শিবসেনায় ‘দলত্যাগের’ ভাঙন-চাতুরির ঠিক এক বছরের মাথায় এবার মোদী-শাহ রাজের নিশানায় ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি। মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার আরও একবার উপ মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন। রবিবাসরীয় এই আচমকা অভ্যুত্থান বিশেষভাবে চর্চায় এল কেন? কারণ এটা ঘটলো প্রধানমন্ত্রী মোদীর মধ্যপ্রদেশে ‘প্রতিশ্রুতি’ ভাষণ দিয়ে আসার বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে! সেখানে প্রধানমন্ত্রী মোদী অতিনাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেন যে, বিরোধীরা যদি দুর্নীতির গ্যারান্টি দেয়, তিনি দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের গ্যারান্টি দিয়ে গেলেন! ঐ ভাষণে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে অন্তত ৭০,০০০ কোটি টাকার ঘোটালার জন্য এনসিপি-কে অভিযুক্ত করেন। অজিত পাওয়ার শিবির থেকে যে ন’জন মন্ত্রী মহারাষ্ট্রের ক্যাবিনেটের জন্য শপথ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজন ইডি’র নজরে আছেন কয়েক বছর ধরে। এইভাবে মহারাষ্ট্র আরও একবার মোদীর দুর্নীতি-বিরোধী বাগাড়ম্বরের ‘অলীক কুনাট্য’ তথা মিথ্যাচারের পর্দাফাঁস করে দিল।
মোদীর দুর্নীতিগ্রস্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের ‘গ্যারান্টি’র মানেটা এখন মানুষের কাছে জলের মত পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে, রাজনীতিবিদরা বিরোধী শিবিরে থাকলে শিকার হবেন নির্যাতন ও প্রতিহিংসার, আর তারা বিজেপি-শিবিরে ভিড়ে গেলে সব অভিযোগ থেকে মিলবে অব্যাহতি, তার সঙ্গে ‘ক্ষমতা’। মোদী যখন বলেন ‘দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো রাজনীতিককে ছাড়া হবে না’ তার আসল মানে তার সরকার সেই সব লোককে বিজেপি’তে ভেড়ানোর জন্য বলপ্রয়োগসহ সব রকম চেষ্টা করবে। বিজেপি হল সব রকম অপরাধে অভিযুক্ত সেই সব লোকেদের ‘শেষ সাফাইয়ের মেশিন’ — যে অপরাধের মধ্যে আছে, আর্থিক তছরূপ থেকে যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ থেকে সমস্ত ধরণের বিদ্বেষ ও হিংসামূলক অপরাধ। অসমে হিমন্ত বিশ্বশর্মা এবং পশ্চিমবঙ্গে শুভেন্দু অধিকারী থেকে এখন মহারাষ্ট্রে অজিত পাওয়ার ও ছগন ভুজবল, বিজেপি শিবিরে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ঘোটালা-অভিযুক্তদের তালিকা দিনের পর দিন আরও দীর্ঘ হয়ে চলেছে।
মোদীর এই বাচিক আগ্রাসন যেখানে তিনি বিরোধীদের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের পরম্পরা’ বলে তোপ দেগেছেন, সেটা স্পষ্টতই একটা ভয় থেকে। তার আশঙ্কা, বিভিন্ন বিরোধীদলগুলোর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নির্বাচনী সমঝোতা আমজনতাকে উদ্দীপ্ত করে মোদী রাজের প্রতি তাদের ক্রোধকে আগামী নির্বাচনগুলোতে বিজেপি’র চূড়ান্ত পরাজয়ের অভিমুখে চালিত করবে। এমনকি, কোনো বিরোধী ঐক্য ছাড়াই কংগ্রেস হিমাচলপ্রদেশ এবং কর্ণাটকে বিজেপি’কে যথেষ্ট জোরালো আঘাত হেনে পরাস্ত করতে পেরেছে। আশাবাদী কংগ্রেস এখন নতুন উদ্যমে পরবর্তী পর্যায়ের বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে ফিরে আসার এক প্রলম্বিত সম্ভাবনা নিয়ে সমুপস্থিত; যেমন মধ্যপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানায় ক্ষমতা দখলের, আর ছত্তীশগড় এবং সম্ভবত রাজস্থানেও ক্ষমতা ধরে রাখার উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে সামনে রেখেই কংগ্রেস নির্বাচন লড়বে। নির্বাচনী গুরুত্বের প্রেক্ষিতে, ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য মহারাষ্ট্র যেটি লোকসভায় ৪৮ জন সাংসদ পাঠায়। তাই নিঃসন্দেহে বিজেপি’র কাছে এই রাজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিজেপি, একনাথ শিণ্ডে-দেবেন্দ্র ফড়নবীশ সরকারের অন্তর্নিহিত অস্থিতিশীলতা সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক (বেশ সপ্রতিভ একটি নাম দেওয়া হয়েছে এই সরকারের — ‘ইডি’ সরকার!)। কারণ একনাথ শিণ্ডে এবং তার সহকর্মীদের মাথার ওপর ঝুলছে ‘অযোগ্যতার’ খাঁড়া যেহেতু অদূর ভবিষ্যতে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মহারাষ্ট্র-সংকটের বিষয়টি ফিরে দেখবে। তাৎক্ষণিক প্রেক্ষিতে, দলত্যাগী এনসিপি বিধায়কদের অন্তর্ভুক্তি হয়তো শিণ্ডে ও তার সহকর্মীদের সম্ভাব্য অযোগ্যতার কারণে যে কোন সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করবে, এই আশায়। কিন্তু এখন এটা পরিষ্কার যে অজিত পাওয়ারের সঙ্গে এখনও প্রয়োজনীয় সংখ্যা নেই এবং বেশ কিছু দলত্যাগী সদস্যের শারদ পাওয়ার শিবিরে ফিরে আসার সম্ভাবনাও রয়েছে যার ফলশ্রুতিতে হয়তো শারদ পাওয়ার আবার জনতার কাছে ফিরে যাবেন পার্টি পুনর্গঠনের জন্য। ইতিমধ্যে এনসিপি অজিত এবং অন্য বিধায়ক যারা শিণ্ডের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছেন তাদের ‘অযোগ্যতার’ আবেদনও জানিয়ে রেখেছে এবং বিদ্রোহী সাংসদদের বহিষ্কার করেছে। এই ভাবেই লড়াইটা শুরু হয়েছে মাত্র এবং পরিস্থিতি অমীমাংসিতই থাকছে, এমনকি সাময়িক ভিত্তিতেও নিষ্পত্তি অধরা।
ভারত জুড়ে মোদী সরকার ‘গুজরাট মডেল’-এর জন্য চিহ্নিত। যদিও গুজরাটের আধিপত্যের ধারণাকে প্রশমিত করতে মোদী-শাহ বন্ধনীতে যোগী আদিত্যনাথকে জুড়ে দেওয়া এবং নরেন্দ্র মোদীকে লোকসভায় বারাণসীর প্রতিনিধিত্বে রাখা হয়েছে, চারটি গুজরাটি হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের অভূতপূর্ব কেন্দ্রীভবন কারও নজর এড়াতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয়তার বিষয়টি ভীষণভাবে অনুরণিত শুধু কাশ্মীরে নয়, যে রাজ্যটি তার সাংবিধানিক অধিকারগুলি হারিয়েছে, বা শুধু দিল্লীতে নয়, যেখানে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকারের সাংবিধানিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে এক আক্রমণাত্মক কার্যনির্বাহী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। অথবা তামিলনাড়ু এবং দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্য যেগুলি ভাষা ও সংস্কৃতিগতভাবে স্বতন্ত্র্যচিহ্নিত, শুধু সেখানেই নয়। ঠিক এই মুহূর্তে সেই প্রতিধ্বনি স্পষ্ট হচ্ছে ভারতীয় পুঁজিবাদের ‘প্রাণকেন্দ্র’ মহারাষ্ট্রে! একদিকে যেমন বহু প্রজেক্ট, অফিস এবং প্রাতিষ্ঠানিক সম্পদ স্থানান্তরিত হয়ে বা গতিমুখ পাল্টে মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাতে চলে যাওয়া, অন্যদিকে মহারাষ্ট্র-কেন্দ্রিক আঞ্চলিক পরিচিতি সম্পন্ন দুই রাজনৈতিক দল শিবসেনা ও এনসিপি'র ওপর জোরালো রাজনৈতিক আক্রমণ, গুজরাট মডেলের আধিপত্যের নিচে থাকা মহারাষ্ট্রকে অস্থির অশান্ত করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা তাই আজ বেশি জরুরি চর্চার বিষয় মহারাষ্ট্র রাজনীতিতে।
গুজরাট ও মহারাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমশ বাড়তে থাকা ফাটলের প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডার উঠে আসাই ছিল তার পরিণাম স্বরূপ শিবসেনা ও বিজেপি’র মধ্যে বিচ্ছেদের অন্তর্নিহিত কারণ।
গত তিন দশক ধরে হিন্দুত্বের উত্থানের সময় এই দুই দলের মধ্যে ছিল মতাদর্শগত ঘনিষ্ঠতম অন্তরঙ্গতা। অন্তর্নিহিত হিন্দুত্বের বন্ধন সত্ত্বেও, যদি বা গুজরাট মডেলের ক্রমবর্ধমান আধিপত্যের কারণে শিবসেনা-বিজেপি’র বন্ধুত্ব টিঁকতে না পারে, এনসিপি বিজেপি’র সঙ্গে প্রকৃত অর্থে মতাদর্শগতভাবে কখনোই যুক্ত ছিল না, সম্ভবত একমাত্র আর্থিক ও বিদেশ নীতিসংক্রান্ত বিষয় ছাড়া। নিগ্রহের ভয় এবং ক্ষমতার লোভ শিবসেনা এবং এখন এনসিপি’রও বেশিরভাগ বিধায়ককে বিজেপি’র ছাতার তলায় ভিড়তে বাধ্য করেছে। কিন্তু উপনির্বাচন ও এপিএমসি নির্বাচনের ফলাফল এবং উদ্ধব ঠাকরে’র শিবসেনা ও শরদ পাওয়ারের এনসিপি’র নিচুতলার সমর্থন পরিষ্কার একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে — শিবসেনা এবং এনসিপি'র যেসব বিধায়ক বিজেপি’র কাছে মাথা মুড়িয়েছেন তারা তাদের সংশ্লিষ্ট গণভিত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।
ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারানোর মুখে দাঁড়িয়ে, ক্ষমতা ধরে রাখতে মোদী সরকার এখন সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ, রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ এবং যে কোনো মতবিরোধের নির্মম কণ্ঠরোধের ওপর বেপরোয়াভাবে নির্ভর করছে। মাটির মানুষের দৈনন্দিন জীবনের উদ্বেগ-ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন এই সরকারের ক্ষমতামত্ত ঔদ্ধত্য এখন মহারাষ্ট্র থেকে মণিপুরে ভয়ানক প্রকট হয়ে পড়েছে। বিরোধীদের এই সরকারের বিবেকহীন ক্ষমতার খেলায় বাধা পেয়ে থামলে চলবে না, জনসংযোগ গড়ে তুলে নতুন শক্তি আর উদ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। মোদীর মহারাষ্ট্র নিয়ে জুয়া খেলা অবশ্যই বুমেরাং হয়ে তার দিকেই ফিরে আসবে আর তার পতনকে ত্বরান্বিত করবে!
এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ৪ জুলাই, ২০২৩