পঞ্চায়েত নির্বাচন : বকেয়া মজুরি, কাজ, জনতার পঞ্চায়েত গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হোন
build-janata-panchayat

আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন আবার রাজ্য রাজনীতিতে গ্রামীণ অ্যাজেন্ডাকে সামনে তুলে ধরল। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সংবিধানে বর্ণিত ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কতটা অর্জন করতে পারল, জনগণের ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে উঠে আসতে পারল কিনা তা আরো একবার আতস কাঁচের নিচে রেখে বিচার বিশ্লেষনের দাবি রাখে। একথা অনস্বীকার্য, জনগণের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের এই পঞ্চায়েতী রাজ বহুদিন যাবত আমলাতন্ত্র ও বাস্তু ঘুঘুদের বাসা হয়ে দাঁড়িয়ে তার শাখাপ্রশাখা বহুদূর ছড়িয়েছে, ক্ষমতাসীন দলীয় গ্রামীণ মাতব্বরের আঁতাত বিপুল অর্থ ও স্থানীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করে শাসক পার্টির রাজনৈতিক আধিপত্যকে গ্রামীণ রাজনীতিতে পরিব্যাপ্ত করেছে।

রাজ্য রাজনীতিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করা সত্ত্বেও পশ্চিমবাংলায় যেমন আর্থিক উন্নয়নের ছিঁটেফোটা অগ্রগতি দেখা গেল না ২০১১ সাল থেকে তৃণমূলের নিরবচ্ছিন্ন স্বৈর শাসনে, পঞ্চায়েতী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করেও গ্রামীণ অর্থনীতির কোনো ইতিবাচক বদল ঘটল না। ২০১৮’র সবচেয়ে বিতর্কিত নির্বাচনে তৃণমূল ৩৪ শতাংশ আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেলায় নিজের পকেটে পুরে ফেলে, ১৯ জেলা পরিষদের ৯৪.৮৪ শতাংশ আসন, পঞ্চায়েত সমিতির ৮০ শতাংশ আসন এবং গ্রামসভার ৬৬ শতাংশ আসন কব্জা করে। বিজেপিকে বহুদুরে ঠেলে, দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে গ্রাম বাংলায় এই প্রথমবার তাদের আসতে দেখা গেল পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে — তার পকেটে গেল ৩.৫৪ শতাংশ জেলা পরিষদের আসন, ১২.৫৪ শতাংশ পঞ্চায়েত সমিতির আসন এবং ১৮.০৬ শতাংশ গ্রাম সভার আসন। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হল বামদের। যারা ২০০৮ পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনে দাপিয়ে বেড়াতো, তারা রাজনৈতিক ভাবে মারাত্মক ধাক্কা খেল, এমনকি ‘নির্দল’দের তুলনায় কম ভোট পেল।

তৃণমূলের সর্বাত্মক দাপট সত্ত্বেও গ্রামীণ অর্থনীতি বরং আরও সংকটাপন্ন হল। ১০০ দিনের কাজে এরাজ্যে কমবেশি ১.৪ কোটি কার্ড হোল্ডার রয়েছেন। মোদী সরকারের দাবি, এরমধ্যে ১৫ লক্ষ বা, প্রায় ১০ শতাংশের কার্ড ভুয়ো। এই যুক্তিতে মোদী মজুরি বকেয়া রেখেছে, যা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও বটে। গ্রামীণ শিক্ষিত বেকারবাহিনী হুহু করে বাড়ছে — বেকারত্ব আজ গ্রাম বাংলার এক দুঃসহ পরিঘটনা।

দুর্বিষহ দারিদ্র, থমকে থাকা ১০০ দিনের কাজ, মজুরদের বকেয়া ১০০ দিনের মজুরি, অত্যন্ত নিম্নহারে কৃষি মজুরি, নিজ গ্রামে বা রাজ্যে পর্যাপ্ত মজুরির কাজ না পেয়ে ভিনরাজ্যে পরিযানের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি, গ্রামীণ মহিলাদের কাজের বাজার থেকে নির্মমভাবে উৎখাত হয়ে যাওয়া, কল্পনাতীত হারে জমি খোয়ানো, গ্রাম বাংলার মর্মান্তিক রূঢ় বাস্তব। কৃষকদের আয় তিনগুণ করার মুখ্যমন্ত্রীর দাবি আজ বিকট এক পরিহাস যা গ্রাম বাংলায় বোবা কান্না হয়ে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ হওয়াটাই এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে সংকটের প্রধান উৎস নয়। এই প্রকল্পে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ যখন পয়লা নম্বরে ছিল, তখনও গ্রামীণ দারিদ্র আষ্ঠেপৃষ্ঠে গ্রাস করে রেখেছিল গ্রামীণ জনগণকে। নাবার্ড তার এক রিপোর্টে দেখিয়েছে এরাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারে গড় মাসিক আয় মাত্র ৭,৫৭৩ টাকা! অন্ধ্রপ্রদেশ-বিহার-ঝাড়খন্ড-ওড়িষ্যা-ত্রিপুরা ও উত্তরপ্রদেশের মতো কৃষিকাজে নিম্ন আয়সম্পন্ন রাজ্যের তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। হেক্টর পিছু কৃষিজমির জন্য কৃষি ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে এরাজ্য রয়েছে পনেরো নম্বরে! দলে দলে চা-বাগিচার মহিলা শ্রমিকরা পাড়ি দিচ্ছেন অন্য রাজ্যে, উচ্চ মজুরির খোঁজে। প্রতিবছর এরাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে চলে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। এমনকি শস্যগোলা হিসাবে পরিচিত বর্ধমান, বা হুগলির মতো জেলাগুলো থেকেও বিপুল হারে তরুণ যুব বাহিনী (যারা বেশিরভাগই সংখ্যালঘু বা তপশিলি জাতি উপজাতি ভুক্ত) অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাচ্ছেন। সেই কাজ যে উন্নত মানের তাও নয়, করমন্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনায় নিহত বা গুরুতরভাবে আহত যাত্রীদের মধ্যে দেখা গেল যে, ট্রাক চালক, জরির কাজ, ফল প্যাকিং, রং মিস্ত্রির কাজ করতেও বাংলার যুবকরা ভিনরাজ্যে ছুটছে। দুর্ঘটনার মুখে পড়া করমন্ডল এক্সপ্রেসে সবচেয়ে বেশি নিহত বা আহত পরিযায়ী শ্রমিকরা হলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার। একটি গোটা পরিবারের তিন যুব সন্তানই প্রাণ হারান ওই রেল দুর্ঘটনায়। যে ছ’জন যুব সুন্দরবনের একটি গ্রাম থেকে ভিনরাজ্যে যাচ্ছিলেন কাজের খোঁজে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজনের কফিন বন্দি দেহ গ্রামে ফিরে এল, ষষ্ঠ যুবক নিখোঁজ।

unite-to-build-janata-panchayat

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত তথ্য, হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিস্টিকস্ অন ইন্ডিয়ান স্টেটস, ২০২০-২১ থেকে জানা যায় এই রাজ্যে গ্রামীণ দিনমজুরদের দৈনিক মজুরি জাতীয় গড় মজুরির থেকে কম। এই রাজ্যে দৈনিক মজুরি হল ২৮৮.৬০ টাকা, যখন জাতীয় মজুরির গড় হার ৩০৯.৯০ টাকা। ২০১৯-২০’র আর্থিক বছরে কৃষিকাজের সাথে যুক্ত দৈনিক মজুরি ২৬৭.৫০’রও কম ছিল।

বাংলার কৃষির নিদারুণ বৈশিষ্ট্য হল, যত দিন গড়াচ্ছে, রাজ্যের গ্রামীণ পরিবারগুলো চরম সংকটের আবর্তে জর্জরিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে নিজেদের জমি হারাচ্ছে। সর্বশেষ ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-৫’র সমীক্ষায় উঠে আসছে রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবারের হাতে (৬৫.২ শতাংশ) কোনো জমি নেই। উপার্জনের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা নামমাত্র। হাতে গোনা যেটুকু অংশ এখনও কৃষির উপর নির্ভর করেন কিছু উপার্জন করতে, তাঁদের আয়ও দিনের পর দিন সংকুচিত হচ্ছে এই কারণে যে অত কম পরিমাণ জমির উপর নির্ভর করে তাকে লাভজনক করা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে কৃষিক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ কৃষিজমির আয়তন ০.৫ হেক্টারেরও কম। এত কম আয়তনের জমির উপর নির্ভর করে এমনকি ন্যুনতম দৈনিন্দন প্রয়োজনকেও মেটানো যাচ্ছে না। ফলে, সিংহভাগ গ্রামীণ জনগণ, ৮০ শতাংশেরও বেশি, অকৃষি কাজের মাধ্যমেই তাঁদের জীবন নির্বাহের রসদ খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, গ্রামীণ জনগণের নিচুতলার প্রান্তিক কৃষকদের সর্বহারাকরণ ঘটছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।

গ্রামাঞ্চলে তরুণ প্রজন্ম নতুন করে কৃষিকাজে আর যুক্ত হচ্ছেন না। অকৃষি ক্ষেত্রে, উপার্জনের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। অনর্গল স্রোতের মতো বিপুল সংখ্যক পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে যাচ্ছে — যার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করতে এতদিন পর রাজ্য শ্রমদপ্তর পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বার্থে একটি পোর্টাল খুলেছে।

গ্রাম বাংলায় যেন হাহাকার লেগেছে। দ্রুততালে কৃষি জমি খোয়ানো, অত্যন্ত স্বল্প মজুরি নিয়ে, বিপুল সংখ্যক স্বনিযুক্ত অনিয়মিত কৃষিমজুরই গ্রামীণ শ্রমবাজারের প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলো শুধু দুর্নীতির আখড়াই নয়, ক্ষমতাসীন দলগুলোর দাপট ফলানোর কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামীণ জনতা এর বিরুদ্ধে কতটা রুখে দাঁড়াতে পারবে তা নির্বাচনী ফলাফলই বলবে। বাম গণতান্ত্রিক শক্তিকে এর বিরুদ্ধেই লড়তে হবে ইতিবাচক মোড় পরিবর্তনের লক্ষ্যে।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-30
সংখ্যা-20