মনুষ্যরূপী রোবটের হাতে যখন কাজের ভার
humanoid-robots

ভবিষ্যতের অর্থনীতি ও প্রযুক্তির রূপরেখা কেমন হতে চলেছে, তা নিয়ে ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ একটি প্রতিবেদন ‘ফিউচার অফ জব রিপোর্টস্ ২০২৩’ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, যে দু’টি প্রধান ক্ষেত্রে বিস্তৃতি ও প্রসার হতে পারে বলে অনুমান তা হল — মনুষ্যরূপী রোবট (humanoid robot) ও অমনুষ্যরূপী রোবট (non-humanoid robot)। অর্থাৎ, আগামীদিনে উৎপাদনের পরিসরকে নিয়ন্ত্রণ করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত রোবট।

অনেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগকে শুধুমাত্র পরিষেবা অথবা তথ্যের আদানপ্রদানের পরিপূরক বলে মনে করেন। তাঁরা ভুলে যান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হল এমন এক স্বয়ংচালিত প্রোগ্রাম বিশেষ যা যেকোনো কার্যাবলীতেই প্রয়োগ হতে পারে। এমনকি কৃষিতেও। আজকাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত এমন সব ট্রাক্টর ও যন্ত্রানুষঙ্গ এসে পড়েছে, যা কোনও মনুষ্যশ্রম ব্যতিরেকেই জমিকে উপযুক্তভাবে পড়ে নিয়ে যথাযথভাবে তার পরিচর্যা সেরে সেখানে ফসলের বীজ রোপণ থেকে তার যত্নআত্তি অবধি সমস্ত কাজের দায়ভার গ্রহণ করতে সক্ষম। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পেও উৎপাদনের যে কাজগুলি যন্ত্র সহযোগে শ্রমিক দ্বারা এতদিন সম্পন্ন হয়ে এসেছে, তার পুরো দায়িত্ব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মনুষ্যরূপী ও অমনুষ্যরূপী রোবট আজ নিয়ে নিতে পারদর্শী। উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে বিপুল কর্মভার তা নিপুণভাবে সে সম্পূর্ণ করতে পারে, মধ্যবর্তী প্রতিটি সমস্যাকে উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করে। সর্বোপরি, সর্বোচ্চ পারদর্শিতার নমুনা রেখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনেক বেশি উৎপাদনক্ষমও বটে।

in-the-hands-of-humanoid-robots

এই বাতাবরণেই শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক নতুন পরিসর — যেখানে বিশেষভাবে মনুষ্যরূপী রোবট ও ‘অবতার’ এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান হয়ে যাবতীয় কাজগুলি মানুষের মতোই সম্পন্ন করে ফেলতে অসম্ভব পটু। অনুমান, এই দশকের শেষে ‘অবতার’ ও মনুষ্যরূপী রোবট তৈরির বাণিজ্য ৫২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। ইতিমধ্যেই লন্ডনে অবস্থিত কোম্পানি ‘সিনথেসিয়া’ এই রোবট তৈরিতে ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং ম্যাকডোনাল্ডস, অ্যাকসেঞ্চুয়ার, এমনকি ব্রিটেনের ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস’ সহ ১৫০০’র বেশি সংস্থার জন্য মনুষ্য ‘অবতার’ নির্মাণে নিযুক্ত রয়েছে। একেকটি ‘অবতার’এর দাম বর্তমানে ১০০০ ডলারের মতো। কিছু কিছু উৎপাদিতও হয়েছে এবং তা বিভিন্ন সংস্থার কাজে ইতিমধ্যে লেগেও গেছে।

তাহলে কি নিকট ভবিষ্যতে মনুষ্যশ্রমকে প্রতিস্থাপিত করতে থাকবে মনুষ্যরূপী রোবট? সেই কারণেই কি কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই এখন চল হয়ে দাঁড়িয়েছে? গত নভেম্বর ২০২২’এ মেটা (ফেসবুক) ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, এই বছরের মার্চে আরও ১০,০০০। অ্যামাজন ইতিমধ্যেই ২৭,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে। এলন মাস্ক যখন ট্যুইটার অধিগ্রহণ করেন তখন তাদের কর্মী সংখ্যা ছিল ৮,০০০, যা এখন এসে ১,৫০০’এ দাঁড়িয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাম্প্রতিক হাতিয়ার ‘ওপেন এআই’এর চ্যাটজিপিটি, মাইক্রোসফট’এর বিং ও গুগল’এর বার্ড আসার পরে এই বছরের মে মাসেই প্রায় ৪,০০০ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। ‘বিজনেস ইনসাইডার’এর একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, এ’বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে সারা বিশ্বে ৪ লক্ষ কর্মী কাজ হারিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী কয়েক বছরে এই প্রবণতা জারি থাকবে। উল্লিখিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, আগামী পাঁচ বছরে ৭৫ শতাংশেরও বেশি কোম্পানি বিগ ডাটা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে তাদের কাজকর্মে পূর্ণ মাত্রায় লাগু করবে। সবথেকে বড় কথা, চলতি দক্ষতাগুলি আস্তে আস্তে অকেজো হয়ে যাবে এবং আগামী পাঁচ বছরে ৪৪ শতাংশ চালু দক্ষতার আর কোনও কার্যকারিতাই থাকবে না। প্রতি দশজন কর্মীর মধ্যে ছ’জন কর্মীকে নতুন করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে।

hands-of-humanoid-robots
কর্মক্ষেত্রের চালচিত্র

অচিরেই হয়তো দেখা যাবে, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের প্রোডাকশন ফ্লোরে একজন মাত্র মানুষ দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছেন — সারি সারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত মনুষ্যরূপী রোবট বোতাম টিপে অথবা হাত-পা চালিয়ে প্রোডাকশন বেল্টে মানুষের মতো কাজ করে চলেছে। উৎপাদিত পণ্যগুলিকে সংগ্রহ করা ও তাকে গুছিয়ে পরবর্তী কাজের ফ্লোরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও এরাই কাজ করছে। এমনকি সেগুলির সর্টিং ও প্যাকেজিং’ও তারা সেরে রাখছে।

উপরন্তু, মানুষের জায়গায় মনুষ্যরূপী রোবট এসে মানুষের মতোই — বরং আরও বেশি নিপুণতা ও দক্ষতায় — যাবতীয় কাজ অধিক গতিতে সম্পন্ন করে উৎপাদনশীলতা ও মুনাফার হারকে যথেষ্ট বাড়িয়ে ফেলছে। এই বাজারের বৃদ্ধি মূলত যে ক্ষেত্রগুলিকে ধরে বিকাশমান — খুচরো বাণিজ্যে ব্যক্তিগত সহচর হিসেবে নানা ধরনের রোবট, শিক্ষা জগতে শিক্ষামূলক কাজে ব্যবহৃত রোবট, চিকিৎসা জগতের প্রাথমিক কাজ করতে সক্ষম রোবট। ২০২২ থেকে ২০২৭’র মধ্যে মনুষ্যরূপী রোবটের বার্ষিক যৌগ বৃদ্ধির হার ৬৩ শতাংশের উপরে থাকবে বলে প্রতিবেদনটি মনে করেছে।

ইতিমধ্যে অনেকেই সোফিয়া নামে এক মনুষ্যরূপী রোবটের পরিচয় পেয়ে গেছেন। সোফিয়া সৌদি আরবের নাগরিক (২০১৭ সাল থেকে) এবং মহিলার আদলে তৈরি এমন এক রোবট যে আপনার প্রায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর নিখুঁতভাবে দেওয়ার চেষ্টা করে আপনার ভাষাতেই। এইরকম নানাবিধ রোবট — কেউ কথায় চোস্ত, কেউ কোনও নির্দিষ্ট কাজে চৌখস অথবা কেউ ব্যক্তিগত সাহচর্যে কর্মপটু, নানাবিধ কর্মক্ষেত্রের চৌহদ্দির মধ্যে ভালো মতোই জায়গা করে নিয়েছে। হয়তো দেখা যাবে, আগামী পাঁচ কী দশ বছরে, কর্মরত হাতগুলির অধিকাংশই হয়ে উঠছে রোবটের, যেখানে বহু পরিশ্রমসাধ্য ও কষ্টকর কাজগুলি আর মানুষেরা করছে না, সেগুলির দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন রূপের রোবট সমাজ। কিন্তু প্রশ্ন হল, এরফলে কি মানুষ এক ব্যাপক কর্মচ্যুতি ও বেকারত্বের কবলে পড়বে? এই প্রশ্নটির উত্তর এখুনি স্পষ্ট করে দেওয়া মুশকিল। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এর অন্য একটি প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে যদিও ৮.৫ কোটি কাজ মানুষের হাত থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে চলে যাবে কিন্তু একইসঙ্গে ৯.৭ কোটি নতুন কাজও তৈরি হবে। এই একই ধরনের বার্তা গত ৭ জুন ভারতে এসে ‘ওপেন এআই’এর কর্ণধার স্যাম অল্টম্যানও দিয়েছেন। এই নতুন কাজগুলি কী ধরনের এবং তারজন্য যথাযথ মানবসম্পদ প্রস্তুত কিনা, সেও এক বড় প্রশ্ন। তাই, পুরো প্রক্রিয়াটি ও এর সম্ভাব্য অভিঘাতগুলি এখনও গবেষণা, বাস্তবতা ও দূরদৃষ্টির পরিসরে পথ খুঁজে বের করার অনুশীলনের মধ্যে রয়েছে।

পাশাপাশি, আজকের চলমান দুনিয়ায় এমন এক অর্থনীতির বয়ান তৈরি হয়েছে যেখানে কর্মবিন্যাসগুলি অতি দ্রুত কয়েক বছরের মধ্যে পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে এবং তৎসংলগ্ন যথার্থ কর্মী-চাহিদার চিত্রটিও বারবার করে পুনর্নির্মিত হচ্ছে। যেমন, ২০২৫ সালের মধ্যে ৯.৭ কোটি নতুন কাজ তৈরি হবে বলে যে অনুমান, সেই কাজগুলি এবং সে কাজে পারদর্শী কর্মীদের শিক্ষা ও দক্ষতার কারিকুলামগুলিই বা কেমন হবে, তা কিন্তু এই মুহূর্তে স্থির-নিশ্চিত নয়। ফলে, যখন সত্যি সত্যিই তেমন কাজের উদয় হবে ও সেই কাজের জন্য কর্মী খোঁজা হবে, তা কি তখন হাতের কাছে রেডিমেড পাওয়া যাবে? এই সমস্যাটা কিন্তু এখনও বিদ্যমান। সেই কারণেই শিক্ষাব্যবস্থারও খোলনলচে বদলে ফেলার প্রসঙ্গ বারবার আলোচিত হচ্ছে। হয়তো সে জন্যই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ বেশি বেশি করে বড় বড় উদ্যোগপতিদের হাতে চলে যাচ্ছে। যেহেতু প্রযুক্তির এক অসম্ভব ঘোড়দৌড়ের অভিঘাতে যে কোনও কর্মপ্রক্রিয়ারই স্থায়িত্ব খুব বেশিদিনের নয়, তাকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলছে আরও নতুন ধরনের কোনও উন্নত প্রযুক্তি-প্রয়োগ, অতএব, শ্রমিক-কর্মীদের কাজের স্থায়িত্বও বেশি বেশি করে অস্থায়ী চরিত্র লাভ করছে। এমতাবস্থায় এটা খুব স্বাভাবিক যে, কর্মীরাও নতুন নতুন কাজের তল্লাশে নিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এবং সেই সব কাজে নিযুক্ত হওয়ার জন্য নিজেদের বার বার প্রশিক্ষিত করে তুলবেন।

এই সামগ্রিক পরিবর্তন যে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির বয়ান নির্মাণ করছে, তা একদিকে যেমন সমাজ জুড়ে এক তীব্র অনিশ্চয়তা, বিচ্ছিন্নতা ও বিপন্নতা গড়ে তুলছে, অন্যদিকে পুঁজিবাদী আর্থব্যবস্থার মধ্যে এক নতুন গতিপথ নির্মাণ করছে। অর্থাৎ, যে কর্মী হন্যে হয়ে দুয়ারে দুয়ারে কাজের তল্লাশে ঘুরে ফিরে অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাইছেন, তিনিও কাল নিজের দক্ষতার দৌড়ে প্রযুক্তির দৌলতে স্ব-উদ্যোগী এক সফল কর্মপরিসর তৈরি করে নিতে পারেন। পারেন তো বটে কিন্তু পারছেন কি? আবার, পারছেন না, তাই বা বলি কেমনে! সে এক অন্য গল্প বটে। সেখানেই ওত পেতে রয়েছে আজকের পুঁজিবাদের নির্মম সংকট।

- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

‘‘একক মাত্রার’’, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

খণ্ড-30
সংখ্যা-21