গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সুপরিকল্পিত হামলা ও হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদকে ওকালতি করার যে ফ্যাসিবাদী প্রকল্প বিজেপির রয়েছে, তার আরও একটা সংযোজন ও চরিত্রলক্ষণ হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণির বিরুদ্ধে শাসক বর্গের খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা। নব্য উদারবাদের বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের এই পর্যায়টি মাথা চাড়া দিয়েছে, যেখানে পুঁজি চলে এসেছে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে। এতদিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন যে সমস্ত সাফল্য অর্জন করেছিল, তা সে কেড়ে নিতে শুরু করেছে, জনপরিসরে যে সকল সম্পদগুলো ছিল তা কব্জা করতে চলছে বেসরকারিকরণ, জমি লুঠ, এবং পরিবেশ ধ্বংসসাধনের লক্ষ্যে জোরালো প্রচারাভিযান। শ্রমিকশ্রেণিকে দুর্দশাগ্রস্থ করে তুলতে নব্য উদারবাদী নীতিসমহের হাত ধরে গত ন’বছরে মোদী জমানার ৯টি হামলা যুক্ত হয়েছে।
পুঁজিবাদি শ্রেণির প্রতি নিজের আনুগত্য প্রকাশ করতে গিয়ে মোদী জমানা শ্রমিক শ্রেণীর প্রতি তার চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে। আদানি-আম্বানির হুকুম তালিম করতে গিয়ে মোদী শ্রমিক শ্রেণীকে ক্রীতদাসে পরিণত করেছে ‘সহজে ব্যবসা-বাণিজ্য করার’ স্লোগানের আড়ালে। তার সরকার ‘গরিবদের প্রতি যত্নশীল’ বলে নিজের পিঠ চাপড়ালেও মোদীর জমানা সন্দেহাতীতভাবে ভারতের সবচেয়ে বেশি কর্পোরেট স্বার্থবাহী ও জনবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।
কথায় ও কাজে মোদীর সমস্ত প্রচেষ্টাগুলোই হচ্ছে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের মধ্যকার সম্পর্ককে ক্রীতদাস ও আনুগত্যের উপর দাঁড় করানো। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে মোদী ঘোষণা করেছিলেন যে দেশে মাত্র দু’টো জাত রয়েছে — একটা হল গরিব, আর আরেকটা হল তারা, যারা গরিবদের দারিদ্র থেকে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করছেন। ২০১৯’র স্বাধীনতা দিবসের সময় তাঁর দেওয়া ভাষণে মোদী দেশবাসীর কাছে আবেদন করেন ওই সমস্ত ‘সম্পদ সৃষ্টিকারী’দের স্বীকৃতি ও যথাযথ সম্মান দিতে। অযথা তাঁদের ‘সন্দেহের’ চোখে না দেখতে। সম্পদ যে শ্রমশক্তির ফসল, এই বুনিয়াদি সত্যটা মোদী অস্বীকার করে পুঁজিপতি শ্রেণির প্রতি তাঁর ভক্তি প্রকাশ করেন। এদিকে, অক্সফাম’এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, কর্পোরেট কর কমিয়ে ও কোম্পানিগুলোকে নানান আর্থিক সুযোগ সুবিধা দিয়ে ২০২০-২১-এ সরকারের রাজস্বে ক্ষতি হয়েছে ১.০৩ লক্ষ কোটি টাকা যা সেই বছরে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইনের সমগ্র বরাদ্দের থেকে বেশি।
সাঙাতী পুজিবাদকে জনপ্রিয় ভাষায় আদানি-আম্বানির কোম্পানি রাজ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করলে মোদী সরকারের আসল চরিত্রকে সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। যে সরকারটি হল, অতি ধনীদের জন্য, অতিধনীদের দ্বারা পরিচালিত এবং অতি ধনীদের স্বার্থে কাজ করা।
মোদী সরকারের আর্থিক ও শ্রমনীতি দেশে উদ্বেগজনক হারে সামাজিক ও আর্থিক অসাম্য তৈরি করেছে। গত তিন দশক ধরে ভুবনীকরণ, উদারবাদ ও বেসরকারিকরণের নীতি বিরাট মাত্রায় অসাম্য ডেকে এনেছে, কিন্তু গত ন’বছরে এই বৈষম্য বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে, আজ ভারতবর্ষ অসাম্যের দিক থেকে রয়েছে সবার উপরে।
সম্পদের কেন্দ্রীভবন পৌঁছে গেছে মারাত্মক জায়গায়। অক্সফাম রিপোর্ট ‘ভারতে অতিধনীদের টিকে থাকা : ভারতীয় অধ্যায়’ দেখিয়েছে সবচেয়ে উপরতলার ৩০ শতাংশ মানুষ সমগ্র সম্পদের ৯০ শতাংশ নিজেদের হাতের মুঠোয় রেখেছে, আর, নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে রয়েছে সমগ্র সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ! প্রত্যক্ষ কর, কর্পোরেট কর হ্রাস করার ফলে লাফ দিয়ে বেড়েছে অপ্রত্যক্ষ কর। দেখা যাচ্ছে, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নিচুতলার ৫০ শতাংশ মানুষ উপর তলার ১০ শতাংশ মানুষের থেকে নিজেদের উপার্জনের ছ’গুণ বেশি অপ্রতক্ষ কর কেন্দ্রীয় সরকারকে দেন। এই বৈষম্য ৭০ শতাংশ ভারতীয়কে এতই দুর্দশাগ্রস্থ করে তুলেছে যে তার প্রভাব পড়েছে খাদ্য কেনার ক্ষেত্রে, ফলে ভারত এখন বিশ্বে অন্যতম এক ক্ষুধাতুর দেশ। ২০২২’র বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২১টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭।
কেন্দ্রীয় সরকারের বর্তমান আর্থিক নীতিগুলো জাতপাত ও পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকে টিকিয়ে রাখাই শুধু নয় তাকে করেছে অনেক বেশি মজবুত। সমাজের গভীরে তার শেকড়কে আরো গভীরে প্রোথিত করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, নয়া লেবার কোড সেই সমস্ত পেশায় কন্ট্রাক্ট শ্রম ব্যবস্থাকে বজায় রেখেছে যেগুলো জাতপাতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যেমন নিকাশী, গৃহকর্মের কাজ। দলিত শ্রমিকরা নিরাপত্তাহীনতার পাপচক্রে ঘুরপাক খায়, সামাজিক সুরক্ষা ও কাজের নিশ্চয়তা ছাড়াই।
মহিলা শ্রমিকদের বেলায় একই কথা খাটে। অক্সফাম ইন্ডিয়ার বৈষম্য রিপোর্ট দেখিয়েছে, ভারতে মহিলা শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ ২০০৪-০৫-এ ছিল ৪২.৭ শতাংশ যা ২০২১-এ দাঁড়িয়েছে ২৫ শতাংশে। মজুরি ও সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেই এই বৈষম্য বড় মাত্রায় গড়ে উঠেছে। ৯৭ শতাংশ মহিলা শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন ঠিকা শ্রমিক, স্কিম কর্মী প্রভৃতি পেশায় যেখানে কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই, নেই কোনো ধরনের সামাজিক সুরক্ষা। আশা, মিড-ডে-মিলে কর্মরত বিপুল সংখ্যক মহিলা কর্মী এমনকি শ্রমিক হিসাবেও স্বীকৃতি পান না। যে শ্রমকোড তৈরি করা হয়েছে তা সরাসরি লিঙ্গ সাম্যের উপর আঘাত নামিয়েছে, যা সমমজুরি ও কাজের শর্তগুলোর উপরও হামলা।
গত ৪৫ বছরের মধ্যে বেকারত্ব শীর্ষস্থানে উঠেছে, কর্মহীনতা শ্রমিকশ্রেণির গোটা অংশকেই, বিশেষ করে প্রান্তিক ও নিপীড়িত স্তর থেকে আসা মানুষদের নিক্ষিপ্ত করেছে দারিদ্র, ঋণের ফাঁদ, অনাহার এবং আরও বেশি করে ঠেলে দিয়েছে প্রান্তসীমায়। দু’কোটি চাকরি দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি মোদী ২০১৪-তে দিয়েছিলেন, তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ও শ্রমনীতি নতুন কোন কাজের সুযোগ তো তৈরি করছে না, বরং তা কেড়ে নিচ্ছে সেই কাজগুলোকে যা এখনও টিকে রয়েছে, ফর্মাল সেক্টরকে আরও ইনফর্মাল করছে, যার দরুণ বেকারত্ব আরও তীব্র হচ্ছে, শ্রমিকদের ঠেলে দিচ্ছে নিরাপত্তাহীন কাজের জগতে। এমনকি সেনাবাহিনীকেও ঠিকাকরণের হাত থেকে রেহাই দেওয়া হল না। অগ্নিপথ প্রকল্প হল তারই প্রকাশ।
আজ অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুল ৯৩ শতাংশ হল অসংগঠিত শ্রমিক যারা জিডিপি’তে ৬৫ শতাংশ অবদান রাখেন। তাঁরাই আজ কাজের জগতে, মজুরির বা সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এই সমস্ত শ্রমিকরাই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিক্ষিপ্ত, ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক সম্প্রদায় থেকে আগত। তাঁদের অধিকার যে কি মাত্রায় খর্ব করা হচ্ছে তা বোঝা যায় এই তথ্য থেকে যে ২০১৯-২০২০’র মধ্যে দিন মজুরদের সামাজিক স্তরটি সবচেয়ে বেশি আত্মঘাতী হয়েছেন।
শ্রমিকশ্রেণির উপর এই তিনটের আঘাত বিপর্যয়কারী। নোটবন্দী দেশের ইনফর্মাল অর্থনীতিকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। লক্ষ লক্ষ কাজ উধাও হয়ে যায়। সিএমআইই-সিপিএইচএস’এর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৭’র প্রথম চার মাসে ১৫ লক্ষ কাজ চলে যায়। নোটবন্দীর কয়েকমাসের মধ্যেই চালু করে দেওয়া হল জিএসটি, যা আবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল।
কোভিড লকডাউন আরও বড় ধাক্কা দিয়ে সংকটকে তীব্র করল। ২৪ মার্চ চার ঘণ্টার নোটিশে দেশব্যাপী লকডাউন শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলোকে চরম দুর্দশা, বুভুক্ষা, কাজ হারানোর নিদারুণ অবস্থায় ফেলে দিল। কাজ হারিয়ে ক্ষুধার্ত-ক্লান্ত পরিযায়ী শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে নিজভূমে ফেরার পথে চরম লাঞ্ছনার শিকার হলেন। সুরাটে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে লাঠি চালায় এমনকি গ্রেপ্তারও করে। যে সমস্ত শ্রমিক লকডাউনের সময়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে, তাঁদের সাইকেল বাজেয়াপ্ত করে বেচে দিয়ে ২১ লক্ষ টাকা তুলে নেয়। বাড়ি ফেরার পর শ্রমিকরা খাদ্য ও কাজের দাবিতে বিক্ষোভও দেখান।
প্রথম পর্বে লাখে লাখে যে সমস্ত কাজগুলো খোয়া যায়, তা আর কোনোদিন ফিরে এল না। যারা ফের কাজ ফিরে পেলেন, দেখলেন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তাঁদের নিয়োগ করা হচ্ছে। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট ‘স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া’ দেখিয়েছে, যারা কাজে ফিরে এসেছেন তাঁরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় ইনফর্মাল কাজের ধরনে নিযুক্ত হলেন। ২০১৯-২০’র মধ্যে ফর্মাল ক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক বেতনভুক কর্মী যুক্ত হলেন ইনফর্মাল কাজে — হয় স্বনিযুক্ত হিসাবে অথবা ইনফর্মাল কর্মী হয়ে। অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গ এবং ২০২১’র দ্বিতীয় লকডাউন পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলল। সরকার শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে একচুল উদ্যোগও নিল না। উল্টে, অতিমারীর সুযোগে নিয়ে এল শ্রমিক বিরোধী আইন। অতিমারীর গোটা পর্যায়ে বিজেপি যে কাজটা করেছে তা নাওমি ক্লেইন’এর ভাষায় ‘ঝাঁকানি দেওয়ার তত্ত্ব’। যার অর্থ হল, সমষ্ঠিগতভাবে জনগণ যখন যুদ্ধ, ক্যু বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় দিগভ্রান্ত থাকে, তখন সেই সুযোগে নির্মম কৌশল নিয়ে কর্পোরেট স্বার্থবাহী নীতিগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। শ্রম সংক্রান্ত আইন, কৃষি, জমির মালিকানা, শিল্পের জন্য জমির অধিগ্রহণ — এই সমস্ত কিছুই সংশোধন করেছিল বিজেপি সরকার। ২০২০’র ৫ মে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক সমস্ত রাজ্য সরকারের কাছে এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, “অতিমারী যে সমস্ত চ্যালেঞ্জগুলো সামনে আনল তা মোকাবিলা করতে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যেন শ্রম সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হয়।” স্ব-শংসাপত্র প্রদান, পরিদর্শনের ব্যবস্থাকে কমিয়ে আনা, আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের আইনের রক্ষাকবচের বাইরে এনে ফেলা, এই সবকিছুই কয়েকটা উদাহরণ মাত্র।
৪৪টি শ্রম আইনকে বাতিল করে তার জায়গায় ৪টি শ্রমকোড নিয়ে আসা আসলে শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার নামান্তর।
শ্রমিকদের কষ্টার্জিত অধিকারগুলোকে খারিজ করে শ্রমকোড ক্রমবর্ধমান বেসরকারিকরণ, ঠিকাকরণ ও ইনফর্মাল ক্ষেত্রকে আরও প্রসারিত করতেই এক আইনী ছাড়পত্র দিয়ে বসল। ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের উপর আক্রমণ শানিয়ে শ্রমিক শ্রেণির যেকোনো সংঘবদ্ধ কার্যকলাপ, যেমন ধর্মঘটকে কঠোর শাস্তি ও বেআইনি হিসাবে চিহ্নিত করাটাই এর মূল উদ্দেশ্য। লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনি পরিসরের বাইরে রেখে, বর্তমানের সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলোকে ভেঙে খান খান করে, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকারের উপর হামলা নামানো হয়েছে। মহিলা শ্রমিকদের জন্য বেশ কয়েকটি সুরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রত্যাহার করে কন্ট্রাক্ট প্রথাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে, জাতপাত ও লিঙ্গ নিপীড়নকেই কর্মস্থলে আইনসিদ্ধ করা হল।
সংবিধানে বিধৃত শ্রমিকদের অধিকারের উপরও আক্রমণ হল এই শ্রমকোড। সংবিধান যখন ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ)-এর কথা বলছে, তখন শ্রমকোড ‘অনাহারে দিন কাটানোর জন্য মজুরি’ বা স্টারভেশন ওয়েজ নির্ণয় করছে। সংবিধান যখন ম্যানেজমেন্টে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের পলিসিকে অনুসরণ করাটা বাধ্যতামূলক করছে, কোড তখন ব্যক্তি নিয়োগকর্তার একচ্ছত্র দাপট কায়েম করার অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক করে দিচ্ছে।
একশ দিনের কাজের প্রকল্পকে ক্ষয়প্রাপ্ত করে কেন্দ্রীয় সরকার ভারতে কৃষি সংকটকে আরও তীব্র করে তুলল। ক্ষমতায় আসার এক বছরের মধ্যে, ২০১৫ সালে মোদী মস্করা করে বলেছিলেন মনরেগা হল কংগ্রেসের ব্যর্থতার এক জীবন্ত স্মারক। আর তারপর থেকেই এই প্রকল্পকে হেয় করতে সংগঠিত প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
এই প্রকল্পের চাহিদা দিনের পর দিন বাড়তে থাকলেও কেন্দ্রীয় বাজেট বরাদ্দ হ্রাসপ্রাপ্ত হতে থাকে আর ২০২৩-এ এই খাতে বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করা হয় ৩৩ শতাংশ।
ত্রিমুখী পন্থায় সরকার মনরেগার উপর হামলা নামিয়েছে, যা জ্যাঁ দ্রেজ দেখিয়েছেন। প্রথমটা হল, নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ স্বরূপ ডিজিটাল অ্যাপ চালু করা হয়েছে যা শ্রমিকদের দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে কারণ ডিজিটাল স্বাক্ষরতা তাঁদের মধ্যে নেই, এছাড়া সংযোগ বা কানেক্টিভিটির সমস্যাও গ্রামগুলোতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আধার লিঙ্কের সাথে মজুরি প্রদান নির্ভরশীল। আর তৃতীয়ত, মনরেগার মজুরি থমকে রয়েছে। আধার ভিত্তিক মজুরি প্রদান ব্যবস্থা হওয়ায় যাদের এই ব্যবস্থা থাকবে না তাঁরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হবেন। সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, মাত্র ৪৩ শতাংশ মজুর এই ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত হতে পেরেছেন।
পরিকল্পিত বেসরকারিকরণ এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোকে বেচে দেওয়া, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও ‘ন্যাশনাল মনেটাইজেশন পাইপলাইন’এর আড়ালে গোটা অর্থনীতিকেই বিদেশি পুঁজির কাছে খুলে দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় সম্পত্তিকে কর্পোরেটদের কাছে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি কর্পোরেটদের কব্জায় যে বিপুল সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটেছে তার ফলাফল মারাত্মক হবে। শ্রমিকরা কর্মচ্যুত হবেন, দলিত ও জনজাতি মানুষদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধাকে সুরক্ষিত করতে সংরক্ষণের নীতিও বাতিল হয়ে যাবে।
রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের সম্পত্তিকে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া যেমন চলছে জোর কদমে, তেমনি শূন্যপদে নিয়োগ প্রথাও বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি তথ্য বলছে (ডিপার্টমেন্ট অফ এক্সপেন্ডিচার, পে রিসার্চ ইউনিট) ৯.৮৩ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি পদ খালি হয়ে পড়ে রয়েছে যা সমগ্র অনুমোদিত পদের ২৪.২৯ শতাংশ।
গত ৯ বছর ধরে মোদী সরকার শ্রমিকশ্রেণি ও তাঁদের আন্দোলনকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
লকডাউনের সময়, সুরাটে পরিযায়ী শ্রমিকরা যখন নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন, তখন তাঁদের উপর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়, লাঠি চার্জ করে গ্রেপ্তারও করা হয়। মুম্বাইয়ে রিলায়েন্স এনার্জি লিমিটেডের কন্ট্রাক্ট শ্রমিক, মুম্বাই ইলেক্ট্রিক কর্মী ইউনিয়নের কর্মচারীরা যখন কর্মস্থলের জঘন্য পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করে শ্রমিকদের বুনিয়াদি দাবিগুলোতে সোচ্চার হন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে ইউএপিএ’তে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়।
নব্য উদারবাদী রাষ্ট্র শ্রমিকদের পরিকল্পিতভাবে প্রচন্ড ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করছে, কন্ট্রাক্ট প্রথায় কাজ ও ইনফর্মালকরণকে মদত দিচ্ছে, যা শেষ বিচারে নিরাপত্তাহীন কাজকেই উৎসাহিত করে। শোভন কাজের দাবিতে শ্রমিকদের যেকোনো আন্দোলনকেই ঘৃণাভরে বিরোধিতা করা হয়। কর্পোরট সেক্টর রাষ্ট্রযন্ত্রকে, পুলিশ বাহিনীকে নিজের পোষা বাহিনী বলেই মনে করে। এই সমস্ত আন্দোলন সংগঠিত হলেই তাকে দমন করা হয়।
বিগত ৯ বছর ধরে শ্রমিক শ্রেণি মোদী সরকারের হামলার মুখে ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে প্রতিরোধ করে চলেছে। এর ভালো উদাহরণ হল বেঙ্গালুরুতে হাজার হাজার পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট। ২০১৬-তে কেন্দ্রীয় সরকার পিএফ’এর কিছু বিধিনিয়ম সংশোধন করতে উদ্যত হলে এই ধর্মঘট হয়, যার চাপে সরকার পিছু হটে ও সংশোধনী প্রত্যাহার করে নেয়।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে শ্রমকোডের বিরুদ্ধে প্রতিবছর ধর্মঘট পালন করে, যার ফলশ্রুতিতে সরকার এখনও তা লাগু করতে পারল না। আশা কর্মী, সাফাই শ্রমিক, অঙ্গনওয়াড়ির শ্রমিকদের উদ্দীপ্ত লড়াই সরকারকে বাধ্য করেছে উন্নত কাজের পরিবেশ ও শ্রমিক হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করতে।
শ্রমিকশ্রেণির কাছে এই লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ন্যায্যতাপূর্ণ সাম্যভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যা আগামীদিনে ভূমিকা রাখতে পারবে।
- মৈত্রেয়ী ক্রিশনান, অবনী চোকস্কি ও ক্লিফটন ডি’রোজারিও
(জুন ২০২৩ লিবারেশনে প্রকাশিত)