১৮ জুন সুভাষগ্রামের দেবীবরণ হলে অনুষ্ঠিত হল এক পরিপূর্ণ স্মরণসভা। অবিভক্ত বাংলার বগুড়া শহরে জন্মে সুভাষগ্রামে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন ৯১ বছরের কমরেড বাণী ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন সমস্ত পার্টির কাছে মাসীমা। এই মা ছিলেন সারা জীবন ধরে একটা ব্যাঙ্কের মত যার কাছে সবাই অনুভূতি, আবেগ, সম্মান ও দুঃখ কষ্ট জমা রাখত, এবং বিনিময়ে পেত তাঁর অফুরান ভালবাসা। এ সম্পদ কোনোদিন ফুরোবার নয়। পূর্ণ সভাগৃহে সেদিন কে আসেননি? সুভাষগ্রামের প্রতিবেশীরা থেকে শুরু করে আত্মীয় পরিজনেরা, পুত্র দীপঙ্করের প্রাইমারী স্কুলের থেকে শুরু করে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের সহপাঠী বন্ধুবান্ধবেরা, এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী থেকে শুরু করে মাসীমার গুণমুগ্ধ অসংখ্য মানুষেরা, পার্টি কর্মী ও নেতৃবৃন্দ। ছিলেন বিশিষ্ট গায়িকা মৌসুমী ভৌমিক, তিনি কীর্তন সঙ্গীতের বিরহ বিষাদের মুর্চ্ছনা পরিবেশন করেন। এছাড়াও জাগরণের সংগীত পরিবেশন করেন মেহুলী চক্রবর্তী, মীরা চতুর্বেদী, নীতীশ রায়। সঞ্চালনায় ছিলেন নাতনী শর্মিষ্ঠা। দীর্ঘদিন মাসীমার পরিবারে একাত্ম হয়ে, নিত্যানন্দ ঘোষ সুরটা বেঁধে দেন তাঁর আন্তরিক উচ্চারণ দিয়ে। তাই তিনি ঘটনাবহুল জীবনের প্রাথমিক পর্ব নিয়ে শুরু করলেন।
মাসীমার জন্ম হয় এখনকার বাংলাদেশের বগুড়া শহরে। ১৯৫০এ তাঁরা বালুরঘাটে চলে আসেন। মেসোমশাই এনএফ রেলে কাজ করতেন। আলিপুরদুয়ার থেকে গৌহাটি ছিল তাঁর এক্তিয়ার। কমরেড দীপঙ্করের জন্ম হয় অসমের গৌহাটিতে। মাসীমার দাদু বেনারসে ন্যায়রত্ন করে বৃন্দাবনে আশ্রম স্থাপন করেন। ১৯৮৪ সালে এক মামার উদ্যোগে সুভাষগ্রামে বাড়ি পত্তন হয়। তারপর থেকে নিত্যানন্দ সংসারেরই একজন হয়ে ওঠেন। নিত্যানন্দের কথায়, মাসীমা দেশভাগের তিক্ততাকে অতিক্রম করে জাতিবিদ্বেষ ও সংস্কারের সংকীর্ণতাকে অনায়াসে ত্যাগ করতে পেরেছিলেন। ওদিকে পুত্র দীপঙ্কর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ক্লাস এইটে ভর্তি হলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে শীর্ষস্থান অধিকার করে আইএসআই’তে এমস্টাট করে পার্টির হোল টাইমের হলেন। মাসীমা তাঁকে কোন বাঁধা দেননি। প্রতিষ্ঠিত উপার্জন থেকে অনিশ্চয়তার জীবন। অন্যদিকে, মাসীমা কিন্তু নিজ সংসারে কাজের মেয়ে সাবিত্রীর দুই ছেলেকে শিক্ষিত করে বড় করে তুলছেন। মেসোমশাই ২০০৭-এ ক্যান্সারে মারা গেলেন। সেই কঠিন সময়ে নিত্যানন্দ মাসীমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। কমরেডরা বাড়িতে এলে মাসীমা সবাইকে আদর যত্ন করতেন। জাতপাতের বিচার কোনদিন করেননি। অথচ পুজো আচ্চা করতেন। ধার্মিক ছিলেন। প্রতিবেশীদের জন্য যতটা পারতেন করতেন। সামান্য পেনশন পাওয়া সত্ত্বেও ছোট বাচ্চাদের জন্মদিনে বই উপহার দিতেন। উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, লীলা মজুমদার ইত্যাদি, সাপ্লাই দিতেন নিত্যানন্দ। কে কী পড়ছে বা পড়ছে না, সব খবর রাখতেন। অগ্রণী মানুষের যা করার দরকার তাই করতেন। পার্টির কাগজপত্র, বিশেষ করে ছেলের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। আজকালের শব্দজব্দ নিয়মিত করতেন। শ্রুতিধরও ছিলেন। একবার নিত্যানন্দ গাঙ্গুলিবাগানের বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়েন, মাসীমা প্রায় জোর খাটান যে তাঁকে সুভাষগ্রামে এসে থাকতে হবে। প্রায় দত্তক সন্তানের মত।
তাঁর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দীপঙ্কর আফসোস করলেন, মাসীমা বেশি দ্রুত চলে গেলেন। পার্টি কংগ্রেস চলাকালীন অসুস্থতা ছিল। চলে যাবার পর তাঁর শূন্যতা এত ব্যাপকভাবে দেখা দিল যে তাঁর সম্পূর্ণতা কতটা প্রসারিত ছিল তা বোঝা যায়। ১৩ বছর বয়েস পর্যন্ত তিনি মা’কে পেয়েছেন। প্রথমে নরেন্দ্রপুর তারপর আইএসআই। মা’র স্নেহ সব সময়ই ছিল যা একান্ত ব্যক্তিগত, অথচ তাঁর মা ছিলেন ভীষণ সামাজিক। সমাজকে চিনতে পারার প্রথম পাঠ তিনি পান তাঁর মা’র কাছেই। সবাইকে খুব ভালোবাসতেন তিনি। কিন্তু কখনই আঁকড়ে ধরতেন না, বরং এগিয়ে দিতেন। এটাই মা’র চরিত্রের বিশেষ দিক। তিনি বলেন, “মা’র মতো আমরাও কলকাতা ভাল চিনতাম না। ছুটিতে কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার আত্মীয়র বাড়ি বড়োজোর বহরমপুর। মা কিন্তু এককভাবে অসুস্থ বাবাকে অচেনা কলকাতায় থেকে তাঁকে সুস্থ করে নিয়ে গেছেন। এমনই কুশলতা ছিল তাঁর।” সুভাষগ্রামের প্রায় কেউ দীপঙ্করকে চিনতেন না। কিন্তু মাসীমাকে সবাই চিনতেন। পার্টির থেকে তিনি সান্মানিক সদস্যপদ পেয়েছিলেন, এতে তিনি বেজায় খুশি ছিলেন। কোভিড বা আম্ফানের সময় তাঁর নিয়মিত অবস্থান ছিল রাস্তার ধারের জানালা। জনে জনে পথ চলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করছেন কার পরীক্ষা কবে, চাকরির কিছু হল কিনা, মেয়ের শরীর এখন কেমন ইত্যকার কথা। মাসীমা ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু তাঁর ধর্মে কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকত না, না কোন বিদ্বেষ, না কোন তিক্ততা। এখন তো ঘৃণা আর বিদ্বেষ একটা ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মাসীমা ছিলেন অত্যন্ত উদার। প্রয়োজনে তিনি সবার। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখা, কার নামে অল্প পেনশন থেকে এফডি করা, কাকা নীলুর মৃত্যুর পর নির্মল হৃদয়ের সমস্ত আবাসিকদের খাইয়ে দেওয়া কত কি? বলে শেষ করা যাবে না। অন্যদিকে মাসীমার ঔদার্য ছিল শিক্ষণীয়, জাতপাতের উর্ধ্বে।
অসুস্থতার সময়ে কত ছাত্রছাত্রী কমরেড তাঁর বিছানার পাশে রাতের পর রাত জেগে থেকেছেন। মৌসুমী সহ আর সবাই তাঁর টানেই ছুটে এসেছেন সভায়। যেভাবে তিনি জীবন ও মূল্যবোধ যাপন করে প্রকাশ করেছেন তাঁর থেকে পরের প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। মাত্র দু’তিন বার তামিলনাডু তিনি গেছেন কিন্তু তাঁর ভাষা না জানা কোনো ওয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা বারবার মাসীমার খোঁজ নিতেন। এত ঘনিষ্ঠতা তাদের সাথে ভাবা যায় না। সেদিনের সভায় আরো এসেছিলেন এলাকার বিশিষ্ট চিকিৎসক, ব্যাঙ্ক কর্মচারী থেকে শুরু করে দীপঙ্করের সহপাঠী প্রত্যেক স্তরের বন্ধুবান্ধবরা, মাসীমার গুণমুগ্ধ মানুষজন। পার্টি কর্মী, নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন বর্ণালী রায়, মীনা পাল ও সহপাঠী বন্ধুরা। মাঝে মাঝে সুরের ধারায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেন মেহুলী, মীরা চতুর্বেদী ও নীতীশ রায়। সকলেই মাসীমার জীবনের বিভিন্ন উজ্জ্বল দিকগুলি তুলে ধরেন। তাঁর আন্তরিকতা, একাত্মতা, ভালোবাসা, শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ অনুরাগের কথাও বলেন। দীপঙ্কর মনে করিয়ে দেন, সকলকে আপন করে নেওয়া এবং অন্যের মধ্যে বেঁচে থাকার এক উজ্জ্বল নিদর্শন ছিলেন তিনি। এক কঠিন সময়ে এভাবেই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি। তাহলে কী তিনি ম্যাক্সিম গোর্কি’র কালজয়ী মা অথবা রবীন্দ্রনাথের সেই মা যাকে দেখে লিখেছিলেন,
তার চেয়ে মা আমি হব মেঘ
তুমি যেন হবে আমার চাঁদ
দুহাত দিয়ে ফেলব তোমায় ঢেকে
আকাশ হবে এই আমাদের ছাদ।
কিংবা শামসুর রাহমানের মা’র মতো যিনি সব গান কাঠের সিন্দুকে বন্ধ করে রেখেছেন আজীবন, অথবা হুমায়ুন আজাদের মা’য়ের মতো ধানক্ষেতে বিছিয়ে আছেন আজো তাঁর অশ্রুবিন্দু গ্রাম থেকে নগর পর্যন্ত টলমল করে? অথবা সব মিলিয়ে? সেই আমাদের যৌথ মা?
- অসিত টুডু