মোদীর সাম্প্রতিক মার্কিন সফরে সম্পন্ন হল ভারতের সামরিক ক্ষেত্রের জন্য নতুন ‘মউ’। বলাবাহুল্য, ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার নামে। প্রস্তাবটি মোদী সরকারের, তাতে সাড়া দিয়েছে মার্কিন পক্ষ।
বিশ্বজুড়ে ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্য ও বেকারির জ্বালা! ভারত-মার্কিন দু’দেশেই কিছু কমবেশি একই দুরাবস্থা! বিশেষত বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে জনসংখ্যার দেশ ভারতে অভাবী অবস্থা পৌঁছেছে বর্ণনাতীত চরমে। লোকসংখ্যা ১৫০ কোটিতে পৌঁছে যাওয়া আমাদের দেশে এবছর এপর্যন্ত (জুন ২০২৩) বেকারি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৪৫ শতাংশে। চলতি বছরে মার্চ ও মে মাসে কিঞ্চিৎ কমার ব্যতিক্রমের বিপরীতে গত ছ’মাস যাবত কর্মহীনতা বৃদ্ধির ধারা লেগেই আছে। সর্বোপরি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির বিভীষিকা, মারাত্মক প্রভাব ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। এই সময়কালে, যখন বিশ্বের দেশে দেশে মানবতাবাদী কন্ঠে নিনাদ উঠছে “যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই, বাঁচার জন্য যা যা অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন তার সবকিছু পেয়ে বাঁচতে চাই”; যখন ভারতের জনজীবনের জরুরি চাহিদাগুলি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি ততোধিক তৎপরতায় সমাধানের দাবি রাখে, তখন মোদীর মার্কিন সফরে এক অত্যন্ত অবাঞ্ছিত ঘটনা হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারতের সামরিক সম্ভারের বরাত দেওয়া। অন্যদিকে আরও একবার দৃশ্যমান হল, ট্রাম্প বিদায় নেওয়ায় বাইডেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় বসলেও মার্কিন রয়েছে তার পূর্বাপর অবস্থানেই। মুখিয়ে আছে ভারতের ‘প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে’ সম্প্রসারণ আরও বাড়াতে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র সংক্রান্ত ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আগে থেকেই যথেষ্ট ঘনিষ্ট, তার ওপর নতুন পরত দিতে ‘মউ’ করা হল।
এবারের দ্বিপাক্ষিক বোঝাবুঝি অনুসারে মোদী সরকার কথা দিয়েছে আমেরিকার কাছ থেকে ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের ৩১টি ড্রোন কিনবে। ১৫টি ভারতীয় নৌবাহিনীর সামুদ্রিক পাহারাদারী চালাতে, আর ৮টি করে স্থলবাহিনী ও বিমানবাহিনীর আকাশপথে নজরদারী চালানোর জন্য। যাতে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন ও পাকিস্তান সীমান্তের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বহু দূর থেকে গোয়েন্দাগিরি, নজরদারী ও বিপক্ষ শক্তির উপস্থিতি জরীপ করা এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানা যায়। তাছাড়া, ভারত-মার্কিন উভয় কর্তৃপক্ষ এই আশা পোষণ করে, ভারতে জিইএফ-৪১৪ আইএনএস-৬ টার্বো-ফ্যান ইঞ্জিন একসাথে তৈরি করতে পারলে তা ভারতীয় ‘তেজস মার্ক-২’ যুদ্ধবিমানকে আরও শক্তি যোগাবে। এখন যেখানে ‘তেজস মার্ক-১’ জেট তৈরি হচ্ছে মার্কিন থেকে কোনোরকম প্রযুক্তি হস্তান্তর ছাড়াই। ‘তেজস মার্ক-২’ জেট উৎপাদন শুরু হলে পরে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতায় এদেশে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা-শিল্পক্ষেত্র গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও পদক্ষেপ করার দরজা খুলে যেতে পারে। এহেন জেট ইঞ্জিন ও ড্রোনের হাতিয়ার উপরন্তু ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্দ্ধমান আগ্রাসী চ্যালেঞ্জকে প্রতিহত করতে ভারত-মার্কিন রণনীতিগত সম্পর্ককে অভিন্ন কেন্দ্রাভিমুখী করে তুলতে সহায়ক হবে। এই ‘চুক্তি’ হয়েছে মার্কিন কোম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের অন্তর্গত হিন্দুস্থান এ্যারোনেটিক্সের মধ্যে।
উপরোক্ত ‘মউ’ করার নেপথ্যে মার্কিনের অন্যতম আরও এক উদ্দেশ্য হল, সামরিক সরঞ্জাম কেনার প্রশ্নে ভারতকে রাশিয়ার ওপর ব্যাপক নির্ভর করা থেকে ক্রমশ সরিয়ে নিয়ে আসা। বিগত ১৫ বছরে ভারত থেকে রীতিমতো লোভনীয় ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক রসদ লেনদেন হাসিল করার পর এখন মার্কিন পক্ষ চাইছে এই ক্রেতা-বিক্রেতার সামরিক সম্পর্ককে আরও বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।
মোদী সরকারের বড়গলায় বোলচাল আছে যে, সামরিক ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপারেই ভারত নাকি স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার রণনৈতিক স্বায়ত্ততা অর্জনের তালাশ করে চলছে! কেন্দ্রের সরকারি ভাষ্যে অবিরাম হৈ হল্লা চালানো হয় — ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীরা অন্তর্ঘাত হানতে চোরাপথে এদেশে অস্ত্র ঢুকিয়ে বোঝাই করছে! কিন্তু প্রকৃত বাস্তবে ভারত আজও সরকারিভাবে বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। এবং এই সর্বনাশা পথে দেশকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সর্বোপরি কোন পরিস্থিতিতে, কোন সময়ে? ক্ষুধার ভারতে, বৈষম্যের ভারতে, দারিদ্রের ভারতে, কর্মহীনতা বৃদ্ধির ভারতে।
- অনিমেষ চক্রবর্তী