ভারতের অর্থনীতির মরা গাঙে কি বান ডাকল?
২০২২-২৩ বিত্তবর্ষে জিডিপি বাড়ল ৭.২ শতাংশ হারে, পূর্ববর্তী বিত্তবর্ষে যা সম্প্রসারিত হয় ৯.১ শতাংশে। আগের বছরের তুলনায়, তার এবারের বৃদ্ধি কিছুটা নিচুতে নামলেও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশ ও প্রতিবেশীদের সাপেক্ষে ভারতকে ‘আর্থিক ক্ষেত্রে দ্রুততম বিকাশশীল দেশের’ মুকুট পরিয়েছে আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থাগুলো। দৃষ্টিহীনদের রাজত্বে ভারত যেন এখন একচক্ষু রাজা!
আর, এই ‘বৃদ্ধি’তে আহ্লাদে আটখানা ভক্তকুল উদ্বাহু নৃত্য করে, নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়ে বলছে, ভারত নাকি কোভিডের ধাক্কা সম্পূর্ণ সামলে জগৎ সভায় আবার শ্রেষ্ঠ আসনটি দখল করে নিয়েছে।
বেশ কিছুদিন আগে, সংবাদ সংস্থা পিটিআই’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ভারতীয় অর্থনীতি খুবই বিপজ্জনক ভাবে বৃদ্ধির হিন্দু হারের (হিন্দু রেট অফ গ্রোথ) দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর অত্যন্ত মন্থর গতিতে বিনিয়োগ, ঋণের উচ্চহার, বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বৃদ্ধির শ্লথ গতি — এগুলোকেই তিনি এর পেছনে প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেন। তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের জিডিপি তার আগের তুলনায় (৬.৩ শতাংশ) ৪.৪ শতাংশে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। প্রথম ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ১৩.২ শতাংশ। বৃদ্ধির এই যে অনুক্রমিক (সিকোয়েন্সিয়াল) গতি ভঙ্গ, রাজন তাকেই উদ্বেগজনক হিসাবে চিহ্নিত করে ওই মন্তব্য করেন (হিন্দু রেট অফ গ্রোথের শব্দবন্ধটি ১৯৭৮ সালে অর্থনীতিবিদ রাজ কৃষ্ণ প্রথম ব্যবহার করেন সেই সময়ে ভারতের মন্থর আর্থিক বৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে)। রাজনের ওই মন্তব্যের পর ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মোদী-ভজা অর্থনীতিবিদদের দল তেড়ে-মেরে উঠল। যাই হোক, জিডিপি বৃদ্ধির এই সরকারি গপ্পোর ‘সত্যতা’ কিছুটা কাটা-ছেঁড়া করা যাক।
বিশ্বব্যাঙ্কের পূর্বাভাস হল, চলতি অর্থবর্ষে (যা শেষ হবে ৩১ মার্চ ২০২৪) ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার হবে ৬.৩ শতাংশ, যা তাদের গতবছর অক্টোবরে করা পূর্বাভাসের তুলনায় ০.৭ শতাংশ বিন্দু কম। এর পেছনে যে কারণগুলো তারা চিহ্নিত করেছে, তা হল, সুদের উচ্চ হার, অত্যন্ত শ্লথ ভোগ ব্যয়, সরকারি খরচ কমে যাওয়া। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে আরও যে দু’টো উদ্বেগের কথা বিশ্বব্যাঙ্ক সামনে এনেছে, তা হল, মহিলাদের শ্রম বাজারে অংশগ্রহণের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে, আর, ইনফর্মাল সেক্টার থমকে থাকছে — সেটা উৎপাদনশীল হয়ে উঠতে পারছেনা, আবার সংকুচিতও হচ্ছে না। তবে, জিডিপি’র এই ৭.২ শতাংশ বৃদ্ধির হার কিছুটা ভালো হলেও, বেশ কিছু প্রশ্ন তা সামনে এনেছে।
মোদী আসার পর থেকেই দেশের অর্থব্যবস্থার হাল নিম্নগামী হতে শুরু করে। কোভিড হানা দেওয়ার পূর্বেকার চার চারটি বছরে প্রতিটি বর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগেরটির তুলনায় কম ছিল। কোভিড থাবা বসাবার ঠিক আগে সেই আর্থিক বৃদ্ধির হার ঠেকেছিল চার শতাংশের নিচে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, অতিমারী তার ফণা না তুললে বার্ষিক বৃদ্ধির হার চার শতাংশে, অর্থাৎ, প্রতিবছর হ্রাস পেতে পেতে কোভিডের আগে ভারতে যে হারে বৃদ্ধি হচ্ছিল তা বজায় রাখা যেত। কোভিড হানায় ২০২০-২১ বিত্তবর্ষে জিডিপি কমেছিল ৬.৬ শতাংশে।
সরকার ঘোষিত পরিসংখ্যান হল সমষ্ঠিগত বা এগ্রিগেট — এখানে সেক্টর ভিত্তিক পরিসংখ্যান আড়ালে চলে গেছে। জেএনইউ’র অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অরুণ কুমার দেখিয়েছেন, জিডিপি’র সবচেয়ে বড় উপাদান হল ব্যক্তিগত ভোগব্যয় বা প্রাইভেট ফাইনাল কনজামশন এক্সপেন্ডিচার। জিডিপি’তে এই অংশের অবদান গত বছরের ৬১.১ শতাংশ থেকে কমে এবছর হয়েছে ৬০.৬ শতাংশ। বিভিন্ন খাতে সরকারের ব্যয় বা গভর্মেন্ট ফাইনাল কনজামশন এক্সপেন্ডিচার ১১.২ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১০.৩ শতাংশ। রপ্তানি কমেছে -২.৭ শতাংশ থেকে -৩.৬ শতাংশ। অর্থাৎ, বৃদ্ধির সবকটা ইঞ্জিন তার গতি হারিয়েছে।
এবার যে বৃদ্ধি হল, তার পেছনে প্রধান নায়কের ভূমিকা পালন করেছে পরিষেবা ক্ষেত্র। দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০’র মাঝামাঝি থেকেই পরিষেবা ক্ষেত্রটি ভারতের শহুরে আর্থিক বৃদ্ধির ভাষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা পরবর্তীতেও উৎপাদন শিল্পের তুলনায় প্রধান ভূমিকা রেখে চলেছে। এই আর্থিক বৃদ্ধির নেপথ্যে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রের অংশ নামমাত্র, ১.৩ শতাংশ। অর্থনীতিবিদ অজিত ঘোষ তার এক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে দেখিয়েছেন (ইন্ডিয়াজ এক্সক্লুসিভ গ্রোথ, ইপিডবল্যু, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) ১৯৬০ সালের পর থেকেই ভারতের উৎপাদন ক্ষেত্র একই জায়গায় রয়েছে। আগেই দেখানো হয়েছে, ব্যক্তিগত ভোগব্যয় ক্রমশই কমছে যা প্রমাণ করে দেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যম বর্গের নাগরিক খুবই কম ব্যয় করছেন। অর্থাৎ চাহিদা কমছে। মোদী সরকারের ন’বছরে ক্ষেতমজুর, গ্রামীণ মজুর ও নির্মাণ কর্মীদের মজুরি এক শতাংশও বাড়েনি। বিপরীতে, নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি কমতে কমতে ঋণাত্মকে গিয়ে ঠেকলেও এবারের জিডিপি বৃদ্ধিতে নির্মাণ ক্ষেত্রের অবদান ১০ শতাংশ! ভারতীয় আর্থিক বৃদ্ধির বিরোধাভাস এমনই পরিহাসময় পরিসংখ্যানকে তুলে ধরেছে! ১৯৭০’র মাঝামাঝি পর্যায় থেকে নির্মাণ শিল্প ক্রমবর্ধমান হারে জিডিপি’তে বেশি বেশি অবদান রাখছে, যেহেতু, গ্রামাঞ্চল থেকে বেশি বেশি করে মজুর কৃষি কাজ ছেড়ে শহরাঞ্চলে নির্মাণ কাজে যোগ দিচ্ছেন। কৃষিক্ষেত্র, বনাঞ্চল, মৎস চাষ প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেশিরভাগ গ্রামীণ মানুষ যুক্ত থাকলেও জিডিপি’তে এই ক্ষেত্রে অবদান দিনের পর দিন কমছে। অজিত ঘোষ তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন, একদিকে ধনী ও দক্ষতা সম্পন্নদের কর্মসংস্থান আজও বাড়ছে, কিন্তু গরিব, অদক্ষ বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজের বাজার থেকে প্রতিনিয়ত ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সামগ্রিক কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ১৯৯৩ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত বাৎসরিক ১.৭ শতাংশ হারে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। ২০০৪’র পর তা মুখ থুবড়ে পরে, আর ২০১১’র পর থেকে তা চলে যায় ঋণাত্মকের ঘরে। ১৯৯৩ থেকে ২০১৭’র এই দীর্ঘ পর্যায়ে অদক্ষ কর্মীরা কাজের বাজার থেকে ক্রমবর্ধমান হারে ছিটকে বেরিয়ে যেতে থাকেন আর ২০১১-১৭’র সময় তা ঋণাত্মকে প্রবেশ করে।
সরকারের ঘোষিত জিডিপি পরিসংখ্যানে বিভিন্ন আর্থিক বর্গের বা শ্রেণির আয়ের বিন্যাসকে সযত্নে এড়িয়ে চলা হয়। কারা কত আয় করছেন, কতই বা ব্যয় করছেন, বেঁচে বর্তে থাকার জন্য কোন কোন খাতে তাঁরা কত খরচ করছেন, জিডিপি’র প্রাণহীন শুষ্ক পরিসংখ্যানে তা ধরা পড়ে না। কিন্তু, প্রকৃত আর্থিক বৃদ্ধির ছবি পেতে গেলে এই সমস্ত তথ্য যে অপরিহার্য তা অ্যাঙ্গাস ডিটন, জ্যঁ দ্রেজ, কৌশিক বসু বা রবি ক্যানবুরের মতো অর্থনীতিবিদ এনিয়ে ভূরি ভূরি প্রবন্ধ লিখেছেন।
অর্থনীতিবিদ অরুণ কুমার সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান ও ব্যাখ্যা করার পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যান স্বাধীনভাবে অ-কৃষি অসংগঠিত ক্ষেত্রটিকে পরিমাপের বাইরেই রেখেছে। তার বদলে, তার প্রক্সি হিসাবে সংগঠিত ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানকে ব্যবহার করেছে। এটা মারাত্মক ভুল। যেন সংগঠিত ক্ষেত্র বিকাশ লাভ করছে, আর অসংগঠিত ক্ষেত্রটি ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। ত্রৈমাসিক পরিসংখ্যানে শুধুমাত্র এই ভ্রান্তি গুলোই যে আছে তা নয়, বার্ষিক পরিসংখ্যানে তা না শুধরে পেশ করায় জিডিপির প্রাপ্য পরিসংখ্যানে বড় ধরনের ভুল থেকে গেল।
যে উদ্বেগের জায়গাগুলো থেকেই যাচ্ছে, তা হল যে পরিষেবা ক্ষেত্রটি বর্তমানে আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে, আগামীদিনে তা বজায় থাকবে কিনা। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস হল আগামী বিত্তবর্ষে বিশ্বজুড়েই কমবে বৃদ্ধির হার। অনিশ্চিত বর্ষা, এল নিনোর চোখ রাঙানি কৃষি উৎপাদনে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমাদের দেশে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে আর্থিক অসাম্য, আর্থিক বৃদ্ধির পথে বড় কাঁটা দিনের পর দিন বেড়ে চলা বেকারত্ব। বিশ্বব্যাঙ্ক ২০২২’র যে ছবি তুলে ধরেছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে সমস্ত দেশে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব খুব উঁচুতে, ২৩.২ শতাংশ হার নিয়ে ভারত তার অন্যতম। জনসংখ্যায় বিশ্বে সবচেয়ে বেশি তরুণ সম্প্রদায়ের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট নিয়ে যতই আমরা গর্ব করিনা কেন, নির্মম বাস্তব হল দেশের এক চতুর্থাংশেরও বেশি শিক্ষিত যুবক কর্মহীন।
আর্থিক বৃদ্ধির এই স্বপ্নমাখানো মায়ামৃগের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন করতেই হবে।
- অতনু চক্রবর্তী