এনডিএ সরকার এবং ল কমিশন ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ ও ব্যক্তিগত আইন সংস্কারের ইস্যুটিকে যেরকম চেহারা দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যে তাঁরা লিঙ্গ ন্যায়ের প্রশ্নগুলিকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করার বদলে বরং দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িকভাবে সংজ্ঞায়িত এক ইউনিফর্মিটি অর্থাৎ সমরূপতা চাপিয়ে দিতেই বিশেষ আগ্রহী। বিতর্কটিকে সাম্প্রদায়িক আকার দেওয়ার ফলে লিঙ্গ সমতার জরুরি প্রশ্নগুলি হারিয়ে যেতে বসেছে।
বিজেপি ও আরএসএসের ‘এক জাতি এক আইন’ প্রচারণাটি ভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাংবিধানিক স্ব-ভাবের ওপর প্রত্যক্ষ আঘাত। এই প্রচারণার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, কেবলমাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের — বিশেষ করে মুসলমান সংখ্যালঘুদের — ব্যক্তিগত আইনগুলির সংস্কারসাধন জরুরি এবং ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ আদতে মুসলমান ও খ্রিস্টান ব্যক্তিগত আইনকে ‘হিন্দু ব্যক্তিগত আইন’-এর খাপে ঢুকিয়ে দেওয়ার বিষয়।
বাস্তবে, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ এবং সম্পত্তির অধিকার ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিগত আইনগুলির বেশিরভাগেরই সংস্কার জরুরি সেগুলিকে লিঙ্গ সমতা ও লিঙ্গ ন্যায়ের সাংবিধানিক নীতির সাথে সাজুয্যপূর্ণ করতে। উদাহরণস্বরূপ, সম্পত্তির অধিকার সংক্রান্ত ‘হিন্দু’ আইনে পারিবারিক সম্পত্তির ওপর কন্যা সন্তানের অধিকারকে মান্যতা দেওয়া সংশোধনীটি এখনও প্রবল বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয় এবং তার বাস্তব প্রয়োগ ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়, কন্যাসন্তানদের সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে কোনো আইনি রক্ষাকবচ নেই।
হিন্দু বিবাহ আইনে বিচ্ছেদ প্রাপ্ত কোনো পুরুষ তার প্রাক্তন স্ত্রীকে খোরপোষ দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে যদি সে ‘অসতী’ হয় বা অন্য ধর্ম গ্রহণ করে। এই ধারা খোরপোষের বিষয়টিকে মেয়েদের অধিকারের বদলে পিতৃতান্ত্রিক নৈতিক বিধি ও ধর্মীয় পরিচয়ের সাথে জুড়ে দিয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে ‘নিষ্ঠুরতা’-র যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা খুব শিথিল ধরনের — নিষ্ঠুরতাকে পিতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞায় ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করার যথেষ্ট জায়গা ছাড়া আছে। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক এক রায় এই প্রসঙ্গে এক আঘাতপ্রদ উদাহরণ। সেখানে ঘোষণা করা হয়েছে যে, কোনো স্ত্রী তাঁর স্বামীকে নিয়ে শ্বশুড় বাড়ি থেকে ভিন্ন হতে চাইলে তা ‘নিষ্ঠুরতা’ এবং তা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে।
ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহ আইনে এক মাস আগে নোটিশ দেওয়ার যে বিধান রয়েছে তারও সংস্কার জরুরি। কারণ, এই লম্বা অপেক্ষার কাল বাপ-মা এবং সাম্প্রদায়িক ও জাতবাদী ঠ্যাঙাড়ে দলগুলিকে ভিনজাত ও ভিনধর্মের যুগলের ওপর হিংস্রতা সংগঠিত করার সুযোগ করে দেয়। মুসলমান ব্যক্তিগত আইনে বহুগামিতা স্বীকৃত। আবার, গুজরাটে ‘মৈত্রী কারার’ (বন্ধুত্বের চুক্তি) প্রথা দ্বিগামিতাকে বৈধতা দেয়। ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মুসলমান সম্প্রদায়ই ‘বিশেষ’ ছাড়ের মজা লোটে — এই ধারণা সম্পূর্ণত এক সাম্প্রদায়িক গালগল্প মাত্র। প্রকৃত পক্ষে, ‘হিন্দু অবিভক্ত পরিবার’ বিশেষ কর ছাড় পেয়ে থাকে, এমনকি হিন্দু যুগল স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করলেও এই বিশেষ ছাড় প্রযোজ্য হয়।
মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই বহুদিন ধরে দাবি উঠেছে মুসলমান ব্যক্তিগত আইনে বিধৃত তিন তালাক ও হালাল প্রথা বাতিল করার।
দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় রাষ্ট্র ও শাসক দলগুলি নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘুর অধিকার — এই উভয় বিষয়েই নিজেদের দায়দায়িত্বের প্রশ্নে নীতিনিষ্ঠ নয়, উন্নাসিক ও সুবিধাবাদী। শাহ বানো মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে একটা কংগ্রেসী সরকার উল্টে দেয় মুসলমান সম্প্রদায়ের গোঁড়া রক্ষণশীল নেতাদের প্রীতিতুষ্ট করতে, আর সেই সরকারই আবার হিন্দুত্বের সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয় বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে। বিজেপি ইউনিফর্ম সিভিল কোডের দাবিটিকে এক সুস্পষ্ট সাম্প্রদায়িক রং ও সুর দিয়েছে। ফলত অধিকাংশ নারী আন্দোলনের গ্রুপগুলিকে এ’কথা আবার জোরের সাথে তুলে ধরতে হচ্ছে যে তাঁরা বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইনগুলির লিঙ্গন্যায় সঙ্গত সংস্কার দাবি করে আসছেন — বাঞ্ছনীয় হল, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিতর থেকেই উঠে আসা সংস্কার — হিন্দুত্বে রাঙানো ইউনিফর্মিটি চাপিয়ে দেওয়া নয়।
২০১৫ সালে, হিন্দু মহিলাদের উত্তরাধিকারের অধিকার প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টে শুনানি চলাকালীন, মুসলমান মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্ট আদেশ দেয় ‘মুসলমান মহিলাদের সমতার আকাঙ্খা’ প্রশ্নে পিআইএল দায়ের করার। তৎপরবর্তী অনেকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান মেয়েরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন তিন তালাক ও হালাল প্রথাকে অসাংবিধানিক বিধায় বাতিল করার আবেদন নিয়ে। ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড’ (এআইএমপিএলবি) আদালতে এইসব আবেদনের জবাবে যুক্তি দেয় যে, আদালত ব্যক্তিগত আইনের চৌহদ্দিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। ইতমধ্যে ল কমিশন একটি প্রশ্নমালা জারি করে ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ বিতর্ককে পুনরায় সামনে আনতে — এবং মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে একে বিভিন্ন ব্যক্তিগত আইন খর্ব করে ইউনিফর্মিটি চাপিয়ে দেওয়ার বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডার অঙ্গ বলে অভিহিত করে।
ল কমিশনের প্রশ্নমালার ফরম্যাটটি নিঃসন্দেহেই ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট এবং এর আসল উদ্দেশ্য ও কুফল সম্পর্কে আশঙ্কারও জোরালো ভিত্তি আছে। ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ইস্যুকে নতুন করে ফিরিয়ে এনে এবং সমগ্র আলোচনাকে ‘ইউসিসির পক্ষে না বিপক্ষে’ এই দুই মেরুতে বিভাজিত করে ল কমিশন আদতে শাসক দলের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডাকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে বিজেপি মুসলমান মেয়েদের প্রতি বৈষম্যে কাতর হয়ে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করছে, সেই বিজেপিই আবার সাম্প্রদায়িক হিংস্রতায় মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ ও খুনে সামিল হচ্ছে গুজরাটে বা সাম্প্রতিক মুজফ্ফরনগরে।
ব্যক্তিগত আইনে সংস্কার চেয়ে মুসলমান মহিলাদের বেশ কিছু গ্রুপ ও ব্যক্তি নারী তীব্র সোচ্চারের দাবি অত্যন্ত আশাপ্রদ বিকাশ। এই গ্রুপগুলি (যেমন ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন, বেবাক কালেক্টিভ ও অন্যান্য) এবং বিভিন্ন ব্যক্তি নারী এই সাম্প্রদায়িক বিজেপি আর পিতৃতান্ত্রিক এআইএমপিএলবি — উভয়কেই নিশানায় রেখেছে। তাঁরা এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে তাঁরা তাঁদের সমতা ও ন্যায়ের দাবির সুরাহায় আর বিলম্ব সহ্য করতে রাজি নন। মুসলমান ব্যক্তিগত আইনের স্বঘোষিত পাহারাদাররা পরিবর্তনের দাবি কানে নিতে যখন অনিচ্ছুক, তখন মেয়েরা সুবিচার চেয়ে আদালত ও রাষ্ট্রের দ্বারস্থ হওয়ার অধিকার বলবৎ করছে।
দেশের বাম ও প্রগতিশীল শক্তিকে, সাম্প্রদায়িক ছকের ইউনিফর্ম সিভিল কোড বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার দৃঢ় বিরোধিতা গড়ে তোলার সাথে সাথে, নারীর সমতা ও মর্যাদাক প্রাধান্য দেওয়া ব্যক্তিগত আইনের দাবিতে চলমান নারী আন্দোলনকে অবশ্যই দৃঢ় সমর্থন যোগাতে হবে।
২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর এমএল আপডেট সম্পাদকীয়