গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা
democratic-decentralization

“এতদিন পঞ্চায়েতের উপর আমরা গুরুত্ব দিইনি। দু’মাস আগে আমরা পঞ্চায়েত ঘিরে মানুষের মতামত নিয়েছি।... নির্বাচনের পর আমরা তৃণমূল স্তরে দুর্নীতিকে নির্মূল করব।” কুচবিহারে নির্বাচনী এক জনসভায় এই কথাগুলো বললেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরও জানালেন, এরপর থেকে তিনিই পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করবেন। নির্বাচনের পরই তিনি দুর্নীতিকে নির্মূল করার কথা বলছেন, শিকার করেছেন যে পঞ্চায়েতকে তাঁর সরকার এতদিন গুরুত্ব দেয়নি। বাস্তু ঘুঘুর বাসা হয়ে ওঠা পঞ্চায়েতকে দুর্নীতিমুক্ত করার যে কোনো তাড়নাই মুখ্যমন্ত্রীর ছিল না তা তাঁর বক্তব্যেই ধরা পড়ল।

২০২৩ হল সংবিধনের ৭৩তম ও ৭৪তম সংশোধনের ৩০তম বার্ষিকী। এই দু’টি সংশোধনী যথাক্রমে পঞ্চায়েতীরাজ ও পৌরসভাকে স্বশাষিত সংস্থা হিসাবে স্বীকৃতি ও আইনসিদ্ধ করেছে। কিন্তু দীর্ঘ ৩০ বছরেও এই সংস্থাগুলোর ঘোষিত সাংবিধানিক লক্ষ্য তো অর্জনই করা যায়নি বরং তার অন্তর্নিহিত মর্মার্থকে ক্ষমতাসীন শাসক দল তিলে তিলে ধ্বংস করেছে। বাম জমানার ৩৪ বছর শাসনে যা চলেছিল, তৃণমূল জামানায় তার আরও গতিবৃদ্ধি হয়েছে। শাসক পার্টির খবরদারি, গ্রামীণ মোড়লতন্ত্র ও সরকারি আমলাতন্ত্রের সম্মিলিত আঁতাত হরণ করেছে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত এই স্বশাসিত সংস্থাগুলোর প্রাণশক্তি ও সজীবতা। নিচুতলার এই সমস্ত স্বশাসিত সংস্থাগুলোর দৈনন্দিন পরিচালনা, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষদের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করার বদলে আগামীদিনে মুখ্যমন্ত্রীই পঞ্চায়েতকে নিয়ন্ত্রণ করার চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বললেন। এটা পঞ্চায়েতের ক্ষমতাকে নিজের মুঠোয় কুক্ষিগত করে নেওয়ার নির্জলা অগণতান্ত্রিক হুঙ্কার ছাড়া আর কিছুই নয়।

রাজ্য সরকার যে সমস্ত ‘দান খয়রাতির’ প্রকল্প (যেমন, লক্ষীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি) চালু করেছে, তার প্রতিদান স্বরূপ তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আবেদন মুখ্যমন্ত্রী রেখেছেন। এইভাবে, রাষ্ট্র ও নাগরিকদের মধ্যকার সম্পর্ককে নামিয়ে আনা হচ্ছে দাতা-গ্রহিতার সম্পর্কে। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ায় পঞ্চায়েতগুলোকে আরো ক্ষমতা প্রদান, এক একটা গ্রামের প্রয়োজন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কী কী উন্নয়নমূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে, সেক্ষেত্রে গ্রামীণ মানুষের চাহিদা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিকে কেন্দ্রবিন্দুতে না রেখে একমেবাদ্বিতীয়ম এক নেত্রী সমস্ত মুশকিল আসানের যে প্রবঞ্চনাময় কথাবার্তা বলছেন, তার বিরুদ্ধে রাজ্যের মানুষ সমুচিত প্রত্যুত্তর দেবেন আসন্ন এই নির্বাচনে।

panchayat-system

দুর্নীতিগ্রস্ত পঞ্চায়েত কর্মকর্তাদের ‘গালে দু’টো চড়’ মারার যে দাওয়াই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান দিয়েছেন, তাও ডাহা এক ভাওতাবাজি। আগেও যে সমস্ত তৃণমূল নেতানেত্রী উন্নয়নী প্রকল্পের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কাটমানি নিয়েছিলেন, তা মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন তিনি অতীতে একবার করেছিলেন। তা ফেরত দেওয়া তো দূরে থাক, রাজ্যের মানুষ দেখলেন, মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাজ্যের সমগ্র শিক্ষাদপ্তর দুর্নীতির এক প্রকান্ড প্রতিষ্ঠানে অধঃপতিত হয়েছে, যার জেরে প্রায় আস্ত শিক্ষা দপ্তরটি এখন জেলখানায়। রাজ্যের আপামর মানুষ দেখলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে তাবড় মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে দুর্নীতির বিশাল জাল কিভাবে ছড়িয়ে পাকাপোক্ত প্রণালীবদ্ধ ব্যবস্থাপনায় পরিণত হয়েছে। এতদিন ধরে এত বড় পরিসর জুড়ে যে এই কান্ডকারখানা চলে আসছিল তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অগোচরে থাকতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। এবারও দলের নেতা-বিধায়কদের একটা অংশ প্রকাশ্যেই জানালেন যে নেতৃত্বকে বিপুল টাকার বিনিময়ে পঞ্চায়েতের টিকিট কেনা হয়েছে।

এক বশংবদ নির্বাচন কমিশন, হাতের মুঠোয় থাকা পুলিশ প্রশাসনের দৌলতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে গিয়ে রাজ্য প্রশাসন এবার অতিসক্রিয় এক বিচারবিভাগের সম্মুখীন হল। বেশ কিছু অনিয়ম, বিরোধীদের ভোট প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে বাধাদানের নানা অপচেষ্টা সত্ত্বেও তৃণমূলের দাপট ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধের ঘটনা দেখা গেছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর ভরসায় নয়, ঐক্যবদ্ধতা ও নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার তাগিদই প্রতিক্রিয়ার দাপটের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারে প্রতিস্পর্দ্ধার নতুন অধ্যায়।

খণ্ড-30
সংখ্যা-21