স্কুল-চত্বরে রাখা শ’য়ে শ’য়ে মৃতদেহ। তার মধ্যে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। বাড়ি তার ওড়িশার ভদ্রক জেলার সুগো গ্রামে। একের পর এক মৃতদেহের ওপর ঢাকা কাপড় সরিয়ে মুখ দেখছিলেন। কাকে খুঁজছেন তিনি? ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, “আমার ছেলেকে খুঁজছি। ও এই করমণ্ডল এক্সপ্রেস-এ ছিল। কিন্তু আমি ওকে খুঁজে পাচ্ছি না”। শত শত হতভাগ্যের তিনি একজন, যাদের পরিবার বা বন্ধুস্বজন ছিলেন ঐ দু'টি ট্রেনে, গত ২ জুন যে দু’টি ওড়িশার বালেশ্বরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় পড়েছিল। একই মর্মান্তিক আখ্যান তাদেরও। ৩ জুন সকালে সেই মর্মন্তুদ ঘটনার ব্যাপকতা আর তীব্রতা বুঝে গোটা ভারত শিউড়ে উঠলো, যে বিপর্যয়ের সনাক্তকৃত বলি প্রায় ৩০০ মানুষ, আহত অন্তত ১০০০ জন। এই বিপুল সংখ্যক চিহ্নিত মৃত্যুর বাইরেও, আমাদের হিসাব রাখতে হবে যাত্রী তালিকা এবং যে মৃতেরা এখনও নিখোঁজ রয়েছেন তাদের। আশঙ্কাজনক এবং গুরুতর আহতদের সংখ্যাও যথেষ্ট বেশি। এই সব ইঙ্গিত থেকেই বলা যায়, বালেশ্বর ভারতের সব চেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনাগুলির একটি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে যার যন্ত্রণা ও বিপর্যয়ের মাত্রা এখনও পুরো উন্মোচিত হয়নি।
বালেশ্বরের ট্রেন দুর্টঘনার মতো ব্যাপক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় ভারতের কী কী জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল? তৎক্ষণাৎ উদ্ধার ও পুনর্নির্মাণ ছাড়াও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা এবং দুর্ঘটনার শিকার যারা তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার প্রশ্ন রয়েছে। আর অবশ্যই, এই রকম বিপর্যয় যাতে আর কখনও না ঘটে, যথাসাধ্য তা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
দুর্ঘটনার শিকার যারা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই হলেন পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার এবং ঝাড়খণ্ড থেকে কেরালা ও তামিলনাডুতে কাজ খুঁজতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিক। সংসারের উপার্জনকারীদের এই মৃত্যু পরিবারগুলোকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে ফেলেছে, যে যন্ত্রণা আর কষ্ট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তাদের দরকার রাষ্ট্রের তরফ থেকে দীর্ঘকালীন আর্থিক সহায়তা। কিন্তু দুর্গতদের জন্য এই আর্থিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে, সর্বপ্রথম সরকারকে এই দায়বদ্ধতা স্বীকার করতে ও গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য এই দায়বদ্ধতা বোধের অভাবই মোদী সরকারের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য এবং এর জন্য সে কুখ্যাতও বটে! পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও সমীক্ষা চালানো এবং মৌলিক কাঠামো সংক্রান্ত বিষয়গুলির জরুরি সংশোধন দূরে থাক, সরকার এই বিপর্যয়কে অন্তর্ঘাত এবং ষড়যন্ত্রমূলক কাজ বলে তুলে ধরার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। এমনকি রেলপথ সুরক্ষা কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করার আগেই সরকার রেলওয়ে বোর্ডকে দিয়ে তদন্তভার সিবিআই-কে হস্তান্তরিত করেছে। কয়েকবছর আগে, দু’টি দুর্ঘটনার (কানপুর-২০১৬ এবং কুনেরু-২০১৭) তদন্তভার এনআইএ-কে হস্তান্তরিত করা হয়েছিল এবং রেল দুর্ঘটনার মোকাবিলায় দানবীয় ইউএপিএ-র ধারাগুলিকে কাজে লাগানো হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে আজ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।
রেল দুর্ঘটনার তদন্তে সিবিআই বা এনআইএ-কে ডাকার ইঙ্গিত খুব পরিষ্কার। মোদী সরকার রেল সুরক্ষার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অবহেলিত বিষয়টি নিয়ে তার দায়িত্ব অস্বীকার করেই যাবে। কমিশন ফর রেলওয়ে সেফটি (সিআরএস), কম্পট্রোলার জেনারেল অব ইন্ডিয়া (সিএজি) সহ বিভিন্ন সংস্থা এবং রেলের আধিকারিক ও কর্মীরা রেলের সুরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নজরে আনলেও, যথারীতি সেইসব সতর্কবার্তা উপেক্ষিত হয়েছে। রেলের বেশিরভাগ পরিকাঠামোর জরুরি মানোন্নয়ন দরকার, কিন্তু আধুনিকীকরণ বা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার বদলে সরকার দ্রুতগামী ট্রেনের ভাবনায় মশগুল হয়ে আছে। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদযাপনের নামে মোদী সরকার পঁচাত্তরটি বন্দে ভারত ট্রেন চালু করার চটকদার প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে, যেগুলো আসলে নতুন মোড়কে নতুন চেহারায়, বিভিন্ন বড় শহরের মধ্যে যোগাযোগকারী পুরোনো শতাব্দী এক্সপ্রেস ছাড়া আর কিছুই নয়! প্রতিটি ট্রেনের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী, আর ওদিকে রেলদপ্তর নতুন ট্রেন সরবরাহ করতে অপারগ; এমনকি সরকার ট্রেনে কোচের সংখ্যাও কমিয়ে দিচ্ছে।
রেল সুরক্ষা, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং আধুনিকীকরণে গাফিলতির সমস্যা বর্তমানে বিপজ্জনক আকার নিয়েছে। রেলে কর্মীসংখ্যা ক্রমাগত ছাঁটা হচ্ছে। ঐতিহ্যগত ভাবে রেল সরকারের বৃহত্তম কর্মসংস্থান ক্ষেত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ক্ষেত্রটিতে ভয়াবহ মাত্রায় কর্মীসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে রেলে তিন লক্ষাধিক পদ শূন্য পড়ে আছে। আর সমানে চলেছে পদের অবলুপ্তি। শূন্য ও বিলুপ্ত পদের অর্ধেকের জন্য নিরাপত্তা সরাসরি বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রতিকূল প্রভাবটি স্পষ্ট প্রতীয়মান সিএজি'র পারফরম্যান্স অডিট রিপোর্টে : ২০২২-এর ডিসেম্বরে সংসদে পেশ করা এই রিপোর্ট দেখিয়েছে কী ভয়ঙ্কর মাত্রায় বেড়ে চলেছে ডিরেইলমেন্ট-এর ঘটনা; আর এই ধরনের প্রতি চারটি ঘটনার মধ্যে তিনটির ক্ষেত্রেই দায়ী ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিদর্শনের অভাব।
কবচ নামে সংঘর্ষ-রোধী একটি প্রযুক্তির গুণকীর্তন প্রচারে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই প্রযুক্তি কার্যত ভারতের প্রায় ৭০ হাজার কিলোমিটার রেলপথের ২ শতাংশের সামান্য বেশি অংশে কার্যকর হয়েছে! আর বাজেট বরাদ্দ ও কার্যকর করার বর্তমান স্তর চালু থাকলে পুরো দৈর্ঘ্য এই প্রযুক্তির আওতায় আনতে কয়েক দশক লেগে যাবে! এই ক্ষেত্রে, দুর্ঘটনা-কবলিত রুটের সংশ্লিষ্ট অংশটি কবচ সুরক্ষিত ছিল না। সরকার অবশ্য আপাতত আমাদের এটা বোঝাতে ব্যস্ত যে এক্ষেত্রে কবচ সম্ভবত দুর্ঘটনা এড়াতে পারতো না কারণ এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ইন্টারলকিং সিগনাল সিস্টেমের ব্যর্থতাই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। কিন্ত সত্যটা হচ্ছে, এই প্রশ্নেও একটা সুনির্দিষ্ট সতর্কীকরণ রয়েছে প্রশাসন যেটাতে কর্ণপাত করেনি।
গত ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ-পশ্চিম রেলওয়ের অপারেশনস্ ডিপার্টমেন্টের এক প্রবীণ পদস্থ আধিকারিকের এক নোটে দক্ষিণ-পশ্চিম রেলওয়ের মহীশূর ডিভিশনের বিরুর-চিকজাজুর সেকশনে হোসাদুর্গা স্টেশনে সম্ভাব্য মুখোমুখি সংঘর্ষের উল্লেখ আছে যেটা এড়ানো গেছে চালকের সতর্কতা আর ট্রেনের মন্থর গতির জন্য। ঐ নোটে হোসাদুর্গা এবং বাহানাগা বাজার স্টেশনের মধ্যে লে আউট-এর সাদৃশ্যের উল্লেখ করা হয়েছে এবং সিগনাল সিস্টেমকে আগাগোড়া খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে মেরামতির জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া এবং স্পষ্ট যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি ও নিরাপত্তাহীনতার ফাঁকফোকর চোখে পড়ছে সেগুলো দূর করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। রেল প্রশাসন কি এই সতর্কীকরণে আদৌ নজর দিয়েছিল? নজর দিলে কিন্তু বালেশ্বর ট্রেন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সেই দেশের যাতায়াত ও ভ্রমণের প্রয়োজন পূরণের জন্য রেলকে গণপরিবহনের একটি ব্যবস্থা হিসেবে উন্নত করার জন্য প্রয়োজন ছিল সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং মৌলিক পরিকাঠামোগত বিষয়গুলির উন্নতি ঘটানো। কিন্তু তার পরিবর্তে আমরা কী দেখছি? সম্পূর্ণ বিপরীত অভিমুখে রেলের ধারাবাহিক পুনর্বিন্যাস চলেছে নিয়মিতভাবে! বার্ষিক রেল বাজেটে রেলের সুরক্ষা এবং সংস্থানকে প্রভাবিত করে যে সব মৌলিক পরিকাঠামোগত বিষয়, সেগুলির নিয়মিত প্রকাশ্য সমীক্ষার সুযোগ থাকতো। সেই রেল বাজেটকে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসে ছুঁড়ে ফেলে দিল। ঠিক যেভাবে পরিকল্পনা কমিশনকে ভেঙে দিয়ে সেটিকে তথাকথিত নীতি (এনআইটিআই) আয়োগে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। সত্যি বলতে কী, রেলের জন্য সম্পূর্ণ নিয়োজিত পূর্ণ সময়ের কোনো ক্যাবিনেট মন্ত্রী আর নেই। বর্তমান মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণোর হাতে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর-রেল, ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি — সঙ্গে কম্যুনিকেশনস্! বস্তুত এতগুলো দপ্তরের দায়িত্ব নিয়ে কোন জাদুকা খেল্ দেখাবেন তিনি!
প্রাইভেটাইজেশন, প্রফিট এবং পিআর — এই তিনটি ‘পি’ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জীবন রেখাকে চালিত করছে। আর দু’টো পি, যার জন্য অনেক কিছু যায়-আসে — পিপল (জনগণ) এবং পাবলিক সার্ভিস (জন পরিষেবা) — সেগুলোকে ঠেলে পিছনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারতের জনসাধারণের জন্য নিরাপদ, সুলভ ও সাশ্রয়ী এবং লোক-বান্ধব একটি পরিবহন ব্যবস্থার বদলে বিত্তশালীদের স্বাচ্ছন্দ্যের একটি পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে রেল পরিষেবাকে ক্রমশ একটি বিক্রয়যোগ্য পণ্য করে তোলা হচ্ছে। এই ধারাকে উল্টে দিতে হবে এবং রেল পরিষেবাকে জনগণের স্বার্থে পুনরুদ্ধার করতে হবে। শূন্য পদগুলি অবিলম্বে পূর্ণ করতে হবে এবং নিরাপত্তাকে শীর্ষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মূল বিষয়গুলি নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করা বা প্রাথমিক শিক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে সরকার এই শোক যন্ত্রণাকে তার প্রচারের হাতিয়ার করতে এবং রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা বানাতে চাইছে। মানুষের কষ্টকে তুলে ধরা এবং সরকারকে তার জন্য দায়ী করার বদলে রেলমন্ত্রীর ভাবমূর্তিকে রক্ষা করা ও তুলে ধরার জন্য মিডিয়াকে প্ররোচিত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে বিজেপি’র বাছাই করা শত্রুদের, সে হতে পারে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক বিরোধীরা, তাদের নিশানা করে আইটি সেলের মিথ্যা আর বিদ্বেষভরা ন্যারেটিভের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এক ভয়াবহ যন্ত্রণাকে এই লজ্জাজনক মানববিদ্বেষী হাতিয়ার করে তোলাকে অবশ্যই পরাস্ত করতে হবে। ক্ষমতাশালীদের দায়ী করতে হবে এবং মানুষকে আশ্বস্ত করতে হবে যে বালেশ্বরের মতো বিপর্যয় আর কখনও ঘটবে না।
এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৬ জুন, ২০২৩