[ “ও দাদা, পা-টা তোলো” — প্রভাতী দৈনিক বা মোবাইল মগ্ন ‘দাদা’র (দিদি, বৌদি, ভাই বা অন্য কেউও হতে পারেন) কানে সেই মৃদুস্বর হয়তো পৌঁছালো না। তার খেয়ালই নেই যে একটি ঝাঁটা বা ন্যাতা ধরা হাত তার চটিপরা পায়ের তলার মেঝেটা পরিষ্কারের জন্য অপেক্ষমান। ওদিকে উচ্ছিষ্ট সমেত ডাঁইকরা বাসন কলতলায় পড়ে আছে। এঁটো শুকিয়ে কড়কড়ে বাসনে জল ঢেলে আসতে হয়েছে। না হলে মাজা যাবে না।
হ্যাঁ, কাকভোরে উঠে সকাল থেকে এগুলোই করতে হয় সবজান বা সবিতাদের। সব কাজের বাড়ি যে তাদের প্রতি একই রকম নির্লিপ্ত বা অবিবেচক বা অমানবিক — এমনটা নয়। তবুও সাধারণ ভাবে মাসান্তে মাইনের কটা টাকার সঙ্গে মাসভর তাচ্ছিল্য বা কখনও কখনও অসম্মানও প্রাপ্য।
গত ১৬ জুন ‘আন্তর্জাতিক গৃহশ্রমিক দিবস’ পালিত হয়েছে। সবজান-সবিতাদের হয়তো তা জানা ছিল না।
সমাজে অত্যাবশ্যক পরিষেবা দিয়ে চলেছে যারা তাদের চরম অবহেলিত নিপীড়িত জীবনে রোজকার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও আনুষঙ্গিক অনেক যুদ্ধ। সেইসব লড়াই লড়তে লড়তে তারা কীভাবে বহমান জীবনস্রোতের এক এক দক্ষ ‘নাইয়া’ হয়ে ওঠে, নিজেদের ক্লীন্ন জীবনের গ্লানি মুছে কখনও কখনও ‘অসামান্যা’ হয়ে ওঠে, তারই কয়েকটা মুহূর্ত তুলে ধরছি।
না, গল্প নয়। ১০০ শতাংশ সত্যি। এই প্রতিবেদনের ‘সবজান’ এক জীবন্ত মানুষ। বাবা ঘরামির কাজ করতেন। ওরা দু’বোন খুব ছোট্ট বয়েস থেকে মায়ের সঙ্গে রাস্তায় কয়লা বাছতো। থাকতো বস্তির এক ঘুপচি ভাড়া ঘরে। দশ বছরে বিয়ে হয়ে যায়। বরের হাতে নিত্য মার খাওয়া সেই মেয়ে এখন অনেক কিছুর বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে জানে। ]
সবজান বিবির মনের মধ্যে এক নাবাল জমি আছে। সেখানে কচি ঘাসে জল ফড়িং নেচে বেড়ায়। ছোট্ট পাখিরা শিস দিয়ে গান গায়। সেই গান শুনে ছোট্ট ফুলখুকিরা বাতাসে দুলে দুলে হাসাহাসি করে। হ্যাঁ, নির্ঘাত তার বুকের মধ্যে এক ভালোবাসার চরভূমি আছে! কেন? সে বৃত্তান্তই বলছি!
ছ’বাড়ি ঠিকে কাজ। ঘরে ফিরতে সূয্যি পাটে বসে। তখন এঁদো পুকুরে গা ডুবিয়ে চান। বাসি পান্তা দিয়ে খাওয়া সেরে একটু গা এলিয়ে আবার রাতের রান্না। কোনো কোনো দিন ভাত গেঁজিয়ে ওঠে। তখন দু’টো শুকনো মুড়ি চিবিয়ে জল খাওয়া। সব কাজের বাড়িতে তো আর খেতে দেয় না। দু’টো বাড়ি থেকে চা রুটি তরকারি দেয়। ঐটুকুর জোরে চার তলা ঠেঙানো। এখন অবশ্য বৌমা ঘরে আসায় কাঠের জ্বালে সে’ই সকালে রান্না করে। তাই কাজ থেকে ফিরে দু’টি সাজো ভাত পায়। যাক সে কথা, ফুল্লরার বারোমাস্যা।
সতেরো না পুরতেই যখন বড় ছেলে বিয়ে করবে বলে বায়না ধরলো, সবজানের খুব রাগ হয়েছিল। তারপর অবশ্য মতো দিয়েছে। কচি বৌমা যেন মাচার ঢলঢলে লাউডগাটি। গাড়ি থেকে নেমেই গলা জড়িয়ে বলেছিল “আমি তোমার আরেকটা মেয়ে গো মামণি”!
বৌয়ের বাপের ভাড়া ঘরে আছে শুধু বাপ আর পঙ্গু মা। মেয়ের জন্মের দেড়বছর পর থেকে কী কাল ব্যাধি ধরেছে, নড়াচড়া করতে পারে না। সবজানের ধারণা নার্ভের রোগ। (ও নিজের মহল্লায় অন্তত দু’টো কেসে পরিবারের লোকদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। তাদের চিকিৎসা চলছে। বাড়ির লোকজন ওঝা বৈদ্য ‘বাবার থানে’ ছুটছিল।) চৌকির ওপর তালগোল পাকানো দেহটা পড়ে থাকে। নিজে ভাতটুকু মেখে মুখে দিতে পারে না। দেখে শুনে বেয়াই বেয়ান দু’জনের জন্যেই প্রাণ কেঁদেছিল সবজানের। পুরুষ মানুষ, হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হয়। পড়ে থাকা মানুষটার গু’মুত কাছাতে হয়। আবার বেয়ানেরও কত কষ্ট। কথা বলার ক্ষমতাও নেই। কখন দুটো খেতে পাবে, পরিষ্কার হবে বলে হাপিত্যেশ করে থাকে বেচারা।
সবজান আগে আগে বেয়াইকে বলতো, “দাদা, এত কাচে হাসপাতাল, একবারটি দেকিয়ে এসো না মানুষটাকে! কত কষ্ট পাচ্চে”। টেরি বাগানো রং করা চুলে ছোকরাদের মতো আঙুল চালাতে চালাতে লোকটা বলেছিল, “তুমার বুনের কিছু হবার লয় গো; বদ নসীব। আমি কম জ্বালাতনে আচি গো।” সবজান আর কিছু বলেনি। ছেলেকে দিয়ে বলিয়েছিল যে ওরাই হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তাতেও লোকটা রাজি না। সেও তো আজ ক’বছর হয়ে গেল।
এই সেদিন বৌমার বাপ এসে মেয়েকে বললে, “তোর আম্মির সারা গায়ে ঘা হয়ে গেচে। একটু চান করিয়ে দিয়ে আসিস তো মা।”
বৌমা মায়ের কাছ থেকে ফিরে আছড়ে পড়ল কান্নায়, “আমার বাপটা মা-টারে মেরেই ফেললো গো! আমারে একদিন বলেছিলো — এই তোর মায়েরে ঘরে ঢুকোলাম। আর মলে ঘর থেকে একবারে বার করবো। মা আর বাঁচবে নি।” তার সারা গা পচে গেছে। কাঁথাকানি সব পূঁজ রক্তে ভরে গেছে।
শুনেই সবজানের ভীষণ রাগ হল। বলল, “আমি ওরে হাসপাতালে নে’যাব। দেকি কী কত্তে পারি।” বিকেলে কাজ থেকে ফিরে মহল্লার আরও দুই মহিলাকে নিয়ে বেয়াই বাড়ি চলল। ও সবার বিপদে আপদে সবার আগে দৌড়ে যায়। তাই ওকে কেউ না করে না। ছেলেকে দিয়ে প্লাস্টিক কিনিয়েছিল। সেটা সঙ্গে নিল।
পৌঁছে দেখলো ঘরে শেকল তোলা। শেকল খুলে ঢুকে দেখে পাখা বন্ধ। বেচারা দরদর করে ঘামছে। এমন সময়ে বেয়াই ঢুকতে সবজান রাগে ফেটে পড়ে বলল, “তুমি কেমন ধারার মানুষ গো! পাখা বন্ধ করে শেকল তুলে চলে গেছ!” বেয়াই বলে, “এই চায়ের দোকানে বন্ধুদের সঙ্গে ছিলুম। পাখা চালিয়ে গেলে কত বিল উঠবে বলোতো?” সবজানের কথা বলতে ঘেন্না হচ্ছিল। কী অমানুষ! আর দুই সঙ্গিনীর সাথে প্লাস্টিক জড়ানো মানুষটাকে পাঁজাকোলা করে অটোয় উঠল। পড়শিরা কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। দূর থেকে নাকে কাপড় চাপা দিয়ে যেন তামাশা দেখছে।
এমার্জেন্সিতে দেখে ইঞ্জেকশন দিয়ে ওষুধ লিখে দিল। কীভাবে ঘা পরিষ্কার করতে হবে বুঝিয়ে দিল। কিন্তু ভর্তি রাখলো না। সবজান নিয়ে এল নিজের ঘরে।
মহল্লার সবাই ভীড় করে এল। সবজান বিজয়িনীর মতো বলল, “ওরে আমি আমার কাছে রেখে চিকিচ্ছে করাব। ঘা’টা সারলে ওরে নার্ভের চিকিচ্ছে করাতে হবে। দেখবে ও ভালো হয়ে উঠবে। জানো আজ কতদিন পর ওর মুখে কতা ফুটেচে! দুধ খেতে চেয়েচে নিজমুখে!”
সবজানের কথা শুনে কেউ কেউ মুখ চাওয়া চাউয়ি করছিল। কী বলে ও! নিজে কিছু দিন আগে বিরাট অসুখ থেকে উঠেছে। একখানা প্লাস্টিক ছাওয়া ঘরে পাঁচ ছ’জনে গাদাগাদি করে এই গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে রাত কাটায়। দিনের পর দিন ভাতে ভাত খেয়ে থাকে। সে এই রোগীকে, যার সব্বাঙ্গ খসে পড়ছে, তাকে ঘরে রেখে চিকিচ্ছে করাবে!
মহল্লার এক বুড়ো মানুষ এগিয়ে এসে বলল, “তুমি যেকালে সাহস করে এই দায়িত্ব নিয়েচো, আমরাও তোমার সঙ্গে আছি”। সবাই যেন এবার ঘোর কাটিয়ে বলে ওঠে, “হ্যাঁগো, আমরাও আচি”।
বৌমাকে ওষুধপত্তর সব বুঝিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে সবজান এবার খোলা আকাশের নিচে বসে। কতদিন পর যেন আকাশটা দেখে। আকাশে আজ তারার মেলা। ঝিরি ঝিরি হাওয়া দিচ্ছে। চোখ দু’টো আপনা থেকে জড়িয়ে আসে।
পরদিন। বিকেল হব হব। কাজ শেষে ঘাম মুছতে মুছতে রাস্তা পেরোতেই দেখে ছোট ছেলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে। সঙ্গে আরও ক’টা বাচ্চা। দম ফেলে কোন মতে বলে, “উ আর লেই গো। এক্কুনি মরে গেল।” সবজান ছুটতে ছুটতে এসে দেখে দমচাপা গলিটা লোকে লোকারণ্য। বৌমা ছুটে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “মরার আগে মা আজ কত কতা বলল। নাতিকে আদর কল্ল। আমার হাতে পানি খেল, আমার মুকে হাত বুলিয়ে দেল। চলে গেল। কেন এসেছিল? মা, মাগো”। বৌমার বুক ভাঙা কান্নায় সবজানেরও কান্না পায়। শুধু বিড় বিড় করে বলে, “কেন যে আগে ওরে আনিনি, থা’লে মানুষটা বাঁচত”।
সেই বয়স্কা মহিলা যে ওর সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিল, বলল, “দুঃখু করিসনে বোন। কটা বচ্ছর তো কোন আদর যত্ন পায়নি, পশুর মতো বেঁচে ছিল। তোদের আদর যত্ন ভালোবাসা পেল। একটা দিন মানুষের মত বাঁচার সোয়াদ পেল। তোর বাড়ির ভালোবাসা নিয়েই চলে গেল।”
সবজানের বুকের সেই ভালোবাসার চরভূমিতে ভীষণ ঝড় উঠেছে। মানুষকে কেন এত কষ্ট পেতে হয়? কেন?
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত