বছর তিন-চার আগে কলকাতা শহরের বাস স্ট্যান্ডগুলি থেকে শুরু করে খবরের কাগজের পাতায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি সমেত বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছিল যে, এরাজ্যে কৃষকের আয় তৃণমূল শাসনের ৭ বছরে ৩ গুণ করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ সালের বাজেট পেশ করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেছিলেন, “এই রাজ্যে কৃষকের বার্ষিক আয় ২০১১ সালে যেখানে ছিল ৯১,০০০ টাকা, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে বার্ষিক ২,৩৯,০০০ টাকা”। ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বক্তৃতায় তিনি পুনরায় বলেন, “...সেখানে বাংলায় তাদের গড় আয় ২০১০-১১ সালের ৯১,০২০ টাকা থেকে তিনগুণ বেড়ে ২০১৭-১৮ সালে ২,৯১,০০০ টাকা হয়েছে।”
এরাজ্যের কৃষকদের আয়ের এই হিসেবের ভিত্তি কী তা বোঝাও যাচ্ছে না, জানাও যায়নি। তথ্য অনুসারে ২০১৭-১৮ সালে এরাজ্যের জনসাধারণের মাথাপিছু আয় (জিএসডিপি) ছিল চলতি মূল্যে ৯০,৪১৭ টাকা, ২০১১-১২ সালে তা ছিল ৫৬,৬৯৩ টাকা। ফলে ওই ৫ বছরে চলতি মূল্যে রাজ্যবাসীর মাথা পিছু আয় বেড়েছে সাকুল্যে ৬০ শতাংশ। যেহেতু দ্রব্যমূল্য বেড়েছে বা টাকার দাম কমেছে তাই ওই বৃদ্ধিও প্রকৃত বৃ্দ্ধি নয়। সেটা মাপতে গেলে ওই দু’টি পরিমাপকে স্থির মূল্যে ধরতে হবে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর মাথাপিছু জিএসডিপি স্থিরমূল্যে (২০১১-১২ সালের মূল্যে) ২০১১-১২ সালে ছিল ৫৬,৬৯৩ টাকা, ২০১৬-১৭ সালে তা বেড়ে ৬৭,৭১৮ টাকা হয়েছে; অর্থাৎ সাকুল্যে ২০ শতাংশ বেড়েছে। যেহেতু কৃষি ক্ষেত্রে মাথা পিছু আয় অন্য ক্ষেত্রগুলি থেকে কম, তাই ধারণা করা যায় যে, কৃষকের আয় ওই ৫ বছরে ২০ শতাংশর থেকে কম বেড়েছে। অন্যদিকে ২০১৭-১৮ সালে রাজ্যবাসীর মাথাপিছু আয় চলতি মূল্যে বেড়ে হয়েছিল ৯৯,৯৬৯ টাকা। ফলে ২০১১-১২ সালে তুলনায় তা চলতি মূল্যে বেড়েছিল ৭৬ শতাংশ। স্থিরমূল্যে ২০১৭-১৮ সালে রাজ্যবাসীর মাথাপিছু আয় হয়েছিল ৭১,৩১২ টাকা। ফলে রাজ্যবাসীর মাথাপিছু আয় ২০১১-১২ সালের তুলনায় প্রকৃত পক্ষে ২৬ শতাংশ বেড়েছে (৬ বছরে)। সারা রাজ্যবাসীর গড় আয় যেখানে সর্বোচ্চ হিসেবেও ২০১১-১২ সালের তুলনায় ৬ বছরে ৭৬ শতাংশের বেশি বাড়েনি, তাও চলতি মূল্যে, সেখানে কৃষকদের গড় আয় ২০১০-১১ সাল থেকে ২০১৭-১৮ সাল পর্যন্ত এই ৭ বছরে ২০০ শতাংশ বেড়ে ৩ গুণ হয়েছে তা অতিশয়োক্তি বললেও কম বলা হবে, বলা উচিৎ অসত্য ভাষণ।
আরেকটি দিক দিয়ে কৃষি আয়ের পরিমাণ ও তার বৃদ্ধির হিসেব করা যেতে পারে। ২০১১-১২ সালে এবং ২০১৬-১৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের চলতি মূল্যে নীট আভ্যন্তরীণ উৎপন্ন ও মাথা পিছু আভ্যন্তরীণ উৎপন্নর সঙ্গে অনুমিত জনসংখ্যার পরিমাপ পেতে পারি। নাবার্ডের ২০১৬-১৭ সালের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সমীক্ষা থেকে অনুমান করা যেতে পারে রাজ্যের ২৭ শতাংশ মানুষ মূলত কৃষক থেকে আয় করে। ফলে ওই অনুমিত জনসংখ্যার ২৭ শতাংশকে কৃষিনির্ভর হিসেবে গণ্য করে কৃষিতে মোট আভ্যন্তরীণ উৎপন্নের মূল্য থেকে মাথা পিছু মোট আভ্যন্তরীণ কৃষি উৎপন্ন নির্ধারণ করা যায়। ওই হিসেবে চলতি মূল্যে ২০১৬-১৭ সালে কৃষিতে মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়াচ্ছে ৪৬,১৯৮ টাকা, ২০১৭-১৮ সালে ৪৯,৮৩৯ টাকা। ফলে ২০১১-১২ সালের তুলনায় ৫ বছরে ও ৬ বছরে বৃদ্ধির হার দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ৫৮ শতাংশ ও ৭০ শতাংশ। স্থিরমূল্যে ওই দুটি সময়কালে বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬ শতাংশ ও ১০ শতাংশ মাত্র। সুতরাং কৃষকের আয় ২০১০-১১ থেকে ২০১৭-১৮ এই ৭ বছরে ৯১,০২০ টাকা থেকে ২২০ শতাংশ বেড়ে ২,৯১,০০০ টাকা হয়েছে এটা সম্পূর্ণ অলীক মনে হচ্ছে। নিচের তালিকাকে অনুসরণ করলে দেখা যাবে যে, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ সালে কৃষি ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় সামান্যই বেড়েছে।
ফলে ২০১৬-১৭ সালে কৃষকদের বার্ষিক মাথা পিছু আয় ২ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা হওয়ার যে ঘোষণা অর্থমন্ত্রী ২০১৮-১৯ সালের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন বা ২০১৯-২০ সালের বাজেট বক্তৃতায় কৃষকদের মাথা পিছু বার্ষিক ২ লক্ষ ৯১ হাজার টাকার যে উল্লেখ তিনি করেছেন তার কোনো ভিত্তি তো নেইই, উপরন্তু তিনি তাদের আয় নিয়ে নির্মম রসিকতা করছেন।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষা দপ্তর (এনএসএসও) কর্তৃক ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে (৭০তম দফা) প্রকাশিত গ্রামীণ পরিবার সমূহের পরিস্থিতি মূল্যায়ন সমীক্ষা অনুসারে জুলাই ২০১২ থেকে জুন ২০১৩ কৃষি বৎসরে পশ্চিমবঙ্গে কৃষক পরিবারের বার্ষিক আয় ছিল ৪৭,৭৬০ টাকা, অর্থাৎ পরিবার পিছু সদস্য সংখ্যার গড় নাবার্ড-এর পূর্বে উল্লেখিত সমীক্ষা অনুযায়ী ৪.২ ধরলে, মাথা পিছু বার্ষিক আয় ১১,৩৭১ টাকা। কৃষক পরিবারের সব আয় কৃষি থেকে আসে না। এনএসএসও’র উপরোক্ত সমীক্ষা অনুযায়ী, কৃষি থেকে পরিবার পিছু মাসিক নীট আয় ৯৭৯ টাকা, অর্থাৎ বার্ষিক ১১,৭৪৮ টাকা বা মাথা পিছু বার্ষিক ২,৭৯৭ টাকা। পরবর্তীতে নাবার্ডের ২০১৬-১৭ সালের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের কৃষক পরিবারের মাসিক সামগ্রিক গড় আয় দাঁড়িয়েছে ৭,৭৫৬ টাকা,বা বার্ষিক ৯৩,০৭২ টাকা। মাথাপিছু হিসেবে বার্ষিক ২২,১৬০ টাকা।
সব মিলিয়ে কোনো হিসেবই ২০১৬-১৭ সালের ২ লক্ষ ৩৯ হাজার টাকা বার্ষিক বা ২০১৮-১৯ সালের ২ লক্ষ ৯১ হাজার টাকার ধারে কাছে পৌছচ্ছে না। আয়ের ক্ষেত্রে যখন রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ধারাবাহিক অনৃত ভাষণ চলছে, ঠিক তখনই রাজ্যের কৃষক পরিবারগুলি ঋণ ভারে ন্যুব্জ হচ্ছে। নাবার্ডের পূর্বোক্ত সমীক্ষা অনুসারে ২০১৬-১৭ কৃষি বৎসরে ৩২ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে নুতন করে। অপরদিকে সামগ্রিকে ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণগ্রস্ত রয়েছে। যখন এরাজ্যের প্রায় ৯০শতাংশের বেশি কৃষক ছোট ও প্রান্তিক চাষী, যখন কৃষিতে মূল সমস্যা হল ফসলের ন্যায্য দাম ও ঋণের বোঝা, যখন কৃষকের আত্মহত্যা চলতে থাকলেও রাজ্য সরকার স্বীকার করতে নারাজ, তখন কৃষকদের আয় ৩ গুণ করে দেওয়ার ঢাক পিটিয়ে কৃষির সমস্যা থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা হচ্ছে।
কৃষিতে, এবং মূলত, কৃষিতে মূলধনী খাতে, বিশেষত সেচের বন্দোবস্তে বাজেট বরাদ্দ ও প্রকৃত ব্যয়ের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলে রাজ্য সরকারের কৃষি উন্নয়নের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে জানাবোঝা যায়। বাজেট বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে যতটা ঔদার্য দেখানো হয় সেই বরাদ্দকে প্রকৃত ব্যয়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে ততটাই ঔদাসীন্য দেখা যায়। যদি বা রাজস্বখাতে (অর্থাৎ বেতন ও বিবিধ তাৎক্ষণিক বিষয়ে ব্যয়ের ক্ষেত্রে) প্রকৃত ব্যয় অনেকটাই বাজেটের কাছাকাছি পৌঁছায়, মূলধনীখাতে ব্যয় বরাদ্দও কম, প্রকৃত ব্যয় তার থেকে অনেক কম। যেমন ২০১৩-১৪, ২০১৬-১৭, ২০১৭-১৮ ও ২০১৯-২০ সালে কৃষি ও সহযোগী ক্ষেত্রে রাজস্ব খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ৩০৮২, ৪০৭০, ৪৫৭৮ ও ৮২০০ কোটি টাকা; ওই ৪ বছরে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ২০৩১, ৩২৬৫, ৩৭৩০ ও ৪৫৮৬ কোটি টাকা; যা বাজেট বরাদ্দের যথাক্রমে ৬৬ শতাংশ, ৮০ শতাংশ, ৮১ শতাংশ ও ৫৬ শতাংশ মাত্র। আদতে কৃষি ও সহযোগী খাতে বা সেচ ও বন্যারোধের খাতে (রাজস্ব হিসাবে ও মূলধনী হিসাবে) প্রকৃত ব্যয় প্রায় কখনোই বাজেট বরাদ্দকে টপকে যেতে পারেনি। পরের তালিকা দেখলে তা ভালোভাবে বোঝা যাবে। লক্ষ্যণীয়, মূলধনী খাতে প্রকৃত ব্যয় অনেক ক্ষেত্রেই বাজেট বরাদ্দের প্রায় অর্ধেক হয়েছে। কোনো বছরেই তা উল্লিখিত দুটি খাত মিলিয়ে ৬৫ শতাংশ ছাড়ায়নি। অধিকাংশ বছরেই তা অত্যন্ত কম, অর্ধেকেরও অনেক কম। কৃষিতে মূলধনী ব্যয় ব্যতিরেকে কৃষিকে লাভজনক ও উৎপাদনশীল করে তোলা যায় না।
কৃষকের ও কৃষির অবস্থাকে পর্যালোচনা করার জন্য আর কয়েকটি বিষয়কে সংক্ষেপে দেখা যাক। রাজ্যের নীট কর্ষিত এলাকা ২০১০-১১ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে, তবে ৮০-৮১ সালের তুলনায় তা ৪.৫ শতাংশ মত কমেছে। মোট কর্ষিত (বারবার একই জমিতে চাষ করার ফলে মোট কর্ষিত এলাকা নীট কর্ষিত এলাকার থেকে বেশি হয়) এলাকা ২০১০-১১ সালের তুলনায় ২০১৮-১৯ সালে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর কারণ হচ্ছে গড় চাষের নিবিড়তার (ক্রপিং ইনটেনসিটি) বৃদ্ধি। সম পরিমাণ জমিতে যদি ১ বার চাষ করা হয় তাহলে চাষের নিবিড়তাকে ১০০ ধরা হয়, ২ বার করা হলে তা ২০০। ২০১০-১১ সালে ওই নিবিড়তা ছিল ১৭৭, ২০১৮-১৯ সালে তা ৭ শতাংশ বেড়ে ১৯০ হয়েছে। সমগ্র ভারতের তুলনায় ওই নিবিড়তা পশ্চিমবঙ্গে বেশ বেশি। সারা ভারতে সেটির মান ১৪২। ভারতের বড় রাজ্যগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এক্ষেত্রে ২০১৮-১৯ সালে তৃতীয় স্থানে আছে। কেবল তাই নয়, ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ এই ৭ বছরে পশ্চিমবঙ্গের মত ক্রপিং ইনটেনসিটি বাকি দুটি উপরে থাকা রাজ্য হরিয়ানা বা পাঞ্জাবের বাড়েনি। হরিয়ানায় তা সামান্য কমেছে, পাঞ্জাবে তা ০.৫ শতাংশ বেড়েছে।
২০১০-১১ সালে কৃষি মজুরদের গড় দৈনিক মজুরি ছিল ১৩০ টাকা। ২০১৯-২০ সালে তা বেড়ে ৩০২ টাকা হয়েছে। ফলে বৃদ্ধির পরিমাণ ৮ বছরে ১৩২ শতাংশ, অবশ্যই চলতি মূল্যে। সমসময়ে সমগ্র ভারতে কৃষি মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩৮ শতাংশ, ১৪৫ টাকা দৈনিক থেকে বেড়ে ৩৪৫ টাকা দৈনিক হয়েছে। গড় দৈনিক কৃষি মজুরি সব থেকে বেশি কেরালায়, ৭০০ টাকা। তারপরে হরিয়ানায়, ৪৫২ টাকা, তামিলনাড়ুতে ৩৮৭ টাকা, অন্ধ্রপ্রদেশে ৩৭৫ টাকা, কর্ণাটকে ৩৬৭ টাকা, মধ্যপ্রদেশে ৩২২ টাকা। উল্লেখযোগ্য ভারতের ‘আদর্শ’ রাজ্য গুজরাটে কৃষি মজুরির দৈনিক গড় মাত্র ২৪৫ টাকা। সামগ্রিকে কৃষি মজুরির ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে রয়েছে, কী পরিমাণে কী বৃদ্ধির হারে।
জমির একক পরিমাণ পিছু উৎপাদনশীলতার দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে যে, পশ্চিমবঙ্গ সমগ্র ভারতের নিরিখে খুব ভালো অবস্থায় নেই। ২০১৯-২০ সালে পশ্চিমবঙ্গ ধান উৎপাদনে প্রথম স্থানে ছিল। কিন্তু হেক্টর পিছু ধান উৎপাদনের নিরিখে বড় রাজ্যগুলির মধ্যে স্থান দশম। এরাজ্যে ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত জমিতে প্রতি হেক্টরে ২,৮৯২ কেজি উৎপাদন হয়েছিল ওই বছরে। পাঞ্জাবে তা ছিল ৪,০৩৪ কেজি, অন্ধ্রপ্রদেশে ৩,৭৬৫ কেজি, তামিলনাড়ুতে ৩,৭৬৯ কেজি, তেলেঙ্গানাতে ৩,৬৯৪ কেজি। ফলে উৎপাদনের পরিমাণে প্রথম হওয়াটি তেমন বড় কিছু বলে মনে হচ্ছে না, অন্তত কৃষকের আয়ের দিক থেকে দেখলে। সাম্প্রতিক কালে আমাদের রাজ্যে ডাল উৎপাদন খানিক বেড়েছে। যদিও সারা ভারতের নিরিখে সেটি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ২০১০-১১ সালের ১,৭৬,০০০ টন উৎপাদনের তুলনায় ২০১৯-২০ সালে ৩,৮৪,০০০ টন উৎপাদনের অর্থ হল ১১৮ শতাংশ বৃদ্ধি, যেখানে সমসময়ে সারা ভারতে তা ১৮২.৪ লক্ষ মেট্রিক টন থেকে ২৬ শতাংশ বেড়ে ২৩০.৩ লক্ষ মেট্রিক টন হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হল, ২০১০-১১ সালে ডালের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের হেক্টর পিছু উৎপাদনশীলতা ছিল ৮৯৮ কেজি, যা ২০১৯-২০ সালে কমে হয়েছে ৮০০ কেজি। কিন্তু সারা ভারতে ওই গড় উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, ৬৯১ কেজি থেকে ৮২৩ কেজি হয়েছে। পাট উৎপাদনের সিংহভাগ এরাজ্যেই হয়। ২০১৯-২০ সালে সারা ভারতের ৯৪.৫ লক্ষ বেল পাট উৎপাদনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই হয়েছে ৭৯ লক্ষ বেল। তবে সারা ভারতে ২০১০-১১ সালে উৎপাদনশীলতা ছিল হেক্টর পিছু ২,৩২৯ কেজি, যা ২০১৯-২০ সালে ১৬ শতাংশ বেড়ে ২,৭০৬ কেজি হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা বেড়েছে সাকুল্যে ৯ শতাংশ, হয়েছে ২,৫৭৭ কেজি থেকে ২,৮১৫ কেজি। তৈলবীজ উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে এরাজ্যে সম্প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। ২০১০-১১ সালে উৎপদন হযেছিল ৭ লক্ষ টন যা সারা ভারতের ভোজ্য তৈলবীজ উৎপাদনের ২.২ শতাংশ ছিল। ২০১৯-২০ সালে তা বেড়ে ১০ লক্ষ টনে দাঁড়িয়েছে, যা ওই বছরে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনের ৩.২ শতাংশ। আলু চাষে পশ্চিমবঙ্গ সারা ভারতে উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। দেশের মোট ৪৮৬ লক্ষ টন আলু উৎপাদনের মধ্যে ১২৬ লক্ষ টন এরাজ্যে উৎপাদিত হয়েছে, অর্থাৎ ২৬ শতাংশ। কিন্তু ২০১০-১১ সালের তুলনায় এরাজ্যে আলু উৎপাদন কমেছে। ওই বছর উৎপাদিত হযেছিল ১৩৪ লক্ষ মেট্রিক টন। সরা ভারতে হয়েছিল ৪২৩ লক্ষ মেট্রিক টন। ফলে পশ্চিমবঙ্গে সারা ভারতের ৩২ শতাংশ আলু উৎপাদিত হয়েছিল। হেক্টর পিছু উৎপাদনশীলতাও আলুর ক্ষেত্রে কমেছে। ২০১০-১১ সালে তা ছিল ৩৩ মেট্রিক টন; ২০১৯-২০ সালে যা কমে দাঁড়িয়েছে ২৮.৯ মেট্রিক টনে। সমসময়ে সারা ভারতে হেক্টর পিছু গড় উৎপাদনশীলতা ২২.৭ মেট্রিক টন থেকে বেড়ে ২৩.৬ মেট্রিক টন হয়েছে।
সারা দেশ জুড়েই খাদ্য শস্য ও পাটের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বছর বছর ঘোষণা করা হয়ে তাকে। তবে যদি চাষিদের কাছ থেকে ওইসব কৃষিজ দ্রব্য কেনার যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত না করা হয় তাহলে কৃষক সেই দামের নীচের দামেই অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়। পশ্চিমবঙ্গে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনার ব্যবস্থা ভালো নয়। অনেকক্ষেত্রেই মান্ডিতে ফসল নিয়ে গিয়ে বিবিধ বিধিনিষেধের কারণে ছোট চাষি বিক্রি করতে পারে না। ফেরত আনার খরচ এড়াতে মান্ডির বাইরেই কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আলু চাষের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যও নেই। ফলে ফসল ওঠার সময়ে অভাবী বিক্রি করারা তাগিদে চাষি যথোপযুক্ত মূল্যে বিক্রি করতে পারে না।
সামগ্রিকে একথা বলা যেতে পারে কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত জমি, কৃষিজ দ্রব্যের উৎপাদনশীলতা, কৃষি নিবিড়তা এমন কোনো দারুণ উন্নতির দিকে দিক নির্দেশ করছে না যাতে কৃষকের বিপুল উন্নতি হয়েছে বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হলেও তা কৃষকের আয় নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি করেছে একথা বলা যায় না। তাছাড়া কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির কথা ভাবতে গেলে এটাও মনে রাখতে হবে যে, ২০১০-১১ থেকে ২০১৯-২০ এই ৯ বছরে ৬-৭ শতাংশ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষিতেও সেই অনুপাতে জনসংখ্যা বেড়েছে ধরে নিলে কৃষকের মাথাপিছু আয়ের তেমন কোনো প্রকৃত বৃদ্ধি হয়েছে বলে মনে হয় না।
দ্রষ্টব্য : আলোচনাটি করার সময় অনেকক্ষেত্রে ২০১০-১১ সালের সাথে তুলনা করা হয়নি কারণ ২০১১-১২ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে জাতীয় আয় হিসেবকে আমূল পাল্টে দেওয়ার ফলে পূর্ববর্তী বৎসরগুলির ক্ষেত্রভিত্তিক আয়ের সঙ্গে ২০১১-১২ বা তার পরবর্তী বছরগুলির অনুরূপ আয়ের তুলনা সমস্যাসঙ্কুল হয় পড়েছে। দ্বিতীয়ত, আলোচনার শেষ বিন্দুটিকে ২০১৯-২০ ধরা হয়েছে কারণ ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ কোভিড পরিস্থিতি ও তদদ্ভুত লকডাউন পরিস্থিতির কারণে তৎপূর্ববর্তী বছরগুলির সঙ্গে যথেষ্ট তুলনীয় নয়। কখনো কখনো তথ্যের অভাবে শেষ বিন্দুটিকে ২০১৮-১৯ ধরা হয়েছে।
অন্য কোনো তথ্যসূত্রের উল্লেখ না থাকলে সমস্ত পরিসংখ্যান EPWRF India Time Series থেকে নেওয়া হয়েছে, তবে পরিসংখ্যানকে প্রয়োজনমত গাণিতিক হিসেব করে ব্যবহার করা হয়েছে।
- অমিত দাশগুপ্ত