সংঘ পরিবার চেয়েছিল স্বাধীন ভারতের সংবিধান করা হোক ‘মনুস্মৃতি’কে। পুরুষতন্ত্রকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং নারীকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে উপস্থাপিত করার মনু রচিত সেই পুঁথি অবশ্য ভারতের সংবিধান হতে পারেনি। কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা আদালতগুলো যে সব সময় সংবিধানের প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছে তা কিন্তু নয়। কোনো-কোনো আদালত থেকে প্রায়শই উঠে আসে হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণা এবং ‘মনুস্মৃতি’র প্রতিধ্বনি। সম্প্রতি যেমন শোনা গেল গুজরাট হাইকোর্টের এক বিচারপতির কণ্ঠে।
এক নাবালিকা ধর্ষিতা হওয়ার পর গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এবং তার গর্ভে সৃষ্ট ভ্রুণের বয়স এখন ২৯ সপ্তাহ। মেয়েটি এবং তার পরিবার চাইছিল গর্ভপাত ঘটিয়ে ভ্রুণটিকে নষ্ট করা হোক। তাদের উদ্বেগের কারণ হল, এই বয়সে সন্তানের জন্ম দিতে হলে সেটা তার শরীর ও মনের ওপর যথেষ্ট চাপ ফেলবে যা তার অস্তিত্বকেই বিপন্ন করতে পারে। আইন অনুসারে ভ্রুণ সৃষ্টি হওয়ার পর ২৪ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে গর্ভপাতের জন্য আদালতের অনুমতি প্রয়োজন। মেয়েটির বাবা তাই দ্বারস্থ হলেন গুজরাট হাইকোর্টের। কিন্তু হাইকোর্টের বিচারপতি সমীর দাভে মেয়েটির অধিকারের সহমর্মী হওয়ার পরিবর্তে আনুগত্য প্রকাশ করলেন ‘মনুস্মৃতি’র প্রতি।
আদালতে মেয়েটির গর্ভপাতের পক্ষে সওয়াল করছিলেন মেয়েটির বাবা সিকান্দার সাঈদ। বিচারপতি তাঁকে বললেন — ‘মনুস্মৃতি’তে রয়েছে যে আগের দিনে মেয়েদের বিয়ের সর্বোচ্চ বয়স ছিল ১৪-১৫ বছর এবং বয়স ১৭ বছর হওয়ার আগেই তারা প্রথম সন্তানের জন্ম দিত। কাজেই, এক্ষেত্রে মেয়েটি প্রাপ্তবয়স্ক অর্থাৎ, তার বয়স ১৮ বছর পার হওয়ার আগেই সে যদি সন্তানের জন্ম দেয় তাতে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না। বিচারপতি তাঁর অভিমত বিধৃত করতে গিয়ে কি দেশের আইন সম্পর্কে বিস্মৃত হলেন, ১৮ বছরের নীচে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া এবং ফলে তার কম বয়সে সন্তানের জন্ম দেওয়াটা যে বৈধ নয়, এর বিপরীত অভিমত বিচারপতির আসনে বসে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এল কিভাবে? তিনি মেয়েটির বাবাকে বললেন যে তিনি নিশ্চয় ‘মনুস্মৃতি’ পড়েননি এবং পরামর্শ দিলেন সেই পুঁথি তিনি যেন অবশ্যই পড়েন। তিনি রাজকোট সিভিল হাসপাতালের সুপারিনটেনডেন্টকে নির্দেশ দিলেন মেয়েটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিতে। এবং মৌখিকভাবে জানালেন, ভ্রুণ এবং মেয়েটি সুস্থ থাকলে তিনি গর্ভপাতের অনুমতি দেবেন না। আরও বললেন, সন্তানের জন্ম হলে “কে তার পরিচর্যা করবে? আমিও খোঁজ নেব, এই ধরনের সন্তানদের জন্য সরকারের কোনো প্রকল্প আছে কিনা। এই সন্তানকে দত্তক নিতে কেউ রাজি আছে কিনা সেই খবরও আপনাদের নিতে হবে।” তিনি একদিকে গর্ভপাতের অনুমতি দিলেন না, আবার পরবর্তী শুনানির দিন এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়ে মেয়েটির মানসিক উদ্বেগ ও যন্ত্রণাকে বাড়িয়ে দিলেন। এইভাবে, আধুনিক যুগের, একবিংশ শতকের নারীর বোধ, সংবেদনশীলতা ও অধিকারকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন আলোচ্য মামলায় তাঁর রায়কে নির্দিষ্ট করতে, মনুস্মৃতির সময়কার পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রতিষ্ঠায়।
নারী সন্তানের জন্ম দেবে নাকি গর্ভপাত ঘটাবে — নারীর এই অধিকারের প্রতি অনুমোদন আদালত থেকে আসেনি এমন নয়। গতবছর সেপ্টেম্বরেই সুপ্রিম কোর্ট ভ্রুণের বয়স নির্বিশেষে গর্ভপাতের প্রতি নারীর অধিকারে সম্মতি জানায়। দিল্লী হাইকোর্ট ২০২২’র জুলাই মাসে ১৩ বছরের ধর্ষিতার ২৬ সপ্তাহের ভ্রুণের গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। আদালত বলে, এত অল্প বয়সে মাতৃত্বের দায় বহন করতে হলে মেয়েটির যন্ত্রণা ও দুর্দশা মাত্রাতিরেক ও অসহনীয় হতে পারে। এ’সত্ত্বেও মাঝেমাঝেই কোনো-কোনো বিচারপতির মুখ থেকে সোচ্চারে ঘোষিত হচ্ছে অবিমিশ্র হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারা। গতবছর দিল্লী হাইকোর্টের বিচারপতি প্রতিভা সিং ‘মনুস্মৃতি’র প্রশংসায় বলেছিলেন — ঐ রচনায় নাকি নারীর ‘সম্মানজনক’ অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে! এ’বছরের মার্চ মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারপতি তাঁর আসন থেকে এই আশা প্রকাশ করেন যে, “দেশে গো-নিধন নিষিদ্ধ করতে এবং গরুকে ‘সংরক্ষিত প্রাণী’ ঘোষণা করতে কেন্দ্র সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।” কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতির ভিত্তিতে বিলকিস বানোর ধর্ষক এবং তার শিশু-সন্তান ও আত্মীয়দের হত্যাকারী হিন্দুত্ববাদী কর্মীদের গুজরাট সরকারের মুক্তি প্রদান এক কলঙ্কজনক নজির হয়ে দেখা দিলেও সর্বোচ্চ আদালতের কাছ থেকে এই বিষয়ে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ এখনও আসেনি। অতএব, সংবিধান ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র রূপে ঘোষণা করলেও, সাধারণ জনগণের সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা ও নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার সেখানে বিধৃত হলেও হিন্দুত্ববাদের প্রভাবে চালিত কিছু বিচারপতি নিজেদের সংবিধানের ঊর্ধ্বে জ্ঞান করতে, সংবিধানের নীতিমালাকে নস্যাৎ করতে কুন্ঠিত হচ্ছেন না। আর তাই ধর্মীয় মৌলবাদী প্রভাব থেকে আদালতকে মুক্ত করা, আদালতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মোদী সরকারের সক্রিয়তাকে রোখা, সংবিধানের নীতিমালার প্রতি বিচারপতিদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করাটাও আজকের ফ্যাসিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।