দু’দফা মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদীর ন’বছরেরও বেশি শাসন যদি সংখ্যাগুরুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে থাকে, তবে সেই শাসনের আর একটা অবিসংবাদী পরিণাম হয়েছে কর্পোরেট লুটেরাদের প্রতি মদত ও সেই লুটেরাদের সুরক্ষা জোগানো। এমনকি দেশের বিচারকে এড়ানো সম্ভব করতে তাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতেও সহায়তা করা। বিজয় মাল্য, নীরব মোদী, মেহুল চোক্সিদের রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ব্যাঙ্কের অর্থ লুট করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে সেসময় দেশে যথেষ্ট আলোড়ন হয়েছিল, এবং ব্যাঙ্কের, অর্থাৎ ভারতীয় জনগণের অর্থ লুট প্রতিরোধের দাবি জোরালো হয়ে সামনে এসেছিল। কিন্তু মোদী জমানা যত এগিয়েছে অনুৎপাদক সম্পদের রূপে প্রকট হওয়া ব্যাঙ্ক অর্থের লুটে কোনো নিয়ন্ত্রণ আসেনি। এরথেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ব্যাঙ্ক অর্থের এই লুটেরারা বেপরোয়া এবং ক্ষমতার অলিন্দই তাদের স্পর্ধার সবচেয়ে বড় উৎস। সম্প্রতি আবার রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এমন একটা নির্দেশিকা জারি করল যা ব্যাঙ্ক লুটেরাদের ঋণ অপরিশোধ জনিত অপরাধ থেকে অব্যাহতি পাওয়ারই একটা অবলম্বন হয়ে দেখা দিচ্ছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গত ৮ জুন বার করল ‘আপসে রফা ও পারিভাষিক রাইট-অফ’এর কাঠামো’ সম্পর্কিত নির্দেশিকা। এই নির্দেশিকার সারকথা — ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে যারা শোধ করেনি, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে আপসের মাধ্যমে সেই বকেয়া ঋণের কিছুটা অন্তত আদায়ের চেষ্টা করবে। এই ঋণ খেলাপিদের দুটো বর্গের কথা বলা হয়েছে — ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করেনি সেই ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী এবং প্রতারণার মাধ্যমে ব্যাঙ্ক অর্থ হাতিয়ে নিয়ে শোধ না করা জালিয়াতরা। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ এই সমস্ত অপরিশোধকারী এবং জালিয়াতির রূপকারদের সঙ্গে আলোচনায় বসবে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বকেয়া অর্থের কিছুটা অন্তত তাদের দিতে বলবে। আর, যে সমস্ত অপরিশোধিত ঋণ অনুৎপাদক সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোকে ব্যাঙ্কের ঋণের খাতা থেকে রাইট-অফ করা বা মুছে দেওয়া হবে, তারপরও যদিও সেই বকেয়া অর্থ আদায়ের অধিকার ব্যাঙ্কের থাকবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আপস-আলোচনা চালানোর জন্য ব্যাঙ্কগুলোর বোর্ডকে নীতি তৈরি করতে বলেছে এবং ব্যাঙ্কগুলো পরিচালন বোর্ডের সম্মতি নিয়ে এ ধরনের আপস আলোচনায় অংশ নিতে পারবে। এই নীতি প্রবর্তনের পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো — ব্যাঙ্কের প্রচুর অর্থই অনাদায়ী হয়ে পড়ে আছে; কাজেই, আপসের মাধ্যমে সেই অর্থের কিছুটা আদায় হলেও ব্যাঙ্কের লাভ। কিন্তু সাধারণ জনগণের ধারণায় এবং ভাষ্যকারদের মতে — রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এই নির্দেশিকার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী এবং জালিয়াতির কারবারীদের কাছে উৎসাহের সংকেত এবং সৎ ঋণগ্ৰহীতাদের কাছে হতাশজনক বার্তাই পৌঁছাবে।
ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারী হল সেই সমস্ত ব্যক্তি বা সংস্থা পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা ঋণ পরিশোধ করেনি। এই সমস্ত সংস্থা বা ব্যক্তিদের মাথায় হাত বুলিয়ে কতটুকু অর্থ আদায় সম্ভব? পরিশোধ না করার দুরভিসন্ধি থেকেই কি তারা ঋণ কব্জা করেনি? দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে তারা ছিটেফোঁটা হয়ত শোধ করবে। আর এটুকু নিয়েই ব্যাঙ্ক সন্তুষ্ট হয়ে তাদের অপরাধ থেকে, পরিশোধের দায় থেকে মুক্ত করবে? সরকার যেমন বলছে, অনুৎপাদক সম্পদ রূপে অনাদায়ী যে অর্থকে ব্যাঙ্ক ঋণের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে সেই অর্থ আদায়ের প্রচেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সেই আদায়ের পরিমাণ কতটা? গত চার বছরে, ২০১৭-১৮ থেকে ২০২১-২২’র মধ্যে ব্যাঙ্ক ঋণের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে ১০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু মুছে দেওয়ার পর এই অর্থ আদায় করা গেছে মাত্র ১৩ শতাংশ। হিসেব অনুসারে যা গিয়ে দাঁড়াচ্ছে — ৮ টাকা ঋণ নিলে তার থেকে শোধ হচ্ছে মাত্র ১ টাকা। এটাই কি সরকার এবং ব্যাঙ্কগুলোর চূড়ান্ত লক্ষ্য? ঋণ আদায়ের অমোঘ ভবিতব্য? ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলোর দুই সংস্থা এআইবিওসি এবং এআইবিইএ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকার বিরোধিতা করে বলেছে, এই পদক্ষেপ ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার ন্যায়পরায়ণতাকেই সংকটাপন্ন এবং ইচ্ছাকৃত অপরিশোধকারীদের মোকাবিলার প্রচেষ্টাকে দুর্বল করে তুলবে। এই নির্দেশিকা কার্যকরী হলে তা নীতিজ্ঞানরহিত ঋণ গ্ৰহীতাদেরই শুধু লাভ এনে দেবে না, যাঁরা বহু কষ্ট স্বীকার করেও ঋণ পরিশোধ করে চলেছেন তাদের কাছে অসন্তোষের এক বার্তাও পাঠাবে। সৎ ঋণ পরিশোধকারীরা ভাবতেই পারেন, ঋণ পরিশোধ করাটা কি তাঁদের অপরাধ হচ্ছে? শোধ না করলে ঐ ঘোড়েল ও ধড়িবাজ অপরিশোধকারীদের মতো সুবিধাও কি তাঁরা পেতেন না? ব্যাঙ্ক ইউনিয়নগুলোর দুই সংস্থা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই ধরনের নরম পদক্ষেপ নীতি পালন না করার প্রবণতা, নীতিভ্রষ্টতাকেই স্থায়ী করে, ক্ষতির মূল ধাক্কাটা ব্যাঙ্ক ও তার কর্মীদেরই বহন করতে হয়।” এবং বিবৃতিতে তারা আরবিআই’এর নির্দেশিকা প্রত্যাহারের দাবিও জানিয়েছে।
আরবিআই’এর ঐ নির্দেশিকায় আরও বলা হয়েছে, আপস আলোচনার মাধ্যমে ঋণের কিছু টাকা শোধ করা ব্যক্তিদের একবছরের আগে আর ঋণ দেওয়া যাবেনা। এর গূঢ় অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, কিছু টাকা শোধ করে দায়মুক্ত হওয়ার একবছর পর তারা আবার ঋণ পাবে। এবং তার পরের সম্ভাবনা এই যে, ঐ ঋণও পুরো শোধ হবে না এবং আপসের মাধ্যমে কিছু টাকা শোধ করে পুরো দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা হবে। দ্য ওয়্যার ওয়েব পত্রিকায় প্রকাশিত এআইবিওসি’র প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক টমাস ফ্র্যাঙ্কোর লেখা এক নিবন্ধে ব্যক্ত অভিমত হলো, “মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আমানতকারীদের আমানতকে কাজে লাগিয়ে সামান্য কিছু অর্থ পুনরুদ্ধারের ভিত্তিতে ঋণ ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হবে। আর অপরাধীরা আবার ঋণ নিতে পারবে!”
খুব সঙ্গত ভাবেই এই প্রশ্নটা উঠছে যে — এই সময়েই, ২০২৪’র লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যখন আর এক বছরও বাকি নেই, সে সময় আরবিআই এই নির্দেশিকা জারি করল কেন? বিশেষত, ২০১৯ সালের ৭ জুন তারিখে জারি করা তাদের বিজ্ঞপ্তিকে খারিজ করতে আরবিআই এত সক্রিয় হলো কেন? ঐ বিজ্ঞপ্তিতে আরবিআই জানিয়েছিল, “যে সমস্ত ঋণ গ্ৰহীতা জালিয়াতি/অবৈধ কাজ/স্বেচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি করেছে তারা পুনর্বিন্যাসের অমনোনয়নযোগ্য হবে।” অর্থাৎ, তাদের নেওয়া ঋণের অর্থ ও পরিশোধের সময় কোনোভাবেই রদবদল করা যাবে না। এরপর এই নতুন নির্দেশিকা কি সন্দেহ জাগায় না? সংবিধান সম্মত সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাগজে-কলমে ‘স্বাধীন’ হলেও সবই চলে মোদী সরকারের নিয়ন্ত্রণে ও নির্দেশে। এই নির্দেশিকার পিছনেও আরবিআই’এর ওপর মোদী সরকারের চাপ সৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। ওপরে টমাস ফ্র্যাঙ্কোর যে নিবন্ধের উল্লেখ করা হলো, তাতে তিনি এই সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছেন যে — বিজয় মাল্য, মেহুল চোক্সি, নীরব মোদীর মতো ব্যাঙ্ক তথা সাধারণ জনগণের অর্থের যে লুটেরারা দেশের বিচারকে ফাঁকি দিতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিল, তারা এবার দেশে ফিরে আসতে পারবে। অনাদায়ী ঋণের অল্প কিছু অর্থ শোধ করে পরিশোধহীনতার সম্পূর্ণ দায় থেকে মুক্ত হতে সমর্থ হবে। আরবিআই একবার ৫০ জন স্বেচ্ছাকৃত অপরিশোধকারীর যে তালিকা তৈরি করেছিল তার প্রথম দিকেই ছিল এবিজে শিপইয়ার্ড (ঋষি আগরওয়াল), উইনসাম ডায়মন্ড (যতীন মেহতা) ও অন্যান্য নাম যারা মোদী ও বিজেপি ঘনিষ্ঠ। টমাস ফ্র্যাঙ্কো বলেছেন, যে এবিজে শিপইয়ার্ড ২৮টা ব্যাঙ্কের সঙ্গে ২৩,০০০ কোটি টাকার প্রতারণা করেছে, তারা এবার আপস মীমাংসায় গিয়ে গৃহীত ঋণের সামান্য কিছু শোধ করে অপরাধ থেকে পুরোপুরি দায়মুক্ত হতে পারবে!
আজকের ভারতে ঋণ অপরিশোধের পরিণামে ঘটা ব্যাঙ্ক সংকটের পিছনে মূল কারণ হয়ে রয়েছে ক্রোনি ক্যাপিট্যালইজম বা স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্র। মোদী সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের নানা বৈধ-অবৈধ সুবিধা দেয়, আবার ঐ পুঁজিপতিরাও ইলেক্টোরাল বন্ড এবং অর্থ প্রদানের অন্যান্য রূপে বিজেপির ভাঁড়ারে হাজার হাজার কোটি টাকা ঢালেন। আদানি সম্পর্কে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টেও বলা হয়েছে যে, “কার্যত কোনো ধরনের আর্থিক নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতির কারণেই” মরিশাসের মতো করের বিপুল সুবিধা থাকা দেশগুলো থেকে অনামি কোম্পানিগুলো আদানির কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ ঘটিয়ে সেগুলোর শেয়ারের দামকে বাড়িয়ে তুলেছে, ২৫ শতাংশ শেয়ার কোম্পানি ও তাদের মালিকদের পরিবারের বাইরে রাখার নীতির লঙ্ঘন ঘটিয়েছে। এই পুঁজিপতি-রাজনীতি গাঁটছড়ার মধ্যেই, সারা ভারতে গুজরাট মডেল প্রয়োগের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ব্যাঙ্কের অর্থ লুন্ঠনের নির্ধারক শর্ত। মোদী সরকার ক্ষমতায় থাকবে আর বিজেপি ঘনিষ্ঠ ঋণগ্ৰহীতারা ঋণ পরিশোধে তৎপর হয়ে উঠবে তা নিছকই আকাশকুসুম কল্পনা। কিছুদিন আগে জম্মু ও কাশ্মীরের শেষ রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক দুর্নীতি সম্পর্কে মোদীর মনোভাব নিয়ে একটা কথা বলেছিলেন — নিজেকে দুর্নীতি-বিরোধী যোদ্ধা রূপে জাহির করার চেষ্টা করলেও মোদী দুর্নীতিকে প্রকৃতই ঘৃণা করেন না। দুর্নীতিতে বিজেপির নেতারা জড়িত থাকলে চোখ ফিরিয়ে রাখাতেই তিনি অভ্যস্ত। আরবিআই’এর এই নির্দেশিকার ভিত্তিতে যে সমস্ত ঋণ খেলাপি বকেয়া ঋণের সামান্য অর্থ শোধ করে ঋণ পুরো পরিশোধ না করার অপরাধ থেকে মুক্ত হবেন, তাদের পরিশোধ না করা ঋণের একটা অংশ যে বিজেপির তহবিলে যাবে না, সে কথা কেউই হলফ করে বলতে পারবেন না!