দেশজুড়ে আগুন লেগেছে কাঁচা সব্জির বাজারে। কয়েকমাস আগে যে টমেটো চাষিরা দাম না পেয়ে তাঁদেরই উৎপাদিত পণ্যকে রাস্তায় ফেলে নষ্ট করলেন সরকারের নজর কাড়তে, সেই টমেটোই এখন দেশের বিভিন্ন বাজারে বিকোচ্ছে কোথাও কেজি প্রতি ১০০ কোথাও বা ১৩০ টাকায়। বহুদিন ধরেই আটা, ভোজ্য তেল সহ সমস্ত ধরনের ডালের দাম চড়া। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম অনেকটা কমা সত্ত্বেও সাধারণ গ্রাহকেরা তার সুফল পেলেন না। রান্নার গ্যাসের আকাশ ছোঁয়া দাম কমার কোনো লক্ষণই নেই। এবার নুনেরও দাম উঠতে শুরু করেছে। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা, তীব্র দাবদাহ বা এল-নিনোর ভ্রুকুটির জন্য বর্ষার খামতি, কোথাও বা অতিবৃষ্টিকে এই দামবৃদ্ধির কারণ হিসাবে ঠাওরানো হচ্ছে। এমন একাধিক খলনায়কের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না।
এই আগুন ঝড়ানো মূল্যবৃদ্ধির পেছনে প্রকৃতিকে দুয়োরানি হিসাবে সামনে খাড়া করে নিজেদের দায়িত্ব ও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে আড়াল করছে সরকার — তা কেন্দ্রই হোক বা রাজ্য। বিশ্বে ফল ও আনাজ ফলনে চীনের পরই ভারতের স্থান। বহু বৈচিত্র্যময় ফল সব্জি আমাদের মতো বিশাল দেশে সারা বছর ধরেই বিভিন্ন মরশুমে উৎপাদিত হয়। প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার কারণে কোনো অঞ্চলে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য অঞ্চলের উৎপাদিত ফসল থেকে তা সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু তা করতে গেলে দরকার কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা, ফলনের পর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা, হিমঘর বা তা সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক আধুনিক ব্যবস্থা — যার কোনটাই সরকারের পক্ষ থেকে আজ পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়নি। এই নয় যে এই প্রথম দেশজুড়ে আনাজ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে আগুন লাগল। প্রকৃতির দোহাই দিয়ে ফড়ে ব্যবসায়ী, মজুতদার অশুভ আড়তদার ফি বছরই এই সমস্ত সংকট থেকে বিপুল মুনাফা তোলে। উৎপাদনের বিন্দু থেকে বাজারে ফসল আসার সমগ্র প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত হয় মধ্যসত্ত্বভোগীদের নানা স্তরের মাধ্যমে, লাভের গুড় তারা মাঝখান থেকে খেয়ে নেয়। দরিদ্র চাষির অবস্থা যে তিমিরি ছিল তাই থাকে। আমজনতারও কোনো সুরাহা হয় না।
আম জনতার ক্রয়ক্ষমতা দিনের পর দিন কমছে, যার প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়েছে। আইএমএফ’এর পরিসংখ্যান দেখিয়েছে বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির মধ্যে মাথা পিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত সবচেয়ে নিচে। বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশের গরিমা নিয়ে চললেও, বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্যই দেখিয়েছে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত লজ্জাজনক ভাবে অ্যাঙ্গোলা ও আইভরি কোস্টের থেকেও নিচে রয়েছে। এই অবস্থায় বাজারে আনাজ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশছোঁয়া দামে নাজেহাল সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। এদিকে, সিএমআইই’র সাম্প্রতিকতম তথ্য জানাচ্ছে, জুন মাসে বেকারত্ব ৮.৪৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
গভীর সংকটে জর্জর ভারতীয় অর্থনীতি। আর্থিক বৃদ্ধির অর্ধসত্য পরিসংখ্যানে কপট উল্লাসে মাতোয়ারা প্রবঞ্চকদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশবাসী সমুচিত জবাব দেবে অনাগত দিনে।