ছোটবেলা থেকে অনেকেই হয়তো এই কথাটা শুনে এসেছেন, “লোকে যাঁরে বড় বলে, বড় সেই হয়, নিজে যাঁরে বড় বলে, বড় সেই নয়”। আজকের সময়ে কথাটা হয়তো খুব বেশি প্রযোজ্য নয়, আজকের সময়টাই প্রচারের সময়, নিজের ঢাক নিজে পেটানোর সময়। আজকের সময়টা নিজস্বী তোলার সময়, জানান দেওয়ার সময়, আমিও ছিলাম। ঘটনাচক্রে যেদিন থেকে এই আধুনিক মুঠোফোন চালু হয়েছে, সেদিন থেকেই এই নিজস্বী তোলাটাও চালু হয়েছে কি না, তা জানা না গেলেও, আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী যে এই বিষয়ে পথিকৃৎ তা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, কীভাবে নিজের প্রচার আরও বেশি বেশি করে করা যায়, সেই বিষয়েও তাঁর থেকেই শিখতে হয়। তিনি তাঁর নিজস্ব ক্যামেরাম্যান, নিজস্ব পোষাক পরিচ্ছদ সহকারে এমনভাবে নিজেকে দেশের মানুষের সামনে আনতে চান, যাতে দেশের মানুষও মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং অন্যান্য জরুরি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার কথাও মানুষ ভুলে যায়।
এদিকে দু’মাস হয়ে গেল, ভারতের উত্তর পূর্বের একটি ছোট অঙ্গরাজ্য, মণিপুর, জাতিগত হিংসায় জ্বলছে। যে প্রধানমন্ত্রী ছোটখাট বিষয় নিয়েও ট্যুইট করে থাকেন, যে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ করে থাকেন, সেই প্রধানমন্ত্রী মণিপুর নিয়ে এখনও অবধি মুখে কুলুপ এঁটেছেন। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি মণিপুর নিয়ে চিন্তিত, প্রতিদিনকার ঘটনাবলির দিকে তিনি নাকি নজর রাখছেন, ওদিকে বিদেশ সফর থেকে ফিরে তিনি প্রশ্ন করে বসছেন, দেশে এখন কী চলছে? ঘটনাচক্রে সেটাও খবর হচ্ছে। তার পরের দিন দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করছেন, তাতে কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা জানা না গেলেও, পরের দিন থেকে প্রধানমন্ত্রীর কর্মকাণ্ড দেখে বোঝা যাচ্ছে সেদিনের মন্ত্রীসভার বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, আরও বেশি করে নরেন্দ্র মোদীর মুখকে সামনে রেখে আগামী লোকসভা ভোটের প্রচার করবে শাসক বিজেপি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনকে কেন্দ্র করে একটি অনুষ্ঠান হবে সেখানে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, বক্তব্য রাখবেন, প্রথম থেকে শেষ অবধি তা প্রচার করা হবে, পৌঁছে যাবে, দেশের কোনায় কোনায়, প্রধানমন্ত্রীর স্থির ছবি, চলমান ছবি, মানুষ অবাক চোখে দেখবে, তাঁদের স্বপ্নের সওদাগরকে।
সকাল থেকে সেই মতো প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। যে কোনও সময়ে ভারতের মতো প্রধানমন্ত্রী তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি করেই হয়তো যেতে পারতেন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু সেটা করলে তো প্রচার করা যাবে না, যে তিনিও একজন সাধারণ মানুষ, তিনিও দিল্লীর সাধারণ মানুষের মতো সরকারি যানবাহনে চলাফেরা করেন। তাই ঠিক হয়, তিনি দিল্লীর মেট্রো রেলে চড়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন। সেইমতো প্রস্তুতি নেওয়া হয়, দিল্লী মেট্রো রেল সকাল থেকে খালি রাখা হয়। স্টেশন চত্বর খালি রাখা হয়। যদিও নিরাপত্তার কারণেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ক্যামেরাম্যান এবং কিছু মানুষকে প্রস্তুত রাখা হয়, যাতে তাঁরা পরবর্তী স্টেশন থেকে ঐ একই মেট্রো রেলে ওঠেন, এবং দেখেন যে প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন সেই ট্রেনে। তারপর তাঁদের সঙ্গে খানিক কথাবার্তা হবে, সেটাও আগে থেকে ঠিক করে রাখা বিষয়ে। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার ছবি তোলা এবং তাঁর পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের মদতে যাতে, সেই ছবি এবং ভিডিও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে, তার ব্যবস্থাও আগে থেকে করে রাখা হয়।
এই পর্যন্ত সব কিছু, সমস্ত ঘটনা, পরিকল্পনা মাফিক হলেও, কিছু কিছু বিষয় এরপর সামনে চলে আসে, যা প্রধানমন্ত্রীর এই প্রচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয়। খবর আসতে থাকে, যে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ছাত্রনেতাদের ঘরবন্দী করে রেখেছে, দিল্লী পুলিশ। অভিজ্ঞান ও দিল্লী আইসার সম্পাদক অঞ্জলি ট্যুইট করেন, প্রধানমন্ত্রীকে যাতে কোনও ছাত্র কোনও অপ্রীতিকর প্রশ্ন না করে, সেই জন্যেই কি তাঁদের গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে? ধীরে ধীরে আরও বেশ কিছু খবর পাওয়া যায়, যে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ নাকি, তাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত হিন্দু কলেজ, ভীম রাও আম্বেদকর কলেজ সহ বেশ কিছু কলেজের ছাত্র শিক্ষকদের প্রধানমন্ত্রীর এই অনুষ্ঠানটি দেখা বাধ্যতামূলক করেছে, বলা হয়েছে, এই অনুষ্ঠানে যদি তাঁরা উপস্থিত হন, তাহলে তাঁদের পাঁচটা অতিরিক্ত হাজিরা দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, তাঁদের নাকি বলা হয়েছে, তাঁরা যেন কেউ কালো রঙের পোষাক পরে না আসেন, তাঁরা যেন কেউ প্রধানমন্ত্রীকে দেশের চলমান কোনও বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করেন। আরও শোনা গেছে, অদ্যাপকদের জামা কাপড় খুলে অবধি তল্লাশি করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নকে এড়ানোর জন্য, প্রধানমন্ত্রী এতো কিছু করলেন, সেই প্রশ্ন করা কি আটকানো যায়? এই ছাত্ররা একযোগে সামাজিক মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোই তুলে ধরলেন, যা আরও বেশি পরিমাণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। সকলে যে যার বাড়ি থেকেই পোষ্টার তুলে ধরলেন, মণিপুর নিয়ে কেন প্রধানমন্ত্রী মুখে কুলুপ এঁটেছেন? কেন, ভারতীয় মহিলা কুস্তিগিরদের যৌনহেনস্থা করেও বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে এখনও গ্রেপ্তার করা হল না? সেই পোষ্টার কিন্তু আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে গেল। প্রধানমন্ত্রী যা আটকাতে চেয়েছিলেন, তা কি তিনি পারলেন?
এরপরেও কিছু কথা থেকে যায়। প্রধানমন্ত্রী বারংবার নিজেকে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনি বলে প্রচার করে থাকেন, তিনি নাকি ‘সমগ্র রাষ্ট্র বিজ্ঞানে’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, কিন্তু এই শতবর্ষের অনুষ্ঠানে তাঁর সমসাময়িক একজন ছাত্রকে খুঁজে পাওয়া গেল না কেন? আজকের সময়ে সকাল থেকে বিকেল অবধি অনেকেই দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুকে গালাগালি দিয়ে থাকেন, কিন্তু সেই নেহেরুর একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, যা আজকের ঘটনার সঙ্গে হয়তো সম্পর্কযুক্ত। অধ্যাপক হরদয়াল আইএসআই কলকাতায় একটি ঘরোয়া আলোচনায় জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নেহরু রোজ সকালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হাঁটতে যেতেন। বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হাঁটলে একটু যদি বিদ্বজ্জনদের ও বিদ্যাচর্চা কেন্দ্রের হাওয়া গায়ে লেগে বিদ্যাবুদ্ধি বিকশিত হয়। অধ্যাপক হরদয়াল আরও বলেছিলেন, ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর সেক্রেটারিকে একবার বলেন যে, তিনি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে চান, সেক্রেটারি সাহেব যেন মাননীয় উপাচার্যের সেক্রেটারির সাথে কথা বলে উপাচার্য মহাশয়ের সময় অনুযায়ী সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করেন। ওই সেক্রেটারি বলেন যে, এর কী দরকার? বরং উপাচার্য মহাশয়কে জানালে তিনিই দেখা করতে আসবেন। মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রীর তাঁর কাছে যাওয়া উচিত এবং তিনি তাই যাবেন। আজকে দেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার নামে যেভাবে শুধু নিজের প্রচারের ব্যবস্থা করলেন, তাতে এই পুরোনো কথাগুলো আবারও মনে করিয়ে দিতে হল। আসলে আজকের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন পছন্দ করেন না, তিনি শুধু নিজের প্রচার চান, আর সেইজন্যেই তিনি শিক্ষাকে আরও গুরুত্বহীন করে দিতে চান। তিনিও হয়তো সেই কথাটাই বিশ্বাস করেন, “ওঁরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে”। তিনি চান প্রশ্নহীন আনুগত্য। কিন্তু আজকের পড়াশুনা জানা যে কোনও ছাত্র তো প্রশ্ন করবেই, পেয়াদা দিয়ে ঘরবন্দী করে রেখে কি সেই প্রশ্ন করা আটকানো যাবে?
- সুমন সেনগুপ্ত