর্ঘ বিবৃতিতে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে ভূ-ভারতের সমস্ত বিষয়, কিন্তু মূল নজর নিবদ্ধ- প্রতিরক্ষা বন্ধনকে আরও গভীর, আরও সম্প্রসারিত করা। যার একমাত্র অর্থ হল, আমেরিকার ওপর ভারতের আরও বেশি রণকৌশলগত নির্ভরতা এবং তার ফলশ্রুতিতে ভারতের রণকৌশলগত স্বশাসনের সীমাবদ্ধ হওয়া! ভারতকে ইতিমধ্যেই কোয়াড (আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া জাপান এবং ভারতকে নিয়ে) ১২ইউ-২ (ইজরায়েল, ভারত, আমেরিকা, ইউএই)-র মতো জোটে টেনে নেওয়া হয়েছে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল — চিনের প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণে রাখা ও তাকে ঘিরে ফেলার এবং মার্কিন-ইজরায়েল আঁতাতকে আরও সুদৃঢ় করার মার্কিন নীতিকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করা।
ভারতের মহাকাশ, প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকা যে তার রণকৌশলগত অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ফেলেছে তার খুব স্পষ্ট ছাপ ধরা পড়েছে এই যৌথ বিবৃতিতে। ভারতীয় নৌবাহিনী ও নৌবাহিনীর সম্পদের ক্ষেত্রে আমেরিকার নাক গলানোর সুযোগ অনেক বেড়ে গেল। আর সেই সূত্রেই ভারতকে মাত্রাতিরিক্ত ও অযৌক্তিক উচ্চমূল্যে ৩১টি প্রিডেটর (হানাদার) ড্রোন ৩.১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কেনার ব্যাপারে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। রাফায়েল কেলেঙ্কারির মতো সমস্ত ফাঁদ রয়েছে এই চুক্তিতেও। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রেও যৌথ সহযোগিতার কিছু প্রস্তাব রয়েছে; যেমন এফ-৪১৪ জেট ইঞ্জিন তৈরির ব্যাপারে জেনারেল ইলেকট্রিক এবং হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড-এর মধ্যে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। গুজরাতে একটি সেমিকন্ডাক্টর যন্ত্রাংশ জোড়া দেওয়ার ও পরীক্ষা করার কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে মউ স্বাক্ষরিত হয়েছে। তবে বিনিয়োগের বেশিরভাগটাই বহন করতে হবে ভারতকে। আর একমাত্র সময়ই বলতে পারবে ভারত প্রযুক্তির এই তাৎপর্যপূর্ণ হস্তান্তর থেকে আদৌ লাভবান হবে কিনা।
ভারতের ক্রমশ বেশি বেশি করে মার্কিন-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠা বিদেশ নীতির কারণে শুধু যে অন্যায় আর্থিক মূল্য বহন করতে হচ্ছে তা-ই নয়, বরং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এর প্রতিকূল কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য। ভারতের নিজের জাতীয় স্বার্থে, তার প্রয়োজন এই অঞ্চলে শান্তি এবং সমস্ত পড়শী দেশগুলোর সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত-বিরোধ নিয়ে চাই কূটনৈতিক সমাধান। কিন্তু ভারত যদি চিনের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রটিকে ঘিরে ফেলার মার্কিন রণকৌশলগত পরিকল্পনা রূপায়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠে, তাতে চিনের সঙ্গে ভারতের বিরোধ আরও বাড়বে, আরও ঘনীভূত হবে। ভারত যত মার্কিন-ইজরায়েল শিবিরের দিকে ঘেঁষবে, তত তার ঘরের পাশের পড়শী দেশগুলোর সঙ্গেই শুধু নয়, উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব বেড়ে যাবে। ফলে চিনের পক্ষে প্রভাব বিস্তার আরও সহজ হয়ে যাবে। নতুন সংসদ ভবনে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ইতিমধ্যেই নেপালসহ ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে ভারতের কল্পনালালিত সম্প্রসারণবাদী আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে শঙ্কিত করে তুলেছে।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত বা ভারতীয়-আমেরিকান সম্প্রদায়সহ জনমতের একটা বিরাট অংশের কাছে মোদীর সফর মানে ভারতীয় গণতন্ত্রের সংকট সম্পর্কে তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করার একটা অবকাশ। মোদীর ভারতে, প্রতিবাদী, ভিন্নমতের মানুষদের নির্যাতন, বেড়ে চলা হিংসা, ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা ও তাদের প্রতি বৈষম্য, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, নাগরিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিপজ্জনক ক্ষয় সম্পর্কে জানতে চাওয়ার একটা অবকাশ। আইন পরিষদের ৭৫ জন সদস্য তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে চিঠি লিখেছিলেন। কয়েকজন মোদীর ভাষণ বয়কট করেছেন। আমেরিকার রাস্তায় নেমে কয়েকশো মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছেন। মোদীকে যখন হোয়াইট হাউসে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তার সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ওবামাও প্রকাশ্যেই এসব প্রশ্ন তুলে তার দুর্ভাবনা প্রকাশ করেছেন। সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে পড়ে মোদী ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের উত্তর দিতে গিয়ে অর্থহীন পুনরুক্তি করেছেন মাত্র। যেকোনো রকম বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং এটা করতে গিয়ে ভারতের সংবিধানকেও টেনে এনেছেন। বলেছেন ওসব হতেই পারে না, কারণ ভারত সাংবিধানিকভাবে ঘোষিত একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। কিন্তু ওবামা-র মন্তব্য ও সাংবাদিক সম্মেলনের প্রশ্নের যে রাগী প্রতিক্রিয়া এল বিজেপি’র ট্রোলবাহিনী এবং বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের থেকে, তা আরও একবার প্রকৃত সত্যের পর্দাফাঁস করে দিল!
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক সাব্রিনা সিদ্দিকী, যিনি ভারতে গণতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, সমাজমাধ্যমে ‘পাকিস্তানী এজেন্ট’ হিসেবে সমানে হেনস্থার শিকার হয়ে চলেছেন। হোয়াইট হাউস এবং আন্তর্জাতিক সাংবাদিক মহল শ্রীমতী সিদ্দিকীর এই হেনস্থার তীব্র নিন্দা করেছে। এমনকি বারাক ওবামাও বিজেপি নেতাদের দ্বারা সমাজমাধ্যমে ‘হুসেন ওবামা’ নামে ট্রোলড হচ্ছেন! তাকে ‘মুসলিম’ আর সে কারণেই ‘ভারত-বিদ্বেষী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। অত্যন্ত লজ্জার কথা, অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ট্যুইটারে এক সাংবাদিককে দেওয়া এক কদর্য উত্তরে বলেছেন অসম পুলিশ আগে ভারতে ‘হুসেন ওবামা’দের ঢিট করবে, তারপর ‘আমেরিকান ওবামা’র ব্যাপারটা দেখা যাবে! অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংও ওবামা সম্পর্কে যা খুশি তাই অর্থহীন কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন, তার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মুসলিম দেশগুলোর বোমা বর্ষণের জন্য। এক্ষেত্রে তারা খুব ঠাণ্ডামাথায় এড়িয়ে গেলেন এই সত্যটা যে মোদী সরকার মুসলিম দেশগুলোর ক্ষেত্রে মার্কিন বিদেশ নীতির এক কট্টর সমর্থকই রয়েছে!
মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনেও মোদীর ভাষণ অনুধাবনযোগ্য — যদিও তার টেলিপ্রম্পটারের টেক্সট-এর ভুল পাঠের জন্য নয়! (টেলিপ্রম্পটারের টেক্সট-এ ছিল ‘ইনভেস্টিং ইন দি গার্ল চাইল্ড’ তিনি ভুল করে পড়েন ‘ইনভেস্টিগেটিং ইন দি গার্ল চাইল্ড’। আবার ‘লেয়িং অব থাউজ্যান্ডস অব মাইলস অব অপটিক্যাল ফাইবার’-এ ভুল করে পড়লেন ‘পলিটিক্যাল ফাইবার’! চরম বিভ্রাট!)
ঐ টেক্সট অর্থাৎ ভাষণের বিষয়বস্তু আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভাষণ বা তার বাচনভঙ্গি নয়। ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী নিয়ে বলতে গিয়ে মোদী আরও একবার হাজার বছরের বিদেশী শাসনের কথা বলে ফেললেন। আর ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে হাজার বছরকে খারিজ করে দেওয়ার বিষয়টিই রয়েছে হিন্দু আধিপত্যকামী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিষাক্ত ন্যারেটিভ-এর মূলে, এই ‘খারিজ’ তত্ত্বই ভারতীয় মুসলিমদের হানাদার আক্রমণকারী ও ‘আভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসেবে তুলে ধরেছে এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসার অবিরাম প্রচারের জন্য মতাদর্শগত সাফাই যুগিয়েছে। এই ‘খারিজ’ এখন একের পর এক রাজ্যে মুসলিমদের পণ্য বয়কট ও বিতাড়নের আওয়াজ তুলে কার্যত সম্প্রদায়টিকে গণনিধনের হুমকি দিচ্ছে।
ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন মোদী তার যুক্তরাষ্ট্র সফরকে ট্রাম্পের প্রচার মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছিলেন; তার সেই চওড়া উচ্ছ্বাস ‘আবকি বার ট্রাম্প সরকার’ (এক বিরাট ঠাট্টার মতো) সেই কথাই বলছে! আমেরিকান ভোটাররা, যাদের মধ্যে সেদিন মোদীর শ্রোতৃমণ্ডলীতে উপস্থিত থাকা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের অনেকেও আছেন — যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। কেন? ট্রাম্পকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফেরানোর জন্য চীয়ার লীডার মোদীর হর্ষোৎফুল্ল উচ্ছ্বাসের হট্টগোল ভরা আবেদনে তারা বিভ্রান্ত হননি! প্রাক-নির্বাচনী রাষ্ট্রীয় সফর এবং তার প্রচারে মোদীকে অনুগৃহীত করে বাইডেন প্রশাসন একটা বিষয়কে সুনিশ্চিত করেছে। সেটা হল — গোটা বিশ্বের সামনে মোদী রাজের আসল চরিত্রটা একেবারে নগ্ন করে ফেলা! আমেরিকান ভোটাররা যেমন ট্রাম্পের নতুন করে জয়ের সমর্থনে মোদীর বাগাড়ম্বরকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আমাদের আশা, ঠিক সেভাবেই ভারতীয় নির্বাচকরা মোদীর ‘বিশ্বগুরু’র দাবির ডাহা মিথ্যেটাকে বোঝার ও তাকে খারিজ করার মতো পরিণতবোধের পরিচয় দেবেন। মোদী রাজ যে চরম বিপর্যয়কে আবাহন করে এনেছে, তাকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার আর কোনো সুযোগ তারা পাবে না — ভারতবাসীকে এটাই নিশ্চিত করতে হবে!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২৭ জুন ২০২৩)