দীর্ঘ টালবাহানার পর নির্ধারিত সময়সীমার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে রাজ্য সরকারের পরামর্শে নির্বাচন কমিশন পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করল। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার। নিয়োগ থেকে আবাস — হরেক দুর্নীতি ও প্রবঞ্চনার কারণে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গণক্ষোভ প্রশমিত করতে লক্ষীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, নবজোয়ার ইত্যাদির প্রচার যতদিন চালানো যায় আর কী! তাছাড়া আচমকা দিন ঘোষণা করে ও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য খুব কম সময় দিয়ে বিরোধীদের অসুবিধেয় ফেলাটাও শাসকদলের লক্ষ্য ছিল।
এ’রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মেয়েদের ক্ষমতায়নের কথা বলেন, কিন্তু তাঁর আসল লক্ষ্য যেন-তেন-প্রকারেণ সর্বস্তরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। তাই তো বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁর দল অন্যান্য দলের এমনকি মহিলা প্রার্থীদের ওপরেও সন্ত্রাস চালিয়েছিল, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের মনোনয়ন পর্যন্ত আটকে দেওয়া হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি রোখার জন্য অবশ্যই আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। কিন্তু শাসকদল যথারীতি সন্ত্রাস ও রক্তপাত ঘটালো। তবে এবার মহিলা প্রার্থীরাও প্রতিরোধের জন্যে তৈরি আছেন। কারণ পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণ ফলপ্রসূ করতেই হবে। আবার দাঙ্গাবাজ বিজেপি যাতে বাংলার মাটিকে রক্তাক্ত করতে না পারে, সেজন্যও আমরা সজাগ ও সক্রিয় থাকব।
মনে রাখতে হবে, পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নিপীড়িত-বঞ্চিত-খেটে খাওয়া মানুষকে অল্পসল্প সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিজেদের জনদরদী বলে প্রমাণ করা এবং ভোটব্যাংক তৈরি করাই শাসকদের উদ্দেশ্য। কতজনকে আবাস যোজনায় পাকা বাড়ি দেওয়া হবে, কোন গ্রামে কোথায় পাকা রাস্তা তৈরি হবে, তার টেন্ডার কে পাবে, শৌচালয়, জলের কল কোথায় হবে — এই সবই কিন্তু ওপর থেকে দলীয় নেতা ও আমলারা ঠিক করে দেয়। সাধারণ মানুষের সে ব্যাপারে কিছুই বলার সুযোগ থাকে না। বরং ঘুষ দিয়ে বা শাসক দলের তল্পিবাহক হয়ে কাজ করে তাঁদের এইসব সুবিধা পেতে হয়। তাই আমলাতান্ত্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ধুমায়িত হচ্ছে। এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং মুসলিম-বিদ্বেষ ও হিন্দুত্বের জিগির তুলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাজিমাত করতে চাইছে বিজেপি। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনে তারা যদি শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে তবে তা আগামী লোকসভা নির্বাচনেও তাদের আসন বাড়াতে সাহায্য করবে, ব্যাপকতম বিরোধী ঐক্য গড়ে দিল্লীতে মোদী সরকারকে গতিচ্যুত করার যে আয়োজন আজ গোটা দেশে চলছে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং যারা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধানের পক্ষে তাঁরা ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে একটি ভোটও দেবেন না। মহিলারা তো অবশ্যই দেবেন না কারণ বিজেপির মতো কট্টর মনুবাদী নারী বিদ্বেষী দল আর নেই।
গ্রামাঞ্চলে জনগণের, বিশেষত মহিলাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য সংগ্রামী মেয়েদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসা দরকার। কারণ আইন করে পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণ হলেও বাস্তবটা তাতে পাল্টে যায় না। লড়াই করে আইনি অধিকার যেমন অর্জন করতে হয়, তেমনই লড়াই করেই তা বাস্তবে প্রয়োগও করতে হয়।
প্রায়শই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা বা প্রভাবশালী ব্যক্তির স্ত্রী, কন্যা, বোন এঁদেরই প্রার্থী করা হয়। নির্বাচিত হলে ঐ পুরুষ ‘অভিভাবকদের’ নির্দেশেই তাঁরা পরিচালিত হন। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেক মহিলা নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচিত হওয়ার পর স্বাধীনভাবে পঞ্চায়েতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে থাকেন। মহিলাদের এই সক্রিয়তাই পারে পুরুষতান্ত্রিক বা কর্তৃত্ববাদী পরিবেশকে বদলে দিতে। মেয়েদের কোনো যোগ্যতাই নেই — এই অবমাননাকর ধারণাকে তখনই একমাত্র ভাঙ্গা সম্ভব। জনপ্রতিনিধিরা এইভাবে মাথা তুলে দাঁড়ালে অন্যান্য মহিলারাও সামন্ততান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক শেকল ভাঙ্গার প্রেরণা পাবেন।
মহিলা প্রার্থীরা মেয়েদের কথা কিছুটা বেশি বলবেন, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু তাঁরা কি শুধু বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, লক্ষীর ভান্ডার — এইসব কথা বলবেন? মোটেই তা নয়। মহিলা প্রার্থী ও জনপ্রতিনিধিরা আরো অনেক ইস্যু জোরের সাথে তুলে ধরবেন। যেমন — স্বামী-স্ত্রীর যৌথ পাট্টা, সমকাজে সমমজুরি, ‘একশো দিন কাজ’ প্রকল্পে সমস্ত মেয়েদের জন্য কাজ ও কর্মস্থলে ক্রেশের বন্দোবস্ত, স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন ও তার উন্নত পরিষেবা, পরিবারিক হিংসা ও সামাজিক হেনস্থার হাত থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দেওয়া ইত্যাদি। অনেকে তা করছেনও। এ’প্রসঙ্গে তাঁদেরই কয়েক জনের বক্তব্য আমরা এখানে তুলে ধরছি। এঁরা হুগলি জেলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের প্রার্থী, পতাকায় তিন তারা চিহ্ন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ধনিয়াখালির অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী রুমা আহিরী বলেন, এলাকায় পানীয় জলের কল, একশো দিন প্রকল্পের কাজ ও মজুরি বৃদ্ধি, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের উন্নয়ন, ঋণ মকুব ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলন করছি। বিশেষত মেয়েদের অধিকারগুলো তুলে ধরা ও তা আদায় করা এবং মাতাল স্বামীদের অত্যাচারে অতিষ্ট মেয়েদের সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
পোলবার সারাংপুরের কৃষি শ্রমিক মিনু মুর্মু, তাঁদের এলাকায় শৌচালয়ের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, নির্বাচিত হলে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে লড়াই আরো তীব্র করবেন। পান্ডুয়ার তিন্নার কৃষি শ্রমিক ময়না কিসকু বয়েসে প্রবীণ, কিন্তু প্রতিদিনই বিভিন্ন ইস্যুতে সংগ্রামের ময়দানে থাকেন। তিনি বিশেষত আদিবাসীদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং এলাকায় মেয়েদের নিরাপত্তার দাবিতে লড়াই চালাচ্ছেন। বলাগড়ের গুপ্তিপাড়ার গৃহবধূ জ্যোৎস্না বিদ্যান্ত এলাকায় দীর্ঘদিনের পরিচিত মহিলা আন্দোলনের সংগঠক। তিনি বললেন, গ্রামের মানুষের রেশন কার্ড, একশো দিন কাজ, রাস্তা-ঘাট, আবাস যোজনায় ঘরের দাবিতে আন্দোলন করছি, শাসকদলের দুর্নীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার আছি। বিশেষভাবে বঞ্চিত অসহায় মেয়েদের পাশে থাকছি, থাকবো। পান্ডুয়ার দ্বারবাসিনীর শিপ্রা চট্টোপাধ্যায়, তিনি জেলাপার্টি সদস্য ও সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির জেলা-সম্পাদিকা। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্র-রাজ্য দুটো সরকারই গরিব মানুষকে বঞ্চিত করে চলেছে। সীমাহীন দুর্নীতি, গ্রামে গরিব মানুষের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে, তাঁরা বাইরে চলে যাচ্ছেন, সেখানেও তাঁরা ন্যায্য মজুরি পাচ্ছেন না। এই বিষয়গুলো প্রচারে আনতে হবে। মহিলাদের পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণ পঞ্চায়েতে কার্যকরী করতেই হবে, কারণ সংসদে তেত্রিশ শতাংশ সংরক্ষণ আজও মহিলাদের দেওয়া হলো না, কিন্তু পঞ্চায়েতে মানুষের এবং মেয়েদের দাবিগুলো আমাদের জোরের সঙ্গে তুলতেই হবে। বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ মহিলা খেলোয়াড়দের যৌন হেনস্তা করেছে, তার উপযুক্ত শাস্তির দাবি এবং এই সাংসদ পকসো আইন তুলে দেওয়ার দাবি তুলেছে এর বিরুদ্ধেও আমাদের এই সময় জোরালো প্রচার করতে হবে।
দলবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বদা আওয়াজ তোলার ‘অপরাধে’ তাঁরা বিভিন্ন প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। কিন্তু তাঁদের জনসংযোগ ও লড়াকু মেজাজ লক্ষ্য করে শাসক ও অন্যান্য দল কিছু সাহায্য করার লোভ দেখিয়ে কয়েকজনকে তাদের দলের প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু এঁরা গরীব হলেও কেউই সে ফাঁদে পা দেননি। বরং রাজ্যের ও কেন্দ্রের উভয় শাসক দলের বিরুদ্ধেই লড়ছেন। সকলেই নিজেদের জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছেন, তাঁরা মনে করেন, ব্যাপক মানুষের স্বার্থই আমারও স্বার্থ। গোটা রাজ্যে এরকম আরও অনেক মহিলা নারীর স্বার্থে মানুষের স্বার্থে কাজ করার জন্য পঞ্চায়েতের মঞ্চে এগিয়ে আসছেন।
এই মানসিকতা নিয়েই সমস্ত মহিলা প্রার্থীদের এগিয়ে আসা উচিত। কারণ এঁরাই হতে পারেন পঞ্চায়েত পরিচালনায় অগ্রণী সৈনিক। আমরা লক্ষ্য করছি, গ্রামবাংলায় শোষণ ও বঞ্চনা, দুর্নীতি ও অত্যাচার যেমন বাড়ছে, তেমনই ক্ষোভ থেকে প্রতিবাদ, প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধও গড়ে উঠছে দিকে দিকে। এই ইতিবাচক ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। পঞ্চায়েতকে সমঅধিকার ও সংগ্রামের মঞ্চ তথা মেয়েদের ক্ষমতায়ণ ও আত্মঘোষণার মঞ্চ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই নির্বাচনী প্রচারে কয়েকটি নির্দিষ্ট দাবি তুলে ধরতে হবে।
১) দলতন্ত্র নয়, দুর্নীতি মুক্ত জনগণের পঞ্চায়েত গড়ে তুলুন।
২) অসাংবিধানিক গ্রাম্য সালিশি প্রথা বন্ধ কর।
৩) শ্রমজীবী, দলিত ও আদিবাসীদের কাজ-মজুরি-জমি-বাসস্থান, পেনশন সুনিশ্চিত করতে হবে।
৪) ‘একশো দিন কাজ’ প্রকল্প নিয়মিত কর ও বকেয়া মজুরি মিটিয়ে দাও।
৫) পঞ্চায়েত স্তরে যৌনহেনস্থা প্রতিরোধ সেল গড়ে তোলো।
৬) ব্লক হাসপাতালগুলোতে মা ও শিশুর উন্নত যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলো।
৭) আবাস যোজনায় প্রত্যেক গরিব মানুষকে ঘর দিতে হবে।
৮) সরকার পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোকে প্রকৃত স্বনির্ভর করে তোলার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
৯) স্কীম ওয়ার্কারদের সমস্ত রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে ।
- চৈতালি সেন