প্রতি বছরের মতো এবারও ধর্মতলায় ২১ জুলাই শহীদদের স্মরণে জনসমাবেশ করল তৃণমূল কংগ্রেস। ৩০তম শহীদ দিবসেও যে উত্তরটা অজানা থেকে গেল, ‘গণহত্যার তদন্ত’ রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হল না কেন? আমাদের দেশে এটাই যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনগণের টাকায় কখনো সখনো গণহত্যার তদন্ত হবে, কিন্তু তা জনসমক্ষে আসবে না।
এবারের জনসমাবেশে ভিড় অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি বা কম ছিল কিনা এ’তুলনা অর্থহীন। বরং যে প্রশ্নটা আড়ালে আবডালে ঘোরাঘুরি করছিল, ২০২৩’র ২২ জুলাই কী হবে? ২০২২’র ২১ জুলাই সমাবেশের পরদিন, বস্তুত ২৪ ঘন্টার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব তথা মন্ত্রীসভার দ্বিতীয় ব্যক্তি তথা শিক্ষামন্ত্রীর দুর্ণীতির অভিযোগে গ্রেফতার ও পরবর্তী ঘটনাবলী তৃণমূল কংগ্রেসকে যথেষ্ট কোণঠাসা করে দিয়েছে। এ’বছরের ২২ জুলাই এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। বরং সদ্য সমাপ্ত ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল জয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে কর্মীবাহিনী ও সমর্থকরা সমাবেশে হাজির হয়েছিল। যুব তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকা এই সমাবেশে দু’জনের বক্তব্যই রাজনৈতিক মহলে চর্চায় আসে। বাকিদের বক্তব্য ও উপস্থিতি ক্ষমতার বৃত্তে তারা এখনও আছেন কিনা সেটুকু জানান দেয়। তাদের সম্মিলিত বক্তব্য থেকে এটা বোঝা যাচ্ছিল, মুখ্য বক্তাদের বক্তব্যের অভিমুখ কোন দিকে হতে পারে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ‘প্রকাশ্যে দুঃখ’ প্রকাশ করে তাঁর ৪১ মিনিট ২৩ সেকেন্ড বক্তব্যের সূত্রপাত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর এই দুঃখ প্রকাশে তথ্য পরিসংখ্যানে শুধু ভুল ছিল এমন নয়, আন্তরিকতা আদৌ ছিল কিনা, এ’প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রী বললেন, বিরোধীরা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কখনো ১৯ জন, কখনো ২৯ জনের মৃত্যু/খুনের কথা উল্লেখ করে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, এর বেশিরভাগই তাঁর দলের কর্মী। অথচ বিরোধী দলগুলি শুধু নয়, সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা ৫৫ থেকে ৬২ জন বলা হচ্ছে। মৃত্যুর বিষয়টি শুধুমাত্র সংখ্যা দিয়ে হিসাব নিকাশ হবে? এবং কিছুটা ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিতে হবে? ২০০৩ ও ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মৃত্যুর সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করে এবারের নির্বাচন অনেক বেশি ‘গণতান্ত্রিক’ হয়েছে, এটা হাস্যকর বলেই মনে হয়। এর থেকে বরং যুক্তিযুক্ত হতো ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে। সেবার ৩৪-৩৬ শতাংশ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছিল, এবার ১২-১৮ শতাংশ আনুমানিক। সেদিক থেকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক! তবে মুখ্যমন্ত্রীকে একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ, ২০০৮এ শাসন ক্ষমতায় থাকা দলটি দেওয়ালের লিখন পড়তে পারেনি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী দেওয়ালের লিখন পড়তে শিখুন।
মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে কুৎসিত তুলনা করার রীতি তখনই বন্ধ হবে যখন নির্বাচকমণ্ডলী বিনা বাধায় তার প্রতিনিধি নির্বাচন করার জন্য ভোট দিতে পারবেন।
মমতা ব্যানার্জী তাঁর ভাষণ অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক উপস্থিত করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী ‘জগাই, মাধাই গদাই’কে সম্বোধন করে সাধারণত তাঁর ভাষণ শুরু করেন। এবার কংগ্রেস দলের নাম (মুখ্যমন্ত্রীর জগাই) একবারও উচ্চারিত হয়নি, মাধাই অর্থাৎ সিপিএমের কথা একবারই মাত্র এসেছে, উভয় শাসনে পঞ্চায়েত নির্বাচন ও মৃত্যুর তুলনা করার সময়। মমতা ব্যানার্জীর এবারের ২১ জুলাই ভাষণ কেন্দ্রিত ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। সেটাই স্বাভাবিক ও যুক্তি সংগত। দেশজুড়ে বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, আবহাওয়া ও জোটের সম্ভাবনা পাটনা ও বেঙ্গালুরু কনভেনশনে মূর্ত হয়ে উঠেছে, তার অন্যতম শরিক হিসেবে নিজেকে দেশব্যাপী তুলে ধরার চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি এরাজ্যে বিজেপি বিরোধী প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসকে তুলে ধরা। পশ্চিমবাংলায় ২০২১’র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী যে মনোভাব/জনাদেশ নজরে এসেছে, তাকে একশ শতাংশ কাজে লাগাতে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ ব্যবহার করলেন মমতা ব্যানার্জী। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো বেঙ্গালুরু বৈঠকে সদ্য গড়ে উঠা ‘ইন্ডিয়া’ (INDIA) নামে শ্লোগান তুললেন। ৪১ মিনিট ভাষণের সিংহভাগ সময় এই লক্ষে ব্যয় করলেন।
পশ্চিমবাংলায় শাসনক্ষমতায় থাকার সুবাদে বিজেপিকে উদ্ঘাটিত করার সর্বতোভাবে চেষ্টা তিনি করেছেন। তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থান থেকে জোটের কোনো পদ বা মন্ত্রীত্ব চাই না বলে ঘোষণা করলেন। জোটের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তিনি শুধু সৈনিক। রাজনীতির অ আ ক খ জানা মানুষ জানেন এসব কথার কথা। শুধু বললেন, চাই “বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে হটাতে”। এরাজ্যে INDIA বনাম NDA নির্বাচনী লড়াইয়ের রাশ নিজের হাতে রাখতে ভাষণের একটা বড় অংশ মণিপুরের জাতিদাঙ্গা, বীভৎস নারী নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। দেশ আজ উত্তাল। বিরোধী পক্ষের কোনো রাজনৈতিক দল তা এড়িয়ে যেতে পারে না। রাজ্যবাসীর অভিমতকেই তুলে ধরেছেন। মমতা ব্যানার্জীর ভাষণের পরিপূরক হিসেবে বিরোধী পক্ষের রাজনীতির পরিসর তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে ধরে রাখার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক ব্যানার্জী দিল্লী অভিযানের ডাক দিলেন।
১০০ দিনের কাজে কেন্দ্রের বকেয়া টাকা ও আনুষঙ্গিক কিছু দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। যুবনেতা আরও একধাপ এগিয়ে বিজেপির বুথস্তরের নেতাকর্মীদের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী সে অভিযানের সীমানা বুথস্তর থেকে ব্লকস্তরে সরিয়ে নিলেন এবং সাথে এও ঘোষণা করলেন ঘেরাও কর্মসূচি ১০০ মিটার দূরে প্রতীকী চরিত্রের হবে। শাসক দলের এই ধরনের কর্মসূচি নৈরাজ্য ও রক্তপাতের কারণ হতে পারে। প্রসাশনের কোনো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে। বাংলার মাঠে ঘাটে কারখানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও যুক্ত সমস্ত বামপন্থী সংগঠন ও কর্মীবাহিনীকে ভারতের জনগণের প্রধান শত্রু বিজেপি আরএসএসের ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে হটিয়ে দেওয়ার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। দেশ ও রাজ্য পরিস্থিতির এক জটিল সন্ধিক্ষণে এরাজ্যে বামপন্থী-গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগোতে হবে। ব্যাটেল লাইন ইজ ড্রন (যুদ্ধরেখা টানা হয়ে গেছে)। ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের নেতৃত্ব বামপন্থীরা অন্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারে না। জনগণের সংগ্রামী ঐক্যকে শক্তিশালী করার সাথে সাথে বামপন্থী নেতৃত্বকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করে তুলতে হবে। একই সঙ্গে জনবিরোধী সমস্ত সরকারের জনবিরোধী সমস্ত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। একথা মাথায় রাখতে হবে, জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ।
- পার্থ ঘোষ