ক্যাবের দেশ, ছবির দেশ ফ্রান্স কেন জ্বলছে ?
country-of-poetry-country-of-pictures

ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের নানতেরে এলাকায় নাহেল এম নামের এক তরুণ গত মঙ্গলবার ২৭ জুন ২০২৩, পুলিশের হাতে খুন হয়েছেন। গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় ট্রাফিক পুলিশ তাকে থামতে বলে। সে না থামলে পুলিশ খুব কাছে থেকে তাকে গুলি করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ অফিসার একটি গাড়ির চালকের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এরপর একটি গুলির শব্দ শোনা যায় এবং তারপর গাড়িটি থেমে যায়। বুকে গুলিবিদ্ধ হবার পর নাহেলকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া হলেও বাঁচানো যায়নি। গুলিবর্ষণকারী অফিসারকে হত্যার অভিযোগে আটকও করা হয়। ফরাসী মিডিয়ায় বলা হয়, পুলিশ প্রথমে ইঙ্গিত দিয়েছিল যে তরুণটি তাদের দিকেই গাড়িটি চালিয়ে দিয়ে পুলিশদের আহত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে বোঝা যায় যে প্রকৃত ঘটনা ছিল একেবারেই আলাদা।

নাহেলের মৃত্যুর পরেই ফরাসী সংবাদ মাধ্যম তার সম্পর্কে নানা তথ্য জোগাড় করে প্রচার করেছে। তা থেকে জানা যাচ্ছে যে প্যারিসের নানতেরে শহরেই বেড়ে ওঠেন ১৭ বছর বয়সী নাহেল এম। তিনি খাবার ডেলিভারির কাজ করতেন এবং রাগবি লিগে খেলতেন। একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন তার মা। নাহেলের লেখাপড়া ছিল কিছুটা অবিন্যস্ত। প্রথাগত পড়াশুনোর বদলে ইলেকট্রিশিয়ান হতে চেয়েছিল সে। আর সেজন্যে যে এলাকায় সে থাকত, তার কাছেই সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। যারা নাহেলকে চেনেন, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী নাহেল ভালো ছেলে ছিল এবং সবাই তাকে ভালোবাসতো। নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত, তবে নাহেলের বাবা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি।

নাহেলের মৃত্যু ফ্রান্সে বর্ণবাদ এবং সংখ্যালঘু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষদের প্রতি পুলিশের বৈষম্যমূলক আচরণের ব্যাপারে ক্ষোভ উস্কে দিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে পুরো ফ্রান্স বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। ২৭ জুনের রাত থেকেই প্যারিস ও অন্য আরো কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়। গাড়ি ও বাসস্টপে আগুন দিয়ে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা। কিছু রাস্তায় ব্যারিকেড করে দেওয়া হয়, আক্রান্ত হয় পুলিশ স্টেশনও। দাঙ্গা প্রতিরোধী পুলিশ বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। শনিবার বিকেল থেকেই মার্সেই শহরের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে মার্সেইয়ের কেন্দ্রস্থল লা ক্যানেবিয়েরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ফরাসি মিডিয়াগুলোর খবর অনুযায়ী ওই এলাকায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে লড়াই চলে। নাহেল হত্যার বিচার চেয়ে রাস্তায় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া এক তরুণ তাদের ক্ষোভের উৎস ব্যাখ্যা করে বলেন যে পুলিশের হিংসা দমন এখান প্রতিদিনের ঘটনা। আরব বা কৃষ্ণাঙ্গ হলে এই দমনপীড়ন বাড়ে।

বিক্ষোভ থামাতে ফ্রান্সের পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর সক্রিয় হয়ে উঠেছে ও বিক্ষোভকারীদের ওপর দমনপীড়ন চালাচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে শনিবারেই ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে প্রায় ৪৫,০০০ পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই এক ট্যুইট বার্তায় জানিয়েছেন যে গত শনিবার অর্থাৎ ১ জুলাইয়ের রাতে অন্তত ৪২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর পাশাপাশি তিনি পুলিশকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন আর বলেছেন যে তাদের পদক্ষেপের জন্যই শনিবার রাতের পরিস্থিতি শান্ত ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এর ঠিক আগে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শনিবারই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল যে বিক্ষোভ শুরু হবার পর থেকে প্রথম চার দিনে অন্তত ২,৩০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার মধ্যে শুক্রবার অর্থাৎ ৩০ জুন রাতেই গ্রেপ্তার করা হয় ১,৩১১ জনকে। ফ্রান্সের বিচারমন্ত্রী জানিয়েছেন গ্রেপ্তার হওয়া ফরাসীদের মধ্যে ৩০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের কম। বোঝাই যাচ্ছে ফ্রান্সের নাগরিকরা, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বর্ণবাদ, সংখ্যালঘু নিপীড়ণ, বাড়তে থাকা নানা দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক প্রবণতাকে নীরবে মেনে নিতে প্রস্তুত নন। গোটা ইউরোপ জুড়ে দক্ষিণপন্থা ও প্রগতিশীল মতাদর্শের মধ্যে যে তীব্র লড়াই চলছে এখন, ফ্রান্সের এই ঘটনাবলীতেও তার ছাপ স্পষ্ট।

খণ্ড-30
সংখ্যা-22