নদীর পিঠও দেওয়ালে ঠেকে। তখন কোনো কোনো নদী হারিয়ে যায়। আবার কোনো কোনো নদী ঘুরে দাঁড়ায়। প্রশ্ন তোলে,
“...কি দেইনি তোমাদের —
জলের জীবন, ইস্টিমার,
পাল তোলা নাও,
গাভীন রাত্রির ভাটিয়ালী,
কুমারীর স্নান,
শক্ত মাটির ভিটা, ঝিল,
প্রশাখার বিস্তার।
তোমরা কি না ভাসাও —
বস্তা বন্ধী লাশ,
মৃত পশুর অণুজীব,
গুম খুন ক্ষুধা
ইত্যাদির দিনলিপি
ট্রাকের মূত্র, জিঞ্জিরার জঙ্গল, অ্যাসিড।...”
এই কবিতার নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা। বাংলাদেশে তার বাস। আমাদের রাজ্যেও নদীয়া জেলার চাকদহে রয়েছে আর একটি বুড়িগঙ্গা। তবে তা নদী নয়, খাল। তাতে কী? এই খালই তো চাকদার প্রাণ। কিন্তু বিগত বহু বছরের উদাসীনতায় নিষ্ঠুরতায় তারই প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু মানুষ আর নদীর সখ্যতা আদিঅন্তহীন। কিছু মানুষ তাই এগিয়ে আসেন। হাত ধরেন বুড়িগঙ্গার। চিকিৎসার দাবি তোলেন। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দাবি পেশ হয়ে চলেছে। সেই দাবি অবশেষে মান্যতা পেলো। মে মাসের তীব্র দাবদাহের মধ্যেই মাটি খুঁড়ে তোলা হলুদ রঙের বিশাল মেশিন এসে হাজির। তারপর খালের বুকে জমা মাটি ঝপাঝপ কেটে তোলা। আর দেখতে না দেখতেই আবার ছলাৎ ছল। বুড়িগঙ্গার স্তব্ধ জল।
ভাগীরথী প্রবাহিণী প্রাচীন জনপদ চাকদহ। এই নদীতে যেখানে চূর্ণি নদী মিশেছে, সেই মোহনা থেকে বুড়িগঙ্গা খাল ৮ কিলোমিটার বয়ে গিয়ে মুকুন্দনগরে আবার ভাগীরথীতে মিশেছে। ফলে ভাগীরথীর চাপ যেমন কমেছে তেমনি বুড়িগঙ্গা হয়ে উঠেছে চাকদহ শহরের একমাত্র নিকাশি ব্যবস্থা। কিন্তু সংস্কারের অভাবে বুড়িগঙ্গা ভরাট হয়ে যাচ্ছিল, শহরের বর্জ্য, আবর্জনা, জঞ্জাল, প্লাস্টিকে। গজিয়ে উঠেছিল কচুরিপানার জঙ্গল। এভাবে একসময় ভাগিরথী থেকে ছিন্ন হয়ে গেলো এই জলধারা। ফলে চাকদার আবর্জনা আর ভাগীরথীতে পড়তে পারছিল না। আর এভাবেই বুড়িগঙ্গা মলমূত্র মৃত পচা প্রাণী ও অন্যান্য আবর্জনার স্তুপে ভরা এক বদ্ধ নালাতে পরিণত হয়েছিল। অথচ এই নদীই একসময় দুহাত ভরে ফসল দিয়েছে চাষিকে, মৎসজীবীদের নৌকো ভরে দিয়েছে কত না সব মাছ। জলজ প্রাণীদের আশ্রয় হয়েছে তার স্বচ্ছ বহমান জলধারা। একসময় এর তীরে বেশকিছু সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। যেমন আনন্দগঞ্জ। সেখানে নদীবন্দরকে কেন্দ্র করে নৌবাণিজ্য চলত বছরভর। ছিল প্রসিদ্ধ নৌশিল্পাঞ্চলও। কত রকমের মেলা বসেছে তখন। গনেশজননীর মেলা, চড়ক মেলা, হাজরা উৎসব। গ্রামের মানুষের জীবনে তখন ছিল কত না রঙ। কিন্তু যার উপরে এত জীবনের ভার তার নিয়মিত সংস্কারের ব্যবস্থা হচ্ছে না। অগভীর খাতে চর জেগে উঠছে। সেই চর বিক্রিও হয়েছে। কিন্তু চাষিরা “লাঙল যার জমি তার” দাবি তুলে, জমির অধিকার অর্জন করেন। রাস্তার ধারে জমা জলে পাট পচাতেন পাট চাষিরা। তাও দখল করে দোকান দাঁড়িয়ে গেল। এভাবে এখানে ওখানে ভরাট হওয়া চলতেই লাগল। তার মাঝে মাঝে জলস্রোতও থমকে গেল। জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ভগ্নাংশে নেমে গেল। মাছ সহ জলজ জীবকূল মরতে লাগল। বৃষ্টি হলেই দুকূল ছাপিয়ে বিষাক্ত জল জমিতে পড়ল। চাষিদের চাষ মাথায় উঠল। মৎসজীবীরা হলেন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক। বা পরিযায়ী উড়ান দিলেন ভিনরাজ্যে। বিপদের উপর বিপদ। বলাগড়ে গঙ্গার চরে সিইএসসি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিল। তা থেকে নির্গত কার্বনে ফসল ও মাছচাষ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে লাগল। চাকদার জলে আবার আর্সেনিক প্রবণতা। ওই বিদ্যুৎ প্রকল্পের ফলে সেই জল শোধন প্রকল্পও বাধাপ্রাপ্ত হল। প্রতিবাদে সে প্রকল্প বন্ধ হল শেষমেশ। ওদিকে জল জমা শুরু হল চাকদা শহরাঞ্চলে। নাগরিকদেরও সেই জল নাকানি-চোবানি খাওয়াতে লাগল।
৬০-৭০’র দশক থেকেই বুড়িগঙ্গা এভাবেই ক্রমশ রুদ্ধ গতির শিকার হয়ে চলেছে। ২০০৪ সালের বন্যায় বাস্তুহারা মানুষের দুর্দশা চাকদাবাসীর চোখ খুলে দেয়। বাম আমলে সুনীল চন্দ্র দাস, অজয় নন্দী, বিপুল রঞ্জন সরকার, অভয় বিশ্বাস, নন্দদুলাল বিশ্বাস সহ আরও কিছু বুদ্ধিজীবী মানুষ বুড়িগঙ্গার সংস্কার নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তাঁদের বেশিরভাগই আজ প্রয়াত। কিন্তু তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘চাকদহ বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা’ বুড়িগঙ্গা বাঁচানোর লক্ষ্যে কর্মসূচি নিতে শুরু করে। স্থানীয় বহু বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষও সমবেত হলেন। কিন্তু আসলে নদীকে বাঁচাতে গেলে নদীর দুই পাড়ের মানুষ ও যারা নদীর উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেন তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এ আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না। তাই ক্রমে ক্রমে ৪০০ মৎসজীবী ও ১৫০০০ ব্যবসায়ীও যুক্ত হলেন।
এখন বহু কৃষকও তাদের সাথে পা মিলিয়েছেন। ২০১৪-১৫-তে এই আন্দোলন তীব্র মাত্রা পায়। সেমিনার, পথসভা, পোস্টারিং, পথনাটক, পদযাত্রা, সাইকেল মিছিল চলতে থাকে। সাথে বিডিও অফিস, সেচদপ্তর, জলসম্পদ দপ্তরের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিতে ও রাজ্যের মুখ্য সচিবের কাছে তাঁরা লিখিতভাবে তাদের দাবি পেশ করেন। ২০১৭-তে চাকদায় বিদ্যুৎ চুল্লী উদ্বোধন করেন তৎকালীন মন্ত্রী মুকুল রায়। তখন এই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাননীয় বিবর্তন ভট্টাচার্য মহাশয় তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “চুল্লী তো হল, অস্থি বিসর্জন কোথায় হবে? সেখানে যেতে তো তিন কিলোমিটার হাঁটতে হয়।” মুকুল রায় বলেন, “আমাকে তিনমাস সময় দিন”। ২০২২-এ ১০০০ লোকের সই নিয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁরা জমা দেন। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে গ্রামবাসীরা খালের মাটি কাটা শুরু করেন। ইতিমধ্যে এই সংস্কারের দাবিতে ৩০ বছর গেছে বিবর্তনবাবুর। হুমকির মুখেও পড়তে হয়েছে তাঁকে। ক্যামেরার সামনে তিনি বলেছেন, “আমার জীবন দিতে হলে দেবো, কিন্তু আন্দোলন ছাড়বো না।” এই নাছোড়বান্দা আন্দোলনই তো জিতে নেওয়ার পাসওয়ার্ড। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল, “চাকদা থানার চিঁড়ের কল এলাকা থেকে তিন কিলোমিটার সংস্কারের জন্য ৩২ লক্ষ টাকা অনুমোদিত হয়েছে।” সেচদপ্তরের বাস্তুকার শ্রী স্বপন বিশ্বাস মহাশয় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আগামী মে মাস থেকে কাজ শুরু হবে”। স্বভাবতই এলাকার মানুষ খুশী।
বুড়িগঙ্গার সংস্কার হলে এলাকার ছবিটাই বদলে যাবে বলে মনে করেন শ্রী ভট্টাচার্য। স্তব্ধ স্রোত সচল হলে চাকদায় জল জমার সুরাহা হবে। শশ্মানঘাটেই অস্থি বিসর্জন দেওয়া যাবে। প্রবল বৃষ্টি বা জোয়ারের ফলে ভাঙন ও বন্যা রোধ হবে। মৎসজীবী, চাষি ও পাটচাষিরা তাদের জীবিকা ফিরে পাবেন। নেমে যাওয়া জলস্তর উঠে আসবে। বলাগড়ে নৌশিল্পে আসবে জোয়ার। জলপথে পর্যটন বৃদ্ধি পাবে। দুই তীরে পার্ক ও মেরিন ওয়াকিং’এর ব্যবস্থা হলে যা আরও বিকশিত হবে। বুড়িগঙ্গার জীববৈচিত্র্য উন্নত হলে সন্নিহিত এলাকাগুলির জীববৈচিত্র্যও উন্নত হবে। সবমিলিয়ে চাকদার এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে আবারও রঙ ছড়াবে। এই ঘনঘোর রাজনৈতিক সামাজিক দূর্যোগে বুড়িগঙ্গাকে ঘিরে এক স্বপ্ন সত্য হয়ে নেমে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। যা আরও একবার প্রমাণ করল আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
- বর্ণালী রায়
(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী বিবর্তন ভট্টাচার্য।
কবিতাঃ বুড়িগঙ্গার চোখে জল, কবি ইকবাল হোসেন বাল্মিকী)