শুধু ডিজিটাল বানানো নয়, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যেরও সুরক্ষা প্রয়োজন
people's-personal-information-also-needs-protection

আমাদের দেশ এখন স্বাধীনতার ‘অমৃত মহোৎসব’ পালন করছে, আমরা সবাই এই মুহূর্তে ‘অমৃত কাল’ সময়ে আছি, আর রোজ আমাদের দেশ লজ্জার নতুন নতুন উচ্চতা ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের মানুষ আজকাল দুবেলা দুমুঠো খাবার পাক, ছাই না পাক, রোজ সেই মানুষদের ডিজিটাল বানানোর প্রক্রিয়া কিন্তু চলছেই। কখনো স্বেচ্ছায় কখনো বাধ্য হয়ে মানুষেরাও সেই ডিজিটাল দুনিয়াতে প্রবেশ করছে। ডিজিটাল হওয়ার উগ্র বাসনার মধ্যে যে কী পরিমাণ বিপদ লুকিয়ে আছে, এবং এই প্রক্রিয়া যে কতটা অসুরক্ষিত, তা বোঝার মতো বোধ না থাকলেও সরকার যখন প্রতিটি মানুষকে এক একটি তথ্যভান্ডার মনে করে, তাঁদের নানান তথ্য, নানান সময়ে নিতে চায়, তখন বেশিরভাগ মানুষ, তাই না বুঝেই তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্য দিয়ে থাকেন।

গত কয়েকদিন ধরে তুমুল হইচই চলছে, কোউইনের তথ্য ভান্ডার থেকে, দেশের বহু মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য নাকি চুরি হয়ে গেছে। এই বিষয়টিকে চুরি বলা হবে, না কি অন্য কিছু, তা অবশ্য ভিন্নতর বিতর্ক, কিন্তু সমস্যা হলো, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা থেকে সাংবাদিক কেউই বাদ যাননি, এমনকি প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনেরও ব্যক্তিগত তথ্য আজ খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু নাম দিয়ে খুঁজলেই নাকি, এই তথ্য যে কোনও মানুষের সামনে চলে আসছে। যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, টেলিগ্রাম নামক মেসেজিং মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন থেকে এই ঘটনাটি ঘটেছে। যদিও বিরোধীরা এই নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন, সবাইকে ডিজিটাল বানাতে গিয়ে, তথ্যের সুরক্ষা নিয়ে উদাসীন থেকেছে সরকার, কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। প্রথমদিন থেকেই বহু মানুষ এবং বেশ কিছু অসরকারী সংস্থা এই কোউইন এবং আরোগ্য সেতু নিয়ে, তাঁর তথ্য সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেদিনও যেভাবে সরকার বলেছিল, সব ঠিক আছে, আজও তেমন করেই বুক বাজিয়ে বলছে, কোনও চিন্তা নেই, সব কিছুই সুরক্ষিত। যা তথ্য দেখা যাচ্ছে, তা নাকি আগেই চুরি হওয়া তথ্য, আর নতুন করে কিছু হয়নি। যদি এই কথা সঠিক ধরে নেওয়া যায়, তাহলেও আরো কিছু প্রশ্ন এসেই যায়, যা নিয়ে কথা বলা জরুরি।

যদি মনে করা যায়, যে সময়ে, কোভিডের সংক্রমণে সারা দেশ প্রায় অচল, সেই সময়ে সরকারের ইনফর্মেশন এবং প্রযুক্তি মন্ত্রক থেকে, দুটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আনা হয়েছিল। একটি ছিল, আরোগ্য সেতু, অন্যটি কোউইন। প্রথমটির কাজ, আশেপাশে কোনও মানুষ সংক্রমিত কি না, তা জানানো, আর দ্বিতীয়টির কাজ, কোভিডের যে টীকাকরণ হবে, তা এই মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিক, টীকা নিয়েছেন কি না, তা দেখাটাই ছিল সরকারের উদ্দেশ্য। সরকারের যদিও আরো কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল, সমস্ত মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য একটি জায়গায় নিয়ে আসা এবং কত মানুষ টীকা নিয়েছেন, সেই সংখ্যা দেখিয়ে প্রচার করা, কিন্তু তা তাঁরা সামনাসামনি বলেনি। প্রাথমিকভাবে, কোউইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছিল, যে সমস্ত মানুষ, যেহেতু স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেন না, তাহলে কী প্রক্রিয়ায় তাঁদের টীকাকরণ হবে? তখন সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, পরিবারের কোনও একজনের স্মার্ট ফোন থাকলেই হবে, আরো বলা হয়েছিল, একজন ব্যক্তির আধার এবং একটি ফোন নম্বর দিলে, সরকারী টীকাকরণ কেন্দ্রের কর্মীরা এই কাজটা করে দেবেন। অনেকেই তখন প্রশ্ন করেছিলেন, আধার কেন? আধার তো কোনও বৈধ পরিচয়পত্র নয়। সরকারের তরফে তখন বলা হয়েছিল, যে কোনও পরিচয়পত্র, যেমন ভোটার কার্ড বা পাশপোর্ট দেখালেও এই কোউইনে নিবন্ধীকরণ করা যাবে।

প্রথম দিন থেকেই অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তরফ থেকে এই ধরনের কোনও উদ্যোগ না নিয়ে কেন তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের তরফে এই কোউইন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আনা হলো? বিগত সরকারের আমলেও তো নানান ধরনের টীকা দেওয়ার প্রক্রিয়া নেওয়া হয়েছিল, তখন তো এই ধরনের কোনও পরিচয়পত্র বা ফোন নম্বর জমা নেওয়া হয়নি, তাহলে এখন কেন? আসলে এখানেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য, যা নিয়ে এতো আলোচনা চলছে এই সময়ে। প্রতিটি মানুষ আজকের সময়ে একটি তথ্য ভান্ডার, তাঁর ফোন নম্বর, তাঁর আধার নম্বর, তাঁর লিঙ্গ, বয়স, বাসস্থানের সম্পর্কে যদি যদি জানা যায়, তাহলে তাঁর অবয়ব সম্পর্কে যে কোনও ব্যক্তিই একটা ধারণা তৈরি করে নিতে পারবেন সহজেই। নন্দন নিলেকনী, যিনি এই আধার তৈরি করেছিলেন, তিনি এক জায়গায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, মানুষের তথ্য যদি পাওয়া যায়, তাহলে আরো ভালো স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। তিনি পরিষেবা বললেও, আসলে যে ব্যবসা বুঝিয়েছিলেন, তা কী আর নতুন করে বলে দিতে হয়? যে কোনও মানুষের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য যদি কোনও বীমা সংস্থার কাছে থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তিটি আজ অবধি কোন কোন অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন, কোন কোন ওষুধ খেতে হয়েছে, কোন কোন কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, সমস্ত কিছু জানা সম্ভব নয় কি? তাহলে আগামী দিনে তাঁর বীমার প্রিমিয়াম কতটা বৃদ্ধি করা হবে, তা কে নির্ধারণ করবে, বেসরকারী বীমা সংস্থাগুলো ছাড়া আর কে?

আসলে আমরা ভারতীয়রা, কোনোদিনই নিজেদের তথ্য এবং তার সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত নয়, আমরা জানি না, আমাদের তথ্য বাইরের কোনো সংস্থার হাতে পড়লে, আমার কী ধরনের সমস্যা হতে পারে। আমরা বুঝতেই পারিনা, কেন আমাদের ফোন নম্বরে, অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে? আসলে আমরাই আমাদের তথ্য দিয়ে দিই, জেনে বা না জেনে, আর সেই তথ্য বিভিন্ন সংস্থা কিনে নেয়, বিপুল টাকা দিয়ে, এবং পরে তা ব্যবহৃত হয়, আমাদের কাজে লাগানোর ছুতোয়। আজকে যে কোউইনের তথ্য খোলা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেই তথ্যও কিন্তু ফিরে আসবে আমাদের কাছে, কোনও বেসরকারি বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে, যা আমাদের প্রভাবিত করবে। তথ্য আজকের সময়, তেলের চেয়েও মহার্ঘ বস্তু, তেল খরচ হয়ে যায়, তথ্য কিন্তু খরচ হয় না, তথ্য প্রতিদিন নতুন তথ্যের আমদানি করে, যা দিয়ে আরো বেশি মানুষকে করায়ত্ব করা যায়, আরো বেশি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ এবং নজরদারী করা সম্ভব। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী যখন রোজ ভারতবর্ষকে ডিজিটাল বানিয়েছেন বলে গর্ব করেন বলে প্রচার করেন, তখন তাঁর কি উচিৎ নয়, প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যকেও কীভাবে আরো সুরক্ষিত রাখা যায়, সেদিকে নজর দেওয়ার? উনি ভারত আর ইন্ডিয়ার পার্থক্য মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছেন, ওদিকে ইন্ডিয়ার মানুষের তথ্যই সুরক্ষিত নয়, ভারত তাহলে কী করবে?

- সুমন সেনগুপ্ত

খণ্ড-30
সংখ্যা-19